নিজের জীবন রক্ষা করতে পারলেন না ‘ডিফেন্ডার’ দুর্জয়
স্বপ্ন ছিল প্রশাসন ক্যাডার হবে। ভালো কলেজে পড়ালেখা করে বাবা-মায়ের দুঃখ দূর করবে। স্বপ্ন জয়ের পথে পাড়ি দেয়ার আগেই যাত্রী হলো অনন্ত মহাকাশ যাত্রার। সোমবার, ২৯ নভেম্বর ১৯তম জন্মদিনেই মায়ের কোল খালি করে নির্মম সড়ক ব্যবস্থার বলি হলো মাইনুদ্দিন ইসলাম দুর্জয়।
রামপুরায় অনাবিল পরিবহনের বাসের নিচে চাপা পড়ে নিহত দুর্জয়ের স্মৃতিতে ভারাক্রান্ত তার স্বজন ও এলাকাবাসী। ঘন্টাখানেক আগে দেখা হাসিখুশি ছেলে মুহূর্তেই কীভাবে মৃতুর কোলে ঢলে পড়লো তা বিশ্বাসই করতে পারছেন না তারা।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় জন্ম হওয়ার পর ছোটবেলাতেই বাবা-মায়ের সঙ্গে ঢাকায় চলে এসেছিল দুর্জয়। রামপুরা এলাকাতেই তার বেড়ে ওঠা। তিন ভাই-বোনের মধ্যে সবচেয়ে ছোট দুর্জয় ভালোবাসত ফুটবল খেলতে। পড়ালেখার পাশাপাশি রামপুরায় বাবার চায়ের দোকানে বসত সে। আর অবসরে বন্ধুদের নিয়ে মেতে থাকত ফুটবলে। ফুটবল দলে দুর্জয়ের জার্সি নম্বর ছিল ১৭। খেলত ডিফেন্ডার হিসেবে। মৃত্যুকে 'ডিফেন্ড' করতে না পেরে চলে গেল দল ছেড়ে। গতকালের পর ১৭ নম্বর জার্সি পরে আর কেউ খেলতে আসবে না রামপুরার এফসি স্করপিয়নের দলে।
কয়েকদিন আগেই রামপুরা একরামুন্নেসা স্কুল থেকে এসএসসি পরীক্ষা শেষ করেছিল দুর্জয়। ভালো কলেজে ভর্তি করার জন্য অনুরোধ করেছিল বাবাকে। নিজে না খেয়ে কষ্ট করে হলেও ছেলেকে ভালো প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করাতে দৃঢ় প্রত্যয়ী ছিলেন দুর্জয়ের বাবা। কিন্তু সে সুযোগ আর পেলেননা। ছেলেকে হারিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন তিনি। দুর্ঘটনার খবর পাওয়ার কিছুক্ষণ আগেই যে তার দেখা হলো ছেলের সাথে। দোকান থেকে বের হয়ে বন্ধুর সাথে দেখা করতে গিয়েছিল সে। ছোলা খাওয়ার জন্য চেয়ে নিয়েছিল ১০ টাকা। সে ছেলেই যে না ফেরার দেশে চলে গেছে তা কীভাবে মেনে নেবেন! বারবার ছেলের মোবাইলে কল করে তার সাথে কথা বলতে চাচ্ছেন। বিশ্বাস করেন কল করলেই সাড়া দেবে দুর্জয়। কাঁদতে কাদতেই বলছিলেন, 'তোরা আমার পুতরে ফোন দে। ফোন দিলেই আমার পুত বাসায় চলে আসবে। ভিক্ষা করে হলেও আমার পুতরে কলেজে পড়াব।'
দুর্জয়ের প্রিয় খাবার ছিল মুরগী। ছেলের প্রিয় মুরগী রান্না করে কাঁদতে কাঁদতে মূর্ছা যাচ্ছেন দুর্জয়ের মা। ছেলেকে নিয়ে দেখা স্বপ্নগুলো মুহূর্তেই দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে তার। আশা-ভরসা সব ধুলোয় মিলিয়ে গেছে।
'বাবারে তোর জন্য আমরা কি না কষ্ট করছি? তোকে বড় করার জন্য কত আশা, কত স্বপ্ন ছিল। তার সবই শেষ হলোরে। তুই কেন গেলিরে বাবা। তুই তো দোকানেই ছিলি। আব্বারে আব্বা তুই মুরগীর মাংস ছাড়া ভাত খাস না! মুরগীর মাংস রাঁধছি, কোথায় তুই খাবি না?' বিলাপ করে বলছিলেন দুর্জয়ের মা।
এলাকায় নম্র-ভদ্র ছেলে হিসেবে পরিচিত দুর্জয়ের এই অকাল মৃত্যু মানতে পারছেন না তার প্রতিবেশীরাও। রামপুরার তিতাস রোডে বাসা হলেও ছেলেবেলা থেকেই পুরো এলাকার পরিচিত মুখ ছিল দুর্জয়। এখানেই তার বেড়ে ওঠা, খেলাধূলা, পড়াশোনা।
বাসের নিচে চাপা পড়ার খবর পেয়ে প্রথমে ছুটে আসেন দুর্জয়ের দুলাভাই সাদ্দাম। চিরচেনা হাসিমুখের ছিন্নভিন্ন রূপ দেখে ঠিক থাকতে পারেননি তিনি। সাদ্দামের ভাই বলেন, 'আমি ও আমার বড়ভাই সাদ্দাম হোসেন গিয়ে দেখি সে পড়ে আছে। রক্ত ভেসে যাচ্ছে। মাথা নেই, চেনার উপায় নেই। চারদিকে বাসে আগুন জ্বলছে। কারা এসব বাসে আগুন দিলো এত তাড়াতাড়ি তাও বুঝে উঠতে পারি নাই। মাইনুদ্দিনের এসব পরিস্থিতি দেখে সাদ্দাম ভাই শারীরিক ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন।'
সোমবার রাতে রাস্তা পেরোতে গিয়ে অনাবিল পরিবহনের বাসের নিচে চাপা পড়ে নিহত হন মাইনুদ্দিন ইসলাম দুর্জয়। দুর্ঘটনার সাথেসাথেই বিক্ষুব্ধ জনতা সেই বাসসহ আশেপাশের কয়েকটি বাসে আগুন জ্বালিয়ে দেয় ও ভাংচুর চালায়। পুলিশ এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে। এই ঘটনায় এখন পর্যন্ত এক বাস চালক ও চালকের সহকারীকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। আজ, মঙ্গলবার সকাল থেকেই দুর্জয়ের মৃত্যুর প্রতিবাদে ও নিরাপদ সড়কের দাবীতে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা রামপুরা ব্রিজ অবরোধ করে আন্দোলন করছে।
ছাত্র আন্দোলনে অংশ নেওয়া দুর্জয়ের বন্ধু হৃদয় হাসান টিবিএসকে বলেন, 'স্কুল জীবনের শুরু থেকে আমার বন্ধু দুর্জয়। এভাবে আমাদের ছেড়ে চলে যেতে হলো তাকে। দুইদিন পরপরই রাস্তায় এমন দুর্ঘটনা হচ্ছে। আপনারা একটু ভালো করে লেখালেখি করেন, যেন আমার বন্ধু হত্যার বিচার পাই।'
পূর্ব রামপুরার তিতাস রোডে জানাজা শেষে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে দুর্জয়ের মৃতদেহ। সেখানে আবার জানাজা শেষে দাফন করা হবে তাকে। গত কয়েকদিন যাবতই ঢাকার রাস্তায় ঘটে গেছে ভয়াবহ কিছু সড়ক দুর্ঘটনা। নিরাপদ সড়কের দাবীতে ছাত্রদের বারবার আন্দোলন সত্ত্বেও কার্যকর কোনো পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের।