সৌখিন মৎস্য শিকার: ব্যয়বহুল শখের হাজার কোটি টাকার বাজার
৩৫ বছর ধরে মাছ শিকার করছেন মোস্তাফিজুর রহমান লিটন। শুক্রবার এলেই মাছ ধরতে নেমে পড়েন তিনি।
"মাছ শিকার আমার কাছে নেশার মতো হয়ে গেছে," বলছিলেন তিনি।
নেশার মতো এই শখে কিন্তু খরচও কম নয়। মাছ শিকারের জন্য নির্দিষ্ট পুকুরে মাছ ধরতে হলে কাটতে হয় টিকিট, যার মূল্যও কম নয়।
গত ১৬ জুন রাজশাহীর দামকুড়া হাট কাঁকন রোড শিউলী তলা ভাটার পুকুরে মাছ ধরার সময় পাওয়া যায় তাকে। এখানে প্রতিটি আসনের মূল্য ১৬ হাজার টাকা। ৫ বিঘা আয়তনের এই পুকুরে আসনসংখ্যা ১৬টি। টিকিটে উল্লেখ করা হয় মাছের ওজন ৪০০ গ্রাম থেকে ৭ কেজি পর্যন্ত।
দেখা যায় নির্ধারিত আসনে দলগত ভাবে সবাই মাছ শিকার করছেন। এক একটি আসনে আট থেকে দশটি ছিপ ফেলা হয়েছে। একেকটি আসনে কয়েকজন মিলে গ্রুপভিত্তিকভাবে শিকার করছেন মৎস্যশিকারীরা।
লিটন জানালেন, তিনি সকাল ৬টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত ১১ টা কাতল মাছ ধরেছেন। এছাড়া রুই, মৃগেল ও গ্লাসকার্প শিকার করেছেন বলেও জানান।
তিনি আরো বলেন, সর্বোচ্চ ৩৫ হাজার টাকার টিকিটে মাছ শিকার করেছেন তিনি। ডালাসের পুকুরে তিনি ১৫ কেজি ওজনের কাতল শিকার করেছেন। গত কয়েকদিন আগেও শিবপুরের পুকরে তিনি সর্বোচ্চ ১১ কেজি ওজনের মাছ শিকার করেছেন।
এসব পুকুরে টিকিটের মূল্য ছাড়াও ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা যায় মাছ শিকারের টোপ ও চার কিনতে। এছাড়া অন্যান্য খরচ তো রয়েছেই।
দেশে বর্তমানে সৌখিন মৎস্য শিকারীর সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। সারাদেশেই প্রতি বৃহস্পতিবার বিকেল থেকে শুক্রবার বিকেল পর্যন্ত চলে মাছ শিকার। বিশেষ করে কার্প জাতীয় মাছ শিকারীর সংখ্যাই বেশি। যেহেতু রাজশাহীতে দেশের মধ্যে ৮০ শতাংশ কার্প জাতীয় মাছ উৎপাদন হয় তাই রাজশাহীতে সৌখিন মৎস্য শিকারীর সংখ্যাও বেশি।
এছাড়া দেশের মধ্যে নাটোর, নওগাঁ, গাজীপুর, টাঙ্গাইল, ঢাকা, কিশোরগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম, যশোর ও খুলনাসহ প্রায় প্রতিটি জেলাতে মৎস্য শিকারীর সংখ্যা বাড়ছে।
লিটনের মতো একই পুকুরে মাছ ধরতে আসা আরেক মৎস্য শিকারী পিয়ারুল ইসলাম বলেন, "টাকার চেয়ে আমাদের শখের মূল্য বেশি। শখের কারণে এমনও এক একজন আছেন যারা সারাদিন কিছুই খান না। একটা চা কিংবা বিস্কুটও না।"
"আমাদের টিকিটের মূল্য ১৬ হাজার টাকা কিন্তু ১৬ হাজার টাকা মূল্যের মাছ অনেকে নাও পেতে পারে। তাই বলে কিন্তু কেউ নিরাশ হয় না।"
মাছ শিকার করতে তারা আটা, ময়দা, পিঁপড়ার ডিম, চার, ছাতু, ভুট্টার ছাতু, কয়েক রকমের খৈল, ফিড, ভাসমান ফিড, ডুবন্ত ফিডসহ নানা ধরনের উপাদান ব্যবহার করেন বলে জানান পিয়ারুল।
মৎস্য শিকারী, আয়োজক ও মৎস্য শিকারের সরঞ্জামাদি বিক্রির দোকানদারদের মতে, দেশে মৎস্য শিকারকে কেন্দ্র করে কমপক্ষে কয়েক হাজার কোটি টাকার মতো ব্যবসা হয়।
মৎস্য শিকারের একেকটি টিকিটই বিক্রি হয় ৫ হাজার থেকে ৬০ হাজার টাকা পর্যন্ত। পুকুরের আয়তন অনুসারে এক একটি পুকুরে মাছ ধরার আসন সংখ্যা থাকে ১০ থেকে ৬০ টি পর্যন্ত।
এক একজন মৎস্যশিকারী একদিনের মাছ শিকারের জন্য কমপক্ষে পাঁচ কেজি পিঁপড়ার ডিম ক্রয় করেন যার বাজারমূল্য কেজিপ্রতি ১৩০০ থেকে ৩০০০ টাকা পর্যন্ত। এছাড়া মাছের জাতভেদে প্রয়োজন পড়ে বিভিন্ন ধরনের টোপ ও চার। তাতে আরও চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা খরচ পড়ে।
মাছ শিকারে প্রয়োজন হয় বিভিন্ন ধরনের ছিপ ও বড়শি। যেগুলোর দামও অত্যন্ত ব্যয়বহুল। বাজারে ৫০০ টাকা থেকে ৭ লাখ টাকা দাম পর্যন্ত মাছ ধরার ছিপ পাওয়া যায় যাকে ফিশিং রড বলে। এছাড়া ফিশিং রিল পাওয়া যায় ৩০০ থেকে ৪ লাখ টাকা দাম পর্যন্ত। বড়শি বিক্রি হয় প্রতি পিস ১ টাকা থেকে ১০০০ টাকা পর্যন্ত।
আবার বেশি দামের টিকিটের ক্ষেত্রে পুরষ্কারের ঘোষণাও থাকে। প্রথম পুরস্কার ১ লাখ থেকে ৬ লাখ টাকা পর্যন্ত দেওয়া হয়ে থাকে। কোথাও কোথাও গ্রুপভিত্তিক মাছ শিকার চলে আবার কোথাও একটি আসনের বিপরীতে কয়টি ছিপ ফেলা যাবে তা টিকিটে উল্লেখ করা থাকে।
রাজশাহীতে প্রায় সারাবছর বিভিন্ন পুকুরে প্রতি শুক্রবার মৎস্য শিকার চলে। বিশেষ করে বৃহস্পতিবার বিকেল থেকে শুক্রবার সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে এই মৎস্য শিকার। কোথাও কোথাও শনি ও রোববারও মৎস্য শিকার চলে। এই মাছ শিকারের ঘোষণার জন্য পোস্টার ও লিফলেট বিতরণ করা হয় যা ছিপ বড়শীর দোকানে সাঁটানো থাকে। অনেক সময় মাইকিং করেও ঘোষণা করা হয়। একই দিনে কয়েকটি পুকুরেও চলে মাছ শিকার।
এই খাতের উদ্যোক্তা রবিউল ইসলাম জানান, তিনি ভাটার পুকুরে তিন বছর ধরে মাছ শিকারের আয়োজন করছেন। তার ছোট ছোট আরও কয়েকটি পুকুর আছে। সেইসব পুকুরে মাছ বড় করে এই পুকুরে নিয়ে এসে ছাড়েন। তারপর মাছ শিকারের টিকিটের আয়োজন করেন।
গত ১০ ও ১১ জুনও রাজশাহীর শিবপুরে মাছ শিকারের আয়োজন করা হয়। মাছ শিকারের টিকিট থেকে দেখা যায়, শিবপুর বাজার থেকে ৩০০ ফিট সামনে প্রীতি কোল্ডস্টরের পিছনে ভাটার পুকুরে ছিলো এ মাছ শিকারের আয়োজন। পুকুরের আয়তন ২০ বিঘা। মাছের আকার ছিলো ১ কেজি থেকে ১৮ কেজি পর্যন্ত। টিকিটের মূল্য ছিলো ১৮ হাজার টাকা। আসন সংখ্যা ২৩টি।
পুকুর মালিকদের একজন মনির জানান, গত দুই বছর ধরে তারা পুকুরে টিকেটের মাধ্যমে মাছ শিকারের আয়োজন করে আসছেন। এ বছর গত মে মাসে তারা ২৫ হাজার টাকা করে টিকিটের দাম রেখেছিলেন। পরে তা ১৮ হাজার টাকায় নিয়ে আসেন।
এছাড়া, গত ২৩ ও ২৪ জুন চট্টগ্রামের আমানবাজার শিকারপুরে ঐতিহ্যবাহী ইউনুছ মিয়ার পাঁচ কড়ি চৌধুরী দিঘীতে প্রথমবারের মতো মৎস্য শিকারীদের জন্য টিকিটের আয়োজন করেছিলেন পুকুরের ইজারাদার জিয়াউদ্দিন বাবলু। মৎস্য শিকারের আসন সংখ্যা ছিলো ৪০টি। টিকিটের মূল্য ছিলো ১৫,৫০০ টাকা।
তিনি মুঠোফোনে এই প্রতিবেদককে জানান, সেদিন একইদিনে আরও সাতটি পুকুরে মৎস্য শিকারের আয়োজন থাকায় তার পুকুরের সর্বমোট ২৭টি টিকিট বিক্রি হয়েছিলো। পুকুরে রুই, কাতল, মৃগেল, কালিবাউশ ও কার্প জাতীয় মাছসহ সর্বোচ্চ ১৪ কেজি ওজনের মাছ ছিলো বলে দাবি তার।
তিনি জানান, এই পুকুরটি তিনি তিন বছরের জন্য ইজারা নিয়েছেন তিনি। তিনবছরই মৎস্যশিকারের আয়োজন করবেন তিনি।
গত ২৩ জুন চট্টগ্রামের খেজুরতলা বেড়িবাঁধ উত্তর কাট্টলীতে ঐতিহ্যবাহী ইলিয়াস-নাছির প্রজেক্টে মৎস্য শিকারের আয়োজন ছিলো । তৃতীয়বারের মতো টিকেটের মূল্য ছিলো ৯০০০ টাকা। এছাড়া একইদিনে চট্টগ্রামের হাটহাজারী ফতেয়াবাদ আদর্শ বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের দীঘিতে মৎস্য শিকারের আয়োজন করা হয়। আসন সংখ্যা ছিলো ৩৬টি। টিকেটের মূল্য ১২,৫০০ টাকা।
গত ১৭ ও ১৮ জুন কিশোরগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী কাটাবাড়িয়া বড় পুকুরে ১৮ হাজার টাকার টিকিটের বিনিময়ে মৎস্য শিকারের আয়োজন করা হয়। আসন সংখ্যা ছিলো ৬০ টি। পুকুরের আয়তন ছিলো ২০ বিঘা।
গত বছর ২৭ আগস্ট কিশোরগঞ্জের হোসেনপুর কুড়িমারা পুকুরে মৎস্য শিকারের আয়োজন করা হয়ে। সেখানে টিকিটের মূল্য ছিলো ৩৫ হাজার টাকা। প্রথম পুরস্কার রাখা হয় ৪ লাখ টাকার প্রাইজবন্ড, ২য় পুরস্কার ছিলো ২ লাখ টাকার প্রাইজবন্ড, ৮ম পুরস্কার ছিলো ৫০ হাজার টাকার প্রাইজবন্ড।
অন্যদিকে, টাঙ্গাইলের ঐতিহ্যবাহী জেলা সদর লেকে গত ২৪ জুন ৩৫ হাজার টিকিটে মৎস্য শিকার প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। সেখানে আসন সংখ্যা ছিলো ১০১টি। প্রথম পুরস্কার ৬ লাখ টাকার প্রাইজবন্ডসহ মোট ১০টি পুরস্কার ছিল।
টাঙ্গাইলের সৌখিন মৎস্য শিকারী সমিতির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আজগর আলী জানান, ১৯৮০ সাল থেকে টাঙ্গাইলের ঐতিহ্যবাহী জেলা সদর লেকে মৎস্য শিকারের প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। প্রতিবছর দুই বার এ আয়োজন করা হয়। ২২ জুলাই আবার এ প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। প্রতিবার ৩৫ হাজার টিকিট ও প্রথম পুরস্কার ৬ লাখ টাকার প্রাইজবন্ডসহ দশটি পুরস্কার দেওয়া হয়। মোট ১৫ লাখ ৩০ হাজার টাকার পুরস্কার দেওয়া হয়।
ছিপ-বড়শীর দোকান
রাজশাহীতে 'প্রিমিটিভ ফিশিং বাই আকিব' নামে এইচ আতাউর রহমানের একটি ছিপ বড়শীর দোকান আছে। তিনি একজন সৌখিন মৎস্য শিকারীও। নিজেই টোপ ও চার তৈরি করেন। এসব কাজে তাকে সহযোগিতা করছেন ১৫ জন প্রশিক্ষিত কর্মী। প্রতিদিন সাড়ে তিন মেট্রিক টন টোপ ও চার উৎপাদন করেন তারা।
আতাউর জানালেন, আগুনজল নামের একটি ফেরোমন স্প্রে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে শুধু তার কারখানাতেই তৈরি হয়। বড় মাছকে আকৃষ্ট করার জন্য টোপে এই আগুনজল স্প্রে করা হয়। এ ছাড়া তার কিছু জনপ্রিয় টোপ ও চার রয়েছে।
এশিয়া ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হচ্ছে আকিবের টোপ ও চার। ভারত ও নিউজিল্যান্ডে নিজস্ব বিক্রয়কেন্দ্র খোলার উদ্যোগ নিয়েছেন তিনি। এছাড়া ঢাকার মেরুল বাড্ডাতেও তার শো-রুম রয়েছে।
আতাউর রহমান জানান, ভারত ও মালয়েশিয়াতে তিনি প্রতিবছর ১০০ মেট্রিক টন টোপ ও চার রপ্তানি করেন। ইউরোপে যাচ্ছে তার টোপ ও চার।
তিনি জানান, টোপ ও চার ব্যতিত তার শো-রুমে নানা ধরনের ও নানা ব্র্যান্ডের ফিশিং রড, রিল ও বড়শী রয়েছে। তার শো-রুমে ৩০০ টাকা থেকে ১ লাখ ১০ হাজার টাকা দামের ফিশিং রিল, ৫০০ টাকা থেকে ৮৫ হাজার টাকার ফিশিং রড ও ১ থেকে ১০০০ টাকা পিসের বড়শী রয়েছে। বিদেশ ছাড়াও দেশের বিভিন্নস্থানে তার পণ্য বিক্রি হয়। কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে তিনি সারাদেশেই টোপ ও চার বিক্রি করেন।
তিনি মনে করেন, দেশে মৎস্য শিকারকে কেন্দ্র করে কমপক্ষে ১০ হাজার কোটি টাকার ব্যবসা হয়।
"এটা একটা বৈধ জুয়া খেলার মতো," বলেন তিনি।
একই ধরনের প্রায় ১৫-২০টি দোকান রয়েছে রাজশাহীতে।
রাজশাহীর সাহেব বাজারে রয়েছে মাসুমের পাইকারী ও খুচরা ছিপ বড়শীর দোকান 'জলদি খাও'। তিনিও নিজেই টোপ ও চার তৈরি করেন। এছাড়া মাছ শিকারের রড, রিল ও বড়শী তিনি বিক্রি করেন। শুধু অনলাইনেই তার লাখ লাখ টাকার পণ্য বিক্রি হয় বলে জানান তিনি।
অন্যদিকে ঢাকার চকবাজার পাইকারি ছিপ-বড়শীর দোকানের জন্য বিখ্যাত। ঢাকার চকবাজারের ফিসিং লাইন স্টোরের সত্ত্বাধিকারী মো. ইয়াছিন জানান, তার দোকানে বড়শি, ছিপ, টোপ, সেন্ট ও চারসহ সব পাওয়া যায়। দোকানে রড ৫০০ থেকে আড়াই লাখ টাকা, রিল ৩৫০ থেকে ৩৫ হাজার টাকা ও বড়শী ১০০০ পিসের দাম ২৮০ থেকে ৩৫০০ টাকা পর্যন্ত বলে জানান তিনি।
তিনি জানান, চকবাজারে একশো থেকে দেড়শো খুচরা ও পাইকারী দোকান রয়েছে। সারাদেশেই চকবাজারের পণ্য যায়। মৎস্য শিকারকে কেন্দ্র করে দেশে বিশাল আকারের বাজার রয়েছে। তার কাছ থেকে পণ্য কিনে সারাদেশে ছোট বড় অনেক উদ্যোক্তা তৈরি হচ্ছে।
চট্টগ্রামের বক্সীরহাটে সবচেয়ে পুরাতন দোকান শাহ ফিশিং। ১৯৬১ সাল থেকে তারা মাছ শিকারের সরঞ্জামাদি বিক্রি করছেন। তৈরি করেন নিজস্ব টোপ ও চার। সারাদেশেই অনলাইনে তাদের পণ্য যায়।
শাহ ফিশিংয়ের ইনচার্জ মো. আরিফ জানান, "সারাদেশেই আমাদের পণ্য যায়। আমরা বিদেশ থেকে সরঞ্জামাদি আমদানি করে তা পাইকারি বিক্রি করি। আর টোপ ও চার নিজেরাই তৈরি করি।"
"ফিশিং ব্যবসার আকার টাকার অঙ্কে বোঝানো মুশকিল। কেউ সেই তথ্য দিতেও চাইবে না," বলেন তিনি।