বজ্রপাত নিয়ন্ত্রণ হবে অতিকায় লেজারে
জেনেভা বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক বজ্রপাত থেকে সুরক্ষার জন্য এক বিশেষ লেজার রশ্মির ব্যবহার উদ্ভাবন করতে চলেছেন।
এই গবেষক দলের নেতৃত্বে আছেন সুইস পদার্থবিজ্ঞানী জ্যঁ-পিয়েরে উলফ। তিনি ২০ বছরেরও বেশি সময় ধরে লেজার নিয়ে কাজ করছেন, বিশেষ করে আবহাওয়া নিয়ন্ত্রণে লেজারের ব্যবহারে তিনি খুবই আগ্রহী।
লেজার খুবই সরু, তবে শক্তিশালী এবং তীক্ষ্ণ আলোক রশ্মি তৈরি করে। হীরা কাটা থেকে শুরু করে অস্ত্রোপচার, বারকোড পড়া সহ নানা কাজে লেজারের ব্যবহার রয়েছে। উলফ মনে করেন, এটি আমাদের বজ্রপাত থেকেও সুরক্ষা দিতে পারে।
উলফের নেতৃত্বাধীন এই প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত আছে প্যারিস এবং লসানে বিশ্ববিদ্যালয়, সেইসঙ্গে রকেট প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান আরিয়ান গ্রুপ এবং লেজার প্রস্তুতকারী জার্মান হাই-টেক কোম্পানি ট্রাম্পফ। আর এই প্রকল্পে অর্থায়ন করছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন।
মহামারির কারণে প্রায় এক বছর প্রকল্পটি বন্ধ থাকার পর, সম্প্রতি লেজারটি সুইস আল্পসের পর্বত সান্টিসের চূঁড়ায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে, যার উচ্চতা মাটি থেকে প্রায় ২,৫০০ মিটার বা ৮,২০০ ফুট।
কৃত্রিম বজ্রপাত
ভূ-পৃষ্ঠ থেকে যখন পানি বাষ্প হয়ে উপরের দিকে উঠতে থাকে তখন মেঘের নিচের দিকে ভারী অংশের সঙ্গে জলীয়বাষ্পের সংঘর্ষ হয়। এর ফলে অনেক জলকণা ইলেকট্রন ছেড়ে দিয়ে ধনাত্মক চার্জে পরিণত হয় এবং অনেক জলকণা সে ইলেকট্রন গ্রহণ করে আবার ঋণাত্মক চার্জে পরিণত হয়।
এসময় ইলেকট্রনগুলো খুবই শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে। এর বিপরীত চার্জের আকর্ষণের কারণে, এগুলো যখন বাতাসের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয় তখন আমরা বৈদ্যুতিক স্পার্ক দেখতে পাই। এই স্পার্কেই বলা হয় বজ্রপাত।
লেজারটি উপরের এই প্রাকৃতিক ঘটনাটিরই পুনরাবৃত্তি করার মাধ্যমে বজ্রপাত তৈরি করবে বলে জানান উলফ। তিনি বলেন, "মূল ভাবনাটি হলো, মেঘগুলো থেকে নিয়ন্ত্রিতভাবে বিদ্যুৎ নিঃসরণ করানো। মূলত এ কারণেই এটাকে আমরা 'লেজার লাইটেনিং রড' বলছি"।
গতানুগতিক আলোক রশ্মিগুলো যত উপরেই বসানো হোক না কেনো, এগুলা মাটিতে একটি সীমিত এলাকাকে সুরক্ষা দিয়ে থাকে। তাই উলফ মনে করছেন, এই লেজার প্রকল্পটির মাধ্যমে একটি বড় এলাকার সুরক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব। তবে সেই বড় এলাকার পরিধি কতটুকু হবে সে ব্যাপারে গবেষকগণ এখনও নিশ্চিতভাবে কিছু জানান নি।
উলফ বলেছেন, এই প্রযুক্তিটি উপগ্রহ বহনকারী রকেটের সুরক্ষায় কার্যকরভাবে ব্যবহার করা যেতে পারে। এছাড়া ঝড়ের মধ্যে বিমান চলাচলের সময়ও এই প্রযুক্তি সুরক্ষা দিতে পারে।
তিনি আরও বলেন, বজ্রপাত থেকে সুরক্ষা পেতে এবং ঝড়ের মধ্যেই নিরাপদে বিমান চলাচল নিশ্চিত করতে শুধুমাত্র যুক্তরাষ্ট্রেই প্রতিবছর বিলিয়ন ডলার খরচ হয়।
ইউরোপিয়ান কমিশন এই বৈজ্ঞানিক গবেষণা প্রকল্পের আর্থিক সহায়তা দিচ্ছে। কমিশনের তথ্য মতে, বিশ্বে প্রতিবছর ৬ হাজার থেকে ২৪ হাজার মানুষ বজ্রপাতে মারা যায় এবং এই প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে প্রতিবছর কয়েক বিলিয়ন ইউরোর বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি এবং অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যা ক্রমেই একটি সামাজিক উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
আশা করা হচ্ছে, এই প্রযুক্তি নিরাপদ বিমান পরিবহন এবং বজ্রপাতের ক্ষয়ক্ষতি থেকে সুরক্ষা দেবে।
বিশালাকৃতির লেজার
বিশাল এই লেজারটি কয়েক দফায় ক্যাবল কার এবং হেলিকপ্টারের সাহায্যে পাহাড়ের চূঁড়ায় নেওয়া হয়েছিলো।
লেজার অ্যারেটিকে তার জায়গায় বসানোর জন্য ১৮ টন কংক্রিট ব্লক সহ মোট ২৯ টন সরঞ্জাম নিয়ে যেতে হয়েছিল সেখানে।
উলফ বলেন, লেজারটি প্রতি সেকেন্ডে এক হাজারবার নিক্ষেপ করা সম্ভব এবং এটি এতটাই শক্তিশালী যে, এক সেকেন্ডে যে পরিমাণ শক্তি এটি উৎপন্ন করে, তা পৃথিবীর সমস্ত পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র হতে উৎপন্ন শক্তির সমান। তবে এই শক্তি খুবই অল্প সময়ের জন্য স্থায়ী হয়।
যখন লেজারটি চালু থাকবে তখন নিরাপত্তার স্বার্থে এর চারপাশে ৫ কিলোমিটার পর্যন্ত 'নো ফ্লাই জোন' তৈরি করা হবে। অর্থাৎ এর আশেপাশে যে কোনো ধরণের আকাশযান চলাচল নিষিদ্ধ করা হবে।
লেজারটি শুধুমাত্র তখনই চালু থাকবে, যখন বেশিমাত্রায় বজ্রপাত হতে দেখা যাবে। এছাড়া, বজ্রপাত কতখানি কাছ থেকে এবং উচ্চতা থেকে লেজার রশ্মিকে অনুসরণ করে সেটা দেখার জন্য, পাহাড়ের চূঁড়ায় বিশেষ ধরণের ক্যামেরা বসানো হবে, যা প্রতি সেকেন্ডে ৩ লক্ষাধিক ছবি তুলবে।
উলফ বলেন, বজ্রপাতের মৌসুম শেষ হওয়া পর্যন্ত, অর্থাৎ সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত এই প্রকল্পের পরীক্ষা চলবে। যদি এটি সফল হয়, তবে পরবর্তী পরীক্ষাটি বিমানবন্দরে চালানো হতে পারে এবং প্রযুক্তিটি কয়েক বছরের মধ্যেই প্রস্তুত হতে পারে।
সেপ্টেম্বর মাস নাগাদ ভালো ফলাফল পাওয়ার ব্যাপারে আশা প্রকাশ করে উলফ বলেন, "আমরা শীঘ্রই বুঝতে পারবো প্রকল্পটি সফল হবে কিনা, তবে বৈজ্ঞানিক তথ্য বিশ্লেষণে কিছুটা সময় প্রয়োজন"।
- সূত্র- সিএনএন