যাদের সবচেয়ে দরকার তারাই টেলিমেডিসিনের সুযোগ পায় না
মহামারির শুরুর দিকের কথা। রোগীদের সঙ্গে সামনাসামনি দেখা করা, তাদের নিয়মিত পরীক্ষার সুযোগ সীমিত হয়ে পড়া শুরু করেছিল তখন যুক্তরাষ্ট্রে। এ অবস্থায় উত্তর ক্যারোলিনা রাজ্যের রেইফোর্ড এলাকার কারেন স্মিথ নামের এক চিকিৎসক অনুধাবন করলেন, রোগীর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগের একটা মাধ্যম দরকার। অথচ যুক্তরাষ্ট্রের এ রাজ্যটিতে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবার পরিধি অন্যদের তুলনায় সবচেয়ে সীমিত। আর স্মিথের নিজ শহরে এ হার ছিল মাত্র ৪০ শতাংশ।
অথচ কিছুদিন পরই পরিস্থিতি এমন দাঁড়ালো ভিডিও কলের সাহায্যে টেলিমেডিসিন সেবা প্রদানেই তার পেশাগত দায়িত্বের অর্ধেক সময় পার হতে থাকলো। স্থানীয় কাউন্টির শিক্ষা কর্তৃপক্ষের ফ্রি ওয়াইফাই সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে রোগীদের যোগাযোগ করার পরামর্শ দিয়েছিলেন স্মিথ।
ওয়াইফাই সিগন্যাল সম্প্রচারের স্কুলবাসগুলো শহরের নানা মহল্লায় পাঠাতে শুরু করেছিল স্থানীয় শিক্ষা কর্তৃপক্ষ। আর সরাসরি পাঠদান সংক্রমণ রোধের চেষ্টায় বন্ধ থাকার সময়ে, এতে শিক্ষার্থীরা বরং নিজ এলাকায় ফ্রি নেটওয়ার্ক ব্যবহারের সুযোগটা ভার্চুয়াল পাঠদানে ব্যাপকভাবে কাজে লাগাতে পেরেছে।
''প্রথমে যখন জানতে পারলাম, শিক্ষার্থীদের সুবিধার জন্য শহরের নানা স্থানে শিক্ষা কর্তৃপক্ষ ওয়াইফাই হটস্পট স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে, তখনই উপায়টা মাথায় এল। ভাবলাম ৯ বছরের শিশু যদি এ সুবিধা নিয়ে ক্লাস করার সুযোগ পায়, তাহলে কেন তার দাদী-নানীমা নিজ স্বাস্থ্য সেবার জন্য এটি ব্যবহার করতে পারবেন না!''
এরপর বিষয়টি নিয়ে যোগাযোগ করি। গুরুত্ব অনুধাবন করে স্কুলবাসে প্রবেশ করে ব্যবহার করতে পারবেন না, এমন ঝুঁকি সম্পন্ন বয়স্কদের পার্কিং লটে অবস্থান করে সুবিধাটি নেওয়ার অনুমতি দিলেন কর্তৃপক্ষ। এর ফলে নিজ গাড়িতে বসেই ভিডিওচ্যাটে টেলিহেলথের সুবিধা পেলেন রোগীরা। স্বাস্থ্য কর্মীরা তাদের বিশেষ ধরনের জীবাণুনাশকও সরবরাহ করেছিলেন। 'এতে পার্কিং লটের ভবনে এসে রোগীদের মধ্যে সংক্রমিত হওয়ার ভয়টাও অনেকাংশে দূর হয়েছিল' জানান কারেন স্মিথ।
বৈষম্যের প্রাচীর নতুন কিছু নয়:
কিন্তু, ডিজিটাল বৈষম্যের প্রাচীর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সহজে দূর হবার নয়। ইন্টারনেট ব্যবহার সুবিধা পাওয়া ও না পাওয়ার মধ্যেখানের এ দেওয়ালকেই বলা হয় – ডিজিটাল ডিভাইড। তাছাড়া, প্রযুক্তি পণ্য ক্রয়ের আর্থিক সঙ্গতি এবং ব্যবহারিক জ্ঞানের বিষয়টিও এর আওতায় পরে।
''ডিজিটাল ডিভাইড- নতুন কোনো বিষয় নয়। সব সময়েই এটা যুক্তরাষ্ট্র বা বাকি বিশ্বে ছিল এবং রয়েছে। কিন্তু, কোভিড-১৯ মহামারি এদিকে আমাদের মনোযোগ নতুন করে আকর্ষণ করছে। শুধু বিদ্যালয়ের শিশু বা তরুণ শিক্ষার্থী নয়, এর পরিধিতে আরো অনেক জনসমষ্টি পড়েন। যা আমাদের চিন্তার চাইতেও বড় এক ব্যাপার'' জানান যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় ডিজিটাল বৈষম্য দূরীকরণ জোটের পরিচালক এঞ্জেলা সিয়েফার।
সিয়েফার জানান, যুক্তরাষ্ট্রের এক কোটি ৮০ লাখ বাসস্থানে কোনো প্রকার ইন্টারনেট সংযোগ নেই। এরমধ্যে ব্রডব্যান্ড থেকে শুরু করে নূন্যতম মুঠোফোনে সংযোগের বিষয়টিও অন্তর্ভুক্ত। খুব সংরক্ষণবাদি জরিপেই দেখা গেছে, এর মধ্যে ৪০ লাখ বাড়ি শহরে এবং বাকি এক কোটি ৪০ লাখ গ্রামীণ এলাকায়।
টেলিমেডিসিনের জগতে পড়েছে- এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব। করোনাভাইরাসের সুবাদে টেলিমেডিসিনের সবচেয়ে রমরমা বছর ২০২০ সাল। অথচ এ সময়েই ডিজিটাল বৈষম্যের ধারা আগের যেকোনো সময়ের চাইতে অনেক বেশি স্পষ্ট করে চোখে পড়ছে।
বাংলাদেশেও বিপুল পরিমাণ প্রান্তিক এলাকার মানুষ টেলিমেডিসিন সেবার পরিধি বঞ্চিত হয়েছেন, বলে ইতোপূর্বে প্রকাশিত নানা সংস্থার প্রতিবেদন সূত্রে জানা গেছে। তাছাড়া, নিম্ন আয়ের অনেক শিশু-কিশোর বঞ্চিত হয়েছে ইন্টারনেট সংযোগ ব্যবহারের উপযোগী উপকরণ না থাকার সুবাদে ভার্চুয়াল পাঠদান থেকে। দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী অধিকাংশ ঘরে টেলিভিশন না থাকার কারণেও- শিক্ষামূলক অনুষ্ঠানের কোনো সুবিধা পায়নি তারা।
গত আগস্টে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জাতিসংঘ জানায়, বিশ্বজুড়ে আনুমানিক ৪৬ কোটি ৩০ লাখ শিশু প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ ও ইলেকট্রনিক সুবিধা না থাকায় অনলাইন ক্লাসে অংশ নিতে পারছে না।
প্রতিবেদনে দেখা গিয়েছে যে, অনলাইন ক্লাস বঞ্চিতদের ৬ কোটি ৭০ লাখ পূর্ব এবং দক্ষিণ আফ্রিকার, ৫ কোটি ৪০ লাখ পশ্চিম ও মধ্য আফ্রিকার, ৮ কোটি প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল এবং পূর্ব এশিয়ার, ৩ কোটি ৭০ লাখ উত্তর মধ্যপ্রাচ্য এবং উত্তর আফ্রিকার, ১৪ কোটি ৭০ লাখ দক্ষিণ এশিয়ার এবং ১ কোটি ৩০ লাখ লাতিন ও ক্যারিবীয় অঞ্চলের।
শুধু শিক্ষায় নয়, বঞ্চনার এ ধারায় অনেক বেশি ঝুঁকিতে রয়েছেন দরিদ্র ও বয়স্ক জনগোষ্ঠী। তাইতো, খোদ যুক্তরাষ্ট্রের মতো উন্নত দেশেও এখন এ সমস্যাটি নিয়ে আলোচনা চলছে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও চিকিৎসক মহলে।
বাস্তবতা কী?:
চলতি বছরের শুরুর দিকেই টেলিমেডিসিন সেবার পরিধি উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ায় ইউএস সেন্টারস ফর মেডিককেয়ার অ্যান্ড মেডিএইড সার্ভিসেস। ইতোপূর্বে, চিকিৎসকের সঙ্গে সরাসরি দেখা করে সেবা নেওয়ার ফি পরিশোধ করা হতো কেন্দ্রীয় সরকারের স্বাস্থ্যবিমা থেকে। তবে সবক্ষেত্রে নয়, কিছু কিছু জটিল রোগের ক্ষেত্রেই এ সুবিধা মিলতো। বিশেষ করে, রোগী যদি গ্রামীণ অঞ্চলের বাসিন্দা হতেন তবে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়ার খরচ অনেকটাই বহন করতো এ বিমাটি।
টেলিমেডিসিন সেবার আওতা বাড়ার মাধ্যমে- তাহলে আরো বেশি সংখ্যক মানুষের সুবিধা পাওয়ার কথাই ছিল। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে তার ব্যতিক্রম। খোদ সরকারি তথ্যই তার প্রমাণ।
মহামারি শুরুর প্রথমদিকে কেন্দ্রীয় সরকার- মেডিকেয়ার পোগ্রামের আওতায় ৪৪ শতাংশ মার্কিনীর ভার্চুয়াল প্রাথমিক চিকিৎসা খরচ বহন করার দাবি করেছিল। অথচ ফেব্রুয়ারিতেই এ হার নেমে আসে মাত্র ০.১ শতাংশে। এই সময়ের বেসরকারি স্বাস্থ্যবিমা কোম্পানিগুলো বিপুল পরিমাণ চিকিৎসা বিল দাবি করে বসে। চলতি বছরের জুন নাগাদ কেন্দ্রীয় সরকারকে কাছে এমন ১৬ লক্ষাধিক চিকিৎসা ব্যয়ের তালিকা ধরিয়ে দিয়েছে তারা। অর্থ সেই তুলনায় গত বছরের একইমাসে দাবীকৃত বিলের সংখ্যা ছিল মাত্র পাঁচ লাখ।
সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে; যুক্তরাষ্ট্রে বয়স্ক জনগোষ্ঠী এবং পেনশন ভোগীরা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজনে আছেন টেলিমেডিসিন সেবার। জুনে ভার্চুয়ালি চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়াদের এক-চতুর্থাংশই ছিলেন ৬৫ বছরের বেশি বয়সের। অথচ এখন চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়ার সুযোগ তাদের জন্যেই সবচেয়ে বেশি সীমিত হয়েছে, সার্বিকভাবে টেলিমেডিসিন সেবার চাহিদা রকেট গতিতে আকাশ ছোঁয়ায়।
শুধু জানুয়ারি থেকে এপ্রিল নাগাদ সময়ে বয়স্কদের জন্য অতি-প্রয়োজনীয় প্রাথমিক চিকিৎসার টেলিহেলথ অ্যাপয়ন্টমেন্ট সংখ্যা হ্রাস পায় ৫৭ শতাংশ। এসময় মেডিএইড এবং মেডিককেয়ার দুই ধরনের স্বাস্থ্য পোগ্রামের আওতায় থাকা বয়স্ক রোগীদের কিছু অংশের ব্যয় নির্বাহের অনুরোধও নাকচ করা হয়।
বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন:
তাছাড়া, সমগ্র যুক্তরাষ্ট্রে মেডিককেয়ারের আওতায় থাকা ৪১ শতাংশ মানুষের ইন্টারনেট সংযোগ পরিচালনার মতো উপযুক্ত কম্পিউটার বা স্মার্টফোন নেই বাড়িতে! বিস্ময়ে চোখ কপালে উঠলেও- এমনটাই সাম্প্রতিক এক গবেষণাপত্রে তুলে ধরেছেন এরিক এল. রবার্টস। এ বিশেষজ্ঞ পিটসবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে জনস্বাস্থ্য নীতির পাঠদান করেন। তার সহ-লেখক ছিলেন হাভার্ড মেডিকেল স্কুলের অধ্যাপক অতিভ মেহরোত্রা।
তাদের গবেষণাপত্রটি পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠীর বঞ্চণার দিকটির দিকেও আলোকপাত করে। নিবন্ধে তারা জানিয়েছেন, শ্বেতাঙ্গদের তুলনায় কৃষ্ণাঙ্গ এবং লাতিন আমেরিকান জ্যেষ্ঠ নাগরিকদের ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ বহুগুণে সীমিত। তাছাড়া, যাদের আয় সীমিত এবং কোনো প্রকার পঙ্গুত্বে ভুগছেন বা ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারেন না, তারাও মেডিককেয়ার সুযোগটি পাওয়ার চেষ্টা করেন।
রবার্টস বলেন, 'বয়স্কদের মধ্যে ডিজিটাল বিভেদ নতুন কিছু না হলেও, আলোচিত জনগোষ্ঠীর মধ্যে এ বিভেদের প্রাচীর বিশাল। প্রযুক্তি সম্পর্কে তাদের অজ্ঞতা বা পূর্ব ব্যবহারের সুযোগ না থাকাটাও এক বড় কারণ।'
এ গবেষকের আশঙ্কা- এর ফলে টেলিমেডিসিনের পরিধি বাড়লেও যাদের সবচেয়ে বেশি দরকার সেই দরিদ্র, বয়স্ক এবং প্রযুক্তিতে অনগ্রসর জনগোষ্ঠী শুধু যুক্তরাষ্ট্রে নয়, বরং সাড়া বিশ্বে বঞ্চিত হচ্ছেন চিকিৎসা সেবার সুযোগ থেকে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে, আগামীদিনে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করাটাও দুরূহ হয়ে পড়বে। বাড়বে মৃত্যুহার ও সামাজিক বিপর্যয়ের হুমকি।
- সূত্র: দ্য অয়ারড