জার্মান বুচার: বাংলাদেশে প্রথম সসেজ, বেকন বানানো শুরু করেন এক বিদেশি দম্পতি!
ইঞ্জিনিয়ারিং প্রজেক্টের কাজে আশির দশকের শেষদিকে ঢাকায় এসেছিলেন ফেরেঞ্জ গেওর্গি। একটু স্পষ্ট করে বলতে গেলে সময়টা ছিল ১৯৮৭-৮৮ সাল। এসেছিলেন প্রজেক্টের কাজে, তবে এই দেশে তিনি বসবাস করেছেন দীর্ঘদিন। ঢাকায় থাকতেন গুলশানে। ওঠাবসা ছিল বিভিন্ন বিদেশিদের সাথে। তাই পাঁচ তারকা হোটেলগুলোতেও তার আসা-যাওয়া ছিল।
জাতিগতভাবে গেওর্গি ছিলেন একজন হাঙ্গেরিয়ান। ইউরোপীয় হওয়ায় সকালের নাস্তায় কিংবা স্ন্যাক্স হিসেবে সসেজ ছিল সেখানকার নিত্যদিনের খাবার। হয়তো এ কারণেই তিনি ছিলেন সসেজের প্রতি নস্টালজিক। কিন্তু সে সময় বাংলাদেশে এ ধরনের খাবারের কোনো চলই ছিল না। বিদেশি ক্লাব বা পাঁচ তারকা হোটেলগুলোর মতো জায়গাতেও সেই সুযোগ ছিল না। ফলে দেশীয় স্বাদের একটা অভাববোধ শুরু হয় তার মধ্যে।
এই অভাববোধ থেকেই মাথায় চিন্তা আসে ঢাকাতেও এমন আইটেম শুরু করার। ভেবে দেখলেন, তার মতো ইউরোপীয় বা বিদেশিদের জন্য যদি সসেজের ব্যবস্থা করা যায়, তাহলে তারাও যেমন দেশীয় খাবারের একটা ছোঁয়া পাবেন, তেমন বাংলাদেশিরাও পরিচিত হবে নতুন এই আইটেমটির সঙ্গে।
সে চিন্তা থেকেই বাংলাদেশে প্রথম শুরু হলো সসেজের ব্যবসা। বাংলাদেশে সসেজের অগ্রদূত বলা হয় 'জার্মান বুচার'কেই। আর জার্মান বুচার নামটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে ফেরেঞ্জ গেওর্গির নাম।
বিদেশি এক দম্পতির বাংলাদেশে ব্যবসা
যদিও জার্মান বুচার লিখে সার্চ দিলে ওয়েবসাইট বা সবকিছুতে ফেরেঞ্জ গেওর্গির নামই উঠে আসে বারবার, তবে এর সঙ্গে জড়িত ছিল আরেকটি নামও। তা হলো সুপা গ্রেগরী, গেওর্গির দ্বিতীয় স্ত্রী।
তারা দুজনেই এসেছিলেন বাংলাদেশে একটি প্রজেক্টের কাজে। যদিও কীভাবে তাদের সম্পর্ক গড়ে ওঠে সে বিষয়ে তেমন কিছু জানা যায়নি।
প্রাতিষ্ঠানিকভাবে জার্মান বুচারের যাত্রা ১৯৯১ সালে শুরু হলেও, এর কার্যক্রম শুরু হয়েছিল আরও আগে। ২০১৩ সালের আগ পর্যন্ত স্বামী-স্ত্রী মিলেই ব্যবসার দেখাশোনা করতেন। সাথে ছিল শুধু ছয় জন কর্মী। এই কর্মীদের প্রশিক্ষণ দিতেন মূলত গ্রেগরী আর গেওর্গি নিজেরাই। তবে জার্মানি থেকেও দুবার শেফ এসে এক মাস কর্মশালা করিয়েছেন কর্মীদের।
বার্ধক্যের কারণে ছেড়ে যান এ দেশ
এই দম্পতি যখন ২০১৩ সালে এ দেশ ছেড়ে চলে যান তখন ফেরেঞ্জ গিওর্গির বয়স ৮৫ বছর। সবার মতে, বার্ধক্যের কারণেই তিনি ২০১৩ সালে জাপান বাংলাদেশ জয়েন্ট ভেঞ্চারের কাছে জার্মান বুচার বিক্রি করে দিয়ে হাঙ্গেরি চলে যান। এরপর থেকে নানা উত্থান-পতনের মধ্য দিয়েই জার্মান বুচার এখনো সদর্পে টিকে আছে।
জার্মান বুচারের বর্তমান প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা কামরুল হাসান বলেন, 'যখন মালিকানা বদলে গেল, তখন অনেকেই আশঙ্কা করছিল, জার্মান বুচার হয়তো আগের সেই বিশ্বাসযোগ্যতা ধরে রাখতে ব্যর্থ হবে। যা পুরোপুরি ভুল প্রমাণ করে এখন জার্মান বুচার আরও বড় পরিসরে কাজ করে যাচ্ছে।'
কেন এর নাম জার্মান বুচার?
ইউরোপের মধ্যে এখন পর্যন্ত সসেজের জন্য সবচেয়ে বিখ্যাত হলো জার্মানি। তাছাড়া অথেন্টিক জার্মান সসেজ তৈরিতে যেসব মশলা বা উপকরণের দরকার, তার সবই পাওয়া যেত ইউরোপ বা জার্মানিতে। একারণে সবকিছু মিলিয়েই জার্মানিকে ধরা হয় সসেজের স্বর্গ হিসেবে।
এই অথেনটিক স্বাদ আনার জন্যই তারা শুরু করেছিল 'জার্মান বুচার' নামটি। শুধু নামের মধ্যেই সীমাবদ্ধ না থেকে আইটেমিগুলোর জন্য রেসিপি এবং সকল উপকরণ, মশলাগুলো আসতো জার্মানি থেকেই। কর্মীদের প্রশিক্ষণের জন্য পেশাদার জার্মান বাবুর্চিও আসতেন তখন। এখনও উপকরণ, রেসিপি, বাবুর্চি সবই জার্মানি থেকেই আসছে।
রিচার্ড নামের একজন জার্মান বাবুর্চির হাত ধরেই মূলত বাংলাদেশে সসেজের পথচলা শুরু হয়।
আগে জার্মান বুচার মানেই ছিল ছোট্ট একটি কক্ষ। যেখানে হাতে গোনা কয়েকটি আইটেমই পাওয়া যেত। তখন এর প্রধান কাস্টমারই ছিল মূলত পাঁচ তারকা হোটেল, বিদেশি ক্লাব। অর্থাৎ ৯৯ শতাংশ কাস্টমারই ছিল মূলত বিদেশি। কিন্তু বর্তমানে এটি বাংলাদেশিদের জন্যও কাজ করছে। হোটেল, রেস্তোরাঁ, ক্লাবগুলো বাদেও বিভিন্ন সুপার শপ যেমন, স্বপ্ন, মীনা বাজার, আগোরার মতো জায়গাতেও পৌঁছে যাচ্ছে জার্মান বুচারের মিট আইটেম।
এছাড়া, বর্তমানে এরাবিকা, মিট থিওরি, সল্ট স্টেক হাউজের মতো স্টেক হাউজগুলোতে, চিলক্স, ইজাকায়া, পিজ্জা ইন এই ধরনের রেস্তোরাঁগুলোতে যে মিট আইটেম পাওয়া যায়, সেগুলো জার্মান বুচার থেকেই যায় বলে জানান প্রতিষ্ঠানটির ব্র্যান্ডিং ম্যানেজার নিয়াজ মাহমুদ।
শুরুতে শুধু মাংস প্রক্রিয়ারকরণের কাজগুলোই হতো এখানে। মিট আইটেমগুলোও ছিল খুব সীমিত। তখন সসেজের আইটেমই ছিল কেবল ৩-৪টা। যার সংখ্যা বর্তমানে ৩০-৩৫ টির মতো।
বিটুবি থেকে বিটুসি
মূলত প্রশিক্ষণগুলো দেওয়া হয় ম্যানেজারদের। ম্যানেজাররাই পরবর্তীতে কর্মীদের সে অনুযায়ী শিখিয়ে থাকেন। তবে এতে করে এই নয় বছরে স্বাদে, মানে বা বিশ্বাসযোগ্যতায় যে কোনো পরিবর্তন এসেছে, তা কিন্তু না। সেই একই মান রেখে জার্মান বুচার এখন আরও বড় পরিসরে কাজ করছে।
বর্তমানে কর্মী সংখ্যা ৮০। তাদের মধ্যে ২০ জন প্রক্রিয়াকরণ বা মিট আইটেমগুলো বানানোর কাজে আছেন। যখন হাত বদল হয় তখন স্টাফ ছিল সাতজন।
আবার আগে যেখানে ব্যবসা ছিল মূলত বিটুবি (বিজনেস টু বিজনেস) কেন্দ্রিক, এখন তা বিটুসি (বিজনেস টু কাস্টমার) নিয়েও কাজ করছে। শুরুর দিকে বড় বড় হোটেলগুলো আর বিদেশিরাই ছিল মূলত তাদের প্রধান ক্লায়েন্ট।
'তখন এমন কোনো পাঁচ তারকা ছিল না, যার সঙ্গে জার্মান বুচারের চুক্তি ছিল না। প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও ছাড়া বাকিসবগুলো পাঁচ তারকার সঙ্গেই আমাদের সম্পর্ক। প্রিমিয়াম রেস্টুরেন্ট বা পাঁচ তারকা বলতে যতগুলো আছে, সবকিছুর সঙ্গেই সম্পর্ক ছিল এবং আছে,' বলেন নিয়াজ মাহমুদ।
মালিকানা বদল হওয়ার পরও ব্যবসার পরিসর শুধু পাঁচ তারকা হোটেল আর বিদেশি ক্লাবগুলোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। হলি আর্টজানের আগ পর্যন্ত কেউ তেমন চিনতো না জার্মান বুচারকে। হলি আর্টিজানের হামলার পর যখন বাংলাদেশে বিদেশি কমে গেলো, তখনই নতুন করে ভাবতে হয়েছে জার্মান বুচারকে।
এরপর করোনায় হোটেলগুলো সব বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তখন স্বপ্ন, আগোরা, পান্ডামার্ট, মীনা বাজারের মতো স্থানীয় সুপারশপগুলোতে আসতে শুরু করে জার্মান বুচারের আইটেমগুলো।
ঢাকার বাইরে সিলেটের দোসাই, চট্টগ্রামের দ্যা পেনিনসুলা চিটাগাং এসব বড় বড় রেস্তোরাঁয় যেকোনো অনুষ্ঠান বা উপলক্ষ্যে জার্মান বুচার তাদের সাথে কাজ করছে। ঢাকার বাইরে সম্প্রতি একটু একটু করে শুরু হয়েছে, তবে সেভাবে নিয়মিত নয়।
বাড়ির নিচে একটি ছোট্ট সুপার শপ
আগে জার্মান বুচার ছিল ৫০ স্কয়ার ফিটের একটি ছোট্ট কক্ষ। যেখানে মূলত মাংস দিয়ে সসেজ, হ্যাম, বেকন, সালামি, মিটলোফ এই আইটেমগুলো বানানো হতো। এখন তা হয়েছে দোতলা এক বাড়ি।
বাড়ির নিচে একটি ছোট্ট সুপার শপ, যেখানে মিলবে টুকটাক জিনিসও। সিইও কামরুল হাসান জানান, 'আমাদের এখানে যেহেতু বিদেশিরা আসতো, দেখা যেত তারা এখান থেকে শুধু সসেজ বা হ্যাম নিচ্ছে। কিন্তু ব্রেড কেনার জন্য বা চিজ কেনার জন্য আরেকটা সুপার স্টোরে যেতে হচ্ছে তাদের। এজন্য তারা প্রায়ই এখানে একটি সুপার শপের অপশন রাখার কথা বলতো। তাদের সেই চাহিদা থেকেই এ জিনিসগুলো সুপার শপে রাখা হয়েছে।'
সেসময় ঢাকায় তেমন সুপার শপও ছিল না। তাই এই জার্মান বুচার সবার কাছে, বিশেষত বিদেশিদের জন্য হয়ে উঠলো একমাত্র ভরসার জায়গা।
রামেনের জন্য জনপ্রিয় টোকিও কিচেন
দোতলায় অফিস কক্ষের পাশে রয়েছে দুটো রেস্তোরাঁ। সসেজ ওয়ার্ল্ড ও টোকিও কিচেন। ২০১৪ সালে রেস্টুরেন্ট দুটো চালু হয়ে হলি আর্টিজানের ঘটনার পর বন্ধ ছিল দু'বছর। মূলত জার্মান বুচারের সসেজের আইটেমগুলোর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্যই এই রেস্তোরাঁর যাত্রা শুরু।
অপরদিকে জাপান বাংলাদেশ জয়েন্ট ভেঞ্চারে মালিকানা থাকায় টোকিও কিচেন নামেও একটা রেস্তোরাঁ খোলা হয়। যেখানে একদম অথেনটিক জাপানিজ স্বাদেরই খাবার পরিবেশন করা হতো প্রথমে। এরপর অবশ্য বাঙ্গালি স্বাদের সঙ্গে মিল রেখেই খাবার তৈরি করা শুরু হয়। টোকিও চিকেন রামেনের জন্য খুব জনপ্রিয়।
কোন আইটেমের চাহিদা বেশি?
সিইও কামরুল হাসান বলেন, 'আমাদের যেমন ভাত, ডাল, তরকারি, তিনটার প্রতিই সমান চাহিদা, এই আইটেমগুলোও তেমন। তবে এখন সবচেয়ে বেশি চলছে স্টেক। এরপর সসেজ। তবে এ মুহুর্তে বাজারে স্টেকের চাহিদাটা বেশি। একসময় ছিল বার্গারের, একসময় ছিল সাব-স্যান্ডুইচের। প্রতিটি আইটেমেরই আলাদা আলাদা চাহিদা রয়েছে। তবে সসেজের চাহিদা থাকে।'
'বসকে মিস করি খুব'
জার্মান বুচারের দুই অগ্রপথিক বর্তমানে থাকছেন জার্মানিতে। তবে তারা এখন আলাদাই থাকেন। মাঝেমাঝেই গেওর্গি খোঁজখবর নেন। আবার যেকোনো সমস্যায় তাকে ফোন দিয়ে পরামর্শও নেওয়া হয়।
এখনো পুরোনো কর্মীরা তাকে বস বলেই ডাকে। ২৩ বছর ধরে এই প্রতিষ্ঠানে কর্মরত রাতুল চিশিম বলেন, 'বস ছিল অসাধারণ মানুষ। কখনো আমাদেরকে কর্মীর চোখে দেখতেন না, বন্ধুর মতো আচরণ করতেন। রাগ বিষয়টাই তার মধ্যে ছিল না। অসুখ-বিসুখ হলে টাকা- পয়সা দিয়ে সাহায্য করতেন আমাদের। আমরা বসকে মিস করি খুব।'
কর্মীদের প্রসঙ্গে কামরুল হাসান বলেন 'আমাদের কাজের জায়গাটা খুব ফ্রেন্ডলি। এখানে তিনজন বাবা আছে, যারা তাদের ছেলেদেরও এখানেই কাজের জন্য নিয়ে এসেছেন। পরিবেশ ভালো বলেই তো এমনটা হয়েছে!'
ফেরেঞ্জ গেওর্গি জার্মান বুচার ছেড়ে চলে গেলেও তার দেখানো পথে এখনো চলছে জার্মান বুচার। হলি আর্টিজান, করোনা, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, কোনোকিছুই জার্মান বুচারকে তার নৈতিকতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা থেকে টলাতে পারেনি।
গুণেমানে কখনো ছাড় দেয়নি জার্মান বুচার
২০১৩ সালে মালিকানা বদলের পর থেকে তিনজন জাপানির বাইরে কামরুল হাসান এবং নিয়াজ মাহমুদ এই দুইভাই মিলেই মূলত দেখাশোনা করে যাচ্ছেন জার্মান বুচার। কখনোই মানের সঙ্গে, পরিমাণের সঙ্গে আপোষ করেননি তারা।
কামরুল বলেন, 'আমাদের একটা বৈশিষ্ট্য হলো, প্রডাকশান কস্ট বেড়ে গেলেই আমরা মানে এপাশ ওপাশ করে ফেলি। এই জায়গায়টায় আমরা কখনো ছাড় দিইনি। সেই দশবছর আগে যে পরিমাণ ছিল, দশবছর পরেও একই পরিমাণই আছে। পরিমাণে, মানে কোথাও কোনো ছাড় দিইনি। তিনবছর আগেও যেমন ছিল, এখনো এর অথেন্টিসিটি তেমনি আছে। যেকারণে, আমরা ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছি।'
জার্মান বুচারের অনলাইন বাজারে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় বর্তমানে বিফ মার্গুইজ সসেজ (৩০০ গ্রাম, ৩৪১ টাকা), বিফ হটডগ সসেজ (৩০০ গ্রাম, ৩৪১ টাকা), চিকেন পাপরিকা বোলগোনা (১৬০ গ্রাম, ২৪৮ টাকা)।
বাজারে কিছু অসৎ প্রতিযোগিতা থাকায় যেখানে তাদের এক কেজি সসেজের দাম পড়ে ১ হাজার ৮০ টাকা, সেখানে বাজারে এমন ৩৪০ গ্রামের সসেজের প্যাকেট বিক্রি হয় ১১০-২০ টাকায়। ফলে ভালো মানের জিনিস, ভালো দামে বিক্রি করতে বেগ পেতে হয় বলে জানান কামরুল হাসান।
তবে কখনো তারা দমে যাননি। নিজেদের প্রতিশ্রুতিতে অটুট থেকে আজ ৩১ বছর যাবত বাংলাদেশের প্রক্রিয়াজাত মাংসের ব্র্যান্ডে শীর্ষে জায়গা দখল করে রয়েছে এই 'জার্মান বুচার'।