ধরিত্রীকে বন্ধ্যা করছে কীটনাশক
বেলচায় একদলা মাটি উঠিয়ে নিলে ভালো সম্ভাবনা আছে, পৃথিবীতে যতো মানুষ আছে আছে তার চেয়ে বেশি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র এককোষী, আণুবীক্ষণিক জীব উঠে আসবে ওই একদলা মাটিতেই।
বিষয়টি কিছুটা মাটির নিচের শহরের মতো, যার বাসিন্দারা সবসময় জেগে থাকে। অমেরুদণ্ডী (ইনভার্টেব্রেট), নেমাটোডা, ব্যাকটেরিয়া ও ফাঙ্গাস প্রজাতির কোটি কোটি জীব প্রতিনিয়ত আমাদের পানি ফিল্টারিং করছে, মাটির বিভিন্ন পুষ্টি উপাদান সক্রিয় রাখছে, পৃথিবীর তাপমাত্রা সঠিক মাত্রায় রাখতেও ভূমিকা রাখছে।
তবে ফসলি জমির নিচে, বিশেষ করে যেসব অঞ্চলের আবাদি জমিতে একটি ফসলেরই চাষ হয়, সে সব জমির নিচে কীটনাশক, ভেষজনাশক ও ছত্রাকনাশক ব্যবহারের কারণে এসব অঞ্চলের ভূর্গভস্থ মানচিত্রই বদলে যাচ্ছে। সম্প্রতি ফ্রন্টিয়ার জার্নালের পরিবেশ বিজ্ঞান অংশে প্রকাশিত একটি বিশ্লেষণী প্রতিবেদনে এব্যাপারে বিস্তারিত তথ্য উঠে আসে।
কীটনাশক কীভাবে মাটির স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব ফেলছে এনিয়ে করা বিস্তারিত গবেষণাটি যুক্তরাষ্ট্রের পরিবেশ সংরক্ষণ সংস্থা (ইপিএ) এবং বিশ্বের অন্যান্য দেশের নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর জন্য কিছু সতর্ক বার্তা দেয়। যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ৮৫০টি কীটনাশক উপাদানের অনুমোদন রয়েছে। কেঁচো, স্প্রিংটেলস, গুবরে পোকা ও অন্যান্য অসংখ্য ভূগর্ভস্থ জীবের ওপর কীটনাশকের উপাদান কিরূপ প্রভাব ফেলে যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য বেশিরভাগ দেশের নিয়ন্ত্রক সংস্থাই এসব কীটনাশক অনুমোদনের সময় তা বিবেচনায় রাখে না।
এই গবেষণাটি পর্যবেক্ষণ করলেই বোঝা যায় কতো দ্রুত এ অবস্থার পরিবর্তন প্রয়োজন।
সেন্টার ফর বায়োলজিকাল ডায়ভারসিটি, ফ্রেন্ডস অব দ্য আর্থ ও ইউনিভার্সিটি অব ম্যারিল্যান্ডের গবেষকদের বিশ্লেষণে ২৮০০টি পরীক্ষার ওপর করা ৪০০টি প্রকাশিত গবেষণার ফলাফল থেকে কীটনাশক কীভাবে মাটির ক্ষতি করে তা ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এতে ২৭৫ ধরনের ক্ষুদ্র ভূগর্ভস্থ জীব ও ২৮৪ ধরনের কীটনাশক ও কীটনাশক মিশ্রণ ব্যবহার করা হয়েছে।
এসব পরীক্ষার ৭০ শতাংশেই দেখা গেছে, ব্যবহৃত কীটনাশক মাটির জন্য উপকারী জীবের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। ইপিএ বা অন্যান্য দেশের নিয়ন্ত্রক সংস্থার গাইডলাইনেও এসব ক্ষতিকর দিক উল্লেখ করা হয়নি।
গুবরে পোকা ও ভূগর্ভস্থ মৌমাছির মতো প্রজাতির বিনাশের অন্যতম কারণ ব্যাপক হারে কীটনাশক ব্যবহার, ব্যাপক চাষাবাদ ও দূষণ। গত দশকে মাটির জীববৈচিত্র্য বিনাশের মূল কারণ হিসেবে এসব বিষয়কে চিহ্নিত করা হয়েছে।
তারপরও বিশ্বের কীটনাশক প্রস্তুতকারী কোম্পানি ও নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি, বলা যায় সযত্নে এড়িয়ে গেছে বিষয়গুলো।
কৃষিকাজে ব্যবহৃত ৫০ শতাংশ থেকে প্রায় শতভাগ কীটনাশকই মাটিতে প্রয়োগ করা হয়। তারপরও কীটনাশকের প্রভাব পরিমাপের পরীক্ষায় ইপিএ নমুনা হিসেবে ইউরোপিয়ান মৌমাছি ব্যবহার করেছে। অথচ মৌমাছির এ প্রজাতিটি মাটিতে বাস করে না।
যে প্রজাতি হয়তো কখনো মাটির সংস্পর্শেই আসেনি, মাটির ওপর কীটনাশকের প্রভাব পরিমাপে সে প্রজাতির ওপর পরীক্ষা চালানো স্পষ্ট করে তোলে, মার্কিন নিয়ন্ত্রক সংস্থা ভূগর্ভস্থ জীববৈচিত্র্য ও বাস্তুসংস্থান রক্ষায় নয়, বরং করপোরেট কীটনাশক কোম্পানির সুরক্ষা দিতেই বেশি উদগ্রীব। বিশ্বের অন্যান্য দেশের অবস্থাও কম বেশি অনেকটা এমন-ই।
এসব ঘটনা থেকে স্পষ্ট হয়, কীটনাশক অনুমোদনের ক্ষেত্রে মাটি ও মাটিতে বাসকারী জীবের ওপর এর কিরূপ প্রভাব পড়তে পারে তা একদমই বিবেচনায় রাখা হয় না।
পুনরুৎপাদনশীল কৃষি নীতি ও মাটির স্বাস্থ্য সচেতনতার বিষয়টি নিয়ে বিশ্বব্যাপী পরিবেশবাদীরা সোচ্চার হতে শুরু করলে, কীটনাশক কোম্পানিগুলো তাদের পণ্যকে পরিবেশবান্ধব বলে প্রচারণা চালানোও শুরু করে। তাদের পণ্য পরিবেশবান্ধব না হওয়া সত্ত্বেও বিভিন্ন বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রচারের মাধ্যমে পরিবেশবান্ধক তকমা দেওয়ার চেষ্টা শুরু করে কোম্পানিগুলো, এ প্রক্রিয়া 'গ্রিনওয়াশিং' নামেও পরিচিত।
বেশিরভাগ বড় কীটনাশক কোম্পানিরই মাটির স্বাস্থ্য রক্ষায় তাদের ভূমিকা বর্ণনাকারী ওয়য়েব কন্টেন্ট, প্রচারণা রয়েছে। অনেক কোম্পানিই জমি কর্ষণ কমিয়ে আনা ও কভার প্ল্যান্ট বা ক্রপস (যেসব গাছ চাষাবাদের জন্য নয়, মাটির আচ্ছাদনের জন্য রোপণ করা হয়) রোপণের ব্যাপারে প্রচারণা চালিয়ে থাকে। এ দুটি পদক্ষেপ-ই মাটির স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী, তবে এজন্য প্রয়োজন সঠিক দিক-নির্দেশনা।
তবে, কীটনাশক কোম্পানিগুলো জানে, উপর্যুক্ত দুটি কাজেই কীটনাশকের ব্যবহার প্রয়োজন। জমি কর্ষণ না করা হলে আগাছা নষ্ট করতেও কীটনাশক ব্যবহার করা হয়। ফসল বপনের আগে কীটনাশক দিয়েই অনেক সময় কভার প্ল্যান্ট নষ্ট করা হয়।
সম্পূর্ণ তথ্য না দিয়ে, প্রয়োজনীয় দিক-নির্দেশনা না দিয়ে এধরণের প্রচারণায় প্রকৃতপক্ষে কোনো সুফল পাওয়া যায় না। এক ধাপ এগিয়ে আবারও এক ধাপ পিছিয়ে আসার মতো হয়ে দাঁড়ায় বিষয়টি। ফলে মাটির সুরক্ষার পদক্ষেপও কোনও কাজে লাগছে না। এ ধরনের পরিস্থিতির দীর্ঘমেয়াদি ফলাফল হতে পারে আরও ভয়াবহ।
বিশ্বের সবচেয়ে জটিল ও জীববৈচিত্র্যপূর্ণ বাস্তুসংস্থান দেখা যায় মাটিতেই। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এই জীববৈচিত্র্য রক্ষায় সচেষ্ট হওয়া প্রয়োজন। পরবর্তী সময়ে কী হবে তখন দেখা যাবে, এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি ভয়ংকর প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণ হতে পারে।
কীটনাশকের প্রভাব সম্পর্কিত এসব গবেষণা থেকে এটি স্পষ্ট, মাটি ও ভূগর্ভস্থ জীবের সুরক্ষায় প্রয়োজন অতি সত্বর ব্যাপক হারে কীটনাশকের ব্যবহার কমিয়ে আনা।
আর একারণে, গবেষণায় উঠে আসা ক্ষতিকর দিকগুলো চিহ্নিত করে প্রচারের মাধ্যমে দেশের নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে এ নিয়ে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে, চালাতে হবে সচেতনতামূলক কর্মসূচি।
- সায়েন্টিফিক আমেরিকানের প্রতিবেদন অবলম্বনে