ব্যতিক্রমী স্কুল! গতানুগতিক ধারায় নয়, মনের আনন্দে পড়ে যারা
ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়ন বেনাপোর্ট বলেছিলেন, আমাকে একটি শিক্ষিত মা দাও, আমি একটা শিক্ষিত সমাজ গড়ে তুলব। শিক্ষা মানুষকে সভ্য করে তোলে। অন্যদিকে, সাংস্কৃতিক চর্চা মানুষের মনন বিকাশে সহায়তা করে। শিক্ষা ছাড়া যেমন সংস্কৃতির বিকাশ সম্ভব নয়, তেমনি সমাজকে এগিয়ে নিতে শিক্ষার পাশাপাশি সাংস্কৃতিক চর্চার প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য। শিক্ষা বলতে কেবল শুধু পুঁথিগত মুখস্ত বিদ্যা নয়, বরং নিজেকে জানা ও সমৃদ্ধ করা। তবে বর্তমানে শিক্ষাব্যবস্থার বাণিজ্যিকীকরণের কারণে স্কুল-কলেজের শিক্ষার মান যেন অনেকটাই প্রশ্নবিদ্ধ। শিক্ষার্থীদের অবস্থা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোটগল্প তোতাকাহিনীর সেই তোতা পাখিটির মতোই। তবে এ অবস্থা থেকে অনেকটা স্রোতের বিপরীতে গিয়ে কাজ করছে নালন্দা, সহজপাঠ ও অরণীর মতো কয়েকটি স্কুল। গতানুগতিক ধারার বাইরে গিয়ে নিজস্ব ধারায় পড়ানোর কারণে এরই মধ্যে এসব বিদ্যালয়গুলো জায়গা করে নিয়েছে সচেতন অভিভাবকদের প্রাণ।
নালন্দা
স্কুলের গৎবাঁধা পড়াশোনার তুলনায় এ স্কুলে পড়ানোর ধরন একদমই আলাদা। ধানমন্ডি ১৫ নম্বরের ছায়ানট ভবনে গেলে দেখা যাবে ছোট ছোট বাচ্চারা কেউ নাচছে, কেউ গান গাইছে, কেউ আবার কোনো পাঠ্যবইয়ের কোনো চরিত্র সেজে নাটক মঞ্চস্থ করছে।
শুরুটা হয়েছিল আজ থেকে প্রায় ২০ বছর আগে, ২০০৩ সালে। তিনটি শ্রেণি নিয়ে সেইসময় প্রতিষ্ঠিত হয় নালন্দা। শিশুদের মনের মতো করে সংস্কৃতিযুক্ত শিক্ষা দেওয়া এবং বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে বিশ্ব সংস্কৃতির অন্তরঙ্গ সম্মিলন ঘটানোই ছিল নালন্দার মূল উদ্দেশ্য, এভাবেই বলছিলেন ছায়ানটের সভাপতি সনজীদা খাতুন।
তবে কীভাবে পড়ানো হয় এখানে?
ক্লাসরুম বলতেই আমরা বুঝি শিক্ষক এক জায়গায় আর সারি বেঁধে আরেক শিক্ষকদের মুখোমুখি শিক্ষার্থীরা। নালন্দার ধরন কিন্তু তেমন নয়। এখানে প্রতি নয়জন শিশুর জন্য একজন করে শিক্ষক থাকেন। এরমধ্য দিয়ে শিশুর শেখার প্রক্রিয়া অনেকটাই সহজ হয়ে ওঠে।
৩ থেকে ৪ বছর বয়সীদের অঙ্কুর শাখায়, ৪ থেকে ৫ বছর বয়সীদের কিশলয়, ৫ থেকে ৬ বছর বয়সীদের মঞ্জরী এরপর শুরু হয় প্রথম শ্রেণি থেকে ভর্তি প্রক্রিয়া। প্রতিবছর নতুন করে ১০০ জনের মতো শিক্ষার্থীকে ভর্তি করা হয়। তবে প্রচলিত পাঠপদ্ধতি অনুযায়ী এখানে শিক্ষার্থীদের শুধু পড়িয়েই যাওয়া হয় না, বরং তারা যেন কৌতূহল থেকে নিজেরাই বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর অনুসন্ধান করে শিখতে আগ্রহ বোধ করে, সেই চেষ্টাই করেন প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষকরা। অনেকসময় আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে তুলতে দলগত ও ব্যক্তিগত ভ্রমণের ব্যবস্থাও করা হয়।
প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণিতে পড়াকালে প্রথমেই অক্ষর জ্ঞান দেওয়ার চেষ্টা করা হয় না শিশুদের। প্রথমে শিশুদের গল্পের বই পড়ে শুনানো হয়। বইয়ের রাজ্যে হারিয়ে গিয়ে একটা সময় পায় অক্ষরজ্ঞান। সকল শ্রেণিতেই মূল্যায়ন হয় সারাবছরের কাজের ভিত্তিতে।
সহজপাঠ
২০১৭ সালে কিছুটা নালন্দার আদলে গড়ে উঠেছে সহজপাঠ নামে আরেকটি স্কুল। মাধ্যমিক পর্যন্ত বাংলা মাধ্যমের এ বিদ্যালয়টিতে শিক্ষার্থীদের পাঠ সহজ করে তোলাই সহজপাঠের কাজ। পাঠ্যপুস্তকের কঠিন বিষয়বস্তুগুলো সহজ করে ছোট ছোট নাটক-গল্পের মধ্য দিয়ে পরিবেশনার মাধ্যমে শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের মন সহজেই জয় করে নিয়েছে সহজপাঠ। পড়ানোর ধরনের দিক থেকে নালন্দার সঙ্গে কিছুটা মিল রয়েছে এ স্কুলটির।
এখানেও প্রাক-প্রাথমিক থেকে শুরু করে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ানো হয়।
সহজপাঠে শিশুর সামগ্রিক বিকাশের ওপর জোর দেওয়া হয়, মূল্যায়ন পদ্ধতিও অন্যান্য বিদ্যালয়ের তুলনায় আলাদা। কেবলমাত্র বিষয়ভিত্তিক মূল্যায়ন নয়, শিশু কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছে কিনা, বড়দের কাছে মনের ভাব প্রকাশ ঠিকমতো প্রকাশ করতে পারছে কিনা, চিন্তাভাবনায় স্বতঃস্ফূর্ততা, সবকিছুর ওপরই মূল্যায়ন করা হয়। ফলে শিশুদের আলাদা করে পরীক্ষা নিয়ে ভাবতে হয় না, এমনটাই জানাচ্ছিলেন বিদ্যালয়টির অধ্যক্ষ মোমেনা বেগম।
যেকোনো পরিবেশে যেন টিকে থাকতে পারে, যেকোনো পরিবেশের সঙ্গে যেন মানিয়ে চলতে পারে, ভয় ও জড়তামুক্তভাবে যাতে গড়ে উঠতে পারে, এমনভাবে গড়ে তোলা হচ্ছে সহজপাঠের শিশুদের।
শিক্ষকদের সঙ্গে অভিভাবকদের একধরনের সমন্বয়মূলক সম্পর্ক রয়েছে, এটি বিদ্যালয়টির অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এজন্য প্রতিবছর দুইবার অভিভাবকদের সঙ্গে মতবিনিময় সভার আয়োজন করে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
অভিভাবকদের সাড়া কেমন, এমন প্রশ্নের জবাবে মোমেনা বেগম বলেন, প্রথমদিকে অভিভাবকরা সন্তানদের পড়াশোনার ওপর অনেকবেশি জোর দিতে বললেও, এখন আর তেমন কিছু শুনতে হয় না। বরং দমবন্ধ করা প্রতিযোগিতা থেকে তাদের সন্তানরা চাপমুক্ত থাকুক, এমনটাই চান অভিভাবকরাও।
শিক্ষকরা যাতে সহজেই শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মিশে যেতে পারেন, তাদের আপন হয়ে উঠতে পারেন, এজন্য বিদ্যালয়টির শিক্ষক নিয়োগ পদ্ধতির ধরনও ভিন্ন। বিদ্যালয়টিতে নিয়োগের জন্য পরীক্ষার পর ২২ কার্যদিবস বয়োজ্যেষ্ঠ শিক্ষকের ক্লাস করতে হয় চাকরিপ্রত্যাশীদের। এরপর তাদের নিজেদেরও ডেমো ক্লাস নিতে হয়। শিক্ষক হতে হলে সে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে।
পাঠ্যপুস্তকের বাইরে খাওয়া, ঘুরে বেড়ানো থেকে শুরু করে সমাজের প্রতিটি কাজের ভেতর থেকেই যে শিক্ষা পাওয়া যায়, তার ছোট্ট নমুনা চোখে পড়বে সহজপাঠের স্কুলটিতে গেলেই। গান-নাচ-কবিতা আবৃত্তির মধ্য দিয়ে তারা আহরণ করে চলেছে প্রয়োজনীয় জ্ঞান।
স্কুলটিতে সবাইকে ক্লাসের ফাঁকে উপাহার (স্ন্যাকস) দেওয়া হয়। যার সন্ধিবিচ্ছেদ করলে দাঁড়াবে উপ+আহার। কোনোদিন উপাহারের মেনুতে থাকে বাঙালি খাবার ভাত-ডাল-আলু ভর্তা, লুচি কিংবা পুরি আবার কোনোদিন পাস্তা বা নুডুলস। এরমধ্য দিয়ে বিভিন্ন দেশীয় খাবারের সঙ্গেও পরিচিত হয়ে উঠছে শিশুরা। ফলে আগ্রহ জন্মাচ্ছে ওইসব দেশ ও তার সংস্কৃতি সম্পর্কে। একইসঙ্গে এসব খাবারের পুষ্টিগুণ সম্পর্কেও স্পষ্ট একটি ধারণা পাচ্ছে, আর বন্ধুদের সঙ্গে কাড়াকাড়ি করে খেতে গিয়ে নিজেদের মধ্যে মনের অজান্তেই গড়ে উঠছে বন্ধুত্ব ও ভ্রাতৃত্ববোধ, এভাবেই বলছিলেন সহজপাঠের একজন ট্রাস্টি সিদ্দিক বেলাল।
কথায় কথায় তিনি জানালেন, যেই ছাত্রটির পড়তে ভালো লাগে না, বা ফলাফল খুব একটা ভালো নয়, তাকেও সমানভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয় স্কুলটিতে ভর্তির সময়। এছাড়া, প্রতিবছরই অন্তত দুইবার শিক্ষাসফরে নিয়ে যাওয়ার ওপরও বেশ জোর দেওয়া হয় স্কুলটিতে। আর প্রাক-প্রাথমিক থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত বছরে অন্তত একবার শিক্ষাসফরের আয়োজন করে বিদ্যালয়টি, এমনটিও জানান তিনি।
ধানমণ্ডি ও লালমাটিয়ার দুইটি শাখায় পরিচালিত হচ্ছে গতানুগতিক ধারার বাইরের আরেকটি স্কুল, অরণি বিদ্যালয়। বিদ্যালয়টির ধানমণ্ডি শাখায় পড়ানো হয় অঙ্কুর, কলি ও কুসুমের শিক্ষার্থীদের। গাছপালা, নানারকম খেলনায় ভরপুর শ্রেণিকক্ষগুলোতে নেই কোনো টেবিল-চেয়ার। ৩ থেকে ৫ বছর বয়সী এ শিক্ষার্থীরা পড়তে শেখে খেলার ছলেই। ক্লাস ওয়ান থেকে পড়ানো হয় লালমাটিয়া শাখায়।
কেন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে ভিন্নধর্মী এ পড়াশোনা
জাপানের শিক্ষাব্যবস্থায় ৩ বছর থেকে ৫ বছর পর্যন্ত কোনো পড়াশোনা নেই। এরপর প্রথম শ্রেণি থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত কোনো পরীক্ষাও দিতে হয় না শিশুদের। ৪ বছর বয়স থেকে পড়াশোনা শুরু হলেও বাধ্যতামূলকভাবে সংস্কৃতি বা খেলাধুলা যেকোনো একটি বিষয়ে অন্তত পারদর্শী হতে হবে তাকে।
তবে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা এখনও অনেকটাই গাইড বই নির্ভর। এ শিক্ষাব্যবস্থায় প্লে গ্রুপের আগের থেকেই থাকে আত্মস্থ করার নামে মুখস্তের প্রবণতা। ফলে নালন্দা বা সহজপাঠ বিদ্যালয়ের মতো পদ্ধতিতে পড়াশোনা দিনে দিনে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। অনেক অভিভাবকই প্রচলিত শিক্ষাপদ্ধতির বাইরে গিয়ে নালন্দা, সহজপাঠের মতো বিদ্যালয়গুলোতে পড়ানোর বিষয়ে আগ্রহী হয়ে উঠছেন। গৎবাঁধা পড়াশোনার বাইরে এ ধরনের পড়াশোনা শিশুকে সৃজনশীল করে তুলতে অনেকটাই সহায়ক বলে মনে করছেন অভিভাবকরা।
মিজানুর রহমান নামে এক অভিভাবক জানান, তার ছোট মেয়ে চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী। বড় সন্তানকে গান শেখানোর জন্য ছায়ানটে নিয়ে আসার সময় জানতে পারেন ছায়ানটের পাশাপাশি বিদ্যালয়ও রয়েছে, যেখানে মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়ানো হয়। পরে যখন ছোট মেয়েটির বিদ্যালয়ে ভর্তির সময় আর দ্বিতীয় কোনো চিন্তা করেননি। তারমতে, শিশুটির চিন্তা-ভাবনা, কাজকর্ম সবকিছুতেই সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ চোখে পড়ার মতো।
নালন্দার প্রাক-প্রাথমিকের এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক মুকুল ধর জানালেন, স্কুলে আসতে এতোটাই ভালো লাগে যে শুক্র-শনিবার রীতিমতো স্কুলে আসার জন্য কান্নাকাটি শুরু করে দেয় তার সন্তান।
মুকুল ধরের সঙ্গে একমত পোষণ করলেন তার স্ত্রীও। তাদের সন্তানের মতোই চাপমুক্ত পরিবেশে আনন্দের সঙ্গে পড়াশোনার মধ্য দিয়ে সুন্দরভাবে বেড়ে উঠবে দেশের সকল শিশু, এমনটিই আশা তাদের।