বিদায় নিলেন বাংলার দুঃসাহসী লিভিং ঈগল, সাইফুল আজম
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকেই এখন পর্যন্ত আধুনিক যুদ্ধজয়ের প্রধান নির্ধারক যুদ্ধবিমান। যুদ্ধবিমানের সুদক্ষ বৈমানিকরা একটি দেশ ও জাতির অন্যতম প্রধান সুরক্ষা কবচ।
বিশ্বের শক্তিধর দেশগুলো সর্বাধুনিক প্রযুক্তির জঙ্গিবিমান তৈরির পাশাপাশি দক্ষ পাইলট তৈরির দিকেও মনোযোগ দেয় । প্রযুক্তি ও পাইলটদের দক্ষতা এ দুয়ের মধ্যে দিয়েই প্রতিষ্ঠিত হয় আকাশযুদ্ধে একটা দেশের শ্রেষ্ঠত্ব।
বাংলার ইতিহাসে এমনই এক কিংবদন্তির বৈমানিক ছিলেন সাইফুল আজম। আকাশযুদ্ধের রণনিপুণতার কারণে পৃথিবীর জীবিত ২২ জন সেরা বৈমানিক বা লিভিং ঈগলদের একজন ছিলেন তিনি।
যুদ্ধক্ষেত্রে অনন্য সব অর্জনের স্বীকৃতি হিসেবে সাইফুল আজমকে ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্র বিমানবাহিনী বিশ্বের ২২ জন 'লিভিং ইগলস' এর একজন হিসেবে স্বীকৃতি দেয় ।
এই সংখ্যাটি আজ একুশে নেমে এসেছে। প্রায় নীরবেই আজ রোববার পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন এই কিংবদন্তি। লড়াকু এই আকাশ যোদ্ধা আজ রোববার দুপুর দেড়টায় ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের (সিএমএইচ) আইসিইউ-তে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন।
কিন্তু মৃত্যু তার গৌরব ও দুঃসাহসের কীর্তি কেড়ে নিতে পারবে না কিছুতেই। তিনটি ভিন্ন দেশের হয়ে আকাশযুদ্ধে অংশ নেওয়া পৃথিবীর একমাত্র বৈমানিক ছিলেন তিনি। এই তিনটি দেশ হচ্ছে; পাকিস্তান, জর্ডান, ইরাক। আর মাতৃভূমি বাংলাদেশসহ বিমানবাহিনীর সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন চারটি দেশের হয়ে।
প্রথমোক্ত তিন দেশের হয়েই রণকৌশল আর বিমান পরিচালনায় অসাধারণ দক্ষতা প্রদর্শন করেন তিনি।
স্বাধীনতার পূর্বে তৎকালীন পাকিস্তান বিমান বাহিনীতে যোগ দেন সাইফুল আজম। এরপর ১৯৬৭ সালের জুন মাসে তৃতীয় সালের আরব-ইসরাইল যুদ্ধে অংশ নেন। এই যুদ্ধেই তিনি পশ্চিমা প্রশিক্ষণে দক্ষ এবং প্রযুক্তিতে বহুগুণ ক্ষমতাধর ইসরাইলি সেনাবাহিনীর উল্লেখযোগ্য সংখ্যক যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করেন। একক ব্যক্তি হিসেবে আকাশপথের যুদ্ধের ইতিহাসে সর্বোচ্চ সংখ্যক ইসরাইলি যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করার অনন্য রেকর্ডটাও তারই। আজ পর্যন্ত যা অক্ষুণ্ণ রয়েছে।
১৯৬৭ সালের যুদ্ধে অংশ নিতে পাকিস্তানের পক্ষ থেকে ইরাকি বিমানবাহিনীতে বদলি হন সাইফুল আজম। পশ্চিম ইরাকে অবস্থান নিয়ে ইসরাইলিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছিলেন তিনি।
যুদ্ধ শুরু হওয়ার মাত্র ৫ দিনের মাথায় গাজা এবং সিনাইয়ের কর্তৃত্ব নিয়েছিল ইসরাইল। জুনের ৫ তারিখে সিরীয় বিমানবাহিনীর দুই-তৃতীয়াংশ শক্তি ধ্বংস করে দেয় ইসরাইলি বিমান সেনারা।
তেমন কোনো প্রতিরোধ ছাড়াই ইসরাইল পশ্চিম তীর এবং জেরুজালেম দখল করে নিয়েছিল। দখল করে নিয়ে ছিল সিরিয়ার গোলান মালভূমিও। তাদের সামনে বিন্দুমাত্র প্রতিরোধ তৈরি করতে পারেনি মধ্যপ্রাচ্যের কোনো দেশ।
এ সময় ইসরাইলিদের যমদূত হয়ে জর্ডানে যান সাইফুল আজম।
৬ জুন আকাশ থেকে প্রচণ্ড আক্রমণে মিসরীয় বিমানবাহিনীর যুদ্ধ-সরঞ্জাম গুঁড়িয়ে দেয় ইসরাইলি বাহিনী। একই দিন বেলা ১২টা ৪৮ মিনিটে চারটি ইসরাইলি সুপারসনিক 'ডেসল্ট সুপার মিস্টেরে' জঙ্গি বিমান ধেয়ে আসে জর্ডানের মাফরাক বিমান ঘাঁটির দিকে। এবার তাদের লক্ষ্য জর্ডানের ছোট্ট বিমানবাহিনীকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া।
সে সময় ইসরাইলি সুপারসনিকের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার মতো সমকক্ষ বিমান আরবদের হাতে ছিল না। তবু ইসরাইলি হামলা ঠেকাতে মাফরাক বিমান ঘাঁটি থেকে 'হকার হান্টার' জঙ্গি বিমান নিয়ে উড়াল দেন অসম সাহসী সাইফুল আজম।
আর সেই হকার হান্টার দিয়েই ক্ষিপ্রগতির দুটি ইসরাইলি সুপারসনিক ঘায়েল করে ফেললেন সাইফুল আজম। তার অব্যর্থ আঘাতে ভূপাতিত হয় একটি ইসরাইলি 'সুপার মিস্টেরে'। আরেক আঘাতে প্রায় অকেজো হয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে কোনো মতে পালিয়ে ইসরাইলি সীমানায় গিয়ে আছড়ে পড়ে আরেকটি বিমান।
সে দিন অকুতোভয় বৈমানিক সাইফুল আজমের অকল্পনীয় বীরত্বের কারণে ইসরাইলের পুরো পরিকল্পনাই ভেস্তে যায়। উল্টো নিজেদেরই দুটো বিমান হারায় তারা।
এমন অসাধারণ বীরত্বের জন্য পুরস্কারস্বরূপ সাইফুল আজমকে বিশেষ সম্মাননায় ভূষিত করে ইরাক ও জর্ডান সরকার।
সাইফুল আজমের কাছে ইসরাইলি বৈমানিকদের ধরাশায়ী হওয়া এটাই প্রথম। পরদিনই তার কৃতিত্বে ইরাকি বৈমানিক দলের কাছে চরমভাবে পরাজিত হয় ইসরাইলিরা।
৭ জুনে ইরাকের 'এইচ-থ্রি' ও 'আল-ওয়ালিদ' ঘাঁটি রক্ষা করার দায়িত্ব পড়ে এক ইরাকি বৈমানিক দলের কাঁধে। আর সেই দলের অধিনায়ক হিসেবে নিযুক্ত হন সাইফুল আজম ।
সে দিন চারটি 'ভালচার বোম্বার' ও দু'টি 'মিরাজ থ্রিসি' জঙ্গি বিমান নিয়ে আক্রমণ চালায় ইসরাইল।
একটি 'মিরেজ থ্রিসি' বিমানে ছিলেন ইসরায়েলি ক্যাপ্টেন গিডিওন দ্রোর। দ্রোরের গুলিতে নিহত হন আজমের উইংম্যান। তার হামলায় ভূপাতিত হয় দুটি ইরাকি বিমান। একটু পর এ ঘটনার মোক্ষম জবাব দেন আজম।
তার অব্যর্থ টার্গেটে পরিণত হয় দ্রোরের 'মিরাজ থ্রিসি'। সে আঘাতের পর বাঁচার উপায় না পেয়ে যুদ্ধবন্দি হিসেবে ধরা দেন ক্যাপ্টেন দ্রোর। ওই যুদ্ধবন্দির বিনিময়ে জর্ডান ও ইরাকের সহস্রাধিক সৈন্যকে মুক্ত করে ইসরাইল।
আরব-ইসরাইল যুদ্ধের প্রথম ৭২ ঘণ্টার মধ্যেই সাইফুল আজম একটি অনন্য রেকর্ড তৈরি করেন। ইতিহাসে তিনিই একমাত্র ব্যক্তি যিনি ভূপাতিত করেছেন সর্বোচ্চ তিনটি ইসরাইলি বিমান। যে জন্য 'নাত আল-সুজাহ' সামরিক সম্মাননায় ভূষিত করা হয়।
সাইফুল আজমের জন্ম ১৯৪১ সালে, পাবনা জেলার খগড়বাড়িয়াতে। বাবার কর্মসূত্রে শৈশবের কিছু সময় তার কাটে কলকাতায়। ১৯৪৭ এর দেশভাগের সময় তার পরিবার আবার ফিরে আসে বাংলাদেশে, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে। মাধ্যমিকের পড়াশোনা করেন এখানেই। ১৪ বছর বয়সে তাকে পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠানো হয় উচ্চ মাধ্যমিকের শিক্ষালাভের জন্য। ১৯৫৮ সালে তিনি ভর্তি হন পাকিস্তান এয়ার ফোর্স ক্যাডেট কলেজে। দু' বছর পর তিনি পাইলট অফিসার হয়ে শিক্ষা সম্পন্ন করেন। সে বছরেই তিনি জেনারেল ডিউটি পাইলট হিসেবে কমিশনপ্রাপ্ত হয়ে যোগ দেন পাকিস্তান বিমান বাহিনীতে।
১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধে তিনি সর্বপ্রথম নিজের রণনৈপুণ্য প্রদর্শনের সুযোগ পান। এসময় তার প্রথম শিকারে পরিণত হয় ভারতীয় 'ফোলান্ড নেট' জঙ্গি বিমান। ভূপাতিত বিমান থেকে ভারতীয় ফ্লাইট অফিসার বিজয় মায়াদেবকে যুদ্ধবন্দি হিসেবে আটক করা হয়।
পাকিস্তান বিমানবাহিনীর মূল জঙ্গি বিমান ছিল যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি এফ-৮৬ স্যাবর। আর এই 'স্যাবর কিলার' নামে বিশেষ পরিচিত ছিল যুক্তরাজ্যে থেকে কেনা ভারতের 'ফোলান্ড নেট' জঙ্গি বিমান।
সেই ঘাতক আতঙ্কের অবসান ঘটে সাইফুল আজমের হাতে। এ কৃতিত্বে তার সহকর্মীদেরও যুদ্ধের মনোবল বহুগুণ বেড়ে যায়।
আকাশপথের সম্মুখ সমরে 'ফোল্যান্ড নেট' বিমানকে পরাজিত করা সে সময় এক বিরল ঘটনা ছিল। এই কৃতিত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ সাইফুল আজমকে পাকিস্তানের তৃতীয় সর্বোচ্চ সামরিক সম্মাননা 'সিতারা-ই-জুরাত' এ ভূষিত করা হয়।
পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করার পর তিনি দেশের নব্যগঠিত বিমান বাহিনীর আগামী দিনের প্রজন্মকে প্রশিক্ষিত করার উদ্দেশ্যে সেখানে যোগ দেন। ১৯৭৯ সালে তিনি বাংলাদেশ বিমান বাহিনী থেকে একজন গ্রুপ ক্যাপ্টেন হিসেবে অবসরগ্রহণ করেন।
অবসরের পর সাইফুল আজম ১৯৮২ থেকে ১৯৮৪ এবং ১৯৮৭ থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত দুবার বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। এ ছাড়া বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক দায়িত্বেও ছিলেন তিনি। ১৯৯১-৯৬ সালে পাবনা-৩ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন সাইফুল আজম। এরপর নিজস্ব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান 'নাতাশা ট্রেডিং এজেন্সি'র ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি ।