যুক্তরাষ্ট্রকে পেছনে ফেলে যেভাবে সৌরশক্তিতে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন চীন
মেয়র টম হিউস যখন আরো অনেক রাজনীতিবিদদের সঙ্গে নিয়ে সোৎসাহে অরিগনের হিলসবোরোতে ৪৪০ মিলিয়ন ডলারের সৌর প্যানেল উৎপাদনের কারখানা স্থাপন করলেন, সেটি ছিল মার্কিনীদের এক গর্বের মুহূর্ত।
'সোলারওয়ার্ল্ড এজি' কোম্পানির আগমন ছিল মেয়রের নিজ জন্মস্থানের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড়। হিউস বলেছিলেন, 'শুধু সোলারওয়ার্ল্ড এজি'র নিজের জন্য নয়, বরং এটি অন্য অনেক কোম্পানিকেও আকর্ষণ করবে এখানকার সিলিকন ভিত্তিক সৌরশক্তি উৎপাদন প্রকল্পে।"
হিউস যখন এসব কথা বলেছিলেন, সেই সময়টা ছিল ২০০৮ সাল এবং সৌরশক্তি তখন বিশ্বে দ্রুততম এক শক্তির উৎস হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছিল। হোয়াইট হাউজ থেকে শুরু করে মার্কিন নেতৃবৃন্দ, সবাই এই ঐকমত্যে পৌঁছেছিলেন যে, সৌরশক্তি ব্যবহার করার ফলে শুধু যে দেশের কয়লা খনি ও তেল উত্তোলন ক্ষেত্রগুলোর বিকল্প পাওয়া যাবে তাই নয়; সেই সাথে এটি নিরাপদ ও আরো টেকসই কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করবে।
কিন্তু, প্রশান্ত মহাসাগরের এপাড়েই যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিদ্বন্দ্বী চীন তৈরি হচ্ছিল। নিজেদের সমাজতান্ত্রিক কাঠামোকে আরো জোরালভাবে প্রমাণ করতে তারা সৌরশক্তি উৎপাদনের পেছনে সরকারিভাবে প্রচুর বিনিয়োগ করতে শুরু করে, বিনিয়োগের বিপুলতা যুক্তরাষ্ট্রকে পেছনে ফেলে। চীন সরকার নিজ দেশে নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহার বাধ্যতামূলক করে দেয়।
সোলার প্যানেল ও সংশ্লিষ্ট যন্ত্রপাতি উৎপাদনে চীন একটি পূর্ণাঙ্গ সরবরাহ চক্র তৈরি করে, অর্থাৎ কাঁচামাল সংগ্রহ থেকে শুরু করে ক্রেতার হাতে চূড়ান্ত পণ্য পৌঁছানো পর্যন্ত সমগ্র প্রক্রিয়াই সরকার নিয়ন্ত্রণ করে।
এই মুহূর্তে চীন বিশ্বের সর্বাধিক পলিসিলিকন প্রস্তুতকারক। পলিসিলিকন সৌর প্যানেল তৈরির একটি মূল কাঁচামাল। এছাড়াও, চীন পরিবেশবাদীদের দাবি উপেক্ষা করে কয়লা প্ল্যান্টও চালু রেখেছে, যাতে এখান থেকে সস্তায় বিদ্যুৎ উৎপাদন করে সৌর খাতের প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি তৈরিতে ব্যবহার করা যায়। অলাভজনক বেশিরভাগ শিল্প প্রধান দেশের আগ্রহ ছিল না, কিন্তু চীন তা করার পাশপাশি শ্রম ব্যয়ও নিয়ন্ত্রণে রেখেছে।
ফলস্বরূপ; আজ চীনা কোম্পানিগুলোই বিশ্বের তিন-চতুর্থাংশ সোলার প্যনেল সরবরাহক হয়ে উঠেছে।
ব্লুমবার্গ নবায়নযোগ্য শক্তি বিষয়ক শাখার 'সৌর বিশ্লেষণ' বিভাগের প্রধান- জেনি চেজের সূত্রে জানা যায়, ২০ বছর আগে যেখানে মার্কিন কোম্পানিগুলো ২২ শতাংশ সোলার প্যানেল তৈরি করতো; এখন তারা নিজ দেশের মাটিতে এর মাত্র ১ শতাংশ তৈরি করে। এক সময় যুক্তরাষ্ট্রে ৭৫টি বড় সৌর যন্ত্রাংশ তৈরির ফ্যাক্টরি ছিল, যা সময়ের সাথে সাথে আরো বৃদ্ধি পাবে বলে মনে করা হয়েছিল, কিন্তু উল্টো সেগুলো আজ মুখ থুবড়ে পড়েছে। চালু হওয়ার মাত্র ১৩ বছর পরেই হিলসবোরো প্ল্যান্ট বন্ধ হয়ে গিয়ে যেন তাদেরই দলে যোগ দিয়েছে।
শত শত কোটি ডলার সরকারি প্রণোদনা এবং জর্জ ডব্লিউ বুশ থেকে শুরু করে দুই দশক ধরে বিভিন্ন মার্কিন প্রেসিডেন্টদের যুক্তরাষ্ট্রকে ক্লিন-এনার্জি' সুপারপাওয়ার তৈরির অঙ্গীকার সত্ত্বেও, সৌর শক্তি উৎপাদন খাতে ব্যর্থ হয়েছে আমেরিকা। এমনকি সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ও ডোনাল্ড ট্রাম্পের চীনা সোলার প্যানেলের ওপর শুল্কারোপের ফলে লাভের লাভ কিছুই হয়নি, বরং চীন থেকে এই খাতের কাজ অন্যান্য এশীয় দেশে গিয়েছে।
অরিগন রাজ্যের সিনেটর রন ওয়াইডেনের মতো আরো অনেক সমালোচকই মনে করেন, সরবরাহ চক্রে জোর করে শ্রমিকদের কাজে বাধ্য করার মতো অনৈতিক বানিজ্যিক পন্থা চর্চার ফলেই চীন তাদের সৌর শক্তি কৌশলে এতটা সফল হয়েছে। যদিও চীন এসব অভিযোগ অস্বীকার করে, বরং চীনের এই নেতৃত্ব বিস্তার বিশ্ব বাজারকে একচেটিয়া করে তোলার ব্যাপারে বেইজিংয়ের দৃঢ় সংকল্পের প্রমাণ।
তবে সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিস এর উপদেষ্টা সারাহ লাডিস্লাও মনে করেন, "তারা আমাদের চাইতে অনেক বেশি কঠোর চেষ্টা করেছে। চাহিদা, যোগান সবকিছু নিয়ে তাদের একটি পরিকল্পনা ছিল এবং তারা তা বাস্তবায়ন করেও দেখিয়েছে।"
যুক্তরাষ্ট্রের সামঞ্জস্যহীনতা:
চীন যখন তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ব্যস্ত, যুক্তরাষ্ট্র তখন তাদের স্বল্পদৈর্ঘ্য প্রণোদনা নিয়ে ধুঁকছিল। চীনের সঙ্গে বাণিজ্যে মার্কিন প্রশাসনের শুল্কারোপ সেক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তাই বেইজিংকে সাজা দেওয়ায় কোনো লাভ হয়নি; বরং প্রতিশোধ হিসেবে বেইজিং পাল্টা ব্যবস্থা নেয়। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যাশিত সোলার প্যানেল উৎপাদনের রেনেসাঁ আতুরঘরেই মারা যায়। চীনের 'শিল্প কৌশল' এর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গতিহীন, টুকরো টুকরো কৌশল কোনোভাবেই পেরে ওঠেনি।
লাডিস্লাও বলেন, "লক্ষ্য অর্জনে মার্কিন নীতি-নির্ধারকরা দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন, তাদের পদক্ষেপেও তাই সংশয়ের ছায়া ছিল, আর এভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে স্থায়ী ফল অর্জন করাও সম্ভব নয়।"
নতুন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন জলবায়ু পরিবর্তন রোধে নবায়নযোগ্য শক্তির বিপ্লব ঘটাবেন বলে প্রতিজ্ঞা করলেও, তার পূর্বসূরিদের ফেলে যাওয়া ব্যর্থ কৌশল মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, জলবায়ু নীতি সম্পর্কে তার এই প্রতিজ্ঞা রাখা খুব সহজ হবে না।
দুই দেশই বিশ্বাস করে যে, আগামীতে বৈদ্যুতিক যানবাহনই হবে প্রধান যোগাযোগ মাধ্যম, আর বাইডেন দৃঢ় অঙ্গীকার করেছেন যে এই দৌড়ে যুক্তরাষ্ট্রই এগিয়ে থাকবে। অথচ, যুক্তরাষ্ট্রে সৌরশক্তি উদ্যোক্তারা এখাতে বিপুল কর্মসংস্থানের আশা কখনোই দেখাতে পারেননি, সর্বোচ্চ সুসময়েও তারা মাত্র ৩০ হাজার কর্মী নিয়োগ দেন। তাই বলাই বাহুল্য যে, নতুন কোনো পরিচ্ছন্ন শক্তি উৎপাদনে চীনের সঙ্গে আগামীর প্রতিযোগিতায় হেরে যাওয়া আরও বেদনাদায়ক হবে।
কিন্তু, মার্কিন কংগ্রেস যখন কর ক্রেডিট ও চার্জিং স্টেশনের ব্যয় বহন করা নিয়ে বাকযুদ্ধে লিপ্ত, চীন তখন ৮০০,০০০ পাবলিক চার্জার বসিয়ে ফেলেছে যা আমেরিকার চেয়ে আট গুণ বেশি। কর প্রণোদনা, ভূমি বরাদ্দ, কম সুদে ঋণ ইত্যাদি নিয়েও পূর্ণ পরিকল্পনা করেছে চীন। এর ফলে তারা টানা ছয় বছরের মতো যানবাহন উৎপাদনের দিক থেকে বিশ্বে শীর্ষস্থান ধরে রেখেছে চীন।
যুক্তরাষ্ট্রের মোটরগাড়ি শিল্পের প্রাণকেন্দ্র ডেট্রয়েট বৈদ্যুতিক যানবাহন উৎপাদনের কেন্দ্র হিসেবে রূপান্তরন সবে শুরু করেছে। মার্কিন কংগ্রেসও বৈদ্যুতিক গাড়ির চার্জিং স্টেশনে কর ছাড় দেওয়া নিয়ে সংশয়ে, ঠিক সেই মুহূর্তেই চীনে এখন রয়েছে ৮ লাখ সরকারি চার্জিং স্টেশন। যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে যা আটগুণ বেশি। তারসঙ্গে, বেইজিং দিয়েছে বিপুল কর রেয়াদ, ভূমি বরাদ্দ, স্বল্প সুদের ঋণ ও অন্যান্য প্রণোদনা। ফলে গত ছয় বছর ধরেই বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ইলেকট্রিক যান উৎপাদনের শিরোপাও চীনের ঘরেই শোভা পাচ্ছে।
চীনজুড়ে কয়েক ডজন বিশেষায়িত উৎপাদন কেন্দ্রে কয়েক শত কোম্পানি বৈদ্যুতিক যানবাহন তৈরি করে চলেছে। বেইজিং এর প্রভাব বিস্তারের লক্ষ্যে চালু করা আরো দুটি শিল্প- সুলভ মূল্যে সেমিকন্ডাক্টর ও ব্যাটারি এর সুবিধা নিচ্ছে উক্ত শিল্প।
উৎপাদন খাতে সুপারপাওয়ার হওয়ার লক্ষ্যে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এর নেয়া বিস্তৃত পরিকল্পনার অংশ হিসেবে চীন ইতিমধ্যেই সৌর প্যানেল উৎপাদনে বিশ্ব জয় করে ফেলেছে। তাদের সফলতার মাত্রা এত বেশি যে মার্কিন নবায়নযগ্য শক্তির সমর্থকরাও এখন মনে করেন, আমেরিকার উচিত এই প্রতিযোগিতা থেকে সরে আসা।
(সংক্ষেপিত)
-
ব্লুমবার্গ থেকে অনূদিত