ফ্যাশন ও আত্মপরিচয়ের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করা ৫ ঐতিহাসিক অনুষঙ্গ
সম্প্রতি পেনসিলভানিয়া ইউনিভার্সিটির মিউজিয়াম অব আর্কিওলজি অ্যান্ড অ্যানথ্রোপলজির (পেন মিউজিয়াম) একটি নতুন প্রদর্শনীতে ২,৫০০ বছর ধরে চলমান স্টাইলের প্রায় ২৫০টি নিদর্শন প্রদর্শিত হয়েছে। 'দ্য স্টোরিজ উই ওয়্যার' নামক এ প্রদর্শনীতে কাজ, খেলা, যুদ্ধ, পারফরম্যান্স, অনুষ্ঠানাদি এবং শাসন- ইত্যাদি ক্যাটাগরিতে ভাগ করা হয়েছে মানুষের পরিধেয় সাজসজ্জার উপাদানগুলো।
১৭০০ শতকের সামুরাই যোদ্ধাদের বর্ম থেকে শুরু করে ১৯৬৫ সালে পরা হলিউড তারকা রাজকুমারী গ্রেস কেলির একটি কোরাল-বিডেড গিভেনচি গাউন সহ উল্লেখযোগ্য কিছু বস্তু প্রদর্শিত হয়েছে সেখানে। জাদুঘরের ওয়েবসাইটের ভাষ্যে, "ভাষা, সংস্কৃতি এবং সময়" এ পরিধির বাইরে যেয়ে এ প্রদর্শনীটি ফ্যাশন এবং চিন্তার মধ্যকার সংযোগকে উপস্থাপন করে।
জাদুঘরের লিড কিউরেটর লরেন রিস্টভেট এক বিবৃতিতে বলেন, "আমরা প্রায়ই ফ্যাশনকে তুচ্ছ বলে উড়িয়ে দেই। কিন্তু আমরা যেভাবে পোশাক পরিধান করি তা আমাদের পরিচয় তুলে ধরে"।
এখানে পাঁচটি ঐতিহাসিক অনুষঙ্গের কথা তুলে ধরা হলো যা ফ্যাশনের শক্তিকে আত্মোপলব্ধির হাতিয়ার হিসেবে প্রদর্শন করে।
ষোড়শ শতকের নেপালি বৌদ্ধ পুরোহিতের মুকুট
পাঁচজন মহাজাগতিক (কসমিক) বুদ্ধের চেহারা মান্দালার আকারে সাজিয়ে তৈরি করা হয়েছে নেপালের কাঠমান্ডু উপত্যকার এই মুকুট। এই জ্যামিতিক প্রতীকটি পবিত্র অনুষ্ঠান এবং ধ্যানের প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হতো। নৈতিকতা, আত্মত্যাগ এবং প্রজ্ঞা সহ বুদ্ধত্বের অন্যান্য বৈশিষ্ট্যগুলো গ্রহণের একটি বাহ্যিক প্রদর্শন হিসেবে পুরোহিতরা এ মুকুট পরতেন।
"আমাদের জাদুঘরে রাখা মুকুট এবং অনুরূপ অন্যান্য মুকুটগুলো বেশ ভারী। ফলে সব রকমের অনুষ্ঠানে এসব পরা হতো না," বলেন রিস্টভেট।
মুকুট পরিধানকারীরা তাদের ধর্মীয় ঐতিহ্যের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠেছিলেন।
কোকল-প্রধানের (বর্তমান পানামা) প্রাচীন সমাধিস্থল থেকে সংগৃহীত অলংকার
৭৫০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১০০০ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণকারী ১২ জন মানুষের সমাধিস্থল থেকে একজনের দেহে এইসকল স্বর্ণের ফলক সহ অন্যান্য উপাদান সংযুক্ত ছিল। ১৯৪০ সালে এ সমাধিস্থলের খোঁজ পাওয়া যায়। রিস্টভেট বলেন, অসাধারণ সোনায় সজ্জিত এ ব্যক্তি 'সমাধিস্থলের মধ্যে পাওয়া সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি ছিলেন'।
প্রতিটি ফলকে তীক্ষ্ণ দাঁত এবং পা-যুক্ত কুমিরের আকার ধারণ করা মানুষের প্রতিকৃতি খোদাই করা আছে । রিস্টভেট জানান, প্রায়শই কুমিরকে শাসন এবং ক্ষমতার প্রতীক হিসেবে ধরা হতো। ফলকগুলো ছাড়াও জাগুয়ারের আদলে তৈরি একটি গলার হার পাওয়া গেছে ওই ব্যক্তির দেহে। পান্না আবৃত এ জাগুয়ার, মেসোআমেরিকা জুড়ে শক্তির প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হতো।
১৯৩০ এর দশকে মারিয়ান অ্যান্ডারসনের পরিহিত ভেলভেট গাউন
মেট্রোপলিটন অপেরার সাথে যুক্ত প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ নারী মারিয়ান অ্যান্ডারসনের এই ভেলভেট মার্লট গাউনটি জেলডা বারবার ভিন ভ্যালডেস ডিজাইন করেছিলেন বলে ধারণা করা হয়। রিস্টভেট জানান, বিশ্বের প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ ফ্যাশন ডিজাইনারদের মধ্যে একজন হিসেবে ১৯৪৮ সালে ব্রডওয়েতে একটি বুটিক খোলেন তিনি। ভ্যালডেস তার ক্যারিয়ারের বেশিরভাগ সময় মারিয়ান অ্যান্ডারসনের পোশাকের দায়িত্বে ছিলেন বলে উল্লেখ করেন রিস্টভেট।
অ্যান্ডারসন তার ক্যারিয়ার জুড়ে বেশ কয়েকবার এ গাউনটি পরেছেন। এমনকি ফিলাডেলফিয়ার একাডেমি অব মিউজিকের বার্ষিক পারফরম্যান্সের জন্য পরিহিত পোশাকগুলোর মধ্যে একটি হতে পারে এ গাউন। জাতিগত পরিচয়ের জন্য মানুষের কটুক্তির শিকার হওয়া অ্যান্ডারসন শেষ পর্যন্ত একজন সাংস্কৃতিক আইকন হয়ে উঠেছিলেন। ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্ট এবং জন এফ কেনেডি সহ অন্যান্য মার্কিন প্রেসিডেন্টদের সামনে গান গেয়েছিলেন তিনি।
চীনের কিং রাজবংশের কর্মকর্তার পোশাক
১৮৯৮ সালে পেন মিউজিয়ামে দান করা 'চাওফু' (শ্রোতাদের পোশাক) নামক এ পোশাকটি ছিল দ্বিতীয় শ্রেণির একজন বেসামরিক কর্মকর্তার সরকারী পোশাক। রিস্টভেট বলেন, সিল্ক এবং বুটিদার রেশমি কাপড়ে তৈরি এ পোশাকে ড্রাগন, ঢেউ এবং মেঘের ডিজাইন এমব্রয়ডারি করা আছে। এটি কর্মকর্তাদের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু অনুষ্ঠানে পরা হতো।
"চীনে সরকারী পোশাকের প্রতিটি দিকই মূলত কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়, এবং এই সমস্ত পোশাকে অনেক প্রতীকি কারুকাজ থাকে... নীল-কালো রঙের এই পোশাক কেবলমাত্র আদালতের কর্মকর্তারা পরতেন," জানান রিস্টভেট।
কিং রাজবংশের পতাকার অন্যতম প্রধান রং ছিল নীল। রিস্টভেট বলেন, "অবশ্যই, চীনের সম্রাটের শাসনের প্রতীক ড্রাগন। পোশাকে আঁকা ড্রাগনের নখের সংখ্যা একজন কর্মকর্তার পদমর্যাদার সাথে মিল রেখে নির্ধারিত হয়।"
সিথিয়ান যোদ্ধার সোনার মুকুট
এই সোনার মুকুটে খচিত গোলাপগুলো সোনার ফয়েল এবং তার দিয়ে তৈরি ছিল। এটি সম্ভবত একজন অভিজাত সিথিয়ান নারীর ব্যবহৃত মুকুট ছিল বলে ধারণা করা হয়।
ঐতিহাসিক নিদর্শন সংরক্ষণকারী ডেব্রা ব্রেসলিন লিখেছেন, "বিশ্বজুড়ে অনেক সংস্কৃতিই স্বর্ণকে উচ্চ মর্যাদার প্রতীক হিসাবে মূল্য দিতো।" এ প্রদর্শনীর জন্য ২০০টিরও বেশি নিদর্শন পরীক্ষা করেছেন তিনি।
রিস্টভেট বলেন, "সামরিক দক্ষতার এই ধারণাটিকে আমরা বহু শতাব্দী ধরেই পুরুষতান্ত্রিক হিসেবে বিবেচনা করে আসছি। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, আমাদের জাদুঘরে প্রদর্শিত প্রায় সব সিথিয়ান উপাদান নারীদের সমাধি থেকে এসেছে বলে মনে হয়"।
'দ্য স্টোরিজ উই ওয়্যার' প্রদর্শনীটি পেন মিউজিয়ামে আগামী বছরের ১২ জুন পর্যন্ত চলবে।
- সূত্র-সিএনএন