বাংলা’র দুর্গাপূজায় সোৎসাহ উপস্থিতি ছিল সাহেব-মেমদের, লিখে-এঁকে গেছেন সেসব অভিজ্ঞতাও
প্রথম শ্রেণীর বিভিন্ন জাতের অতি উত্তম ওয়াইন ও মিষ্টান্ন, সুস্বাদু বিয়ার, নানা স্বাদের বিস্কিট, বিখ্যাত ব্র্যান্ডের চুরুট, লেমনেড, কেকের পাহাড়, ফলের ঝুড়ি, পোলাও, কোর্মা, কোপ্তা, কালিয়া, মুরগি, কাটলেট, মাটন-চপ; ১৯ শতকে ব্রিটিশ শাসনের আমলে কলকাতার বাঙালি বাবুদের বাড়িতে দুর্গাপূজার সময় এভাবেই সারি দিয়ে খাবারের আয়োজন রাখা হতো। লেখক বাবু শিবসুন্দর বসু তার 'দ্য হিন্দুস অ্যাজ দে আর- আ ডেসক্রিপশন অভ ম্যানার্স, কাস্টমস অ্যান্ড ইনার লাইফ অভ হিন্দু সোসাইটি ইন বেঙ্গল' (১৮৮১) গ্রন্থে বাঙালির পূজার ভোজের এমন বর্ণনাই দিয়েছেন।
বাঙালি হিন্দুদের ইউরোপীয়রা ডাকত 'জেন্টু' বলে। কলকাতার ভদ্রসমাজে গোরা সাহেবরাও দুর্গাপূজার নিমন্ত্রণ পেতেন। লেখক প্রাণ নেভিল তার 'নচ গার্লস অভ দ্য রাজ' (২০০৯) বইয়ে দুর্গাপূজা নিয়ে জনৈক সাহেবের বর্ণনার কথা উল্লেখ করেছেন। চার্লস ডয়লি নামক ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ওই জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তার লেখা কবিতা 'টম র, দ্য গ্রিফিন' (১৮২৮) থেকে জানা যাচ্ছে, কলকাতার শোভাবাজারের রাজা নবকৃষ্ণদেবের বাড়িতে দুর্গাপূজা সময় নচনৃত্যের অনুষ্ঠান হতো।
ডয়লি'র মতো আরও অনেক শ্বেতাঙ্গ সাহেব কলকাতায় দুর্গাপূজার স্মৃতি তাদের লেখা ও আঁকায় বন্দি করেছেন। এ তালিকায় আছেন উইলিয়াম প্রিন্সেপ, বাথাজার সলভিনস, জর্জ পামার, ই.বি. হাভেল, টমাস ড্যানিয়েল, সোফি সি বেলনস প্রমুখ।
দুর্গাপূজার ঔপনিবেশিক শেকড়
বাংলায় দুর্গার অনেক রূপের দেখা মেলে। কখনো তিনি শাকম্বরী, আবার কখনো জগদ্ধাত্রী বা অন্নপূর্ণা। তবে বেশিরভাগ সময়ই তিনি কালি- দুর্গার সবচেয়ে উগ্র অবতার।
তবে শরতের দুর্গাপূজার সময়কার চিরায়ত দশভুজার রূপই সবচেয়ে বেশি প্রচলিত ও পরিচিত। মঙ্গলকাব্য ও বৈষ্ণববাদের সমন্বিত প্রভাব আশ্বিন মাসে দুর্গাপূজার রীতি জনপ্রিয় হতে সহায়তা করে। দুর্গাকে এখানে দেখা যায় বাপের বাড়িতে আসা উমারূপে। তবে রামায়ণে কৃত্তিবাস ওঝা লিখেছেন, রাবণের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত যুদ্ধে মুখোমুখি হওয়ার আগে রাম দেবীর কাছ থেকে আশীর্বাদের জন্য দুর্গাপূজা করেছিলেন।
বাংলার রাজা ও জমিদারদের কাছে মেয়ে উমা'র চেয়ে মহিষমর্দিনী দুর্গাই বেশি প্রাধান্য পেয়েছে। কারণ এ দুর্গার তেজ, বীরত্বের সঙ্গেই তারা নিজেদের বেশি মিল খুঁজে পেতেন।
নদীয়ার মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রায় (১৭১০-১৭৮৩) দুর্গার মহিষমর্দিনী রূপকে পূজনের পুরোভাগে ছিলেন। তিনিই প্রথমবারের মতো দুর্গাপূজাকে সর্বজনীন করে তোলেন। শাক্তমতের পরম বিশ্বাসী কৃষ্ণচন্দ্রের সঙ্গে জগৎশেঠ, উমিচাঁদ, মীরজাফর, ও বাংলা প্রদেশের প্রথম গভর্নর রবার্ট ক্লাইভের বেশ খাতির ছিল।
বলা হয়ে থাকে, কৃষ্ণচন্দ্রই মাটির প্রতিমা ও দুর্গার দশভুজা রূপের প্রচলন করে থাকেন। রাজনৈতিক হিসাবনিকাশ ও শাসক-শাসিতের সম্পর্কের সংমিশ্রণে ১৮ শতকের বাংলার দুর্গাপূজা স্রেফ হিন্দুদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসবের চেয়ে বেশি হয়ে উঠেছিল।
নদীয়ার রাজবাড়ির দুর্গাপূজা থেকেই সম্ভবত শারত উৎসবের সূচনা হয়েছিল। এরপর রবার্ট ক্লাইভের এইড ও তার ফার্সি শিক্ষক এবং শোভাবাজার রাজপরিবারের প্রতিষ্ঠাতা নবকৃষ্ণ দেব ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধের পর ক্লাইভের বিজয়কে উদযাপন করতে কলকাতার শোভাবাজারে দুর্গাপূজার আয়োজন করেন।
ক্লাইভ ওই পূজায় অংশগ্রহণ তো করেছিলেনই, পাশাপাশি পূজায় বলির জন্য ছাগলও পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। 'কোম্পানি পুজো' নামে খ্যাতি পাওয়া এ পূজা দুর্গাপূজাকে আনুষ্ঠানিকভাবে আরও সর্বজনীন করার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে।
যেভাবে দুর্গাপূজার স্মৃতি ধরে রেখেছেন গোরা সাহেব-মেমরা
১৯ শতকের মাঝামাঝি জমিদারদের মধ্যে দুর্গাপূজার আয়োজন নিয়ে প্রতিযোগিতা শুরু হয়। তাদের দেখাদেখি পরে পূজা শুরু করেন অবস্থাপন্ন গৃহস্থরাও, যারা 'বাবু' নামেই বেশি পরিচিত। আর দুর্গাপূজার এ উদযাপন-প্রকৃতি আকর্ষণ করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বড়কর্তা, শিল্পী, ইউরোপীয় পর্যটক সবাইকে। সাহেব-সুবোদের সঙ্গে একটু মেলামেশার জন্য দুর্গাপূজা বাঙালি বাবুদের জন্য বড় বাৎসরিক অনুষ্ঠান হয়ে ওঠে।
ড্যানিয়েল, বালথাজার ছিলেন প্রশিক্ষিত চিত্রশিল্পী। অন্যদিকে ডয়িল ও প্রিন্সেপ ছিলেন শখের লেখক ও আঁকিয়ে। তাদের কাছে দুর্গাপূজার উদযাপনের আবেদন ছিল বিভিন্ন মাত্রায়। পূজার অপরিচিত রীতিনীতি, এর নান্দনিকতা, দুর্গার সাজসজ্জা, বিসর্জন; সবমিলিয়ে এ বিদেশিদের কাছে দুর্গাপূজা পুরোদস্তুর তেজোদ্দীপ্ত একটি উৎসব হিসেবেই ধরা দিয়েছিল।
ধনাঢ্য বাঙালিদের দুর্গাপূজার বনেদিপনায় আশ্চর্য মেনেছিলেন ইউরোপীয়রাও। ১৮৪৭ সালের কাছাকাছি কোনো সময়ে ব্রিটিশ লিথোগ্রাফার সোফি বেলনস কলকাতায় একটি লিথোগ্রাফি প্রেস স্থাপন করেছিলেন। তার বিবরণে তিনি লিখেন: 'মানুষের গুনগুন, নাচিয়ে মেয়েদের উজ্জ্বল পোশাক, তাদের ধীরস্থির রাজসিক অঙ্গচালনা; রাজা ও তার বিত্তশালী স্বদেশী অতিথিদের দামী পোশাক; ইউরোপীয় নারী ও পুরুষদের আনন্দোচ্ছল জটলা, এবং গোলাপ ও চন্দনের মনমাতানো সুবাস অপরিচিতদের (ইউরোপীয়দের) চমৎকৃত করে দেয়।'
প্রিন্সেপ ছিলেন পামার অ্যান্ড কোম্পানি'র একজন বণিক। ইংল্যান্ডের অন্যতম বৃহৎ এ রপ্তানি কোস্পানির একটি অফিস ছিল কলকাতাতেও। এছাড়া প্রিন্সেপ প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর ও উইলিয়াম কারের প্রতিষ্ঠা করা কার, ট্যাগোর অ্যান্ড কোম্পানির সঙ্গেও জড়িত ছিলেন। তাই কলকাতার বনেদিপাড়ায় তার দিব্যি যাতায়াত ছিল।
১৮৩০ থেকে ১৮৪০ সালের মাঝে প্রিন্সেপ 'কলকাতায় দুর্গাপূজার সময় একটি শোভামণ্ডিত বাড়িতে ইউরোপীয়দের নৃত্য ও সংগীতে বিমুগ্ধ হওয়ার' জলরংয়ের ছবি আঁকেন। রাজসিক ও বিস্তৃত ওই ছবিতে দেখা যায়, খোলা উঠোনে নাচছেন নচকন্যা, আর তা আবিষ্টমনে দেখছেন দর্শকেরা।
সাহেব ও মেমসাহেবরা দখল করেছেন সামনের আসনগুলো। দুপাশে স্থানীয়রা জড়ো হয়েছেন। আর অন্যদিকে দেখা যাচ্ছে সপরিবারে দুর্গা। বিশাল বাড়ির দোতলায় কিছুটা আড়ালে বসে নচ উপভোগ করছেন বাড়ির অন্তঃপুরবাসিনীরা।
প্রিন্সেপ ছবিতে গাঢ় রংয়ে ফুটিয়ে তুলেছেন মূল চরিত্রগুলো। ছবিটিতে একজন গোরা অতিথির গায়ে লাল ওয়েস্টকোট দেখা যায়। অন্যদিকে নচকন্যা পরেছেন পাণ্ডুর সবুজ ঘাগড়া বা লম্বা স্কার্ট। তার মতো দুর্গাপূজা উদযাপনের ছবি এঁকেছেন ড্যানিয়েল (১৭৪৯-১৮৪০) ও জর্জ গিডলি পামারও (১৮৩০-১৯০৫)।
১৮১০ সালে জলরংয়ে ড্যানিয়েল কলকাতা ও মুর্শিদাবাদের মাঝামাঝি কোনো জায়গায় ভাগীরথী নদীতে বিসর্জনের ছবি আঁকেন। ওই ছবিতে একটি প্রাসাদোপম দুর্গের সামনে ঘাটের ওপর প্রতিমা ও নদীতে নৌকায় ভক্তদের দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। আর ঠিক পাশেই আরেকটি প্রতিমা অর্ধবিসর্জিত অবস্থায় দেখতে পান দর্শক। ছবিতে আলো দেখে ধারণা করা হয় এটির দৃশ্যপট সন্ধ্যার কিছু আগেই।
তবে পামারের আঁকা বিসর্জনের ছবিতে পাওয়া যায় আরও বেশি নাটকীয়তা। ১৮৭৫ সালে আঁকা ওই ছবিতে রাতের বিসর্জনকে তুলে ধরেছেন পামার। হুগলি নদীর ওপর একাধিক নৌকাতে বিসর্জনের আগে নৌকাতে প্রতিমাকে সামনে রেখে ভক্তদের আরতিই পামারের ছবির মূল বিষয়বস্তু। কালো রং ব্যবহার করে রাতের দৃশ্যকে অনবদ্যভাবে ফোটাতে পেরেছেন পামার।
অনেক ইউরোপীয় তাদের জীবনের কেবল একটা অংশ কলকাতায় কাটিয়েছিলেন। আবার অনেকের জন্ম হয়েছে বাংলায়, তারা পরিচিত হয়েছেন এখানকার রীতিনীতির সঙ্গে। নিজেদের আঁকা ছবিগুলোতে তারা দুর্গাপূজাকে দেখেছেন প্রাচ্যবাদী চোখ দিয়ে, একজন শিল্পী হিসেবে দূর থেকেই পর্যবেক্ষণ করেছেন এ সংস্কৃতিকে। তবে শিল্পী যখন নিজেই অতিথি ছিলেন, তখন পশ্চিমের উপস্থিতি অনেক বেশি স্পষ্ট হয়ে ধরা দিয়েছিল তাদের কাজে। আর এসবের মধ্যেই বারবার শক্ত হয়েছে কলোনিয়ালিস্ট ও তাদের স্থানীয় বনেদি মিত্রদের সম্পর্ক।
সূত্র: দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: সুজন সেন গুপ্ত