যুক্তরাষ্ট্র থেকে যে পরিমাণ অর্থ সাহায্য পায় ইসরায়েল
ইসরায়েল নামক দখলদার রাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠতম পৃষ্ঠপোষক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন গণমাধ্যম, অর্থনীতি, সাংস্কৃতিক অঙ্গন সর্বত্র আছে ইসরায়েলের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব। এসব কারণে, যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিপুল পরিমাণ আর্থিক তহবিল ইসরায়েল সাহায্য হিসেবে পায়। আসলে যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক সাহায্যের সবচেয়ে বড় গন্তব্যস্থল হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের এই রাষ্ট্রটি।
তবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন সম্প্রতি নিজ দল ডেমোক্রেটিক পার্টির মধ্যে থেকেই ইসরায়েলকে দেওয়া বিশাল পরিমাণ সাহায্য নিয়ে সমালোচনায় পড়েছেন। দলটির বর্ষীয়ান ও প্রভাবশালী নেতা সিনেটর বার্নি স্যান্ডার্স বলেছেন, মার্কিন অর্থ সাহায্য ইসরায়েল কীভাবে ব্যয় করে তা আরও কঠোর ভাবে খতিয়ে দেখার সময় এসেছে।
এসব প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন জাগে, ইসরায়েল কী পরিমাণে মার্কিন সাহায্য পায় এবং তা কীসের পেছনেই বা ব্যয় করে?
যুক্তরাষ্ট্র কী পরিমাণ সাহায্য দেয়?
যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা দীর্ঘমেয়াদে তেল আবিবকে দেওয়া সাহায্যের পরিমাণ বৃদ্ধি করেন। ওই অঙ্গীকারের আওতায় ২০২০ সালেও ৩৮০ কোটি মার্কিন ডলার দেওয়া হয়। সহায়তাটির প্রায় সম্পূর্ণ অঙ্ক সামরিক সাহায্য হিসেবে দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
২০১৬ সালে বিদায়ী প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা আগামী এক দশকে ইসরায়লেকে ৩৮ বিলিয়ন ডলার সামরিক সাহায্য দেওয়ার পরিকল্পনা যুক্ত বিলে স্বাক্ষর করেন। এর আওতায় ২০১৭-২০২৮ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর সহায়তা পাবে ইসরায়েল। আগের দশকে দেওয়া মার্কিন সহায়তার তুলনায় এই সাহায্যের মোট অঙ্ক ৬ শতাংশ বেশি।
মার্কিন সহায়তার অর্থ ইসরায়েল কীভাবে ব্যয় করছে?
বিগত কয়েক দশক ধরে ইসরায়েলকে পৃথিবীর অন্যতম উন্নত সামরিক বাহিনী গড়তে সাহায্য করেছে যুক্তরাষ্ট্র। প্রদত্ত তহবিল থেকে সর্বাধুনিক মার্কিন অস্ত্র কেনার সুযোগ পায় ইসরায়েল আর সেটাই তার সামরিক বাহিনীর উন্নত হয়ে ওঠার প্রধান কারণ।
যেমন; সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ৫০টি সর্বাধুনিক এফ-৩৫ জঙ্গিবিমান কিনেছে ইসরায়েল। সহায়তার অর্থে কেনা এসব বিমানের মধ্যে ২৭টির ডেলিভারি দেওয়া হয়েছে। ফিলিস্তিনি লক্ষ্যবস্তুতে এগুলো আকাশ থেকে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপেও সক্ষম, প্রতিটির দাম পড়েছে প্রায় ১০ কোটি ডলারের কাছাকাছি।
গেল বছর যুক্তরাষ্ট্র থেকে আটটি কেসি-৪৬এ বোয়িং পেগাসাস ট্যাংকার বিমান কেনে ইসরায়েল, এজন্য ব্যয় করে ২৪০ কোটি ডলার। এমন ট্যাংকার বিমান থেকে আকাশপথেই যুদ্ধবিমানে জ্বালানি ভরা যায়। ইসরায়েলের নতুন কেনা এফ-৩৫ গুলোর কমব্যাট রেঞ্জ বা দূরবর্তী স্থানে আঘাত হানার সক্ষমতা এর ফলে অনেকগুণ বেড়েছে।
২০২০ সালে ইসরায়েলকে যে ৩৮০ কোটি ডলার দেওয়া হয়, তারমধ্যে ৫০ কোটি ডলার যুক্তরাষ্ট্র দেয় ক্ষেপণাস্ত্র ও আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার জন্য। মার্কিন সরকার ইসরায়লের 'আয়রন ডোম' সহ অন্যান্য প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি উন্নয়নে বিনিয়োগও করেছে। হামাসের ছোড়া রকেট প্রতিহত করতে 'আয়রন ডোম' কাজ করে। ২০১১ সালের পর থেকে আয়রন ডোম প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়নে ১৬০ কোটি ডলার দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
এছাড়াও, যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিরক্ষা প্রযুক্তির উৎকর্ষ সাধনে কোটি কোটি ডলার খরচ করেছে ইসরায়েল। এসব প্রযুক্তির মধ্যে আছে ইসরায়েলে অনুপ্রবেশের জন্য ব্যবহৃত ভূগর্ভস্থ সুড়ঙ্গ শনাক্তকরণের মতো প্রযুক্তি। অর্থাৎ, যুক্তরাষ্ট্রের সর্বাধুনিক প্রতিরক্ষা অবকাঠামো ও বিজ্ঞান সক্ষমতা থেকেও উপকৃত হচ্ছে তেল আবিব।
ইসরায়েলি সরকার সামরিক সরঞ্জাম ও প্রশিক্ষণের পেছনে বিপুল অর্থ ব্যয় করে, কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য আঞ্চলিক শক্তির চাইতে আকারে ছোট হওয়ায় মার্কিন সহায়তার অর্থ থেকে বরাদ্দের ঘাটতি পূরণ করা হয়।
ইসরায়েলে মার্কিন সহায়তার সঙ্গে অন্যান্য দেশের তুলনা:
২০১৯ সালে প্রকাশিত সর্বশেষ হিসাবে ইউএসএইড জানায়, ওই বছর আফগানিস্তানের পর বার্ষিক সহায়তা প্রাপ্তিতে ইসরায়েল দ্বিতীয় শীর্ষ স্থানে ছিল। অবশ্য, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া মোট বৈদেশিক সহায়তার বিচারে বেশিভাগটাই পেয়েছে ইসরায়েল।
আফগানিস্তানে দেওয়া যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তার সিংহভাগই দেশটিতে অবস্থানরত মার্কিন সামরিক বাহিনীকে সমর্থনের পেছনে ব্যয় করা হয়েছে। তবে চলতি বছরের সেপ্টেম্বর নাগাদ সেখান থেকে সেনা প্রত্যাহারের লক্ষ্যমাত্রা থাকায় ২০২১ সালের জন্য মাত্র ৩৭ কোটি ডলার সহায়তা চাওয়া হয়েছে।
অন্যদিকে, মধ্যপ্রাচ্যে সবচেয়ে অনুদান প্রাপ্ত রাষ্ট্র ইসরায়েল। মিশর ও জর্ডানও মার্কিন সহায়তার অপর দুই বড় গ্রহীতা। দুটি রাষ্ট্রই ইসরায়েলের সঙ্গে শান্তি চুক্তিতে স্বাক্ষর করায় এই সাহায্য পেয়ে আসছে। ২০১৯ সালে দেশদুটি মোট ১৫০ কোটি ডলারের সহায়তা লাভ করে।
ট্রাম্প ফিলিস্তিনিদের সকল প্রকার সহায়তা বন্ধের সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু, নতুন প্রেসিডেন্ট বাইডেন ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের সহায়তাকারী জাতিসংঘের সংস্থাকে সীমিত আকারে হলেও তহবিল প্রদানের প্রক্রিয়া পুনরায় সচল করেছেন। চলতি বছর এ বাবদ সাড়ে ২৩ কোটি ডলার দেবে যুক্তরাষ্ট্র। ২০১৮ সাল ট্রাম্প প্রশাসন ফিলিস্তিনিদের সহায়তা বন্ধ করে দেয়।
যুক্তরাষ্ট্র কেন ইসরায়েলকে বিপুল পরিমাণ সহায়তা দেয়?
ইসরায়েলকে বিপুল সহায়তার পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের একাধিক কারণ রয়েছে, কিন্তু সবচেয়ে বড় বিষয়টি হলো, ১৯৪৮ সালে ইহুদি রাষ্ট্র গঠনের পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের দৃঢ় সমর্থন ও একে রক্ষার ঐতিহাসিক অঙ্গীকার।
তাছাড়া, মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলকে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মিত্র হিসেবে দেখা হয়। এই অঞ্চলে উভয়ের লক্ষ্য অভিন্ন এবং তারা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের দাবি করে।
মার্কিন কংগ্রেসের গবেষণা শাখা জানায়, "এসব সম্পর্কের ভিত্তি মজবুত করতে মার্কিন সহায়তা অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।"
সেখানে আরও বলা হয়, "ওই অঞ্চলে ইসরায়েলকেই সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসেবে মার্কিন কর্মকর্তা ও আইনপ্রণেতারা বিশ্বাস করেন।"
মার্কিন সরকারের বৈদেশিক সহায়তা সংস্থা বলছে, "সামরিক সক্ষমতার মান বৃদ্ধির মাধ্যমে আঞ্চলিক শত্রুদের সম্ভাব্য হুমকি থেকে মার্কিন সহায়তা ইসরায়েলকে নিরাপদ রাখে।"
সংস্থাটি আরও জানায়, "ইসরায়েল যেন নিজের পর্যাপ্ত নিরাপত্তা নিশ্চিত করার মাধ্যমে ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে শান্তি স্থাপনের ঐতিহাসিক পদক্ষেপ নিয়ে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা স্থাপন করতে পার, সেটা নিশ্চিত করাটাই মার্কিন সহায়তার মূল লক্ষ্য।"
আসলে মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাকেই মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির কেন্দ্রে রাখা হয়। ডেমোক্রেট বা রিপাবলিকান যে দলেরই সরকার হোক, কখনোই এর ব্যতিক্রম হয়নি।
২০২০ সালে ডেমোক্রেট দলের নির্বাচনী প্ল্যাটফর্ম থেকে ইসরায়েলের জন্য সুদৃঢ় সমর্থনের অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়। কিন্তু, সাম্প্রতিক ঘটনাবলীর প্রেক্ষিতে দলের বামপন্থী কিছু রাজনীতিক মার্কিন সহায়তার অঙ্গীকার নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন।
গাজার সঙ্গে সাম্প্রতিক সংঘাতের সময়ে সিনেটর স্যান্ডার্স-সহ আর কিছু ডেমোক্রেট ইসরায়েলের কাছে সাড়ে ৭৩ কোটি ডলারের প্রিসেশন গাইডেড অস্ত্র বিক্রি বন্ধ রাখার চেষ্টা করেন।
- সূত্র: বিবিসি