বিশ্বের দীর্ঘতম ১০ সেতু
নদী, সমুদ্র, হ্রদ বা খালবিল, পর্বতের বাধা যুগে যুগে স্থলপথে সহজে যোগাযোগ স্থাপনের অন্তরায় হয়েই ছিল। এই বাধা দূর করতেই মানব সভ্যতার এক গুরুত্বপূর্ণ প্রকৌশল আবিষ্কার সেতু। সেতু বা ব্রিজ সড়ক সেতু, রেল সেতু বা উভয় বৈশিষ্ট্য সম্পন্নও হতে পারে। জলাশয় বা পাহাড়ি খাদের দুই প্রান্তে যোগাযোগ পরিষেবার গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম আজ তারা। একইসঙ্গে, ভ্রমণের সময়ও কমিয়ে আনতে ভূমিকা রাখে সেতু।
সেতু নির্মাণ-প্রকৌশলের দিক থেকে বিস্ময় জাগানিয়াও হয়। অসামান্য শিল্পকর্মের মতোই যা মুগ্ধ করে পথযাত্রীদের। বিস্তীর্ণ জলরাশির ওপর বা পর্বত প্রান্তে স্থাপিত সেতুগুলো স্থাপত্য কৌশলের পাশাপাশি চারপাশের অনবদ্য প্রাকৃতিক দৃশ্যও উপভোগের সুযোগ করে দেয়। ফলে তারা শুধু যোগাযোগের মাধ্যম না থেকে হয়ে ওঠে একটি অঞ্চল বা দেশের গৌরবেরও বস্তু। সম্প্রতি বাংলাদেশের পদ্মাসেতুর বিষয়েও এমন আলোচনা হয়েছে।
বিশ্বে আইকনিক ল্যান্ডমার্ক হিসেবে বিখ্যাত এমন সেতুর মধ্যে প্রথমেই নাম করা যেতে পারে যুক্তরাষ্ট্রের স্যান ফ্রান্সিসকোর গোল্ডেন গেট ব্রিজের। লন্ডনে টেমস নদীর ওপর টাওয়ার ব্রিজও আরেক অনন্য উদাহরণ।
দৈনন্দিন যাতায়াতের মাধ্যম হোক বা অর্থনীতির চালিকাশক্তি—সুবৃহৎ সেতুগুলোর ক্ষেত্রে একটি বিষয় সর্বজনীন। তা হলো তাদের দৈর্ঘ্য। মানবদক্ষতা ও উদ্ভাবনেরও স্বাক্ষর তারা। চলুন তবে এক নজরে দেখে নেওয়া যাক, দৈর্ঘ্যের শীর্ষে থাকা বিশ্বের ১০টি সেতু সম্পর্কে।
১. দায়াং-কুনশান গ্রান্ড ব্রিজ, চীন
চীনের বিস্ময় দায়াং-কুনশান গ্রান্ড ব্রিজ ১০০ মাইলের বেশি (১৬৫ কি.মি.) দৈর্ঘ্যের। বলাই বাহুল্য এটাই দুনিয়ার দীর্ঘতম সেতু। মাত্র চার বছরে নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করে এটি ২০১১ সালে চালু করা হয়। চীনজুড়ে উচ্চ গতির ট্রেন চলাচলের জন্য এটি নির্মাণ করা হয়, অর্থাৎ এটি একটি রেলসেতু।
খাল, হ্রদসহ বিভিন্ন রকম ভৌগলিক প্রতিবন্ধকতার ওপর তৈরি হয়েছে সেতুটি। এতে ব্যয় হয়েছে সাড়ে ৮০০ কোটি ডলার। শক্তিশালী সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড় বা টাইফুন থেকে শুরু করে রিখটার স্কেলে ৮ মাত্রার অতি-শক্তিশালী ভূমিকম্প সহনশীল করেই এটি গড়ে তুলেছেন চীনের প্রকৌশলীরা। এমনকি ৩ লাখ ৩০ হাজার টন ওজনের জাহাজের ধাক্কা লাগলেও টিকে যাবে এর কাঠামো।
২. চংহুয়া-কাওশিউং ভায়াডাক্ট, তাইওয়ান
বিশ্বের দ্বিতীয় দীর্ঘ সেতু হলো তাইওয়ানের চংহুয়া- কাওশিউং ভায়াডাক্ট। ভায়াডাক্ট হলো এমন ধরনের সেতু, যা একাধিক ছোট সেতুর সমন্বয়ে গঠিত। এটিও একটি রেলসেতু, যা তাইওয়ানের উচ্চ গতির রেল নেটওয়ার্কের অংশ।
এ সেতু দৈর্ঘ্যে ৯৭ মাইল (বা ১৫৭ কিলোমিটার) পর্যন্ত বিস্তৃত। এই অঞ্চলে সচরাচর যে মাত্রায় ভূকম্পন হয়, সেগুলো সহনশীল হিসেবে গড়ে তুলতে চংহুয়া-কাওশিউং ভায়াডাক্টকে বিশেষভাবে একাধিক সংযোগ সেতুর সমন্বয়ে নির্মাণ করা হয়েছে। তাইওয়ান ফিলিপাইন সি প্লেট ও ইউরেশিয়ান প্লেট নামক দুটি টেকটোনিক প্লেটের ওপর অবস্থিত হওয়ার কারণেই এই সতর্কতা।
৩. কাংদে গ্রান্ড ব্রিজ, চীন
বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম এই সেতুটিও চীনে। এটিও একটি রেলসেতু যা দৈর্ঘ্যে ৭২ মাইল (বা ১১৬ কিলোমিটার)। রাজধানী বেইজিং হয়ে যাত্রী পরিবহনের প্রধান রেলপথের অংশ এটি।
বেইজিং-সাংহাই হাই স্পিড রেলওয়ের আওতায় থাকা সেতুটি আসলে এর চেয়েও বড় এবং বিশ্বের বৃহত্তম দায়াং-কুনশান গ্রান্ড ব্রিজ এরই অংশ। এই রেলপথের অন্যান্য সেতুর মতোই এটিকেও উচ্চ মাত্রার ভূকম্পন সহনশীল করে নির্মাণ করা হয়েছে।
৪. তিয়ানজিন গ্রান্ড ব্রিজ, চীন
চীনে যেন বিশ্বের দীর্ঘতম সেতুর ছড়াছড়ি। তাই অবাক হওয়ারও কিছু নেই যখন চতুর্থ দীর্ঘ তিয়ানজিন গ্রান্ড ব্রিজও সেদেশেরই। এটিও একটি রেলসেতু। বিভিন্ন জলাশয়, নিম্ন ভূমি ও অন্যান্য প্রাকৃতিক বাধার ওপর এটি নির্মাণ করা হয়েছে, যাতে মসৃণ পথে যাত্রী নিয়ে ছুটতে পারে ট্রেন।
চীনের হেবেই প্রদেশের তিয়ানজিনে নির্মিত এই রেলসেতু ২০১১ সালে চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হয়। ৭০ মাইল (বা ১১৩ কিলোমিটার) দৈর্ঘ্যের তিয়ানজিন গ্রান্ড ব্রিজ দাঁড়িয়ে রয়েছে কংক্রিটের অতি-শক্তিশালী গার্ডারের ওপর। যার প্রতিটির ওজন ৮৬০ টন।
৫. ওয়েইনান ওয়েইহে গ্রান্ড ব্রিজ, চীন
২০০৮ সালে যান চলাচলের জন্য চালু করা ৪৯ মাইল দৈর্ঘ্যের এই সেতুটি সেসময়ে বিশ্বের দীর্ঘতম সেতুর রেকর্ড করেছিল। পরে এটিকে ছাড়িয়ে যায় ইতোপূর্বে উল্লেখ করা সেতুগুলো।
তবে উদ্বোধনের সময় এটি বিশ্বজুড়ে প্রকৌশলের এক অসামান্য অর্জন হিসেবে সমাদৃত হয়েছিল। এটি একটি রেলসেতু। কয়েকটি নদীর ওপর নির্মিত হওয়ায় যাত্রার সময় কমিয়ে এনে এটি চীনের জেংঝৌ ও জিয়ান শহরের মধ্যে রেলযোগাযোগে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
৬. হংকং-জুহাই-ম্যাকাও ব্রিজ, চীন
২০১৮ সালের অক্টোবরে বিশ্বের ষষ্ঠ দীর্ঘতম সেতু হংকং-জুহাই-ম্যাকাও ব্রিজ যান চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হয়। কেবল বা তারের মাধ্যমে ভারবহনকারী তিনটি সেতু, সমুদ্রের নিচ দিয়ে নির্মিত একটি সুড়ঙ্গ ও চারটি কৃত্রিম দ্বীপ নিয়ে গঠিত এই সেতু চীনের উপকূলীয় হংকং, জুহাই ও ম্যাকাও এর মতো বড় শহরগুলিকে যুক্ত করেছে।
৩৪ মাইল (৫৫ কিলোমিটার) দৈর্ঘ্যের এই সেতু বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র পারাপারের সেতু এবং একইসঙ্গে উন্মুক্ত সাগরের ওপর নির্মিত দীর্ঘতম সেতু।
৭. বাং না এক্সপ্রেসওয়ে, থাইল্যান্ড
বাং না এক্সপ্রেসওয়ে বিশ্বের সপ্তম দীর্ঘ সেতু হলেও, এটিকে বিশ্বের দীর্ঘতম মোটরকার চলাচলের সেতু বলাই যায়। বাং না এক্সপ্রেসওয়ে একটি ছয় লেনের উড়াল সড়ক। প্রতি লেনের প্রান্তে রয়েছে টোল আদায়ের স্টেশন। ৩৪ মাইল দৈর্ঘ্যের এই সেতু ব্যবহার করে ব্যাংককের যানজট এড়িয়ে শহরের এক প্রান্ত থেকে চলাচলের সুযোগ দেয়।
৮. বেইজিং গ্রান্ড ব্রিজ, চীন
চীনের রাজধানী বেইজিংয়ের দক্ষিণে অবস্থিত এই সেতুটিও বেইজিং-সাংহাই হাই স্পিড রেলওয়ের অংশ। ২০১১ সালে চালু করা সেতুটির দৈর্ঘ্য ৩০ মাইল (৪৮ কিলোমিটার)। চীনের পূর্ব উপকূলের বোহাই অর্থনৈতিক অঞ্চল ও ইয়াংজে নদীর অববাহিকা অঞ্চলকে যুক্ত করতে এটি নির্মিত হয়। কৃষিপণ্য ও অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদ পরিবহনে এই অঞ্চলে যে রেল সুবিধা দরকার ছিল, তা নিশ্চিত করেছে বেইজিং গ্রান্ড ব্রিজ।
৯. লেক পন্টচারট্রেইন কজওয়ে, যুক্তরাষ্ট্র
যুক্তরাষ্ট্রের লুইজিয়ানা রাজ্যের লেক পন্টচারট্রেইন কজওয়ে যুক্তরাষ্ট্রের একমাত্র সেতু যা বিশ্বের দীর্ঘতম সেতুর তালিকায় রয়েছে। প্রায় ২৪ মাইল (বা ২৯ কিলোমিটার) এই সেতু এদিক থেকে নবম অবস্থানে। একই দৈর্ঘ্যের পাশাপাশি দুটি সেতু নিয়ে গঠিত লেক পন্টচারট্রেইন কজওয়ে ১৯৫৬ ও ১৯৬৯ সালে উদ্বোধন করা হয়।
হ্রদের ওপর দিয়ে চলাচলের সময় দুই প্রান্তেরই জমি চোখে পড়ে না মোটরযান যাত্রীদের। এটি এতটাই লম্বা যে, গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস একে জলরাশির ওপর নির্মিত বিশ্বের দীর্ঘতম সেতু হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।
১০. উহান মেট্রো লাইন-১, চীন
হুবেই প্রদেশের উহান শহরের কথা মনে পড়ে, সেই যেখানে ২০১৯ সালের শেষদিকে শুরু হয়েছিল করোনাভাইরাসের ভয়াল সংক্রমণ। এটি কিন্তু চীনের অন্যতম প্রধান এক নগর। চলাচলের জন্য রয়েছে এর একটি উড়াল মেট্রোরেল পথ, যাকে একেবারেই সাদামাটাভাবে লাইন-১ নামকরণ করা হয়েছে।
লাইন-১ বিশ্ব রেকর্ডধারী সেতুও। দৈর্ঘ্যে ২৩.৫ মাইল এই সেতু শুধু বিশ্বের দশম দীর্ঘ সেতুই নয়, একইসাথে বিশ্বের অন্যতম দীর্ঘ মেট্রোরেল ভায়াডাক্ট।
সূত্র: হাউ স্টাফ ওয়ার্কস