ঘুঘুর গুঞ্জনে পাখি দেখা
এক জোড়া তিলা ঘুঘু দিনের বেলার বিভিন্ন সময়ে ঘুরররর ঘু ঘুরররর ঘু করে আমাদের ফ্ল্যাটের আশপাশে ডাকত। মন খারাপ করা করুণ সুরের সেই উদাস ডাক অলস মধ্যাহ্নে বাড়ির পাশের বাঁশঝাড়ে শনশন করে বয়ে যাওয়া হাওয়ার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
কখনো বারান্দার গ্রিলের ওপর কখনো বা টবে লাগানো গাছের ডালে বসে এক নাগাড়ে ডেকে যেত। একদিন দেখি নীল অপরাজিতার টবের মাটিতে বেশ যুৎ করে বসে আছে জোড়ের একটি। কাছে যেতেই ঝটপট উড়ে যায়। টবের যেখানটায় বসে ছিল, সে জায়গার মাটি এদিক ওদিক সরিয়ে নিচু করা, বেশ পরিষ্কার। ওখানে ডিম পাড়তেই বসে ছিল কি না কে জানে।
ঘুঘুরা মাটিতে ডিম পাড়ে কি না জানা নেই। পক্ষীবিশারদ সালিম আলী তার সাধারণ পাখি বইতেও মাটিতে ডিম পাড়া নিয়ে কিছু লেখেননি।
পাখি দেখা আমার নেশা নয়, তবে কিছু পাঁড় বার্ড ওয়াচার আছেন, পাখি দেখার জন্য গলায় শক্তিশালী বাইনোকুলার ঝুলিয়ে বনবাদাড়ে ঘুরে বেড়ান। এঁদের ওস্তাদ হচ্ছেন, ভারতের সালিম আলী। পাখি বিষয়ক তার অনেকগুলো বইয়ের মধ্যে আছে আত্মজীবনী দ্য ফল অভ দ্য স্প্যারো,বাংলা অনুবাদে বইটির নাম চড়াই উতরাই। তার একজায়গায় তিনি লিখেছেন, ''ছেলেবেলায় ক্লাসে বসে ক্ষেত্রমিতির অখাদ্য সব অঙ্ক কষার চেয়ে আমি ঢের বেশি ভালবাসতাম মনোরম পরিবেশে মনের সুখে পাখির পিছনে ছুটতে।''
বইয়ের শেষপ্রান্তে এসে লিখেছেন, "কোলাহলময় বিশৃঙ্খল তালগোল পাকানো অনিশ্চিত যান্ত্রিক সভ্যতার ছুটে চলা ডামাডোল থেকে পাহাড় বা গভীর অরন্য যেখানে সকল প্রত্যাশা পরিতুষ্ট হয় এমন জায়গায় নিজেকে সরিয়ে নেওয়ার অজুহাতে আমার মুক্তির উপায় ছিল পাখি দেখা। হতে পারে এটা একধরনের পলায়নী প্রবৃত্তি, তবে সেটা এমনই, যার জন্য কোনো যুক্তি দেখানোর দরকার পড়ে না।"
ভারতীয় উপমহাদেশের পাখিদের স্বভাবচরিত্র, আচার-আচরণ, জীবনযাত্রার খুঁটিনাটি পর্যবক্ষণ করার কাজটি এঅঞ্চলে প্রথম শুরু করেছিলেন সালিম আলীই। পশ্চিমী সায়েবরাও কিছু কাজ করেছেন এখানকার পাখীদের ওপর, তবে সেসব ছিল তাদের শরীরের মাপজোক, পালকের রঙ, ডিমের আকার ইত্যাদি বিষয়ে। এখানকার পক্ষীসমাজের চরিত্র ও প্রবণতার বিষয়ে তাদের তেমন কোনো কাজ নেই, যা সালিম আলী করেছেন।
সত্যজিৎ রায় নাকি 'কাঞ্চনজঙ্ঘা' সিনেমার একটা দৃশ্যের জন্য একটা বিশেষ পাখি খুঁজছিলেন। খবর পেয়ে এক বৃদ্ধ এসে সত্যজিৎ রায়কে বললেন, আপনি আসলে কোন পাখি খুঁজছেন।
সত্যজিৎ রায় বললেন, হিমালয়ান বার্ড।
বৃদ্ধ বললেন, ওই নামের কোনো পাখি নেই।
সত্যজিৎ রায় বললেন, আছে।
বৃদ্ধ বললেন, আমি বলছি নেই এবং অবশ্যই নেই।
সত্যজিৎ রায় তোবড়ানো গালে সাদা দাড়িওয়ালা লোকটার দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলেন, আস্ত পাগল একটা। বিরক্ত হয়ে একজনকে বললেন, এই বুড়োকে সরাও।
অগত্যা বুড়ো লোকটিকে সঙ্গে নিয়ে গাড়িতে তুলে দেওয়া হয়। এসময় সত্যজিতের সহকারী পরিচালক হন্তদন্ত হয়ে এসে বললেন, ভারতের খ্যাতিমান পক্ষীবিশারদ সলিম আলী আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। তিনি কোথায় গেলেন?
সত্যজিৎ রায় জানতে চাইলেন, দেখতে কেমন?
বুড়ো, মুখে দাড়ি আছে, গালটা ভাঙা।
সত্যজিৎ রায় মাথা নিচু করে বললেন, তাকে তো পাগল মনে করে তাড়িয়ে দিয়েছি। কী লজ্জা!
কাহিনিটার কথা ড: মোহাম্মদ আমীনের বিখ্যাতদের কৌতুক, হাস্যরস ও প্রজ্ঞাযশ নামের বইতে উল্লেখ আছে। কিন্তু খটকা লাগে, উপমহাদেশের একনম্বর পাখি বিশারদ, যাঁকে এক নামে সবাই চেনে, তাঁকে সত্যজিত রায় চিনতে পারবেন না কেন?
মুম্বাই থেকে ঘন্টা তিনেকের দূরত্বে মিনি গোয়া নামে পরিচিত আলীবাগের কৃষ্ণসৈকতের কাছে কিহিম গ্রামে সালিম আলীর একটা বাড়ি আছে। বহুবছর আগে আলীবাগে দিন দুয়েক কাটানোর সুযোগ হয়েছিল। এখানকার জনবিরল চুপচাপ শান্ত প্রকৃতির কারণে নিসর্গপ্রেমী অনেকেই সপ্তাহান্তের ভ্রমণের জন্য আলিবাগকেই পছন্দ করেন। জায়গাটা দেখে বুঝতে পারি, জীবনের সেরা সময়টা এখানেই কাটাবার সুযোগ পেয়েছিলেন এই পক্ষীমানব।
যা-ই হোক, এক ঘুঘুর কথা বলতে গিয়ে বহুদূরে চলে গিয়েছিলাম। আমাদের বারান্দায় যে ঘুঘু দম্পতিকে দেখা যায়, সেটি তিলা ঘুঘু। বাদামি রঙের পাখিটির ডানায় যেন ছিট কাপড়ের নকশা আর ঘাড়ের দুপাশে কালোর ওপর সাদা সাদা ফুটকির জন্য এটাকে ছিটা ঘুঘুও বলা হয়। ঘুঘুর আরো কয়েকটা প্রজাতি আছে, রাজঘুঘু, লাল ঘুঘু, সবুজ ঘুঘু ইত্যাদি। তবে তিলা ঘুঘুই দেখা যায় সব জায়গায়। এমনকি এই প্রায়বৃক্ষহীন ঢাকা শহরেও ঘুঘুর ডাক শোনা যায় প্রায়ই।
তেমনই একজোড়া ঘুঘু ঘুরঘুর করত আমাদের বারান্দার আশপাশে, কখনো পুবের, কখনো উত্তরের বারান্দায়। মাসখানেক আগে মালী এসে জানায় উত্তরের বারান্দার অপরাজিতার ঘন ঝোপের মধ্যে ঘুঘুপাখি বাসা করেছে। ওকে কড়া নির্দেশ দেওয়া হয়, গাছের পরিচর্যা করতে গিয়ে কোনোভাবেই যাতে ওদের উৎপাত করা না হয়। ঘুঘু পাখি সরল নিরীহ প্রকৃতির হয় বলে জানি, তবে বাসাটা করেছে এমন জায়গায় যে কোনোভাবেই চোখে পড়ে না।
সেদিন মালী সেই বাসা থেকে একটা বাচ্চা ধরে এনে আমার স্ত্রীকে এসে নিরীহ মুখে জিজ্ঞেস করে, 'ম্যাডাম এইডা খাইবেন?' ওর চিৎকার চেঁচামেচি শুনে ছুটে গিয়ে দেখি ওকে যতই বলা হচ্ছে এক্ষুণি ওটাকে বাসায় রেখে আসো। ও ভ্যাবাচেকা খেলেও বলতে থাকে, 'ক্যান, হগলতেই কিন্না খায়।' আমি কঠিন গলায় বলি, 'হগলতে খাউক গিয়া, তুমি এই মুহুর্তে ওটাকে ওর বাসায় রেখে দাও।'
বেজার মুখে নির্দেশটা পালন করে ও। এসময় বাচ্চাটার মা বাবা কেউই বাসায় ছিল না। থাকলে বাচ্চা চুরি যাচ্ছে দেখলে কি করত জানি না, বোধ হয় ছটফট করত, হামলা করত না। আমাদের বাসার পেছনে রান্নাঘরের বারান্দার বাইরের কার্নিশে এক শালিক বাচ্চা দিয়েছিল। বাসার গৃহকর্মী মহিলাটি সেদিকে গেলেই মা শালিক এমন চেঁচামেচি করত যেন বাসায় ডাকাত পড়েছে। একবার মহিলাকে ঠুকরেও দিয়েছিল।
বাচ্চাটাকে ওটাকে রেখে আসার কিছুক্ষণ পর ঝোপের আড়ালে থাকা বাসাটা খুঁজে বের করতে পারি। আন্দাজে হাত বাড়িয়ে ছবি তুলে খুব কাছে থেকে দেখার সুযোগ পাই। সাধারণত একজোড়া বাচ্চা হয় পাখিদের, কিন্তু এখানে একটা। হয়তো একটাই ডিম পেড়েছিল, কিংবা একটা হয়তো তুফানে নিচে পড়ে গেছে। বাচ্চাটার দৃষ্টিতে ভয় আর অভিমানী ভাব।
এখনো পালক গজায়নি, উড়তেও শেখেনি। এরকম একটা বাচ্চাকে খেয়ে ফেলার কথা ভাবছিল ব্যাটা মালী! আমাদের মধ্যে আসলে জীবে দয়া বা প্রেম বলে কিছু নেই। সবকিছু খেয়ে ফেলার একটা লোভ যেন ভেতরে পাক খেতে থাকে।
একবার রমনা পার্কে নাগলিঙ্গম ফুলের ছবি তুলছিলাম। এসময় খাদক প্রকৃতির একজন পাশে এসে দাঁড়ায়, জিজ্ঞেস করে, ভাই এইডা কী ফুল? ফুলের নামটা বলার পরের প্রশ্ন ছিল, এইডা খাওন যায়? আমি থ মেরে যাই, ভাবি, ফুলের সৌন্দর্যটা চোখে পড়ল না, খাওয়ার কথাই সবার আগে মনে পড়ল? তাই প্রশ্নটা না শোনার ভাব করে ক্যামেরার ভিউ ফাইন্ডারের ভেতর দিয়ে ফুলটার বৈশিষ্ট্যগুলো দেখতে থাকি।
সেদিন এদিক-সেদিক ঘুরে চলে আসার সময় চোখে পড়ল, সেই খাদক লোকটি একটা লম্বা লাঠি দিয়ে নাগলিঙ্গম ফুল পাড়ার চেষ্টা করছে। বাসায় নিয়ে গিয়ে মনে হয় কুমড়ো ফুলের বড়ার মতো ভেজে খাওয়ার চেষ্টা করবে।
নিজ ঘরের বারান্দায় একদম হাতের কাছে ঘুঘু বাসা করেছে জানতাম, তবে সেদিনের আগে কখনোই চোখে পড়েনি। কয়েক বছর আগে সুন্দরবনের ঘাগড়ামারি ফরেস্ট ফাঁড়ির ভেতরের বনে নিচু গাছে একটা তিলা ঘুঘুকে বাসায় বসে ডিমে তা দিতে দেখছিলাম। খুব কাছে থেকে ছবি তুললেও নড়েনি বাসা ছেড়ে। তার মানে আমাকে খুব গেরাহ্যি করেনি ওটা।
সেদিন বকা খেয়ে মালী ঘুঘুর ছানাটাকে বাসায় রেখে আসার পর, মা ঘরে ফিরলে বাচ্চাটা নিশ্চয়ই ওর বিভীষিকাময় অভিজ্ঞতার কথা বলেছিল। তাই সেদিনের পর থেকে ওটাকে প্রায়ই দেখতাম কাছে বসে পাহারা দিতে। সেদিন দেখি বারান্দার গ্রিলে বসে আছে। তারপর গিয়ে বসে মধুমঞ্জরীর ঝাড়ে, একেবারে ফোটা ফুলের পাশ ঘেঁষে, দেখতে মনে হচ্ছিল যেন মহারাণী ভিক্টোরিয়া বসে আছেন।
ছবি তুললাম বেশ কাছ থেকে। আমার দিকে ঘাড় ফিরিয়ে একবার চোখ কুঁচকে সন্দিগ্ধ চোখে চাইল, সরে গেল না। বুঝতে পারলাম সাহস বেড়েছে বেশ। কিংবা বুঝতে পেরেছে, আমি শত্রুপক্ষের একজন নই। পাখি বিশেষজ্ঞ প্রকৃতিপ্রেমী ইনাম আল হক লিখেছেন, 'পাখিদেরও আছে নাকি মন।'
আমি বার্ড ওয়াচার নই, এমনিতে চোখে পড়লে পাখিদের দেখি, ভালো টেলি লেন্স থাকলে বার্ড ফটোগ্রাফি করতাম হয়তো। বাংলাদেশে কয়েকজন খুব ভালো বার্ড ফটোগ্রাফার আছেন, তাদের দুজনকে চিনি, একজন প্রাক্তন সচিব জালাল আহমেদ, আরেকজন পুলিশ কর্মকর্তা আনসারউদ্দীন খান পাঠান।
একবার গ্রামে ঘাসের মধ্যে চড়ে বেড়ানো একটা মোহনচূড়া পাখির ছবি তুলতে পেরেছিলাম। সেটা ফেসবুকে আপলোড করার পর কেনিয়ায় পরিচয় হওয়া বার্না লিখল, এই পাখি তোমাদের দেশে পাওয়া যায় জানতাম না, ভেবেছিলাম কেবল পূর্ব আফ্রিকাতেই মেলে বুঝি, এটার নাম হুপি।
এখানে বলা দরকার, অতি চমৎকার সাদা কালো আর মাথায় একটা লম্বা ঝুঁটিওয়ালা ডোরা বাদামী রঙের এই পাখিটা হুদহুদ নামেই পরিচিত। মাঠ থেকে বীজ, পোকামাকড় ঠুকরে খায় বলে এটাকে মাঠঠোকরাও বলে। কথাসাহিত্যিক বনফুল এটার নাম দিয়েছিলেন, মোহনচূড়া।
সে যাত্রায় কেনিয়া গিয়ে কয়েকটা পাখি জীবনে প্রথমবারের মতো দেখেছিলাম খুব কাছ থেকে। নাইরোবির হোটেল ইন্টারকান্টিনেন্টালের লনে বসেছিলাম, সন্ধ্যা নেমে আসছে ধীরে। এমন সময় চেখে পড়ে বিশাল ডানাওয়ালা বড়সড় একটা পাখি ডানা ভাসিয়ে উড়ে যাচ্ছে মাথার ওপর দিয়ে।
ভঙ্গিতে মনে হচ্ছে কাছেই কোথাও গিয়ে ল্যান্ড করবে প্লেনের মতো। কিছুক্ষন পর আর একটা, তারপর আরও একটা। ওগুলোর গন্তব্য অনুসরন করে গিয়ে দেখি, হোটেলের সামনে একটা বড় গাছের ওপর এসে বসছে পাখিগুলো। এতো বড় পাখি আগে দেখিনি। শকুন দেখতাম ছোটবেলায়, আজকাল আর দেখা যায় না।
পাখিগুলো উড়ে এসে গাছের ডালে বসছে, ওদের ভার সইতে না পেরে নুয়ে যাচ্ছে ডালগুলো, বেগতিক দেখে আবার ডানা ঝাপটিয়ে ডাল বদল করে নিচ্ছে। আমাদের অনভ্যস্ত চোখে অবাক করা দৃশ্য। তখনও দিনের আলো ফুরিয়ে যায়নি, তাই বেশ কিছু ছবি তোলা গেল পাখিগুলোর। আফ্রিকায় প্রথমবারের মতো প্রাণীর ছবি তুলতে পেরে নিজেকে ওয়াইল্ড লাইফ ফটোগ্রাফার বলে মনে হচ্ছিল।
পরে পাখিগুলোর নাম জেনেছি, মারাবু স্টর্ক। ওদের গলার নিচে একটা থলের মতো থাকে খাবার জমিয়ে রাখার জন্য, রাতের বেলায় গাছের ডালে বসে টুন টুন শব্দ করতে থাকে।
বৈশাখী মেলায় পোড়ামাটির যে ঘণ্টা পাওয়া যায়, অবিকল সেই ঘণ্টার শব্দ। পাখির গলা দিয়ে এরকম শব্দ বের হয়, বিশ্বাস হয় না, মনে হয় গলাতেই ঝোলানো রয়েছে ঘণ্টা।
পরে মাসাইমারার রিসর্টের পেছনে বয়ে যাওয়া খালের উল্টো পারে লম্বা একাশিয়া গাছের ডালে রাতের আশ্রয়ে আসা একঝাঁক মারাবু স্টর্ক দেখেছিলাম। ক্রমাগত টুন টুন শব্দের কোরাসে মনে হচ্ছিল বৈশাখি মেলা থেকে মাটির ঘণ্টা কিনে একদল ছেলেমেয়ে সেগুলো বাজিয়ে যাচ্ছে। সে শব্দ ছাপিয়ে মাঝে মাঝে দূর থেকে ভেসে আসছে বিভিন্ন রকমের ডাক।
মাউন্ট কেনিয়া সাফারি ক্লাবের পশুদের অনাথালয়ে খুব চমৎকার ময়ুরের মতো একটা পাখি দেখেছিলাম, মাথার ওপর মুকুটের মতো একটা ঝুঁটি, নাম 'ক্রাউন স্টর্ক,' উগান্ডার জাতীয় পাখি। হাতের তালুতে নিয়ে শস্যদানা রেখে হাত বাড়িয়ে দিলে পাখিটা ঠুকরে ঠুকরে সেগুলো খেয়ে নিয়েছিল। খাওয়ার লোভেই বোধহয়, রাজকীয় ঝুঁটিওয়ালা পাখিটা উগান্ডার জাতীয় পাখির সম্মানবোধ অগ্রাহ্য করে আমাদের পেছন পেছন ঘুরছিল।
সেখানেই দেখতে পাই খোলা মাঠে ঘুরে বেড়ানো বিশালকায় এক উটপাখি। গাইড জেমস জানায় পাখিটা মাদী। বিশাল পাখিটার শরীরে রোদে জলে বিবর্ণ ঘরের চালের শনের মতো পালক, অবিন্যস্ত অসুন্দর। সেই খোলা জায়গাটার একপাশে বুক সমান উঁচু তারের জালির ঘেরার ওপাশে সাদা কালো পালকের আরেকটা উটপাখি বেশ অস্থির ভঙ্গিতে এদিক ওদিক ছোটাছুটি করছিল। ওটার বলশালী মাংশল নিরাবরন গোলাপি উরু আর পরিচ্ছন্ন পরিপাটি পালক দেখে বোঝা যায় পুরুষ পাখি। ওটাকে দেখেই প্রাণীকুলে মানুষ ছাড়া অন্যান্য প্রাণীদের মধ্যে পুরুষরা যে সুন্দর হয়, সেটা উপলব্ধি করি।
জেমস জানায় সঙ্গিনীর খোঁজ করছে বেচারা, এটা তারই একধরনের নাচের ভঙ্গি। মাঝে মাঝে গলাটা বাঁকিয়ে নিচু করে ডানা কাঁপিয়ে দৌড়ে ছুটে যাচ্ছিল, আবার ফিরে আসছিল একই ভাবে, মাথাটা উদ্ধত ভঙ্গিতে উঁচু করা। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে এই অভুতপূর্ব দৃশ্য দেখার পর বোঝা যায় এই ছোটাছুটির মধ্যে নৃত্যের মতো একটা নির্দিষ্ট প্যাটার্ন আছে। জেমস বলে না দিলে বুঝতে পারতামনা এই অস্থির নৃত্যের মুদ্রা হচ্ছে বিরহের আকুতি।
জেমস সাবধান করে বলেছিল, এসময় মেজাজটা চড়ে থাকে ওদের। খুব কাছে যাবেন না, ঠুকরে দিতে পারে। অদ্ভুত ব্যাপার, অথচ ওটার সঙ্গিনীটা দিব্যি নির্বিকার ভেতরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। একটু আগে ওটাকে ভুট্টাদানা খাইয়ে এসেছি।
পাখি সম্পর্কে বিশেষ কিছুই জানি না আমি। তবে কখনো হঠাৎ বারান্দার গ্রিলে দুয়েকটা পাখি এসে বসে, বুলবুলি, টিয়া, একবার একটা হলুদ বেনেবউ পাখিকেও বসতে দেখেছিলাম। বারান্দার টবে কামরাঙ্গা ধরে পেকে ঝরেও যায়, পাখিরা এই ফল খুব পছন্দ করে বলে মনে হয় না। দুয়েকবার কয়েকটা টিয়াকে দেখেছি কামরাঙ্গা ফল ঠোকরাতে। খুব টক বলেই হয়তো কর্কশ ডাক ছেড়ে আবার উড়ে গিয়েছিল। ভাবছি টবে কয়েকটা করমচা লাগাব, তখন হয়তো আরো কিছু পাখি আসবে। ফলটা নাকি পাখিদের বেশ প্রিয়।
এক ঘুঘু দম্পতির কথা বলতে গিয়ে অপ্রাসঙ্গিক অনেক কথা এসে গেল। ঘুঘুর বাচ্চাটা বড় হয়ে উড়তে শিখলে ওর মা বাবা কি আর আসবে? ক্লান্ত দুপুরে বসে করুণ স্বরে ঘুররর ঘু ঘুররর ঘু করে ডেকে ডেকে আর কি চারপাশ সিক্ত করে তুলবে? জীবনানন্দ ঠিকই বলেছিলেন, "এখানে ঘুঘুর ডাকে অপরাহ্নে শান্তি আসে মানুষের মনে; ... একবার দু'পহর অপরাহ্নে যদি এই ঘুঘুর গুঞ্জনে/ ধরা দাও তাহলে অনন্তকাল থাকিতে যে হবে এই বনে;...।"
লেখক: কথাসাহিত্যিক, অনুবাদক