সুয়েজ খাল যেভাবে পরিণত হয়েছিল মুম্বাইয়ের সেক্সরুটে
মিশরের সুয়েজ খাল উদ্বোধনের মাত্র দশ দিন পর ভারতগামী একটি মালবাহী জাহাজ লোহিত সাগরে ডুবে যায়। ১৮৬৯ সালের ২৭ নভেম্বর দুর্ঘটনাটি ঘটে। সুয়েজ খাল ব্যবহার করে প্রথমবারের মতো ভারতের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়ে দুর্ঘটনার কবলে পড়া জাহাজটির নাম ছিল নোয়েল। বোম্বে গার্ডিয়ানের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বোর্দো থেকে জাহাজ ভর্তি ওয়াইন নিয়ে বোম্বে আসছিল ডুবে যাওয়া ঐ জাহাজ।
তবে, সেজন্য জাহাজ চলাচলে কোনো বাঁধার সৃষ্টি হয়নি। সুয়েজ খাল চালু হওয়ার পর ভূমধ্যসাগর থেকে লোহিত সাগরের সংযোগ স্থাপিত হয়। এর আগে দক্ষিণ আফ্রিকার কেপ অব গুড হোপের পাশ দিয়ে ঘুরে যেতে ইউরোপ থেকে ভারত ভ্রমণে তিন মাসের বেশি সময় লাগত। সুয়েজ খাল ব্যবহার করে এই যাত্রাপথের সময়কাল মাত্র চার থেকে পাঁচ সপ্তাহে নিয়ে আসা সম্ভব হয়। ফলে, ইউরোপ ও ভারতীয় উপমহাদেশের বাণিজ্যিক সম্পর্কে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসে।
কিছুদিনের ব্যবধানে গ্লাসগো থেকে আসা 'দ্য স্টারলিং' নামের একটি স্টিমার সুয়েজ খাল ব্যবহার করে মাত্র ১৬ ঘন্টারও কম সময়ে মুম্বাই এসে পৌঁছায়।
এ বছরের ২৩ মার্চ ৪০০ মিটার দীর্ঘ এভার গিভেন সুয়েজ খালে আটকে যাবার পরই বিশ্ববাসী নতুন করে খালটির গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারে।
এই দুর্ঘটনার কারণেই দেড়শো বছর আগে সুয়েজ খাল চালু হবার পর সৃষ্ট উত্তেজনা নতুন রূপে ফিরে এসেছে। সেসময় ভারতবর্ষেও রীতিমতো হুলস্থুল কাণ্ড সৃষ্টি করেছিল এই খাল। ভারতবর্ষের মুম্বাই নগরীর চেহারা রাতারাতি পালটে দেওয়ার পিছে আছে এই সুয়েজ খালের ভূমিকা। নতুন করে করে শোনা যাক সুয়েজের সেই বিস্মৃত ইতিহাস।
ভারতের প্রবেশদ্বার
ভারতীয় উপমহাদেশের পশ্চিম উপকূলে অবস্থিত সবথেকে উন্নত বন্দরনগরী মুম্বাই। সুয়েজ খাল চালু হবার পর ইউরোপের জাহাজগুলো গন্তব্যস্থল হিসেবে মুম্বাইকে বেছে নেওয়া শুরু করে। ফলে, কিছুদিনের মধ্যেই ভারতের প্রবেশদ্বারে পরিণত হয় এই শহর।
দেশের অন্যান্য প্রান্তের সাথে মুম্বাইয়ের রেল সংযোগের মাধ্যমে দ্রুত এক মহানগরে রূপান্তরিত হতে থাকে মুম্বাই।
সুয়েজ খাল স্থাপনের মাত্র দু'বছরের মাথায় ইন্দো-ইউরোপিয়ান টেলিগ্রাফ স্থাপিত হয়। বোম্বে চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির এক প্রতিবেদনে বাণিজ্যের প্রসারলাভ সম্পর্কে আশাবাদ ব্যক্ত করে বলা হয়- "দ্রুত দেশের বাইরে ভারতীয় পণ্যের ভোক্তা বৃদ্ধি পাবে। এছাড়া, ক্লোজড স্পট ও অগ্রীম চুক্তি অনুযায়ী পণ্যের বেচাকেনাও বাড়বে।
পণ্য পরিবহনের দ্রুততা এবং পূর্ব-পশ্চিমের বাড়তে থাকা বাণিজ্যের অর্থ হল- ব্যাংকিং, ইন্স্যুরেন্স এবং শিপিং এর মতো মূল্যবান ব্যবসায়িক অনুষঙ্গের সুযোগ উন্মোচিত হওয়া"।
দুই মহাদেশের মধ্যে যোগাযোগ যত সহজ এবং দ্রুতগামী হয়, তত দ্রুত বদলে যেতে থাকে মুম্বাইয়ের জীবনযাত্রা। সেইসাথে বদলে যায় নগরের চিরাচরিত গণিকাবৃত্তির রূপ।
১৯২৯ সালে প্রকাশিত 'দ্য বোম্বে সিটি পুলিশ' বইতে ভারতীয় সরকারি কর্মকর্তা এসএম এডওয়ার্ডস ক্ষোভ প্রকাশ করে লিখেন, "১৮৬৯ সালে সুয়েজ খাল চালু হওয়ার আগে বোম্বের মানুষের সাথে পূর্ব ইউরোপের বিদেশি যৌনকর্মীদের সাথে পরিচিত ছিল না। এর আগে এ ধরনের অনৈতিক কর্মকাণ্ডে কেবল ইউরেশিয়ান কিংবা ভারতীয় বংশোদ্ভূত নারীরাই সীমাবদ্ধ ছিলেন।"
তিনি আরও লিখেন, "একবার যখন ভারতের সাথে ইউরোপের বড় বড় শিপিং প্রতিষ্ঠানের নিয়মিত স্টিমার-যোগাযোগ স্থাপিত হল, তখন পোর্ট সাঈদে (মিশরে) জাহাজগুলো সাময়িক বিরতির জন্য ভিড়তে শুরু করল। সেই সাথে জায়গাটি ইউরোপের ইতর পর্যায়ের সব মানুষদের আনাগোনার কেন্দ্রস্থলে পরিণত হল। এভাবেই বৈশ্বিক যৌন ব্যবসার সাথে যুক্ত হল ভারত"।
"নারীরা সাধারণত একা একা এবং স্বেচ্ছায় এখানে আসতেন। প্রথমবারের মতো তারা যখন বোম্বে নগরে পা রাখতেন, তখন তাদের বয়স আঠারোর উপরেই থাকত ," লিখেছেন এডওয়ার্ড।
তিনি আরও লিখেন, "পতিতালয়ের 'কর্ত্রী' হিসেবে পরিচিত বয়স্ক অবসরপ্রাপ্ত যৌনকর্মীরা কখনো কখনো পূর্বসূরীদের মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে বিভিন্ন বাড়ির ভোগ দখল করতেন। তারা নতুন আগত এই নারীদের দৈনিক উপার্জনের ৫০ শতাংশের বিনিময়ে তাদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করতেন।"
উনিশ শতকের শেষ নাগাদ, ভারতের অন্য যেকোন শহরের তুলনায় মুম্বাইতে ইউরোপীয় যৌনকর্মীরা সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিলেন বলে জানান অশ্বিনী তাম্বে। 'কোডস অব মিসকন্ডাক্টস: রেগুলেটিং প্রস্টিটিউশন ইন লেট কলোনিয়াল বোম্বে' বইতে এই লেখিকা জানান, "সুদূর পোল্যান্ড থেকেও নারীরা পতিতালয়ে কাজ করতে আসতেন।"
'সফেদ গালি'
ইউরোপীয় নারীদের অনেকেই তারদেও, গ্র্যান্ট রোড এবং বাইকুল্লার বিভিন্ন পতিতালয়ে কাজ করতেন। এমনকি শুক্লাজি স্ট্রিটের একটি গলির নামই হয়ে যায় 'সফেদ গালি' বা 'সাদা গলি'।
তাম্বে লিখেছেন, "বর্ণের বিশুদ্ধতা রক্ষা এবং সংকরায়ন রোধ করা সেসময়কার গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ইস্যুতে পরিণত হয়।"
এছাড়া ইউরোপীয় পতিতালয়গুলো ঔপনিবেশিক প্রশাসকদের আরোপিত তিনটি ভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ নীতি অনুসারে পরিচালিত হত বলে উল্লেখ করেন অশ্বিনী তাম্বে। এগুলো ছিল- ব্রিটিশ সেনা এবং নাবিকদের মনোরঞ্জনের ব্যবস্থা করা, ভিন্ন বর্ণের সাথে যৌন সম্পর্ক স্থাপন প্রতিরোধ করা এবং ব্রিটিশ জাতীয়তাবাদী মর্যাদা রক্ষা করা।
তিনি বিষয়টি ব্যখ্যা করে লিখেন, "ব্রিটিশ প্রশাসকরা পতিতালয়গুলোর অনুমোদন দিলেও সেখানে যেন ব্রিটিশ নারীরা যৌন কর্মী হিসেবে কাজ না করে সে বিষয়টি নিশ্চিত করার চেষ্টা করতেন। কেননা, তা ব্রিটিশ নারীসমাজ সম্পর্কে নেতিবাচক মনোভাব সৃষ্টি করতে পারে বলে ধারণা করেছিলেন এই প্রশাসকরা।"
- সূত্র-কোয়ার্টজ ইন্ডিয়া