হংকং কেন এত কুসংস্কারাচ্ছন্ন?
কুসংস্কারের প্রতি এক গভীর শ্রদ্ধাবোধ রয়েছে হংকংবাসীদের মনে। ফেং সুইয়ের মতো বহু ধারণা ও দর্শন বিরাজ করছে চীন নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলটিতে।
এ অঞ্চলের বেশিরভাগ মানুষই কুসংস্কারে আচ্ছন্ন। অন্যদের চোখে বিষয়গুলো ভিত্তিহীন মনে হলেও হংকংয়ের মানুষ গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে এসব মেনে চলে। তারা মনে করে, এসব আচার-অনুষ্ঠান তাদের সৌভাগ্যের দরজা খুলে এবং দুর্ভাগ্যের দরজা বন্ধ করে দেবে। তারা বিশ্বাস করে, দেবতা ও প্রফুল্ল ব্যক্তিরা ভাগ্য ঠিক বা পরিবর্তন করার দুর্দান্ত ক্ষমতা রাখে।
সৌভাগ্য আকৃষ্ট করার এবং খারাপ শক্তি থেকে রক্ষা পাওয়ার একটি চীনা ভূতত্ত্ব বা দর্শনের নাম ফেং সুই। অন্ধবিশ্বাসীরা ফেং সুইয়ের নীতি অনুসারে তাদের আসবাবপত্র এবং বাড়িঘরের অবস্থান ঠিক করে থাকে। এছাড়াও, হংকংয়ের অনেক বড় বড় বিল্ডিংয়ে ফেং সুইয়ের ধারণা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
উদাহরণ হিসেবে এইচএসবিসি ভবনটির কথাই ধরুন। খারাপ আত্মার প্রবেশ থেকে বাঁচতে ভবনের অভ্যন্তর এসকেলেটরগুলো প্রধান প্রবেশপথের একটি কোণায় বানানো হয়। ভবনের ওপরে স্থাপন করা দুটি ধাতব রড প্রতিবেশী ব্যাংক অব চায়না ভবনটি থেকে বের হওয়া খারাপ শক্তি আটকাতে সহায়তা করে।
অনেকে আবার অসুস্থতা ও দুর্ভাগ্যের মতো নেতিবাচক শক্তি কমাতে উ লউ ব্যবহার করেন, যার আভিধানিক অর্থ, 'জীবনদাতা'।
তাদের যেকোনো শুভ কাজ, যেমন বিয়ে, জন্মদিন- এসব অনুষ্ঠানে লাল রঙের ব্যবহার এবং কালো ও সাদা রঙ পরিহার করা হয়। কখনো কাউকে জুতো উপহার দেয় না তারা। কারণ, তারা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে, সম্পর্ক নষ্টে কলকাঠি নাড়ে জুতো!
আবার, কারও জন্মদিন হলে কেক কাটবার সময়ও তারা কিছু নিয়ম মেনে চলে। একদম নিচ পর্যন্ত কখনো কেক কাটে না তারা। কারণ, ওই মানুষের অবিবাহিত থাকার আশঙ্কা থাকে!
অন্যদিকে, ছাতাকে তারা শয়তানের প্রবেশদ্বার বলে বিশ্বাস করে। বাইরে বের হলে তারা ছাতা ব্যবহার করে। তবে ঘরের ভেতর কখনো ছাতা মেলে না এবং অতিথিদের ছাতাও ঘরের ভেতর আনতে দেয় না।
দুর্ভাগ্য রোধে কুসংস্কারের ভূমিকা নিয়ে লেখালেখি এবং সিঙ্গাপুরের জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন ইয়ান জাং। তিনি বলেন, 'লোকদের কুসংস্কারে বিশ্বাস রাখার প্রধান কারণ, পরিবেশের ওপর নিজেদের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখার শক্তি অর্জন করা।'
জাং আরও বলেন, 'তাদের নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা বাড়িয়ে দিচ্ছে- এমন বোধ মানুষের মনে কুসংস্কার এনে দেয়। এতে তারা উদ্বিগ্ন হয় কম এবং সাহস পায় বেশি।'
হংকংয়ের কুসংস্কার বিশ্বাস মৃতদের মধ্যেও প্রসারিত। মৃত পূর্বপুরুষদের প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধা জানাতে এপ্রিল মাসে কিংমিং উৎসব পালন করা হয় সেখানে। শুধু তাই নয়, শোকার্তরা সেখানে অর্থ, পোশাক, ঘর এবং এমনকি স্মার্টফোন ও টিভির মতো জিনিসপত্রও উপস্থাপন করে। কারণ, তাদের বিশ্বাস, এই নৈবেদ্যগুলো মৃত ব্যক্তিকে সুখী এবং সমৃদ্ধশালী পরকাল দান করে।
হংকংয়ে ১০ বছরেরও বেশি সময় ধরে ফেং সুইয়ের মাস্টার হিসাবে কাজ করা জন চোই বলেন, 'আমরা বিশ্বাস করি, পূর্বপুরুষদের দেখাশোনা করলে তারা এর বদলে আমাদের আশীর্বাদ দেবেন। আমার বাবা মারা যাওয়ার সময় বেশ গরিব ছিলেন। সুতরাং, আমরা তার জন্য প্রচুর জিনিস পুড়িয়ে দিয়েছি, যেন পরকালে তিনি সমৃদ্ধশালী হতে পারেন।'
হংকংয়ের কুসংস্কারের পেছনের কারণগুলো নির্ধারণ করা বেশ কঠিন। চীনারা এইসব বিশ্বাস অর্জন করেছে দেড়শ বছরেরও বেশি সময় ধরে ব্রিটিশ উপনিবেশ এবং পূর্ব ও পাশ্চাত্য- উভয় বিশ্বাস থেকে।
কিছু উদাহরণ খেয়াল করা যাক: হংকং কোঙ্গাররা কখনো মইয়ের নিচ দিয়ে হাঁটে না; কেননা, এটিকে পশ্চিমে এটি দুর্ভাগ্যের প্রতীক ধরা হয়। আবার, তারা উপহার হিসাবে কখনো কাউকে ঘড়ি দেয় না; কেননা, চীনা সংস্কৃতিতে এটি দুর্ভাগ্যের চিহ্ন।
হংকংবাসীরা মনে করে, দরজা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এবং এটি সৌভাগ্য ও সমৃদ্ধি বয়ে আনে। তাই চুই তার ক্লায়েন্টদের জন্য সেরা ফেং সুই নিশ্চিত করতে অভ্যন্তরীণ স্পেসগুলো ডিজাইন করার বিষয়ে পরামর্শ দেন। আশেপাশে কোনো বিল্ডিং বানানো হলে তিনি সেখানে চলে যান এবং কোথায় দরজা থাকলে ভাগ্য ফিরে আসবে, তা গণনা করেন।
চোই মনে করেন, যেকোনো কিছু পাওয়া ৭০ শতাংশ কঠোর পরিশ্রম এবং ৩০ শতাংশ ভাগ্যের ওপর নির্ভর করে। তিনি বলেন, 'আমরা বিশ্বাস করি, ফেং সুইয়ের (সৌভাগ্য সংখ্যা) কিছু জিনিস স্পর্শ করা আমাদের জন্য সৌভাগ্য বয়ে আনতে পারে।'
ধর্ম, বিজ্ঞান ও কুসংস্কার মানুষের মনে সবকিছু নিয়ন্ত্রণের অনুভূতি এবং স্বাচ্ছন্দ্যবোধ এনে দেয়। যেহেতু হংকং তেমন কোনো ধর্মীয় চর্চার স্থান নয়, তাই বিজ্ঞান ও কুসংস্কারে বিশ্বাসের ওপর নির্ভরযোগ্যতা বেশি।
জাং বলেন, 'সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কুসংস্কারের বিশ্বাস হয়তো বদলে যাবে। এই ভুল ধারণাগুলোও ভাঙবে এক সময়। তবে আমি আশা করি কুসংস্কারগুলো কখনো পুরোপুরি বিলীন হবে না।'
- সূত্র: বিবিসি ও অন্যান্য