উন্মুক্ত বিজ্ঞান ও পর্যাপ্ত তথ্যের সাহায্যেই বাংলাদেশের পানি সংকট মোকাবেলা করা সম্ভব
পৃথিবীর বৃহত্তম নদী ভিত্তিক ব-দ্বীপ গাঙ্গের ডেল্টা আর শত শত নদীর আবাসস্থল বাংলাদেশ। আবহমান কাল থেকেই বাংলা ছিল জল সমৃদ্ধ এক অঞ্চল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে বৃষ্টিপাত কমতে থাকা, গভীর সেচকাজ ও নদীর উজান মুখে মাত্রাতিরিক্ত পানির ব্যবহারের কারণে বদলাচ্ছে অবস্থা। আর্সেনিক ও নর্দমা থেকেও বাড়ছে দূষণের মাত্রা।
পৃথিবীকে বাঁচাতে হলে বাংলাদেশের মতো কৃষি অঞ্চলে পানির ব্যবহার আরও টেকসই হওয়া প্রয়োজন। অন্যান্য কৃষিপ্রধান অঞ্চলগুলোতেও পানি নিয়ে একই ধরনের টানাপোড়েন চলছে। পশ্চিম ও মধ্য যুক্তরাষ্ট্র, ভারতের উত্তরাঞ্চল এবং ব্রাজিলেও পানির উচ্চতা নেমে যাওয়ায় বেড়েছে কৃষকদের দুর্ভোগ। প্রায়ই সংবাদপত্রেও জায়গা করে নিচ্ছে এসব সংবাদ।
সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশ কিছু পদক্ষেপও নিয়েছে। ২০১৮ সালে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় 'বাংলাদেশ ডেল্টা প্ল্যান- ২১০০' প্রকাশ করে।
জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে দেশের টেকসই, স্থিতিস্থাপক আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন কৌশলের দীর্ঘমেয়াদী রূপরেখা হলো এই ডেল্টা প্ল্যান। পানির নিরাপত্তা এই পরিকল্পনার একটি মূল অংশ। এখানে দেশের পানি সংক্রান্ত মূল সমস্যাগুলোকে চিহ্নিত করা হলেও কার্যকরী পদক্ষেপের বিষয়গুলো অস্পষ্ট। এর জন্য আরও ভারী বিনিয়োগ এবং সহায়ক গবেষণার প্রয়োজন।
এই প্রতিবেদনে স্যাটেলাইট ও স্থানীয় ডেটা থেকে পানি সম্পদ বিশ্লেষণের মাধ্যমে বাংলাদেশে অপেক্ষাকৃত কম আলোচিত ঝুঁকিগুলো বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এখানে আমরা কী কী জানি, কী কী প্রশ্ন উত্থাপন জরুরি এবং সেখান থেকে আমাদের প্রাপ্ত তথ্যগুলোকে কী করে কাজে লাগানো যেতে পারে সেগুলো বিশ্লেষণ করা হবে।
বাংলাদেশের জল প্রবাহ ও বর্তমান অবস্থা
বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতিগুলোর মধ্যে অন্যতম। এদেশের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) ২০০০ সাল থেকে প্রায় আট গুণ বেড়েছে। খাদ্য নিরাপত্তাকে জোরদার করতে সরকার কৃষি নিয়ে কাজ করেছে। এর ফলে কৃষকরা শুধু জুন থেকে অক্টোবর পর্যন্ত বর্ষার আর্দ্র মৌসুমে নয়, শুষ্ক মৌসুমেও ধান চাষ করছে।
১৯৯০ সালের পর দেশের ধান উৎপাদনশীলতা প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশে বছরে প্রতি হেক্টর জমিতে ৪.৮ টন ধান হয় যেখানে ভারত ও থাইল্যান্ডের মতো অন্যান্য নেতৃস্থানীয় ধান উৎপাদনকারী দেশগুলোর হেক্টর প্রতি ফলন ২.৯- ৩.৯ টন।
কিন্তু ধান চাষে স্বয়ংসম্পূর্ণতার একটি বড় মূল্য চুকাতে হচ্ছে। বাংলাদেশে এখন শুষ্ক মৌসুমে প্রায় পাঁচ মিলিয়ন হেক্টর জমিতে সেচ দেওয়া হয়, যার ৭৩ শতাংশ ভূগর্ভস্থ পানি থেকে আসে। একই সময়ে ভারতেও ব্যাপকভাবে ভূগর্ভস্থ পানি সেচে ব্যবহৃত হচ্ছে। ভারত থেকে বাংলাদেশে পানি প্রবাহিত হওয়ায় পানির উৎসে চাপও বাড়ছে।
আমাদের স্যাটেলাইট ডেটার বিশ্লেষণে দেখা যায় ২০০২ সালের পর দেশের ৩৭.৫ বিলিয়ন ঘনমিটার টেরেস্ট্রিয়াল ওয়াটার মজুদ (নদী, হ্রদ, জলাভূমি, মাটির আর্দ্রতা, ভূগর্ভস্থ জল এবং তুষার জুড়ে থাকা ভূপৃষ্ঠতলের পানির সমষ্টি) কমে গেছে। এর মূল কারণ ভূগর্ভস্থ পানি কমে যাওয়া, যার বেশিরভাগই জমি সেচের জন্য তোলা হয়ে থাকে। বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল ও মেট্রোপলিটন ঢাকাসহ বেশ কিছু জায়গায় ২০০০ সাল থেকে প্রতি বছর পানির স্তর প্রায় এক মিটার নিচে নেমে যাচ্ছে। এর অর্থ অনেক কৃষকই এখন দুই দশক আগের তুলনায় আরও ২০ মিটার গভীর থেকে ভূগর্ভস্থ পানি পাম্প করে থাকে।
তবে সাম্প্রতিক কিছু গবেষণায় এর ইতিবাচক দিক তুলে ধরা হয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে ভূগর্ভস্থ পানির পাম্পিংয়ের কারণে বর্ষাকালে ভূমিতে বৃষ্টির পানি শোষণের ক্ষমতা বাড়ে। একইসঙ্গে তা দেশের জলাধারগুলোকে পুনরায় ভরে উঠতে সাহায্য করে। কিন্তু মাঠপর্যায় ও স্যাটেলাইট ডেটা থেকে প্রাপ্ত তথ্য থেকে দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার প্রমাণ মেলায় আমরা এটা নিয়ে প্রশ্ন তুলছি।
জলবায়ু পরিবর্তনে দেশের পানি সরবরাহের ওপরও চাপ সৃষ্টি হবে। অতিবৃষ্টির সম্ভাবনাও এখন বেশি। উদাহরণস্বরূপ, জুন মাসে বাংলাদেশে তীব্র বন্যায় কমপক্ষে ২২ জন মারা যায় এবং আরও ৪০ লাখ মানুষ বন্যার কবলে পড়ে।
তবে স্যাটেলাইট ডেটা থেকে দেখা যায় বাংলাদেশে বার্ষিক বৃষ্টিপাতের হার গত দুই দশকে প্রায় ১০ শতাংশ বা বছরে ১০ মিলিমিটার কমেছে। ৫০-এর দশক থেকে উদ্বেগজনকহারে বৃষ্টিপাত কমতে দেখা গেছে।
আমাদের রিভার-গজ ডেটা বিশ্লেষণে আরও দেখা যায় গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা নদীর শীতকালীন জল প্রবাহ ১৯৯৩ সাল থেকে ২০২১ সালের মধ্যে অর্ধেক হয়ে গেছে। এই আশ্চর্যজনক হ্রাসের কারণ বৃষ্টিপাতের হার কমে যাওয়া এবং কৃষিকাজে ভারতে উজান মুখে ভূগর্ভস্থ পানির পাম্পিং বেড়ে যাওয়া।
বাংলাদেশের অসংখ্য প্রাকৃতিক জলসম্পদ ভূতাত্ত্বিক ও মানবসৃষ্ট কারণেও দূষণের সম্মুখীন। দেশের শিলাগুলিতে উচ্চ মাত্রার আর্সেনিক রয়েছে। আর্সেনিক একটি বিষ ও কার্সিনোজেন। প্রাকৃতিকভাবে ভূগর্ভস্থ পানিতে প্রবেশ করে আর্সেনিক সেচকৃত ফসল ও মাটিকে দূষিত করতে পারে। বাংলাদেশের জনসংখ্যার ১৭ শতাংশ বা প্রায় ২৯ মিলিয়ন মানুষ আর্সেনিকের ঝুঁকিতে রয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে অগভীর কূপের পানি ব্যবহারে আর্সেনিক ছড়ায়। অথচ এগুলো বাংলাদেশের গ্রামীণ পানি সরবরাহ ব্যবস্থার অন্যতম মাধ্যম।
পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থাও একটি সমস্যা। ২০০৩ সালে ৪২ শতাংশ থেকে ২০১৫ সালে বাংলাদেশ উন্মুক্ত স্থানে মলত্যাগকারীর সংখ্যা প্রায় শূন্যে নামিয়ে আনলেও এখনও অনেকক্ষেত্রেই পয়ঃনিষ্কাশনের পানি ভূপৃষ্ঠের জলে অপসারিত হয়। গৃহস্থালির অপরিশোধিত পয়ঃনিষ্কাশন ছাড়াও ঢাকার নদীগুলোতে প্রতিদিন ৬০ মিলিয়ন লিটার অপরিশোধিত বা আংশিকভাবে শোধিত শিল্প বর্জ্য গিয়ে পড়ছে। ২০১৯ সালে বাংলাদেশ সরকার ও জাতিসংঘের শিশু দাতব্য সংস্থা ইউনিসেফের যৌথ সমীক্ষা অনুযায়ী দেশের মোট জনসংখ্যার ৮২ শতাংশ ই-কোলাই ব্যাকটেরিয়া দ্বারা দূষিত পানি ব্যবহার করছে।
পরিশেষে বাংলাদেশ নিম্নাঞ্চলীয় হওয়ায় সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি দেশের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। আমাদের স্যাটেলাইট ডেটা বিশ্লেষণে দেখা যায় সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা প্রতি বছর প্রায় ৫ মি.মি. হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ভূমি হ্রাসসহ অন্যান্য সব কারণের সঙ্গে মিলে ২০০১ সাল থেকে ৪৯০ বর্গকিলোমিটার উপকূলীয় ভূমি হারিয়ে গেছে। ফলে ভূগর্ভস্থ ও ভূ-পৃষ্ঠ উভয় স্থলের পানিই আরও লবণাক্ত হয়ে উঠছে।
যে তিন বিষয়ে প্রাধান্য দেওয়া জরুরি
নিম্নলিখিত উদ্যোগগুলো অনুসরণের মাধ্যমে বাংলাদেশের পানি সরবরাহ ব্যবস্থাকে আরও টেকসই করে তোলার পাশাপাশি বন্যার ক্ষয়ক্ষতি প্রশমণ করাও সম্ভব হবে।
১। পর্যাপ্ত তথ্য-উপাত্তের সাহায্যে বৃষ্টি ও নদীর পানি ব্যবস্থাপনা
দুই দেশের সীমান্তের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত বাংলাদেশের নদীগুলোর জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো শুষ্ক মৌসুমে তীব্র পানি ঘাটতি ও খরা এবং বর্ষাকালে বিপর্যয়কর বন্যা পরস্থিতি।
বিগত কয়েক দশক ধরে বাংলাদেশে স্থানীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বিশ্বব্যাংকের উদ্যোগে কয়েক হাজার সাইক্লোন শেল্টার, বন্যা ও ঝড় সহনশীল কাঠামো, কয়েক হাজার কিলোমিটার বাঁধ এবং শত শত পোল্ডার নির্মিত হয়েছে। ফলে ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষা পেয়েছে প্রায় তিন লাখ ৩৩ হাজার মানুষ। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট ক্রমবর্ধমান ঝুঁকির বিরুদ্ধে সুরক্ষার জন্য আরও বিনিয়োগ প্রয়োজন।
কিন্তু সব ধরনের উদ্যোগ গ্রহণের আগেই পানির প্রবাহ, সরবরাহ ও অন্যান্য পূর্বাভাস বুঝতে পারার জন্য পর্যাপ্ত ও ভালোমানের ডেটা প্রয়োজন। এসব তথ্যের ওপর ভিত্তি করেই উপযুক্ত স্থানে উপযুক্ত অবকাঠামো নির্মাণ সম্ভব।
তথ্য প্রাপ্তি এখানে একটি বড় সমস্যা। বাংলাদেশে প্রচুর পরিমাণে হাইড্রোলজিক্যাল ডেটা সংগ্রহ করা হয়। যেমন স্রোতের প্রবাহ, ভূ-পৃষ্ঠ ও ভূগর্ভস্থ জলের স্তর, বৃষ্টিপাত, জলের গুণমান এবং জলের ব্যবহার সম্পর্কিত তথ্যসমূহ। কিন্তু এই তথ্যগুলো সহজে পাওয়া যায় না। তথ্য পেতে গবেষকদের পৃথকভাবে অসংখ্য কর্মকর্তাদের কাছে দৌড়াদৌড়ি করতে হয়। শুধু বাংলাদেশের নয়, ভারতের হাইড্রোলজিক্যাল তথ্যগুলোও সংগ্রহ করা কঠিন। অথচ ভারত থেকে দেশে নদী প্রবাহিত হওয়ায় সঠিকভাবে পূর্বাভাস দিতে হলে এসব তথ্য জানাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতসহ নেপাল, ভুটান ও চীনের মতো পানি বন্টনকারী দেশগুলোর মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বৈজ্ঞানিক সহযোগিতা সব দেশকেই উপকৃত করবে। কম্বোডিয়া, লাওস, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামের মেকং নদী কমিশন একটি সফল আন্তঃসীমান্ত নদীবণ্টন চুক্তির মডেল হিসেবে কাজ করতে পারে।
একটি ওপেন-অ্যাক্সেস ডেটাবেজে হাইড্রোলজিক্যাল তথ্যসমূহ প্রকাশ করাটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হবে। তবে এই মুহূর্তে তহবিল, সহযোগিতা ও রাজনৈতিক নানা জটিলতায় বিদ্যমান তথ্যগুলো পাওয়াই বেশ কঠিন।
সৌভাগ্যবশত স্যাটেলাইট থেকে প্রাপ্ত তথ্য এই শূন্যস্থান পূরণ করতে সাহায্য করতে পারে। বর্তমানে পৃথিবী পর্যবেক্ষণকারী বিভিন্ন স্যাটেলাইট মিশন যেমন, গ্র্যাভিটি রিকভারি অ্যান্ড ক্লাইমেট এক্সপেরিমেন্ট (গ্রেস) ফলো-অন, গ্লোবাল প্রেসিপিটেশন মেজারমেন্ট (জিপিএম) নেটওয়ার্ক, মাল্টিপল রাডার অল্টিমিটার অ্যান্ড দ্য মডারেট রেজোলিউশন ইমেজিং স্পেকট্রোরেডিওমিটার (মোডিস) সেন্সরগুলো থেকে বিনামূল্যে তথ্য পাওয়া যায়। এখান থেকে সারা দেশে পানির অবস্থার সামগ্রিক চিত্র পাওয়া যায়। আমরাও আমাদের বিশ্লেষণে এসব তথ্য ব্যবহার করেছি।
স্যাটেলাইট ব্যবস্থা শিগগিরই আরও উন্নত হবে। ডিসেম্বরে নাসা ও ফ্রান্সের মহাকাশ সংস্থা সিএনইএস সারফেস ওয়াটার অ্যান্ড ওশান টপোগ্রাফি (এসডব্লিউওওটি) স্যাটেলাইট মিশন চালু করার পরিকল্পনা করেছে। সূক্ষ্ম স্থানিক রেজোলিউশনের সাহায্যে এসডব্লিওওটি বিশ্বব্যাপী মহাসাগর ও ভূ-পৃষ্ঠের পানি সম্পর্কিত আরও বিশদ তথ্য পর্যবেক্ষণের সুযোগ তৈরি করবে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিজ্ঞানীরা এই এসডব্লিউওওটির তথ্য সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াকরণ ও ব্যবহারের জন্য গত ১৫ বছর ধরে কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে প্রস্তুতি নিচ্ছে।
২। কৃষি অভিযোজন
ভূগর্ভস্থ পানির গতিপথের ওপর আরও গবেষণা প্রয়োজন। সেখান থেকেই বোঝা যাবে কী হারে পানি পুনরায় এসে জমবে, ভবিষ্যতে বৃষ্টির হার কীরকম হবে। ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহারের পদ্ধতি ও প্রয়োজনীয়তা নিয়মিত হালনাগাদ করে পানির স্তরের বিশদ তথ্য প্রকাশ করতে হবে। সেখান থেকেই দেশের একেক অঞ্চলে প্রয়োজন অনুসারে কৃষি ও গৃহস্থালি কাজে পানি পাম্পিং-এর মাধ্যমে টেকসই পানি ব্যবহার ব্যবস্থাপনা নির্ধারণ করতে হবে।
ফসলের জন্য কী পরিমাণ পানির প্রয়োজন তা স্যাটেলাইট-ভিত্তিক সেচ পরামর্শ দেওয়া সিস্টেমগুলোর সাহায্যে নির্ধারণ করা যেতে পারে। আমাদেরই একজন গবেষক উত্তর ভারত এবং পূর্ব পাকিস্তানে এরকম একটি ব্যবস্থা বাস্তবায়নে সাহায্য করেছেন। সিয়াটলের ইউনিভার্সিটি অব ওয়াশিংটনের সঙ্গে কানপুরের ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি ও ইসলামাবাদের পাকিস্তান কাউন্সিল অফ ওয়াটার রিসোর্সেস মিলিতভাবে এই প্রযুক্তির বিকাশ নিয়ে কাজ করেছে।
ধারণা করা হচ্ছে দুই দেশের এই দুই অঞ্চল মিলিয়ে এই প্রযুক্তি কাজে লাগানোর মাধ্যমে বছরে মিলিতভাবে ২০০ বিলিয়ন লিটারের বেশি ভূগর্ভস্থ জল সঞ্চয় করা সম্ভব হবে। সেচকাজের জন্য ব্যবহৃত পানির হিসাবে এটি খুব ক্ষুদ্র অনুপাত হলেও সরবরাহের জন্য যথেষ্ট।
অত্যধিক জলাবদ্ধতা এড়াতে এই ধরনের একটি প্রোটোটাইপ সিস্টেম বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জন্য তৈরি করা হয়েছে। দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলেও এর ব্যবহার সম্প্রসারিত করার পরিকল্পনা রয়েছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর পরিচালিত বাংলাদেশের কৃষি-আবহাওয়া সংক্রান্ত তথ্য ব্যবস্থায় এই সিস্টেমটিকে অন্তর্ভুক্ত করার পরিকল্পনাও রয়েছে।
এছাড়া বাংলাদেশের কৃষিখাত থেকে পানির চাপ কমাতে অন্যান্য যেসব উপায় অবলম্বন করা যেতে পারে, সেগুলো হলো: বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের ভালো ব্যবস্থা, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর যেসব অঞ্চলে খুব বেশি নিচে সেখানে ধানের পরিবর্তে গম ও লেগুমের মতো কম পানিতে উৎপাদনশীল ফসল চাষ।
আরেকটি কৌশল হলো সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি ও লবণাক্ত পানির অনুপ্রবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়া। উপকূলে ক্রমবর্ধমান লবণাক্ততার কারণে ইতোমধ্যে অনেক কৃষক তৈলবীজ, আখ এবং পাট চাষ বন্ধ করে চিংড়ি চাষে যেতে বাধ্য হয়েছে।
স্থানীয় মাছের প্রজাতিও লবণাক্ত অবস্থার সঙ্গে সহনশীল নয়। ফলে মাছ চাষীরাও ধান চাষীদের সঙ্গে মিঠা পানি নিয়ে সংগ্রাম করছে। এ অবস্থায় এখানে লোনা পানির মাছ চাষ করেই স্থানীয়রা উপকৃত হবে।
বেশ কিছু লবণ-সহনশীল গাছ যেমন অ্যাট্রিপ্লেক্স প্রজাতি, টামারিস্ক (টামারিক্স প্রজাতি), ম্যানগ্রোভ (অ্যাভিসেনিয়া মেরিনা), কোরিয়ান লন ঘাস (জোয়সিয়া জাপোনিকা), ইউফোরবিয়া ও স্যালিকর্নিয়া গাছগুলো এখন বাণিজ্যিকভাবে পাওয়া যায়। এগুলো লবণাক্ত উপকূলীয় অঞ্চলে ভালোভাবে জন্মায়।
খাদ্য ও পশুখাদ্য সরবরাহের পাশাপাশি এই গাছগুলোর মাটিকে লবণমুক্ত করার ক্ষমতা রয়েছে। মধ্যপ্রাচ্য এবং দক্ষিণ এশিয়ার উপকূলীয় অঞ্চলে গাছগুলো ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। বাংলাদেশে এরা কতটুকু উপযুক্ত তা নির্ণয়ে বিশদ গবেষণা জরুরি।
৩। দূষণের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তথ্য উন্মুক্তকরণ
কেন্দ্রীয় পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা বাংলাদেশের জন্য ব্যয়বহুল হতে পারে। শহরে বাসাবাড়িতে কম দামের সেপটিক ট্যাঙ্ক রয়েছে। কিন্তু বেশিরভাগই সঠিকভাবে নির্মিত নয়। ফলে এখান থেকে আংশিকভাবে শোধিত বর্জ্য ভূপৃষ্ঠের পানি ও জলাশয়ে নিষ্কাশন করে। গবেষকরা ভূ-পৃষ্ঠ ও ভূ-গর্ভস্থ পানির গুণমান পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে পুরো সিস্টেমের সমস্যা ও নতুন ব্যবস্থাপনায় আর্থিক ব্যয় হিসাব করে সরকারকে ক্ষয়ক্ষতির প্রাক্কলন জানাতে পারে।
আর্সেনিক দূষণ মোকাবেলায় গভীর কূপ খনন, ভূপৃষ্ঠের পরিষ্কার পানির পাইপ সংযোগ কিংবা স্থানীয়দের অন্য কোনো নিরাপদ পানির উৎসের সন্ধান দেওয়ার মাধ্যমে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। পানির গুণগত মান আরও বড় পরিসরে কম খরচে প্রতিনিয়ত নিরীক্ষণ করলে এই উদ্যোগগুলো আরও কার্যকর হয়ে উঠতে পারে।
ঢাকায় ৪১৪ কিলোমিটার ওয়াটার-সাপ্লাই নেটওয়ার্ক জুড়ে স্থাপিত রিমোট সেন্সরের সাহায্যে চাহিদা অনুযায়ী স্বয়ংক্রিয়ভাবে পানি সরবরাহের রেশনিং পানির অপচয় ১৫ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত কমিয়েছে। কর্তৃপক্ষ মনিটরিং সিস্টেম ইন্সটল শুরু করেছে যার মাধ্যমে নাগরিকরা যেকোনো সময় পানির গুণগত মান পরীক্ষা করতে সক্ষম হবে।
বাংলাদেশ নিরাপদ পানি সরবরাহের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় রাজনৈতিক সদিচ্ছা দেখিয়েছে। এর সাফল্য এখন নির্ভর করছে মানসম্মত উন্মুক্ত-অ্যাক্সেস ডেটা, গবেষণা ও অবকাঠামো নির্মাণে তহবিলের পরিমাণের ওপর।
২০৩০ সাল পর্যন্ত ডেল্টা প্ল্যান বাস্তবায়নে প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছে ৩৮ বিলিয়ন ডলার। প্রাথমিকভাবে অবকাঠামোগত উন্নয়নে বিশ্বব্যাংক ১.৮ বিলিয়ন বিনিয়োগ করেছে। দ্রুত বর্ধনশীল বাংলাদেশের জরুরি টেকসই পানি ব্যবস্থাপনার লক্ষ্য পূরণ করতে হলে বাকি অর্থের জন্য এখন অভ্যন্তরীণ বাজেট ও বিদেশি সহায়তার ওপর নির্ভর করতে হবে।
অনুবাদ: তামারা ইয়াসমীন তমা