ভ্যাকসিন আসার পরও শক্তিশালী টেস্টিং ব্যবস্থা কেন দরকার?
মহামারির প্রথম দিকে ভ্যাকসিন কবে আসছে চলছিল সেই অপেক্ষা। কোভিড-১৯ প্রতিষেধকের অনুপস্থিতির সেই সময়ে সংক্রমণ শনাক্ত ও তার ভিত্তিতে আক্রান্ত ব্যক্তিকে বিচ্ছিন্ন রাখা বা প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়ায় 'টেস্টিং' বা করোনাভাইরাস পরীক্ষাই ছিল একমাত্র অস্ত্র। তারপর বিজ্ঞানের চেষ্টায় টিকার মুখ দেখেছে পৃথিবীবাসী। মহামারি প্রতিরোধে টিকাই হয়ে উঠেছে মূল হাতিয়ার।
এই বাস্তবতায় বিভিন্ন ধনী ও উন্নত রাষ্ট্র যারা টিকাদানে এগিয়ে রয়েছে, সেখানে টিকার চাহিদা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে হ্রাস পাচ্ছে টেস্টিং- এর চাহিদা। যুক্তরাষ্ট্রের বহুজাতিক মেডিকেল ও কোভিড টেস্টিং সরঞ্জাম প্রস্তুতকারক অ্যাবট ল্যাবরেটরিজ যেকারণে চলতি বছর বা ২০২১ সালে তাদের মুনাফা কমার আভাস দিয়েছে। অথচ, মহামারির হুমকি দূর হয়নি মোটেও। আগামীতেও, নানা আকারের স্থানীয় প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণে টেস্টিং প্রক্রিয়া গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। ভাইরাসের নিত্যনতুন ধরন শনাক্তসহ টিকাদানে এগিয়ে থাকা রাষ্ট্রের অর্থনীতি পুনঃউন্মুক্তকরণেরও চাবিকাঠি হলো; টেস্টিং।
প্রেক্ষাপটটি অনুমান করেই করোনা পরীক্ষার এই প্রাথমিক অস্ত্রসজ্জা উন্নততর হচ্ছে, যোগ হচ্ছে নতুনতর প্রযুক্তি। এমন কিছু প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ও সম্ভাবনা তুলে ধরতেই এ আয়োজন;
পরীক্ষা হবে এক মিনিট বা তারও কম সময়ে:
করোনা টেস্টের বাজারে সম্প্রতি আলোড়ন সৃষ্টি করা একটি পরীক্ষা পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছে সিঙ্গাপুর ভিত্তিক স্টার্টআপ- ব্রেথটনিক্স। মে মাসেই তাদের কিট সিঙ্গাপুরে অনুমোদন পায়। নিঃশ্বাসের নমুনা একটি টিউবে ভরে নিয়ে এক মিনিটের মধ্যেই এর মাধ্যমে কোভিড নেগেটিভ/ পজিটিভ ফলাফল জানা যায়।
এই পরীক্ষায় নমুনা গ্রহণের স্থানে কোনো পরীক্ষাগার বা বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত ল্যাব কর্মীদের দরকার হয় না। করোনা পরীক্ষার সর্বোচ্চ মানদণ্ড পিসিআর টেস্টের মতো নিঃশ্বাসের বিশ্লেষণ নির্ভুল না হলেও, এটি প্রয়োগ বিবেচনায় খুবই কার্যকর। যেমন; সিঙ্গাপুরে এর মাধ্যমে ভ্রমণকারীদের দ্বিতীয়বার র্যাপিড টেস্ট করা হচ্ছে। বাড়তি পরীক্ষা পদ্ধতির এমন প্রয়োগ বিশ্বের অন্যান্য স্থানেও সফল হতে পারে।
তাছাড়া, ভুলে গেলে চলবে না থেকে থেকেই সংক্রমণে ঊর্ধ্বগতির এই দৌড়ের কালে কর্তৃপক্ষের তরফে নির্ভুল পরীক্ষায় বেশি মনোযোগ দেওয়া প্রায়শ'ই সমস্যাসঙ্কুল হয়ে উঠতে দেখা গেছে। পিসিআর টেস্টের জন্য দরকার হয় দামি যন্ত্র ও পরীক্ষাগারের, প্রশিক্ষিত কর্মীদের সংখ্যাও সব সময়েই সীমিত। তাই জড়ো করা নমুনা পরীক্ষা করে ফলাফল দিতে অনেকটা সময় লাগছে উন্নয়নশীল দেশে। কিন্তু, অপেক্ষার পর ফলাফলে কাউকে নেগেটিভ ঘোষণা করা হলেও, দেখা যায় এরমধ্যেই ওই ব্যক্তি মারণ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে পড়েছেন। তখন নির্ভুল ঘোষণা তার জন্য, তার আশেপাশের মানুষের জন্য তথা; কোন একটি অঞ্চলে ভাইরাস বিস্তারের জন্য অনুকূল বাতাবরণ তৈরি করে থাকে।
সে তুলনায় ব্রেথটনিক্স কিট কোনো জনসমাগম পূর্ণ স্থানে বা ব্যক্তিগত পর্যায়েও আক্রান্তকে শনাক্তে আরও অধিক ফলপ্রসূ সমাধান দেয়। ফলে এড়ানো যায় সুস্থদের মধ্যে ভাইরাসের বিস্তার।
তাছাড়া, টিকাকরণেও দেখা যাচ্ছে, ধনী ও দরিদ্র দেশের মধ্যে রাত-দিনের পার্থক্য। মহামারির নিত্যনতুন ঢেউ তাই আর সম্ভাব্যতা নয় বরং নিশ্চিত বাস্তবতা। তাই পরীক্ষার সকল উপায়কেই কাজে লাগিয়ে যেতে হবে।
পরিবর্তনশীল ভাইরাসকে অনুসরণ:
ভাইরাসের নতুন নতুন ও বিপজ্জনক ধরন দেখা দেওয়ায় যথেষ্ট নয় শুধু সংক্রমণ শনাক্তকরণ। ভাইরাসের স্ট্রেইন বা বংশজগুলোকেও শনাক্ত করাও বৈশ্বিক গুরুত্বের দাবিদার। অথচ খুব কম দেশেই স্ট্রেইন শনাক্তকরণে পর্যাপ্ত নমুনা পরীক্ষা হচ্ছে, হলেও অধিকাংশ হচ্ছে; টিকাকরণে এগিয়ে থাকা ধনী দেশে, অথচ ভাইরাস অভিযোজনের ঝুঁকি বেশি উন্নয়নশীল ও পিছিয়ে থাকা রাষ্ট্রে।
ধরন শনাক্তের প্রধান মানদণ্ড হলো জেনেটিক সিকোইয়েন্সিং, কিন্তু এই প্রক্রিয়াও ব্যয়বহুল ও সময়সাধ্য। বেশিরভাগ জাতির কাছে তেমন বৈজ্ঞানিক সক্ষমতাও নেই। কিন্তু, সুখবর হলো; সিজেন ইঙ্ক ও রায়ো-রাড ল্যাবরেটরিজ ইঙ্কের মতো কয়েকটি কোম্পানি নতুন ধরন দ্রুত শনাক্তের পরীক্ষা পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছে।
আরেকটি কোম্পানি অ্যাপ্লায়েড ডিএনএ ইঙ্ক সাতটি স্ট্রেইন শনাক্ত করতে সক্ষম একটি টেস্টিং প্যানেলের জরুরি অনুমোদন চাওয়ার পরিকল্পনা করছে যুক্তরাষ্ট্রে। ভাইরাসের ধরন শনাক্তের নতুন ও সহজতর পদ্ধতিগুলো জনপ্রতিনিধিদের কোনো ভ্যারিয়েন্টের হুমকি সম্পর্কে আগাম সতর্ক করতে পারবে এবং প্রচলিত পদ্ধতির ব্যয়বহুল সিকোয়েন্সিং শুধু দরকারি নমুনা পরীক্ষার জন্যই সংরক্ষিত রাখা যাবে।
অ্যান্টিবডি টেস্টের নতুনরূপে ফিরে আসা:
অ্যান্টিবডি টেস্ট হলো; কোভিড সংক্রমণের পর শরীরের প্রতিরোধ ব্যবস্থা যাচাইয়ের প্রক্রিয়া। গেল বছর নিয়ন্ত্রক সংস্থার শিথিলতার সুযোগে অনির্ভরযোগ্য পদ্ধতির অনেকগুলো অ্যান্টিবডি টেস্টিং কিট বিশ্বজুড়ে অনুমোদন পায়। এরপর নিয়ন্ত্রক সংস্থা অনুমোদন বাতিলের মতো কঠোর পদক্ষেপে যায়। তাছাড়া, এই টেস্টের ফলাফলের অনিশ্চয়তার কারণে এটি কখনোই অর্থনীতি পুনঃউন্মুক্তকরণের সহায়ক শক্তি হয়ে উঠতে পারেনি। এর মধ্যে উন্নত দেশে টিকাকরণ বাড়তে থাকায়, অ্যান্টিবডি টেস্ট কিটের সীমিত চাহিদা একেবারেই মিলিয়ে যেতে পারে। কিন্তু, দ্রুতগতির ভ্যাকসিন বিতরণেই নতুন ভূমিকা রাখতে পারে অ্যান্টিবডি টেস্ট।
সম্প্রতি চিকিৎসা বিজ্ঞানের শীর্ষ সাময়িকী ল্যানসেট মেডিকেল জার্নালে জনস্বাস্থ্য ও রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা বিশেষজ্ঞদের এক খোলা চিঠি প্রকাশিত হয়। সেখানে তারা কোভিড থেকে বেঁচে ফেরাদের ভ্যাকসিনের দ্বিতীয় ডোজ না দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। এক ডোজ ভ্যাকসিন নিয়ে কেউ আক্রান্ত হলেই তার দেহে পর্যাপ্ত পরিমাণে অ্যান্টিবডি তৈরি হচ্ছে, তাই যারা বেঁচে যাচ্ছেন তাদের দ্বিতীয় ডোজের প্রয়োজন নেই বলেই মনে করছেন তারা। তবে এখন তাদের দরকার এই তত্ত্বের স্বপক্ষে শক্তিশালী ও পর্যাপ্ত সংখ্যক প্রমাণ। অ্যান্টিবডি টেস্ট নতুন করে এই শূন্যস্থান পূরণ করতে পারে। এরপর, জনস্বাস্থ্য বিজ্ঞানীদের ধারণা সঠিক প্রমাণিত হলে ডোজের চাহিদা অনেকাংশে কমবে। তখন যারা নতুন করে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে আছেন এমন জনসংখ্যার মধ্যে টিকাকরণ হার বৃদ্ধি করা যাবে।
অধিকাংশ দেশেই ডোজ সঙ্কটের কারণে দ্বিতীয় ডোজ দিতে দেরি হচ্ছে, এনিয়ে সরকারি নীতিগত দ্বন্দ্ব এড়াতে বৈজ্ঞানিক তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে প্রথম ডোজ দেওয়ার ওপর বেশি গুরুত্বারোপ করা সম্ভব। তবে সেজন্য অবশ্যই ব্যাপক হারে প্রথম ডোজ পাওয়া ও কোভিড থেকে সুস্থতা লাভকারীদের অ্যান্টিবডি টেস্ট করা দরকার। নির্ভরযোগ্য টেস্ট কিটের ব্যবহারই বাঞ্ছনীয়। এব্যাপারে এগিয়ে এসেছে 'নাউ ডায়াগনোস্টিক ইঙ্ক' নামের একটি মার্কিন সংস্থা। গত মে মাসেই তারা মার্কিন নিয়ামক সংস্থার অনুমোদন পায়। নাউ ডায়াগনোস্টিকের তৈরি ফিঙ্গার স্টিক মাত্র ১৫মিনিটের মধ্যে ফলাফল দিতে পারে। স্টার্টআপ উদ্যোগ উইভার হেলথ আবার বাড়িতে বসে মাত্র ১০ মিনিটে অ্যান্টিবডি পরীক্ষার আরেকটি কিটের অনুমোদন পাওয়ার অপেক্ষা করছে।
দ্রুত নিরীক্ষার এসব অ্যান্টিবডি টেস্ট সহজলভ্য হওয়ার আগে ডায়াগনস্টিক খাতের প্রতিষ্ঠিত ও বড় কোম্পানি যেমন; অ্যাবট, রোচে হোল্ডিং এজি এবং সিমেন্স এজি বাজারে বিদ্যমান অ্যান্টিবডি টেস্টের নির্ভরযোগ্যতা পুনঃপরীক্ষণের বেশকিছু পদ্ধতি আবিষ্কার করেছে, সম্ভাবনাময় এদিকটিতে নতুন ব্যবসার ইঙ্গিত পেয়েই নড়েচড়ে বসেছে তারা।
ইমিউনিটি নিরূপণ:
বিশ্ববাসীর গ্রহণ করা টিকাগুলো কোভিডের বিরুদ্ধে কতোটা সময় স্থায়ী রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা বা ইমিউনিটি তৈরি করেছে এবং সেগুলো কতোটা কার্যকর হচ্ছে তা নিরূপণ করাই টেস্টিং প্রক্রিয়ার পরবর্তী বড় লক্ষ্য। এব্যাপারে মানবদেহের অ্যান্টিবডি মাত্রা নির্ণয়ে একটি 'সেমি-কোয়ান্টেটিভ' টেস্ট অনুমোদন দিয়েছে মার্কিন খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসন (এফডিএ)। এই পরীক্ষায় শুধু অ্যান্টিবডি তৈরি হচ্ছে কিনা সেরকম হ্যাঁ/ না-বোধক ফলাফল নয়, বরং মিলবে আরও বিস্তৃত আকারে অ্যান্টিবডির সংখ্যাগত পরিমাণের তথ্য। তবে শুধু মাত্রা দিয়েই অ্যান্টিবডির কার্যকারিতা প্রমাণ নির্ভরযোগ্য নয়, তাই মার্কিন নিয়ন্ত্রক সংস্থা আপাতত অ্যান্টিবডি টেস্টের মাধ্যমে প্রতিরোধ ক্ষমতা নিরূপণ না করার পরামর্শ দিচ্ছে।
এই বিষয়টি একটি প্রতিবন্ধকতা হওয়ায়, তা সমাধানে দেখা দিচ্ছে নতুন গবেষণা শুরুর প্রয়োজনীয়তা। তবে নির্দিষ্ট কিছু কৌশল ও টেস্টের মাধ্যমে বিভিন্ন রকমের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা নির্ণয় করে এই সমস্যার সমাধান হয়তো করা যাবে। এমন একটি পরীক্ষা পদ্ধতি আবিষ্কার করেছে অ্যাডাপ্টিভ বায়োটেকনোলজিস কর্প এবং অক্সফোর্ড ইমিউনোটেক গ্লোবাল পিএলসি। দৈহিক প্রতিরোধ ব্যবস্থার স্থায়ী সুরক্ষা কবচ টি-সেলের পরিমাণ নির্ণয় করে পরীক্ষাটি। এর ফলে ভ্যাকসিন ট্রায়ালে নতুন গতি যেমন আসবে, ঠিক তেমনি দ্রুত জানা যাবে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে প্রার্থী টিকার কার্যকারিতা। এর ফলে সত্যিকার অর্থেই যাদের বুস্টার ডোজ দেওয়া দরকার তাদের চিহ্নিত করা যাবে, দুর্বল স্বাস্থ্যের অধিকারীরা তার ফলে বাড়তি নিরাপত্তা পাবেন।
কোভিড কবে শেষ হবে আর কবে টেস্টিংয়ের দরকার ফুরোবে, সবাই সেদিনের আশা করছেন। আর বুদ্ধিদীপ্ত ও বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া চালিত পরীক্ষা পদ্ধতি ব্যবহার করে আমরা হয়তো সেদিনটির দিকে আরও দ্রুত এগিয়েও যেতে পারব।
- লেখক: ব্লুমবার্গের জৈবপ্রযুক্তি, ওষুধ শিল্প ও জনস্বাস্থ্য খাত বিষয়ক কলামিস্ট ম্যাক্স নিসেন। ইতঃপূর্বে, তিনি কোয়ার্টজ ও বিজনেস ইনসাইডারে বাণিজ্যিক কৌশল ও ব্যবস্থাপনা নিয়ে লিখতেন।
- সূত্র: ব্লুমবার্গ থেকে অনূদিত