ভারতের এক মহারাজা আর তার 'রহস্যময়' উইল
ভারতের ফরিদকোটের রাজপরিবারের ২০০ বিলিয়ন রূপি মূল্যের সম্পত্তির মালিকানা নিয়ে বিরোধের নিষ্পত্তি করেছে দেশটির সুপ্রিম কোর্ট।
অনেক আইনি ঝামেলার পর তিনটি উইল নিয়ে তিন দশক ধরে চলে আসা এ বিরোধের মীমাংসা হলো গত সেপ্টেম্বরে।
বিবাদের সূত্রপাত হয় ১৯৮৯ সালে ফরিদকোট রাজ্যের (বর্তমানে পাঞ্জাব রাজ্য) শেষ শাসক হরিন্দার সিং ব্রারের মৃত্যুর পর। তার বড় মেয়ে উইল চ্যালেঞ্জ করে দাবি করেন তিনি পিতৃসম্পত্তির কোনো ভাগ পাননি।
পরে সর্বোচ্চ আদালত উইলটিকে কাল্পনিক, বানোয়াট ও সন্দেহজনক বলে ঘোষণা দেয় এবং সম্পত্তির বিরাট অংশ হরিন্দরের দুই কন্যাকে প্রদান করে।
বিতর্কিত উইল
১৯৪৮ সালে ভারতের স্বাধীনতা লাভের পর অন্যান্য রাজাদের মতো হরিন্দর সিংও সরকারের সাথে চুক্তিবন্ধ হন। চুক্তি মোতাবেক সম্পত্তির কিছু অংশ তার নিয়ন্ত্রণে থাকবে। এসব সম্পত্তির মধ্যে রয়েছে পাঞ্জাব, হিমাচল প্রদেশ, হরিয়ানা এবং দিল্লীর শত একরের জমি, দুর্গ, ভবন, এয়ারক্রাফট, ভিন্টেজ গাড়ি এবং ব্যাংকে রাখা অর্থ।
ইতিহাসবিদ হরজেশ্বর পাল সিং বলেন, 'হরিন্দর রেলপথ এবং হাসপাতাল স্থাপনসহ অনেক উন্নয়নমূলক কাজ করেছিলেন। ফরিদকোটের এই শেষ শাসক এবং তার পূর্বসূরীদের সাথে ব্রিটিশদের অনেক ভালো সম্পর্ক ছিল।'
হরিন্দর আর তার স্ত্রীর এক ছেলে ও তিন মেয়ে ছিল; তাদের মধ্যে কেবল বড় মেয়ে অমৃত কৌর এখনো বেঁচে আছেন। অমৃতের দুই ছেলে টিক্কা হরমোহিন্দর সিং এবং মহীপিন্দর কৌর কোনো উত্তরসূরি না রেখেই মারা যান।
১৯৫০ সালে মহারাজা হরিন্দর সিং প্রথমবার উইল করেন। সেখানে লেখা হয়েছিল চারটি ফ্ল্যাট এবং ব্যাংকে রাখা অর্থ তার তিন কন্যার মাঝে সমান ভাগে ভাগ করে দেওয়া হবে।
এর দুই বছর পর তিনি আরেকটি উইল বানান। সেখানে লেখেন তিনি বড় মেয়ে অমৃত কৌরকে কোনো সম্পত্তি দিতে চান না। তার পরিবর্তে মোট সম্পত্তি সমান ভাগে ভাগ হবে বাকি দুই বোনের মাঝে।
সুপ্রিম কোর্টের আদেশ অনুসারে, বড় মেয়ে তার বাবার বিরুদ্ধে গিয়ে বিয়ে করায় তাকে উত্তরাধিকার থেকে বাদ দেওয়া হয়েছিল।
দ্বিতীয় উইল করার তিন বছর পর মহারাজা লন্ডনে আরেকটি উইল করেন। এখানে তিনি বড় মেয়ে অমৃতকে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করেননি। তবে উইল মতে বয়স ২৫ বছর পূর্ণ হলে অথবা তার স্বামীর সাথে আইনিভাবে বিচ্ছেদ হয়ে গেলে তবেই অমৃত কৌর তার সম্পত্তির ভাগ পাবেন। বাবার মৃত্যুর পর এই তৃতীয় উইল পড়ে তিনি বড় একটি ধাক্কা খেয়েছিলেন। উইলটি করা হয়েছিল ১৯৮২ সালের জুনের এক তারিখে, বড় ভাই টিক্কা খানের সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর কয়েক মাস পর।
এই তৃতীয় এবং শেষ উইলটিতে বলে হয়েছিল, রাজপরিবারের সব সম্পত্তি দেখাশোনা করবে একটি কেয়ারটেকার ট্রাস্ট যেখানে থাকবেন অমৃতের দুই বোন এবং হরিন্দরের মায়ের একজন আত্মীয়।
যত আইনি লড়াই
১৯৯১ সালে অমৃত কৌর উইলটিকে চ্যালেঞ্জ করেন। অপর দুইবোন এবং অন্যান্য ট্রাস্টিদের বিবাদী করে তিনি মোট সম্পত্তির এক-তৃতীয়াংশ দাবি করে একটি মামলা করেন।
ঝামেলা এখানেই শেষ নয়। হরিন্দর সিং-এর ছোট ভাই কানওয়ার মঞ্জিত ইন্দার সিংও একটি মামলা করেন। তার দাবি মহারাজার সবচেয়ে নিকটস্থ জীবিত আত্মীয় হিসেবে তিনিও সম্পত্তির ভাগ পাবেন।
২০১৩ সালে একটি বিচারিক আদালত এই দুই মামলায় রুল দেয়। এতে বলা হয়, তৃতীয় উইলটি আসল নয় এবং সম্পত্তি অমৃত কৌর ও তার বোন দীপিন্দর কৌরের মাঝে দু'ভাগে ভাগ হবে (আরেক বোন মহীপিন্দর কর ২০০১ সালে মারা যান)।
অমৃত কৌরের নিয়োগ দেওয়া ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ জ্যাসি আনন্দ বিবিসিকে বলেন, তৃতীয় উইলটি যে মহারাজার করা নয় তা প্রমাণের জন্য তারা উইলটি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ করে দেখেছেন। তিনি জানান, মহারাজা একজন জ্ঞানী ব্যক্তি ছিলেন। তার বেশ সুন্দর হস্তাক্ষর ছিল। কিন্তু এসবের কোনো প্রতিফলন উইলটিতে দেখা যায়নি। উইলে অনেক বানান ভুল ছিল এবং তার স্বাক্ষর নকল করা হয়েছিল। আবার উইলটি বানাতে বেশ কয়েকটি টাইপরাইটারের ব্যবহার করা হয়েছিল।
বিচারিক আদালত কানওয়ার মঞ্জিত ইন্দার সিংয়ের দাবিও নাকচ করে দেন। এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ট্রাস্টের সদস্য দীপিন্দর কৌর এবং মঞ্জিতের ছেলে ভারত ইন্দার সিং আপিল করেন।
কিন্তু ২০২০ সালে পাঞ্জাব এবং হরিয়ানার হাইকোর্ট আগের সিদ্ধান্ত বহাল রেখে বলেন তৃতীয় উইলটি বানোয়াট ছিল।
মহারাজার ছোট ভাই মঞ্জিতের দাবিও নাকচ করে দেন আদালত। তবে সম্পত্তির ২৫ শতাংশের অধিকারী হবেন মঞ্জিত। কারণ, হরিন্দর সিংয়ের মৃত্যুর দুই বছর পর ১৯৯১ সালে তাদের মায়ের মৃত্যু হয়।
গত সেপ্টেম্বর হাইকোর্টের এই আদেশ বহাল রেখে সুপ্রিম কোর্ট যে ট্রাস্টি বোর্ড সম্পত্তি পরিচালনা করছিল সেটিকে ভেঙে দেওয়ার নির্দেশ দেয়।
বাকি সম্পত্তি অমৃত কৌর এবং তার বোন দীপিন্দর কৌরের পরিবারের মাঝে ভাগ করে দেওয়া হবে, দীপিন্দর ২০১৮ সালে মারা যান। তবে পুলিশ এখনো নকল উইলটির তদন্ত করছে।
এরপর যা হবে
আদালতের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, রাজপরিবারটির সদস্যদের মাঝে সম্পত্তি ভাগ হয়ে যাবে। কে কোন সম্পত্তি পাবেন তা তারাই আলোচনার মাধ্যমে ঠিক করবেন। এতেও সমাধান না আসলে আদালতই তা ঠিক করে দেবে তবে এই প্রক্রিয়াটি সময়সাপেক্ষ হবে বলে জানিয়েছেন মঞ্জিত ইন্দার সিংয়ের নাতি অমৃন্দর সিং।
অমৃন্দর বলেন, 'অন্তত পারিবারিক বিরোধ শেষ হলো। তবে সম্পত্তিগুলো যেহেতু বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে আছে, তাই মামলা চলমান থাকবে।'
সূত্র: বিবিসি