বিশ্বকাপ মৌসুমে উৎসবমুখর গুলিস্তান!
এক বন্ধুর কাছে শুনেছিলাম, ছেলেরা তাদের প্রিয় দলের জার্সি পরেই ক্লাস থেকে শুরু করে বিয়ের দাওয়াত- সব জায়গায় অনায়াসে চলাফেরা করতে পারে। উপহার হিসেবেও জার্সিই তাদের প্রথম পছন্দ। তবে ছেলে-মেয়ে যে-ই হোক, খেলা পাগল মানুষের কাছে প্রিয় খেলোয়াড় বা প্রিয় দলের জার্সির আবেদন আর কিছুর সাথে তুলনা করা যায় না। এদিকে কিছুদিন পরই শুরু হতে যাচ্ছে পুরো বিশ্বের ক্রীড়াপ্রেমীদের উন্মাদনার মৌসুম ফিফা ফুটবল বিশ্বকাপ-২০২২। পাশাপাশি আইসিসি টি-২০ ক্রিকেট বিশ্বকাপেও মেতে আছে ক্রিকেটপ্রেমীরা। খেলাধুলার এই মৌসুমে তাই জার্সিসহ সবধরনের খেলার সামগ্রীর চাহিদা উঠেছে তুঙ্গে।
দেশে ক্রীড়া সামগ্রী কেনাকাটার সবচেয়ে বড় ঠিকানা গুলিস্তান। বিদেশ থেকে আমদানি করা পণ্য হোক বা দেশে উৎপাদিত স্থানীয় পণ্য- উভয়ের জন্যই গুলিস্তান স্পোর্টস মার্কেট বা সমবায় টুইন টাওয়ার মার্কেটের নাম দেশের যেকোনো প্রান্তের ক্রীড়াপ্রেমীর কাছেই পরিচিত। পাইকারী বা খুচরা সবধরনের ক্রেতার ভিড়ে নিয়মিত জমজমাট থাকে এখানকার মার্কেটগুলো। বিশ্বকাপের ডামাডোলের পাশাপাশি আসন্ন শীতকালীন খেলাধুলার মৌসুমের প্রস্তুতিতে কেমন চলছে তার খোঁজ নিয়েছি দেশের বৃহত্তম ক্রীড়া সামগ্রীর বাজার ঘুরে।
গুলিস্তান শপিং কমপ্লেক্সের দ্বিতীয় তলার প্রায় ১৮৩টি দোকান নিয়ে গুলিস্তান স্পোর্টস মার্কেট। অন্যদিকে সমবায় টুইন টাওয়ার মার্কেটের দ্বিতীয় তলা থেকে চতুর্থ তলা পর্যন্ত ২০০-র বেশি ক্রীড়া সামগ্রীর দোকান। ফুটবল, ক্রিকেট, ভলিবল, ব্যাডমিন্টন, হকি, ক্যারাম ইত্যাদি যেকোনো ধরনের খেলার সকল সামগ্রী পাওয়া যায় এখানে। তবে ফুটবল বিশ্বকাপের মৌসুমে এখন ফুটবল সামগ্রীর দিকেই ক্রেতাদের নজর বেশি বলে জানালেন মার্কেটের বিক্রেতারা। টুইন টাওয়ার মূলত পাইকারী মার্কেট হলেও গুলিস্তান স্পোর্টস মার্কেটের দোকানগুলোতে পাইকারী-খুচরা দুইভাবেই বিক্রি হয়।
সিফাত স্পোর্টসে কর্মরত মুরাদ বলেন, "গুলিস্তান স্পোর্টস মার্কেটে ভ্যারাইটিজ কাস্টমার আসে। যারা খেলাধুলা করে তারাও আসে, যারা খেলাধুলা দেখে তারাও আসে, আর যারা ব্যবসায়ী তারা তো আসেই। বর্তমানে কাস্টমারদের সবচেয়ে বেশি চাহিদা ফুটবলের জার্সির।"
ফিফা বিশ্বকাপের অফিশিয়াল কাউন্টডাউন শুরু হওয়ার পর থেকেই ফুটবল সামগ্রীর চাহিদা বেড়ে যায় বলে জানান বিক্রেতারা। আল্লাহর দান স্পোর্টসের বিক্রেতা বাপ্পির ভাষ্যে, "এবার মেসি-রোনালদোর শেষ বিশ্বকাপ, নেইমারেরও হয়তো শেষ বিশ্বকাপ। সেই অনুযায়ী মানুষের আগ্রহটাও অন্যরকম। বিশ্বজুড়েই ফুটবল মানুষের আবেগের খেলা।"
এই মার্কেটের আরেক পুরোনো ব্যবসায়ী এস স্পোর্টসের মালিক মোহাম্মদ সোলায়মানের ভাষ্যে, "বাংলাদেশের মানুষের কাছে ওয়ার্ল্ডকাপ মানেই ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা। এই দুই দল ছাড়া দেশের মানুষ কিচ্ছু বোঝে না। ইদানিং ফ্রান্স, জার্মানি, পর্তুগালের কিছু ভক্ত আছে। ব্রাজিল আর আর্জেন্টিনার জার্সির সবচেয়ে বেশি চাহিদা দেশে।"
কোয়ালিটি ও বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী তিন ধরনের আমদানিকৃত জার্সি পাওয়া যায় মার্কেটগুলোতে। প্লেয়ার ভার্সন, ফ্যান ভার্সন আর থাই ভার্সনের জার্সি। এর মধ্যে প্লেয়ার ভার্সনের মান সবচেয়ে ভালো। আমদানিকৃত জার্সিগুলোর দাম হয় ৬০০ টাকা থেকে ১১০০ টাকা পর্যন্ত। দেশে বানানো জার্সি বিক্রি হয় ৩০০ টাকা থেকে ৪৫০ টাকার ভেতর। নিজেদের চাহিদা মতো কাস্টমাইজ করে জার্সিও বানিয়ে নেন অনেকেই।
জার্সির পর ফুটবলের দিকে সবচেয়ে বেশি চাহিদা ক্রেতাদের। বিশ্বকাপের অফিসিয়াল বল 'আল রিহলা'র আদলে তৈরি 'কাতার ফুটবল' নামের নানা মানের রেপ্লিকা পাওয়া যায় দোকানগুলোতে। গুলিস্তান স্পোর্টস মার্কেটের টি ওয়ার্ল্ড স্পোর্টসের বিক্রেতা এইচ আর কাউসার বলেন, "আমাদের দোকানে কাতার ওয়ার্ল্ড কাপের রেপ্লিকা বল আছে তিনটা কোয়ালিটির। ৬৮০ টাকা থেকে শুরু করে ১৪০০ টাকা পর্যন্ত দাম সেগুলোর। বলের ম্যাটেরিয়াল, লেয়ার, ডিজাইনের ধরনভেদে দাম আলাদা হয়। আগে বাইরের দেশ থেকে আমাদের এখানে বল ফুলিয়েই আনা হতো। এক কার্টুনে থাকতো ২৪টার মতো বল। আমদানি খরচ বেড়ে যাওয়ায় এখন টুপি ভাঁজ দিয়ে আনা হয় সেগুলো। তাই এক কার্টুনে বল থাকে ৫০টার মতো। কম দামি বলগুলো ফুলানোর পরও তাই ভাঁজের দাগ থেকে যায় অনেক সময়। ফুটবল বা জার্সি ছাড়াও বিভিন্ন দলের থিম অনুযায়ী চাবির রিং, রিস্ট ব্যান্ড ইত্যাদি স্মারকও আনছি আমরা।"
বর্তমানে ফুটবল সামগ্রীর কাছে অনেকটাই ফিকে হয়ে এসেছে ক্রিকেট সামগ্রীর কেনাকাটা। যারা নিয়মিত ক্রিকেট খেলেন শুধু তারাই ব্যাট, বল, হেলমেট, গ্লাভস বা প্র্যাকটিস নেটের মতো জিনিস কিনতে আসছেন বলে জানান ব্যবসায়ীরা। টি-২০ বিশ্বকাপ চললেও ক্রিকেট ভক্তদের মাঝে নেই বাংলাদেশের জার্সি কেনার উন্মাদনা। কারণ হিসেবে টুইন টাওয়ার মার্কেটের পপুলার স্পোর্টসের বিক্রেতা ওমর কোরাইশী জানান, "আমাদের এখানে ক্রিকেটের চাহিদা তো বাংলাদেশের খেলার জন্যই এত বেশি। রিসেন্টলি বাংলাদেশ ক্রিকেটে অনেক খারাপ করছে, তাই মানুষের আগ্রহও কমে গেছে। আগের বিশ্বকাপগুলোতে যেমন দেশীয় ভক্তদের বাংলাদশের জার্সির প্রতি ঝোঁক ছিল খুব। এখন আর তা নেই বললেই চলে। তাই ব্যবসায়ীরাও ক্রিকেটের জার্সি কমই রাখছি।"
শহর বা মফস্বলের নানা দোকানের খুচরা বিক্রেতা, অনলাইন বিক্রেতা কিংবা শুধু ক্রীড়াপ্রেমী হিসেবে গুলিস্তানের এই মার্কেটগুলো থেকে ক্রীড়া সামগ্রী কিনতে আসেন মানুষজন। লয়াল হাব অফিশিয়াল নামক অনলাইন পেইজের ব্যবসায়ী মোরসালিন যাত্রাবাড়ি থেকে এসেছিলেন নিজের ব্যবসার জন্য জার্সি কিনতে। তিনি বলেন, "অনেকগুলো দোকান ঘুরে দেখেছি আমরা। কোন দোকান থেকে কম দামে বেশি পরিমাণে মাল নিতে পারি তা-ই খুঁজছি। বিশ্বকাপ উপলক্ষে মানুষের দল বেঁধে জার্সি কেনার চাহিদা বাড়ছে এখন। তাই স্টক করছি আগে থেকেই।"
ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজের একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী জিহাদ আর ইমনও এসেছিলেন জার্সির বাজার ঘুরে দেখতে। কলেজের বন্ধুদের কাছে জার্সি বিক্রির জন্য একটি অনলাইন পেইজ খোলার পরিকল্পনা তাদের। জিহাদ বলেন, "লেখাপড়ার পাশাপাশি নিজেরা ছোটখাটো কাজের চেষ্টা করছি আমরা। সেটার জন্যই এখানে আসছি বিভিন্ন জার্সি দেখতে, প্রাইসের ব্যাপারে জানতে। নিজেদের পেইজে কোনটা কীভাবে আনতে পারি এই ব্যাপারে কিছু অভিজ্ঞতাও নিতে চাই এখান থেকে।"
খেলাধুলার পুরস্কার সামগ্রীর বেশ কিছু দোকান আছে মার্কেটগুলোতে। যেখানে বিভিন্ন ধরনের ক্রেস্ট, ট্রফি, মেডেল পাওয়া যায়। ক্রেতার চাহিদা অনুযায়ী কাস্টমাইজ করার সুযোগও আছে এগুলো। ফুটবল, ক্রিকেট বিশ্বকাপের নানান ট্রফির বিভিন্ন ধরনের রেপ্লিকা দেখা যায় দোকানগুলোতে। টুইন টাওয়ার মার্কেটের তাজ স্পোর্টসের বিক্রেতা হুমায়ুন বলেন, "পাইকারী হিসাবে ক্রেস্টের দাম ৫৫ টাকা থেকে ৫৫০০ পর্যন্ত হয়। আর ট্রফির দাম হয় ৪৫০ টাকা থেকে ১৮ হাজার টাকা পর্যন্ত। ক্রেস্ট বা ট্রফির ম্যাটেরিয়াল আর সাইজ অনুযায়ী দাম নির্ধারণ হয়।"
বিশ্বকাপ মৌসুমের অন্যতম চাহিদা নানান দেশের পতাকা। মার্কেট ঘুরে দেশীয়, আমদানিকৃত নানা ধরনের পতাকার খবর পাওয়া যায়। আমদানিকৃত পতাকাগুলো হয় প্রিন্ট করা। ৩ ফুট বাই ৫ ফুট সাইজের পতাকার দাম ২৫০ টাকার মতো। অন্যদিকে দেশে তৈরি পতাকাগুলো মূলত কাপড় জোড়া লাগিয়ে বানানো। সাইজভেদে সেগুলোর শুরু হয় ৫০ টাকা থেকে। টুইন টাওয়ার মার্কেটের ফারুক স্পোর্টসের বিক্রেতা মুনীর বলেন, "বিভিন্ন দেশের পতাকার ডিজাইন অনুযায়ীও দাম কম-বেশি হয়। আর্জেন্টিনা আর ব্রাজিলের ১০০ ফুট সাইজের পতাকা আমার দোকানে বানানো আছে। যার দাম পড়বে ৯ হাজার টাকার মতো।"
খেলাধুলার মৌসুম জমজমাট হয়ে এলেও ক্রীড়া সামগ্রীর বেঁচা-কেনা এখনো মার্কেটের বিক্রেতাদের আশানুরূপ শুরু হয়নি। করোনার ধাক্কা, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, যাতায়াত খরচ বৃদ্ধি ইত্যাদি সব মিলিয়ে ব্যবসা চলছে অনেকটাই ধীরগতিতে। ২০১৮ সালের ফুটবল বিশ্বকাপের তুলনায় এবারের বাজার সীমিত বলে ইতোমধ্যে ধরে নিয়েছেন তারা অনেকেই।
৮ বছর ধরে ক্রীড়া সামগ্রীর ব্যবসায় থাকা লগিন দোকানের কর্ণধার সানি কিছুটা হতাশার সুরেই বলেন, "বিশ্বকাপের জন্য খেলার সামগ্রী কেনাবেচার মৌসুম শুরু হয়ে গেছে। কিন্তু আশা অনুযায়ী বিক্রি এখনো হচ্ছে না। সামনের মাসে কিছুটা বাড়বে মনে হয়। তবে ২০১৮ এর বিশ্বকাপের মতো বিক্রির উপায় নেই। এবার সবকিছুরই দাম বেশি। যেটা আমরা গতবার ৯০০ টাকা করে বিক্রি করছি সেটা এবার ১১০০ টাকায় বিক্রি করা লাগছে কারণ আমদানি খরচ বেশি। এইসব কারণে এবার বিক্রিটা কম।"
ফুটবল, ক্রিকেট আর শীতকালীন খেলার মৌসুম একসাথে থাকায়ও কিছুটা চাপে আছেন ব্যবসায়ীরা। তাদের অনেকেরই পর্যাপ্ত পুঁজির সংকটও বড় সমস্যা। কোন জিনিসগুলো ক্রেতারা বেশি পছন্দ করবে, বিক্রি বেশি হবে সে চিন্তা করেই মালামাল আনতে হচ্ছে তাদের। তবে গত কয়েক বছরের করোনার ধাক্কার পর এবারের খেলাধুলার এই জমজমাট মৌসুমে অনেকটাই উৎসবমুখর সময় পার করছেন ক্রীড়া সামগ্রীর বিক্রেতারা।