যেভাবে দ্রুত ছড়াচ্ছে ডেল্টা ভেরিয়েন্ট
টিকা সংগ্রহের জন্য বেশিরভাগ দেশ যখন হিমশিম খাচ্ছে, তখনই নতুন উদ্বেগ ছড়াচ্ছে করোনাভাইরাসের ডেল্টা ভেরিয়েন্ট। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, এখন পর্যন্ত করোনার সবচেয়ে বিপজ্জনক ধরনটি বিশ্বজুড়ে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়িয়ে দেবে।
গত মার্চে ভারতে প্রথম শনাক্ত হওয়ার পর ডেল্টা ধরন এখন পর্যন্ত ৯০টির বেশি দেশে ছড়িয়েছে।
ডেল্টা ভেরিয়েন্টের সংক্রমণ ক্ষমতা আলফা ভেরিয়েন্টের চেয়ে ৬০ শতাংশ বেশি। আলফা ভেরিয়েন্টের সংক্রমণ ক্ষমতা আবার উহানের প্রথম স্ট্রেইনের চেয়ে ৫০ শতাংশ বেশি।
ডেল্টা ধরনের এমন কিছু বৈশিষ্ট্যের অধিকারী, যার ফলে এটি শরীরের কিছু ইমিউন সিস্টেম বা রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে ফাঁকি দিতে পারে। এর সাথে যোগ হয়েছে ধরনটির ছড়িয়ে পড়ার অস্বাভাবিক ক্ষমতা। যুক্তরাষ্ট্রে নতুন করোনা আক্রান্তদের ৫০ শতাংশই ডেল্টা ধরনে আক্রান্ত।
অবশ্য পূর্ণ ডোজ টিকা নিলে ডেল্টা আক্রান্তদের অবস্থা গুরুতর হয় না। নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অফ মেডিসিন-এ প্রকাশিত একটি গবেষণায় দেখা গেছে, মডার্না ও ফাইজার-বায়োএনটেক উভয় এমআরএনএ ভ্যাকসিনই সম্ভবত ডেল্টার বিরুদ্ধে সুরক্ষা দিতে সক্ষম।
আরেকটি গবেষণা থেকে জানা গেছে, অ্যাস্ট্রাজেনেকা বা ফাইজার ভ্যাকসিনের দুই ডোজ ডেল্টার বিরুদ্ধে যথাক্রমে ৬০ ও ৮৮ শতাংশ কার্যকর। জনসন অ্যান্ড জনসনের এক ডোজের ভ্যাকসিনটিও ডেল্টা ধরনের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কার্যকর।
বৈজ্ঞানিক জার্নাল নেচার-এ প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্র থেকে জানা গেছে, এমআরএনএ ভ্যাকসিনের এক ডোজ ডেল্টা ধরনের বিরুদ্ধে খুব কম প্রতিরোধই গড়তে পারে।
ডেল্টার বিরুদ্ধে কার্যকারিতা কমে যাওয়ায় ফাইজার তাদের ভ্যাকসিনের বুস্টার ডোজের অনুমোদন চেয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসন এফডিএ-র কাছে। ফাইজার অ্যান্ড বায়োএনটেক বৃহস্পতিবার জানায়, তারা কোভিড ভ্যাকসিনের একটি হালনাগাদ সংস্করণ তৈরি করেছে। এই সংস্করণ বিশেষ করে ডেল্টার বিরুদ্ধে সুরক্ষা দেবে।
কেন এত ভয়ংকর ডেল্টা ভেরিয়েন্ট:
করোনা ও ইনফ্লুয়েঞ্জার মতো অবাধে বিচরণকারী ভাইরাসগুলোর প্রতিনিয়ত এবং অতি দ্রুত মিউটেট বা অভিযোজিৎ হতে থাকে। ভাইরাস প্রতিনিয়ত অনুলিপির (কপি) মাধ্যমে নিজেদের সংখ্যা বাড়ায়। ডেল্টা ভেরিয়েন্টের অনুলিপি প্রক্রিয়ায় গোলযোগ থাকায় এর অনুলিপি হয় অতি দ্রুতগতিতে। কিছু কিছু অভিযোজনের ফলে ভাইরাস অ্যান্টিবডিকে ফাঁকি দেওয়ার সক্ষমতা অর্জন করে, কিছু মিউটেশনে এর সংক্রামক ক্ষমতা বেড়ে যায়।
ডেল্টার সাফল্যের মূল কারণ হলো এর স্পাইক প্রোটিনের মিউটেশন। এই অভিযোজনের ফলে স্পাইক প্রোটিনগুলো পরিবর্তিত হয়ে অ্যান্টিবডিকে ফাঁকি দেওয়ার সামর্থ্য অর্জন করেছে।
ডেল্টা ভেরিয়েন্টের স্পাইক প্রোটিনে মিউটেশনের ফলে এটি ফুসফুস ও অন্যান্য মানবকোষের সঙ্গে আগের চেয়েও দৃঢ়ভাবে সেঁটে যেতে পারে।
কোনো মিউটেশনের ফলে যদি একটি ভাইরাস ফিটনেস বা প্রজনন সুবিধা অর্জন করে, তাহলে সেই মিউটেশন সারা বিশ্বে স্বাধীনভাবে চলতে থাকে। ডেল্টা ভেরিয়েন্টের মিউটেশনও এরকম।
ডেল্টার বিরুদ্ধে টিকা কম কার্যকর:
ভারত ও যুক্তরাজ্যে ডেল্টা চার থেকে ছয় সপ্তাহের মধ্যে প্রধান ভেরিয়েন্ট হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। এ থেকেই বোঝা যায়, এটি পূর্ববর্তী ধরনগুলোর চেয়ে অনেক বেশি সংক্রামক ও ছোঁয়াচে।
লন্ডনের কুইন মেরি বিশ্ববিদ্যালয়ের মহামারি বিশেষজ্ঞ দীপ্তি গুরদাসানি বলেছেন, উচ্চ সংক্রমণ ক্ষমতাসম্পন্ন এই ধরনটি মহামারির গতিপথ বদলে দিতে পারে।
আলফা ও বেটা ভেরিয়েটের বিরুদ্ধে টিকা ও চিকিৎসা এখনও কার্যকর হলেও, ডেল্টা ধরনের বিরুদ্ধে টিকা ও চিকিৎসার কার্যকারিতা কম। যারা এক বা দুই ডোজ ফাইজার ভ্যাকসিন নিয়েছেন, তাদের শরীরে আলফা ও বেটার তুলনায় ডেল্টা ধরনের বিরুদ্ধে কম অ্যান্টিবডি উৎপন্ন হয়েছে।
আরেক গবেষণায় দেখা গেছে, দুই ডোজ ফাইজার টিকা যেখানে আলফা ধরনের বিরুদ্ধে ৯৩ শতাংশ সুরক্ষা দিয়েছে, সেখানে ডেল্টার বিরুদ্ধে ৮৮ শতাংশ সুরক্ষা দিয়েছে। অ্যাস্ট্রাজেনেকা টিকার দুই ডোজ আলফার বিরুদ্ধে ৬৬ শতাংশ কার্যকর হলেও ডেল্টার বিরুদ্ধে মাত্র ৬০ শতাংশ কার্যকর।
তবে দুই টিকার ক্ষেত্রেই এক ডোজ দিয়ে আলফার বিরুদ্ধে যেখানে ৫১ শতাংশ সুরক্ষা পাওয়া গেছে, সেখানে ডেল্টার বিরুদ্ধে সুরক্ষা পাওয়া গেছে মাত্র ৩৩ শতাংশ। এছাড়াও দেখা গেছে, যেসব অঞ্চলে টিকা দেওয়ার গতি কম, সেখানে ডেল্টা অত্যন্ত দ্রুতগতিতে ছড়াচ্ছে।
টিকার সাহায্যে কেবল ভাইরাসের সংক্রমণের গতি ধীর করা সম্ভব। ভাইরাসের বিস্তার রোধের জন্য টিকার পাশাপাশি সামাজিক দুরত্ব মেনে চলা ও মাস্ক পরার মতো অন্যান্য ব্যবস্থা গ্রহণের বিকল্প নেই।
পৃথিবীর বেশিরভাগ মানুষই এখনও টিকা পায়নি। সবাইকে টিকার আওতায় আনার আগ পর্যন্ত করোনাকে সম্পূর্ণ পরাস্ত করা সম্ভব হবে না। ডেল্টা ভেরিয়েন্টের ব্যাপারে সাবধান না হলে মানবজাতিকে ভয়াবহ পরিণতি বরণ করতে হতে পারে। তাই প্রত্যেকেরই উচিত কঠোরভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা এবং মাস্ক পরা।
- সূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক