সুন্দরবনের মৌয়ালদের বিপদসঙ্কুল আর বৈচিত্র্যে ভরা জীবন!
জঙ্গলের আশেপাশে বাস করা মানুষদের জঙ্গলের সঙ্গে জটিল একটা সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সুন্দরবনের বাসিন্দাদের ক্ষেত্রেও এ কথা সত্য। ম্যানগ্রোভ এ বনটি এ মানুষগুলোকে যেমন খাবার জোগায়, সাইক্লোনের সময় প্রাণে বাঁচায়, ঠিক তেমনিভাবে বনের ভেতরেই তাদের জন্য ওত পেতে থাকে নানা ভয় আর বিপদ। বৃক্ষ আর পর্ণরাজিসমৃদ্ধ গোলকধাঁধার মতো এ বনে যখন ছোটবড় শিকারী প্রাণীদের খুব সন্নিকটে দিনের পর দিনের বাস করতে হয়, তখন মৃত্যু বুঝি এ মানুষদের খুব পরিচিত, নিকটবর্তী একটি অনুভূতি বলে বোধ হয়।
এ কথাটি বিশেষভাবে সুন্দরবনের মৌয়ালদের জন্য প্রযোজ্য। এপ্রিল আর জুন মাসে যখন জঙ্গলের ভেতর জালের মতো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা নদীগুলোতে মাছ শিকার নিষিদ্ধ থাকে, তখন এ মৌয়ালেরা বনের ভেতর প্রবেশ করেন মধু সংগ্রহ করার জন্য। নৌকা ছেড়ে বনের ভেতরে ঢুকে মৌচাক থেকে মধু নিয়ে তারপর ঘরে ফিরে আসার মিশন সম্পন্ন করতে হয়। মৌয়ালেরা যখন জঙ্গলের ভেতর প্রবেশ করেন, তারা নিশ্চিত জানেন যেকোনো সময় বাঘ তাদের ওপর হামলা করে বসতে পারে।
বাংলাদেশের মেঘনা নদী ও ভারতের হুগলী নদীর মোহনায় অনেকগুলো ছোট ছোট দ্বীপ নিয়ে গড়ে উঠেছে সুন্দরবন। দুই দেশ মিলিয়ে বনের আয়তন মোটামুটি ১০ হাজার বর্গ কিলোমিটার। বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন এটি। পৃথিবীর একমাত্র ম্যানগ্রোভ বন হিসেবে কেবল সুন্দরবনেই বাঘের (বেঙ্গল টাইগার) দেখা মেলে। সুন্দরবনের আশেপাশের গ্রামগুলোতে প্রায় চল্লিশ লাখের বেশি মানুষ বাস করেন।
এ বনে বাঘের পাশাপাশি আছে কুমির, বড় গুইসাপ ওরফে রামগদি, শঙ্খচূড়, গাঙ্গেয় ডলফিন, পান্না কাছিম ইত্যাদি।
সুন্দরবনের জীবনযাপনের এ ছবিগুলো সুন্দরবন ওয়াইল্ডলাইফ স্যাংকচুয়ারি থেকে তুলেছেন বিখ্যাত ভারতীয় ওয়াইল্ডলাইফ ফটোগ্রাফার ধৃতিমান মুখার্জি। গত কয়েক বছর ধরে অসংখ্যবার সুন্দরবনে ভ্রমণ করেছেন ধৃতিমান।
সুন্দরবনের নামের পেছনে দুইটি জনপ্রিয় তত্ত্ব আছে। একটির মতে 'সুন্দর' আর 'বন' শব্দ জুড়েই সুন্দরবন নাম দেওয়া হয়েছে। অন্য ধারণাটি অনুযায়ী সুন্দরবনের সুন্দরী গাছ থেকে উৎপন্ন হয়েছে বনের নাম। জীববৈচিত্র্যে ভরপুর এ বনে রয়েছে নানা প্রজাতির গাছ, স্থলজ প্রাণী, ও জলজ জীব। বনের ধারে বাস করা বাসিন্দাদের জন্য সুন্দরবন খাবার, কাঠ, জ্বালানি, ভেষজ ঔষধ ইত্যাদির উৎস। আর মাছ ধরা, কাঁকড়া শিকার, ও মধু সংগ্রহ এখানকার মানুষদের প্রধান জীবিকা।
সুন্দরবনের মধু সংগ্রহকারীরা স্থানীয়ভাবে মৌয়াল নামে পরিচিত। বনের ভেতর মধু সংগ্রহ করার আগে তাদেরকে অবশ্যই বনবিভাগ থেকে অনুমতি সংগ্রহ করতে হয়। প্রতিটি দলে পাঁচ থেকে ১০ জনরে মতো মৌয়াল থাকেন। যিনি বয়সে সবচেয়ে বড় অথবা যার অভিজ্ঞতা সবচেয়ে বেশি, তিনিই দলনেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। মধু সংগ্রহের মৌসুমে মৌয়ালেরা তাদের নৌকাতেই খাওয়াদাওয়া ও ঘুমানোর কাজ সারেন। মধু সংগ্রহের জন্য বেরোনোর আগে তারা নৌকাতে খাবার, জ্বালানি, পানি, তৈজসপত্র, মশারি, সাধারণ ঔষধপত্র, ও মধু সংগ্রহের হাতিয়ার ভর্তি করে নেন।
সুন্দরবনের ভূমিরূপ জোয়ার-ভাটার কারণে নিয়মিত পরিবর্তিত হচ্ছে। বড় জোয়ারের সময় অনেকগুলো দ্বীপ এলাকা ঈষৎ লবণাক্ত পানিতে ডুবে যায়। পানি বেড়ে গেলে মৌয়ালদের বনের ভেতর হাঁটাচলা করতে কিছুটা অসুবিধা হয়। কারণ সুন্দরবনের মাটিতে থাকা শ্বাসমূল পানিতে ঢেকে গেলে তাতে আহত হবার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। তবে গলা পর্যন্ত জোয়ারের পানি হলে আরেকদিক থেকে নির্ভার থাকতে পারেন মৌয়ালেরা, কারণ এরকম পরিস্থিতিতে বাঘ আক্রমণ করার আশঙ্কা কমে যায়।
মৌয়ালেরা যখন জঙ্গলের ভেতর মধু সংগ্রহে ব্যস্ত, তখন তাদের স্ত্রীরা কিছু আচার পালন করেন। তাদের বিশ্বাস এর ফলে জঙ্গলের ভেতরে মৌয়ালদের ক্ষতি হবে না। সাধারণ তারা শোকের কাপড় পরেন, নিরামিষ খান, চুল আঁচড়ান না, আর ঘরের দরজা বন্ধ করেন না। বাংলাদেশ রিসোর্স সেন্টার ফর ইনডিজেনাস নলেজ-এর এক নিবন্ধ অনুযায়ী, এ সময়ে মৌয়ালের স্ত্রীরা কেবল ভোরবেলা আর সন্ধ্যেবেলাতে রান্না করেন, তারা দিনের বেলা আগুন জ্বালান না। কারণ, তাদের বিশ্বাস দিনে আগুন জ্বালালে বন আর মৌচাক দুটোরই ক্ষতি হবে।
ওদিকে মৌয়ালদেরও রয়েছে নিজস্ব কিছু আচার। বনের ভেতর প্রবেশের আগে সব মৌয়াল বনবিবির আশীর্বাদ নেন। বাঘের আক্রমণ থেকে বনবিবি তাদেরকে রক্ষা করবেন, এটাই তাদের বিশ্বাস। বনবিবি মুসলিম ঘরের কন্যা ছিলেন বলে মনে করা হয়। তাকে সব ধর্মবিশ্বাসী মৌয়ালই মান্য করেন। ফটোগ্রাফার ধৃতিমান জানান, 'বনবিবির প্রার্থনা খুবই মনোযোগ দিয়ে করেন মৌয়ালেরা। কেউ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলেও সেই আচারের গাম্ভীর্য টের পাবেন।' বনবিবির অস্থায়ী মাজার তৈরি করেন মৌয়ালেরা, সেখানে বিভিন্ন কিছু তার জন্য উৎসর্গ করা হয়। এরপর কয়েক মিনিট প্রার্থনা করে বনে প্রবেশ করেন তারা।
জঙ্গলের ভেতরে মৌচাক খুঁজে পাওয়া সহজ কাজ নয়। সুন্দরবনে তিন ধরনে মৌচাক দেখা যায়। তার মধ্যে এপিস ডরসাটা প্রজাতির মৌমাছির মৌচাক থেকে সবচেয়ে বেশি পরিমাণে মধু পাওয়া যায়। গভীর বনের ভেতরে মাটির সমান্তরাল গাছে মৌচাক তৈরি করতে পছন্দ করে মৌমাছি। ভরা জোয়ারের সময় পানি থেকে কয়েক ফুট ওপরে থাকে মৌচাকগুলো। এরকম ঘন বনের ভেতর মৌচাক খুঁজে পাওয়ার জন্য দরকার অভিজ্ঞ চোখ আর কান। মৌমাছির শব্দ শুনেও মৌচাক খুঁজে বের করতে পারেন মৌয়ালেরা। যেসব মৌমাছি খলসি গাছের ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করে, তাদের মৌচাক থেকে সবচেয়ে উন্নতমানের মধু পাওয়া যায়।
সুবিধামতো জায়গা খুঁজে পাওয়ার পর মৌয়ালেরা তাদের মুখ গামছায় ঢেকে নেন। এরপর হেঁতালের পাতা কেটে সেগুলোর আঁটি বেঁধে নেন। তারপর সেই আঁটিতে আগুন জ্বালিয়ে ধোঁয়ার সৃষ্টি করে তা দিয়ে মৌচাক থেকে মৌমাছি তাড়ান তারা। এর ফলে মৌমাছির হুল ফোটানোর সংখ্যাও কমে যায়।
মৌচাক থেকে মধু সংগ্রহে দরকার হয় বিশেষ দক্ষতার। রানি মৌমাছি ও লার্ভার কোনো ক্ষতি না করে চাক কাটা হয়। এরপর সে চাক চিপে তা থেকে মধু বের করা হয়। ঠিকমতো করতে পারলে একটি মৌচাক থেকে ১০ কেজি পর্যন্ত মধু পাওয়া যায়। কেটে ফেলা চাক থেকে মোমও তৈরি করেন মৌয়ালেরা। তবে যে পরিমাণ ঝুঁকি মাথায় নিয়ে তারা কাজ করেন, সেদিক থেকে তাদের তৈরি করা মধু আর মোম অতি অল্প দামেই বিক্রি হয়।
মধু-সংগ্রহের প্রতিটি মৌসুমে বেশ কয়েকবার এ প্রক্রিয়ার পুনরাবৃত্তি করেন মৌয়ালেরা। পুরো দলের জন্য যথেষ্ট মধু সংগ্রহ করার পর তারা ফেরার পথ ধরেন। কখনো কখনো ১০০ কেজি মধুও সংগ্রহ করতে পারেন তারা, আবার কখনো কেবল এক ব্যারেল মধু নিয়েই ফিরতে হয় তাদেরকে।
সংরক্ষণাবাদীরা মৌয়ালদের নিয়ে দ্বিধাবিভক্ত। কেউ কেউ মনে করেন মৌয়ালদের এ মধু-সংগ্রহের কাজ করে যাওয়া উচিত, কারণ এতে তাদের সাথে জঙ্গলের সম্পর্ক আরও গভীর হয়। তাই তাদের শ্রমের যথার্থ মূল্য দেওয়ার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার। অন্যদিকে আরেকদল মনে করেন মৌয়ালদের উচিত মৌমাছি পালন করা, যাতে করে তাদের জীবিকানির্বাহের একটি স্থায়ী ও নির্ভরযোগ্য উপায় তৈরি হয়। এতে করে মৌয়ালদের জীবনের নিরাপত্তাও বৃদ্ধি পাবে। তবে আপাতত বনবিবির ভরসাতেই জঙ্গলের ভেতরে গিয়ে মধু-সংগ্রহের কাজটি করে যাচ্ছেন সুন্দরবনের মৌয়ালেরা।
সূত্র: রাউন্ডগ্লাস সাসটেইন
লেখা: সাসটেইন টিম
ছবি: ধৃতিমান মুখার্জি