কাতুয়া দিয়ে শুরু, দুই নির্মাতার সংগ্রামের গল্প!
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকের কল্যাণে দেশে এফ-কমার্সের জোয়ার এসেছে। অনেক তরুণ-প্রবীণ স্বাবলম্বী হয়েছেন ফেসবুকভিত্তিক ব্যবসা করে। এই ফেসবুকভিত্তিক ব্যবসায়ীদের সুবাদে গ্রাহকরাও ঘরে বসে পেয়ে যাচ্ছেন সাশ্রয়ী মূল্যে নিজেদের পছন্দের পণ্য। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য থেকে শুরু করে জামাকাপড়—মোটামুটি সবই আজ মানুষের হাতের নাগালে নিয়ে এসেছে বিভিন্ন ফেসবুকভিত্তিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান।
আবার এমনও কিছু প্রতিষ্ঠান আছে যারা ফেসবুক ব্যবসা শুরু করলেও পরে অফলাইন ব্যবসায় তার চেয়েও বেশি এগিয়ে গেছে। তেমনই একটি প্রতিষ্ঠান তরী।
সাশ্রয়ী মূল্যে মানসম্মত পোশাক দেওয়ার জন্য অনেক গ্রাহকের পছন্দের গন্তব্য হয়ে উঠেছে তরী। দেশে তো বটেই দেশের বাইরে থেকেও উল্লেখযোগ্যসংখ্যক প্রবাসী বাঙালি খুঁজে খুঁজে পোশাক কেনেন তরী থেকে। প্রতিষ্ঠানটি ফেসবুকের মাধ্যমে প্রথমে পরিচিতি পেলেও যাত্রার শুরুটা করেছিল ফিজিক্যাল শোরুম নিয়েই। ক্রেতাদের আস্থা অর্জন করে এখন তারা পরিকল্পনা করছে শোরুম আরও বাড়ানোর। এই সফল উদ্যোগের পেছনের কারিগর দুই স্বপ্নবাজ তরুণ-তরুণী।
তরীর দুই উদ্যোক্তা তাবাসসুম তমা ও রাফি আহমেদ হ্যাভেন। এই মানুষ দুজনের জন্ম গোপালগঞ্জে। দুজনের বেড়ে ওঠা, এইচএসসি পর্যন্ত পড়াশোনাও সেখানেই। দুজনের বন্ধুত্ব ছোটবেলা থেকেই।
সেই ছোটবেলা থেকেই অসম্ভব স্বাধীনচেতা তমা ও রাফির ইচ্ছে ছিল বড় হয়ে নিজে কিছু করবেন, চাকরিবাকরি করবেন না।
তমার ঝোঁক ছিল ফ্যাশন ডিজাইনিংয়ের দিকে। সেজন্য বিভিন্ন পত্রিকার লাইফ স্টাইল-সম্পর্কিত ম্যাগাজিনগুলোর নিয়মিত পাঠক ছিলেন তিনি। তাকে বিভিন্ন পত্রিকার লাইফ স্টাইল সাপ্লিমেন্টের জোগান দিতে গোপালগঞ্জ পুলিশ লাইনের এক কিশোর হকার। এসব সাপ্লিমেন্টে তমা খুঁজে খুঁজে দেখতেন কোথায় ফ্যাশন ডিজাইনিংয়ের ওপর কোর্স করা যায়। গোপালগঞ্জে বসেই তিনি সব খোঁজখবর নিতে থাকেন।
তমা ব্যবসায়ী পরিবারের মেয়ে। ঠিকাদারির ব্যবসা তাদের। আছে চিংড়ির ঘেরের ব্যবসাও। তাই স্বাধীন ব্যবসা করার তীব্র আকাঙ্ক্ষা তিনি উত্তরাধিকারসূত্রেই পেয়েছেন বলা চলে। এছাড়া এয়ার হোস্টেস হওয়ার ইচ্ছেও ছিল তমার। সেজন্য কেবিন ক্রুর কোর্সও করা আছে তার।
যাহোক, তমার ইচ্ছে থাকলে কী হবে, তার বাবা-মায়ের ইচ্ছে ছিল না মেয়ে ব্যবসায় আসুক। তারা চাইতেন তমা যেন কোনো পাবলিক বা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষা শেষ করে ঘর-সংসারে মন দেন।
তাই ২০১৩ সালে এইচএসসি পরীক্ষা দেওয়ার পর তমাকে ঢাকা পাঠানো হয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিপরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য কোচিং করতে। কিন্তু তমা এত সহজে দমার পাত্রী নন। কিন্তু কোচিংয়ের নিকুচি করে তমা ভর্তি হয়ে যান ফ্যাশন ডিজাইনিংয়ের এক বছরের একটি ডিপ্লোমা কোর্সে। বাড়িতে কাউকে জানাননি সে কথা।
তমার মতো রাফিরও একই সমস্যা। রাফি অবশ্য ব্যবসায়ী পরিবারের ছেলে নয়ন, তার বাবা সরকারি চাকরিজীবী। তাই তিনিও চাইতেন ছেলে পড়াশোনা করে তার মতোই চাকরি করবে।
কিন্তু রাফিরও যে পরের অধীনে চাকরি করার মন নেই। তাই তিনিও ২০১৩ সালেই এইচএসসি পরীক্ষার পর ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রস্তুতি নিতে কোচিং করতে এলেও তা করেননি।
ঘোরাঘুরির শখ আছে রাফি ও তমার তমার। কোথাও ঘুরতে গেলেই দেদার ছবি তুলতেন। এভাবে একদিন রাফির মনে হলো একটা ক্যামেরা কিনলে কেমন হয়। যেমন ভাবা তেমন কাজ, নিজের কিছু জমানো টাকা দিয়ে এবং ধার-কর্জ করে একটি ক্যামেরা কিনেও ফেলেন। তারপর তমা যে ইনস্টিটিউশনে ডিজাইনিংয়ে ডিপ্লোমা করছিলেন, সেই প্রতিষ্ঠানের একটি র্যাম্প শোতে গেলেন একদিন। এরপর থেকে নিয়মিত তমার সঙ্গে বিভিন্ন র্যাম্প শোতে যেতেন। সেখান থেকেই পরিচয় হয় অনেক পেশাদার ফটোগ্রাফারের সঙ্গে। এভাবে হাতে-কলমের অভিজ্ঞতায় রাফি ফটোগ্রাফি শিখে নেন।
ওদিকে, ফ্যাশন ডিজাইনিংয়ের কোর্স শেষ করার পর তমা টুকটাক কাজ শুরু করেন। ওই সময় তমার ডিজাইন করা কাপড়গুলো স্বল্প পরিসরে চেনাপরিচিতদের মধ্যে টুকটাক বিক্রি হতো।
তারপর ২০১৬ সালে তরী নামে ফেসবুক পেজ খোলেন তমা। তখন অবশ্য ব্যবসার উদ্দেশ্যে খোলেননি পেজটি, খুলেছিলেন তার নিজের করা ডিজাইনগুলো এক জায়গায় সংগ্রহ করে রাখবেন বলে।
তমা বলেন, '[এসব ডিজাইন থেকে] বিক্রি করব, ব্যবসা করব বা টাকা উপার্জন করব—এরকম কোনো উদ্দেশ্য ছিল না।'
কিন্তু পেজ খোলার পর দেখা গেল তার ডিজাইন করা পোশাকের বিক্রি বাড়ছে। এভাবে কিছুদিন বিক্রি করার পর তমা চিন্তা করলেন, এবার তাহলে বাণিজ্যিকভাবে চিন্তা করা যায়।
তমার ভাষায়, 'প্রথমদিকে টুকটাক বানানোর পর সবাই অনুরোধ করছিল, আমাকে এক পিস পাঠিয়ে দে। বিশেষ করে কাতুয়া। কাতুয়া হচ্ছে শার্ট ও ফতুয়ার মিশ্রণ।
'যাহোক, যখন দেখলাম বন্ধুবান্ধবরা চাচ্ছে, তখন বুঝলাম এটা বাইরেও বিক্রি হবে। আমার এক বন্ধু ছিল ফটোগ্রাফার, ও ছবি তুলে দিত। সেজন্য কাজটা করা একটু সহজ হয়েছে।'
তমার দাবি, কাতুয়া প্রথমে তরীই পরিচিত করায়।
যাহোক, ২০১৬ সালে পেজ খুললেও তরীর বিক্রিবাট্টা শুরু হয় তার এক বছর পর, অর্থাৎ ২০১৭ সালে। সে সময় ব্যবসার পরিসর ছোট ছিল। তমা পোশাক ডিজাইন করতেন, সেগুলো তৈরি এবং ডেলিভারির দায়িত্বে ছিলেন রাফি।
তমা ও রাফি ব্যবসা শুরুর খবর বাড়িতে জানাননি। প্রথম দু-বছর বাড়ির কেউই জানত না। তারপর তাদের ব্যবসার খবর প্রথম জানেন তমার মা, ২০১৮ সালে। মেয়ের ব্যবসার খবর শুনে তিনি খুশিই হন; বেশ কিছু টাকাপয়সাও দেন মেয়েকে। তবে তমার বাবা তখনও জানতেন না। অবশেষে এককান দুকান হতে হতে এক বছর পর তমার বাবাও জানতে পারেন মেয়ের ব্যবসার খবর।
যাহোক, অনলাইনে ব্যবসা শুরু করলেও তমা ও রাফির শুরু থেকেই ইচ্ছে ছিল ফিজিক্যাল শোরুম দেবেন। সেজন্য তিলে তিলে টাকা জমাতে শুরু করেন দুজনে। রাফি মাঝেমধ্যেই বিভিন্ন ইভেন্টে ছবি তুলতেন, সেখান থেকে কিছু টাকা সঞ্চয় হতো। তাছাড়া টিউশন ফি জমিয়ে, অর্থের বিনিময়ে অন্যের অ্যাসাইনমেন্ট করে দিয়ে, ছবি এঁকে দিয়ে তমারও কিছু সঞ্চয় হয়। তমার বাবা মেয়েকে একটি স্কুটার কিনে দিয়েছিলেন। দোকান ভাড়া নেওয়ার জন্য স্কুটার কিনে দেওয়ার পরের মাসেই সেটি বিক্রি করে দেন তমা।
সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করে অবশেষে ২০২০ সালে ছোট পরিসরে দোকান ভাড়া নেন তমা ও রাফি। কিন্তু দোকান নেওয়ার কিছুদিন পরই করোনা মহামারির কারণে অফলাইনের কার্যক্রম বন্ধ করে দিতে হয় তাদের। অফলাইনে বন্ধ থাকলেও ওই সময় অনলাইনে ভালোই বিক্রি হয় তাদের। গত বছর করোনা-সংক্রান্ত বিধিনিষেধ তুলে দেওয়ার পর আবার পুরোদমে অফলাইনে কার্যক্রম চালাচ্ছে তরী। এক ফাঁকে গত বছরের ডিসেম্বরে বিয়েটাও সেরে নিয়েছেন তমা ও রাফি।
ডিজাইনে দেশি ঐতিহ্যকে প্রাধান্য
তরী মূলত দেশি ঐতিহ্যবাহী কাপড় তৈরি করে। তমার একটু ছিমছাম, সাদাসিধে ডিজাইনের কাপড়চোপড় পছন্দ। তরীর সব পোশাকের ডিজাইন তিনিই করেন। রাফিরও তা-ই। তাই পোশাক ডিজাইনে তিনি খুব বেশি চাকচিক্যের দিকে মন না দিয়ে গুছানো, পরিপাটি ডিজাইনের ওপর বেশি গুরুত্ব দেন।
তবে শুধু নিজেদের পছন্দের জন্যই ছিমছাম ডিজাইনের কাপড় বিক্রি করছেন না তারা। রাফির ভাষ্যে, 'আসলে আমার ছিমছাম পছন্দ বলে এটা করলাম, ব্যাপারটা এরকম না। আমরা দেখেছি অনেক মানুষই আছে যাদের সাদামাটা পছন্দ। কিন্তু তারা মার্কেটে গেলে সেটা পাচ্ছেন না। এই মানুষগুলোই আমাদের কাস্টমার।'
হ্যান্ডলুম কাপড় তারা নিজেদের তাঁতে তাঁতিদের দিয়ে বানান। তরী বেশিরভাগই তাঁতের কাপড় তৈরি করে।
তরীর বিক্রি করা পোশাকের মধ্যে আছে হ্যান্ডলুম শাড়ি, ব্লাউজ, পাঞ্জাবি, কাতুয়া, শার্ট, লেডিস কোটি, জেন্টস কোটি, কুর্তি, লেডিস ফ্রক, থ্রি পিস, ওড়না প্রভৃতি।
তরীর পোশাক ডিজাইনে দেশি ঐতিহ্যকে প্রাধান্য দেন তমা। তিনি বলেন, 'পড়াশোনা করার সময় আমি ওয়েস্টার্ন কাজ করতাম। কিন্তু পরে সেটা ছেড়ে ঐতিহ্যবাহী কাপড়ের দিকে চলে আসি।'
পোশাকের রং মূলত কোনো উৎসবকে কেন্দ্র করে বাছাই করা হয় বলে জানালেন তিনি। যেমন, ঈদ, পূজা, পহেলা বৈশাখ প্রভৃতি উৎসব অনুসারে রং নির্বাচন করা হয়। তারপর রঙের ওপর নির্ভর করে নকশা করেন তমা।
ন্যাচারাল ডায়িং, ব্লক বাটিক, কালার বাটিক, স্ক্রিন প্রিন্টিং করেন তারা।
একবারে সাধারণত একটি ডিজাইনের তিন-চারটি রঙের পঞ্চাশটি করে শাড়ি তৈরি করেন তারা।
অনেক প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে একটু একটু করে বড় হচ্ছে ব্যবসা
২০২০ সালের জানুয়ারিতে ফিজিক্যাল দোকান নিলেও কিন্তু মার্চ থেকে লকডাউনে সব বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ফিজিক্যাল দোকানের ফেস ভ্যালু প্রত্যাশামাফিক বাড়াতে পারেনি তরী। এটা নিয়ে সামান্য আক্ষেপ আছে তমার। তবে অনলাইনে ভালো বিক্রি হয়েছে ওই সময়।
এছাড়া ২০২০ সালের শেষ দিকে তমার বাবা মারা যান। তার বড় বোন যুক্তরাষ্ট্রে থাকেন, ছোট ভাই উচ্চমাধ্যমিকের শিক্ষার্থী। তাই বাবার মৃত্যুর পর থেকে পারিবারিক ব্যবসা ও তরী—দুটোর পেছনেই সময় দিতে হচ্ছে তমাকে। এ কারণে তরীর সম্প্রসারণ কাজ একটু ধীর হয়ে গেছে।
এসবের মাঝেও ২০২০ সালের শেষের দিকে কাপড় সেলাইয়ের জন্য কালসিতে ছোট পরিসরে নিজস্ব সেলাই কারখানা নেয় তরী। সামনে তাদের আউটলেট বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে। চলতি বছরের শেষ দিকে ঢাকার মোহাম্মদপুরে এবং ঢাকার বাইরে গোপালগঞ্জ ও বাগেরহাটে তরীর আউটলেট দেওয়ার জন্য কথাবার্তা চলছে।
এছাড়া প্রবাসী বাংলাদেশিদের মাঝেও তরীর পোশাক বেশ জনপ্রিয়। দুবাই, সৌদি আরব, জার্মানি, কানাডা প্রভৃতি দেশ থেকে নিয়মিতই অর্ডার আসে তাদের কাছে। তবে বাংলাদেশে পেমেন্ট গেটওয়ে নিয়ে জটিলতা থাকায় বিদেশে কাপড় বিক্রিতে তাদের বেশ ভোগান্তি পোহাতে হয়।
রাফি বলেন, 'বাংলাদেশে এমন একটা পেমেন্ট গেটওয়ে দরকার যেটা দিয়ে যেকোনো সেক্টরে যেকোনো দেশ থেকে সহজে টাকা আনা যাবে এবং টাকাটা সহজে তোলা যাবে।'
এতদূর আসার জন্য তমা ও রাফিকে পাড়ি দিতে হয়েছে অনেক বন্ধুর পথ। পরিচিতদের কেউ কেউ নিরুৎসাহিত করার চেষ্টাও করেছেন।
এছাড়া তমার অভিযোগ, চাকরির জন্য অনেক ডিজাইনারের কাছে পোর্টফলিও জমা দিলে তারা তমার ডিজাইন কপি করে নেওয়ার পর তাকে সব জায়গা থেকে ব্লক করে দেন। পরের মাসে দেখা গেছে ওই ডিজাইনের কাপড় তারা বাজারে নিয়ে এসেছেন।
কিন্তু দাঁতে দাঁত চেপে সব প্রতিকূলতা পেরিয়ে তমা ও রাফি আজ নিজেদের পরিচয় তৈরি করে নিয়েছেন। বাস্তব রূপ দিয়েছেন নিজেদের স্বপ্নকে। একসময় যারা বলতেন, তারা সফল হবেন না, সেই মানুষগুলোই এখন তরীতে কেনাকাটা করতে আসেন। এটাই এই যুগলের সবচেয়ে বড় তৃপ্তি।