ব্রিফকেস, জুতা, বাজেটের দিনে অর্থমন্ত্রীদের ফ্যাশন বৃত্তান্ত
ঝকঝকে এক ব্রিফকেস হাতে নিয়ে হাসিমুখে সংসদে প্রবেশ করছেন একজন অর্থমন্ত্রী, বাজেট প্রকাশের দিনে এটি অত্যন্ত পরিচিত একটি দৃশ্য। কিন্তু এটি আসলে কোন হেরিটেজ বা উত্তরাধিকার নয়, বরং এমন একটি ঐতিহ্য যা তিনশো বছর পুরনো এক ব্রিটিশ পরম্পরা থেকে গ্রহণ করা হয়েছে।
এখানে বলে রাখা ভালো, 'বাজেট' শব্দটি এসেছে ফ্রেঞ্চ শব্দ 'বুগেট' থেকে; যার অর্থ 'ছোট ব্যাগ' বা 'পার্স'।
১৭২৫ থেকে ১৭৪২ সাল পর্যন্ত যখন রবার্ট ওয়ালপোল ব্রিটিশ অর্থমন্ত্রী এবং কার্যত প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, তখন বছর জুড়েই তিনি বিভিন্ন খাতে কর কমানো বা বাদ দেওয়ার জন্য অসংখ্য প্রস্তাব পেতেন। জনগণ এবং বেসরকারি খাত, দুই জায়গা থেকেই তিনি নানা খাতে কর বসানো এবং কর প্রক্রিয়া পুনর্বিন্যাসের পরামর্শও পেতেন। এই সমস্ত প্রস্তাব ও পরামর্শ তিনি নিজের পার্সে ভরে রেখে দিতেন। এক অর্থবছর শেষে, তিনি এসব প্রস্তাব ও পরামর্শের ভিত্তিতে নতুন বাজেটের খসড়া পরিকল্পনা করতেন। আর এভাবে বাজেট প্রণয়নে জনগণের অংশগ্রহণও নিশ্চিত করা সম্ভব হতো।
কিন্তু শিল্প বিপ্লবের পর ব্রিটিশ অর্থনীতি অবিশ্বাস্য গতিতে প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে থাকে, ফলে ওয়ালপোল করারোপের ব্যাপারে আরো বেশি প্রস্তাব-পরামর্শ পেতে শুরু করেন। ফলে তার ছোট পার্সে সেসব আর রাখা সম্ভব হচ্ছিলো না, বিধায় ওয়ালপোল নতুন একটি ব্রিফকেস ব্যবহার শুরু করেন এবং সেখানেই পরামর্শ ও সুপারিশের কাগজপত্র রাখতেন।
এরপর থেকে তার উত্তরসূরিরাও একই পন্থা অনুসরণ করতে আরম্ভ করেন।
ওয়ালপোলের একজন উত্তরসূরি, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইলিয়াম গ্লাডস্টোন ১৮৫০ সালে রাজস্ব বিভাগের চ্যান্সেলর হিসেবেও কাজ করেছিলেন। তিনি তার ১২ বছরের মেয়াদকালে বক্তৃতার পান্ডুলিপি বহন করতে লাল রঙ এর একটি স্যুটকেস ব্যবহার করতেন। আর এভাবেই রঙও এখানে একটি প্রথার অংশ হয়ে দাঁড়ায়।
গ্লাডস্টোনের উত্তরসূরিরা তার স্যুটকেসের আদলে একটি রেপ্লিকা লেদার ব্রিফকেস ব্যবহার করতে শুরু করেন। আর সেখান থেকেই বাংলাদেশসহ বহু দেশের অর্থমন্ত্রীদের কাছে এটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে ওঠে। ব্রিফকেসের মধ্যে বাজেটের নানা দলিল বহন করা হয়ে ওঠে অর্থনৈতিক দলিলপত্রের গোপনীয়তা ও বিশ্বস্ততার প্রতীক, যার অপর নাম অর্থনৈতিক আমলাতন্ত্র।
এই গোপনীয়তা রক্ষা করতে ব্যর্থ হলে তার ফলাফল যে ভালো হয় না- তা নিশ্চিত। উদাহরণস্বরূপ, সাবেক ব্রিটিশ অর্থমন্ত্রী হিউ ডাল্টনের কথা বলা যায়।
১৯৪৭ সালে লন্ডন স্কুল অফ ইকোনমিকস-এর অধ্যাপক ডাল্টন বাজেট পেশ করতে তার ব্রিফকেস নিয়ে হাউজ অফ কমন্সে প্রবেশ করছিলেন। যাওয়ার পথে কিছু সাংবাদিক তাকে আসন্ন কর প্রস্তাবনা সম্পর্কে প্রশ্ন করেন। জবাবে ডাল্টনও খোলামেলা উত্তরই দেন এবং এভাবেই বাজেটের কর প্রস্তাব ফাঁস হয়ে যায়। কারণ, সাংবাদিকরা এই তথ্য তাদের কার্যালয়ে পৌঁছাতে মোটেই দেরি করেননি। অন্যদিকে, ব্রিটিশ গণমাধ্যমগুলোও দ্রুত তাদের পাঠকদের আসন্ন বাজেট কর সম্পর্কে অবগত করে। অর্থাৎ, ডাল্টন সংসদে পৌঁছানোর আগেই জনগণের সেসব তথ্য জানা শেষ। ডাল্টন যখন সংসদে বাজেট পেশ করতে উঠে দাঁড়ালেন, বিরোধী দলীয় এমপি তার কথা শুনতে চাইলেন না, কারণ তারা আগেই সংবাদপত্রে সব খবর পড়ে নিয়েছেন। ফলে ডাল্টন নিজের ভুল স্বীকার করে পদত্যাগ করেন। তবে বর্তমানের ডিজিটালাইশেন ও প্রযুক্তির বিকাশের যুগে এই ব্রিফকেস পরম্পরায় কিছুটা পরিবর্তন আসাও অস্বাভাবিক নয়।
গেল ফেব্রুয়ারিতেই ভারতীয় অর্থমন্ত্রী নির্মল সীতারাম কাগজবিহীন ভাবেই ডিজিটাল উপায়ে বাজেট পেশ করতে তার ট্যাব নিয়ে সংসদে প্রবেশ করেন এবং ব্রিফকেস প্রথা ভেঙে দেন।
অন্যদিকে, কানাডীয় অর্থমন্ত্রীর কাছে একজোড়া নতুন জুতা হয়ে উঠেছে বাজেটের দিনের ফ্যাশন। প্রায় প্রতি বছরই হাউজ অফ কমন্সে বাজেটের বক্তৃতা দেয়ার আগে নতুন একজোড়া জুতা কেনেন কানাডীয় অর্থমন্ত্রী, যা তার বাজেটের নানা দিক সম্পর্কে উত্তেজনা ও জল্পনা-কল্পনা আরো বাড়িয়ে দেয়।
তবে অন্য সব সংসদীয় প্রথার মতো 'জুতার ফ্যাশন' অবশ্য ব্রিটিশদের কাছ থেকে আসেনি। ১৯৫০ সাল থেকেই কানাডীয় অর্থমন্ত্রীরা বাজেট পেশ করার আগে একজোড়া নতুন জুতা কেনেন। এবছর দেশটির অর্থমন্ত্রী নিজের 'বাজেট ডে শু' বেছে নিয়েছেন এক ইরানি বংশোদ্ভূত নারী উদ্যোক্তার কাছ থেকে। ২৯৫ ডলার দিয়ে কেনা এই জুতার নকশা করেছে একটি ইতালীয় কারখানা। অর্থমন্ত্রীর নতুন জুতোর দাম, রঙ ও নকশা নিয়ে বাজেট পেশের আগে যথেষ্ট জল্পনা-কল্পনা চলেছে গণমাধ্যমগুলোতে। সেই সাথে প্রথম নারী অর্থমন্ত্রী হিসেবে ফেডারেল বাজেট পেশ করতে গেলে ক্রিস্টিয়া ফ্রিল্যান্ডের পায়ের দিকেই সকলের নজর থাকবে সবচেয়ে বেশি।
অর্থবছর কি এখানে গুরুত্বপূর্ণ?
ব্রিটিশ শাসনের অধীনস্ত ভারতীয় উপমহাদেশের একটি অংশ হওয়ায়, বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রীরাও একই ব্রিফকেস পরম্পরা পেয়েছেন। নিজের পূর্বসূরীদের মতো এএইচএম মুস্তফা কামালও ৩ জুন সংসদে আসবেন তার কালো ব্রিফকেস নিয়ে এবং ব্রিফকেসে থাকবে তার বক্তৃতার লিপি ও অন্যান্য দলিল। তিনি সেগুলো বের করবেন এবং সংসদের সামনে পেশ করবেন অনুমোদন পাওয়ার উদ্দেশ্যে।
বর্তমানে প্রায় ১৪৩ টি দেশ তাদের অর্থবছর হিসেবে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারকে অনুসরণ করে।
ভারতও সেই ১৮ টি দেশের মধ্যে আছে, তবে সেখানে বাংলাদেশ থেকে ভিন্ন মেয়াদে ১ এপ্রিল থেকে ৩১ মার্চ পর্যন্ত অর্থবছর হিসাবে ধরা হয়।
আমাদের দেশের মতো আরও ১৩ টি দেশ ১ জুলাই থেকে শুরু করে ৩০ জুন পর্যন্ত নিজেদের অর্থবছর হিসাব করে। যুক্তরাষ্ট্রসহ ৯ টি দেশ নিজেদের অর্থবছর হিসাব করে ১ অক্টোবর থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত।
অন্তত ৬ টি দেশ রয়েছে যাদের অর্থবছর হিসাবের প্রক্রিয়া উপরোক্ত কারো সাথেই মিলে না। আফগানিস্তান ২১ ডিসেম্বর-২০ ডিসেম্বর, নেপাল ১৬ জুলাই-১৫ জুলাই, যুক্তরাজ্য ৬ এপ্রিল-৫ এপ্রিল এবং ইরান ২১ মার্চ-২০ মার্চ পর্যন্ত নিজেদের অর্থবছর হিসাব করে। তবে এসব দেশের নিজস্ব পদ্ধতি বেছে নেয়ার পেছনে জোরাল যুক্তি, ইতিহাস বা প্রথাও থাকতে পারে বলে মনে করা হয়।
এর সঙ্গে অর্থনীতির কোন সংযোগ অবশ্যই নেই।
অর্থবছর শীত বা গ্রীষ্ম বা অন্য যে সময়েই শুরু হোক না কেন, অর্থনীতি তার নিজ গতিতেই চলে। কেউ কেউ এও মনে করেন যে, তথাকথিত 'জুন সিনড্রোম' এড়াতে বাংলাদেশের উচিত জানুয়ারি-ডিসেম্বর অর্থবছর নির্ধারণ করা।
জুন সিনড্রোম বলতে বোঝায় ,এমন একটি সময়ে উন্নয়ন কার্যক্রমের তোরজোড় শুরু হয় যখন দেশে বর্ষাকাল চলে আসে এবং উন্নয়ন কাজের মান খারাপ হয়। আবার অনেকের ধারণা, জানুয়ার-ডিসেম্বরকে অর্থবছর ধরলে বৈশ্বিক লেনদেন সহজতর হবে, যেহেতু বেশিরভাগ দেশই এই পদ্ধতিতে চলে। কিন্তু, তা কি আসলেই আমাদের অর্থনীতির জন্য সহায়ক হবে? এর পেছনেও কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই, আর সে কারণেই এই বিতর্ক খুব বেশি শোনা যায় না।
- মূল লেখাটি ইংরেজিতে পড়ুন: Briefcase, shoe: Finance ministers' fashion on Budget Day
- অনুবাদ: খুশনূর বাশার জয়া