বাসস্থান ছেড়ে কেন শত শত মাইল ঘুরে বেড়াচ্ছে একদল হাতি?
আবাসস্থল থেকে ৩০০ মাইল পাড়ি দিয়ে চীনের একটি শহর কানমিংয়ের আশেপাশে এসে ঘুরে বেড়াচ্ছে একদল বন্যহাতি। হাতিগুলোকে লোকালয় থেকে দূরে রাখতে চেষ্টা করছেন স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তারা, কেনো হাতিগুলো এভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে তার কারণ উদঘাটন করতে ঘাম ঝড়ছে বিশেষজ্ঞদের, চলছে গবেষণাও।
১৫টি এশিয়ান হাতির দলটিতে পূর্ণ বয়স্ক হাতি ছাড়াও বেশ কিছু বাচ্চা হাতিও আছে। চীনা সংবাদমাধ্যমের সূত্রে জানা গেছে, হাতিগুলো এক বছর আগেই চীনের মিয়ানমার ও লাওসের সীমান্তবর্তী একটি সংরক্ষিত বন ছেড়ে উত্তরমুখী যাত্রা শুরু করে।
যাত্রাপথে হাতিগুলো বন-জঙ্গল পাড়ি দিয়েছে, ঝর্ণার ঝিড়িপথ অতিক্রম করেছে, ঘুরে বেড়িয়েছে গ্রাম থেকে শহরে, অনেক গ্রামের ফসলের জমিও নষ্ট করেছে। মদ বানাতে ব্যবহৃত গাঁজানো শস্য শুকে কমবয়সী একটি হাতির মাতাল হয়ে যাওয়ার মতো ঘটনাও ঘটেছে।
স্থানীয় প্রশাসন হাতিগুলোকে চিহ্নিত করার কাজে কয়েকশত মানুষ ও ড্রোন মোতায়েন করেছে। ফল, সবজি দিয়ে হাতিগুলোকে জনবহুল এলাকা থেকে দূরে রাখার চেষ্টা চলছে। কানমিং শহরটিতে প্রায় ৭০ লাখ মানুষের বাস।
কিন্তু, হাতিগুলোর গতিরোধ করা যাচ্ছে না কোনোভাবেই। প্রশ্ন হলো, কেনো একদল বন্যহাতি এমন অদ্ভুত আচরণ করছে। কেনো-ই বা নিজ বাসস্থান ছেড়ে মাইলের পর মাইল পাড়ি দিয়ে লোকালয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বেঁচে থাকার প্রয়োজনীয় রসদের সন্ধানে আদি নিবাস ছেড়েছে হাতিগুলো।
কলোরাডো স্টেট ইউনিভার্সিটির হাতি বিশেষজ্ঞ ও সেভ দ্য এলিফ্যান্টের সায়েন্টিফিক বোর্ডের চেয়ারম্যান জর্জ উইটমেয়ারের মতে, "নিরাপত্তা, খাদ্যের যোগান ও যৌনসঙ্গম- এই তিনটি বিষয় এখানে লক্ষণীয়। সাধারণত বিপজ্জনক পরিস্থিতি এড়াতে হাতিরা আদি নিবাস ত্যাগ করে। খাদ্য ও পানির সন্ধানেও তারা অন্যত্র যাত্রা করে। সামাজিক কারণ ও প্রজননের বাড়তি সুবিধা পেতেও তারা অনেক সময় অন্যত্র চলে যায়,"
এই হাতির দলের আদি নিবাসে সরকার দুটি সংরক্ষিত বন করে দেওয়ার পর হাতির জনসংখ্যা বেড়ে যায়। বর্তমানে সেখানে প্রায় ২৮০টি হাতির বাস। উইটমেয়ার ধারণা করছেন, জনসংখ্যা বেড়ে যাওয়া এই ঘটনার পেছনে ভূমিকা রাখতে পারে।
"কোনো স্থানে হাতির সংখ্যা বেড়ে গেলে, সে স্থান ত্যাগ করে অপেক্ষাকৃত ভালো বাসস্থানের সন্ধান করা হাতিদের মধ্যে খুবই সাধারণ একটি ব্যাপার। একই এলাকায় অনেক হাতি থাকলে রসদের জন্য তীব্র প্রতিযোগিতার সৃষ্টি হয়," বলেন তিনি।
নিউ ইয়র্কের হান্টার কলেজের বিশেষজ্ঞ জশুয়া প্লোটনিক জানান, এর আরেকটি কারণ হতে পারে তাদের আবাসস্থলে ও এর আশেপাশে মানব বসতি গড়ে ওঠা। হাতিগুলোর পর্যবেক্ষণে সার্বক্ষণিক চীনা বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন তিনি।
"হাতি খুবই নির্দিষ্ট ধরনের পরিবেশে বিবর্তিত হয়েছে। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই মানুষের কর্মকাণ্ডে তাদের বাসযোগ্য পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ায় তারা আর সে সব এলাকায় টিকে থাকতে পারছে না। একারণে তারা এখন অন্যত্র বেঁচে থাকার রসদের সন্ধানে নেমেছে, এ উদ্দেশ্যে পাড়ি দিচ্ছে শত শত মাইল," বলেন তিনি।
তারা এতো লম্বা সময় ধরে কেনো ঘুরে বেড়াচ্ছে তা আরেক রহস্য। হয়তো তারা পাকাপোক্তভাবে বসবাস করার মতো উপযুক্ত পরিবেশ খুঁজে পায়নি। হয়তো বা তারা পথে চলতে চলতে আনারস,কলা ও ভূট্টার মতো খাবার পেয়ে আরও সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। কখনো হয়তো কোনো গ্রামের বাসিন্দারা তাদের লোকালয় থেকে দূরে সরিয়ে রাখার জন্য এসব খাবার দিচ্ছে, কখনো বা তাদের এমনিতেই খেতে দিচ্ছে।
চীনা সংবাদমাধ্যম কাইক্সিনের বরাতে জানা গেছে, প্রতিনিয়ত হাতি ও মানুষের সংঘর্ষ বাড়ছে, বাড়ছে মিথস্ক্রিয়াও।
"অনেক বেশি সময় ধরে সংরক্ষিত বনের বাইরে আছে হাতিগুলো, যতো দিন যাচ্ছে, বাসস্থান থেকে আরও দূরে সরে যাচ্ছে হাতিগুলো। প্রতিনিয়ত তাদের আচরণ সম্পর্কে ধারণা করাও আরও কঠিন হয়ে পড়ছে," ওই অঞ্চলের এক বন্যপ্রাণি সংরক্ষণ কর্মকর্তা লি ঝংইউয়ান জানান চীনা সংবাদমাধ্যমটিকে।
তবে আর্থিক ক্ষতি ছাড়া, এসব এলাকায় হাতি ও মানুষের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেনি। কিন্তু, একইসঙ্গে হাতির দলটি যতো জনবহুল লোকালয়ের দিকে যাবে, সংঘর্ষের সম্ভাবনাও ততোই বাড়তে থাকবে।
জশুয়া প্লোটনিকের ভাষ্যে, "হাতি ও মানুষের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ছে,"
হাতিগুলো হয়তো আর খুব বেশি সামনে এগুতেও পারবে না।
ইউনান ইউনিভার্সিটির স্কুল অব ইকোলজি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টের অধ্যাপক চেন মিংইয়ং বলেন, "হাতিগুলো আরও উত্তরে এগিয়ে গেলে তাদের বেঁচে থাকার সম্ভাবনাও কমতে থাকবে, কারণ আরও উত্তরের অঞ্চলগুলোর পরিবেশ হাতিদের বসবাসের উপযোগী নয়,"
এদিকে ওই অঞ্চলের বেশ কিছু বাড়ি-ঘর খালি করার নির্দেশ দিয়েছে কর্তৃপক্ষ, জনসাধারণকে সতর্ক থাকার নির্দেশনাও দেয়া হয়েছে।
শেষ পর্যন্ত হয়তো হাতিগুলোকে ট্রাকে করে স্থানান্তরের প্রয়োজন পড়বে।
হাতিগুলো যদি এমন কোনও জায়গার সন্ধান পায় যে স্থান তাদের বসবাসের জন্য উপযোগী, প্রয়োজনীয় রসদ পাবে তারা, একইসঙ্গে লোকালয় থেকে নিরাপদ দূরত্বে অবস্থিত; সেটিই এ অবস্থার সর্বোত্তম সমাধান হবে বলে মনে করছেন প্লোটনিক।
হাতিগুলোকে তাদের আদি নিবাসে ফিরিয়ে নেওয়াও বিকল্প হতে পারে, কিন্তু সেক্ষেত্রে আগে প্রয়োজন তাদের ব্যবহারের কারণ অনুসন্ধান।
"তাদের এই যাত্রার কারণ খুঁজে না বের করেই সেখানে স্থানান্তর করা হলে, তারা হয়তো আবারও ওই স্থান ছেড়ে চলে আসবে। এর সম্ভাবনাই বরং বেশি," বলে তিনি।
- সূত্র: এনপিআর