স্লিপ স্ট্রিমার: ঘুমিয়ে ঘুমিয়েই আয় করেন যারা
ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে টাকা কামাতে কে না চায়! কিন্তু এমন কোনো কাজ কি আদৌ আছে? গত কয়েক বছর ধরে ইউরোপ-আমেরিকাসহ পশ্চিমা বিশ্বে জনপ্রিয়তা পাওয়া স্লিপ স্ট্রিমাররা কিন্তু ঠিকই ঘুমিয়ে আয় করার উপায় বের করেছেন।
একজন অপরিচিত মানুষকে ঘুমন্ত অবস্থায় দেখতে কি আপনার ভালো লাগে? ঘুমিয়ে থাকা কাউকে তীক্ষ্ণ কোনো শব্দ কিংবা ইলেকট্রিক শক দিয়ে জাগিয়ে তুলতে কি আপনার আনন্দ হয়?
প্রশ্নগুলোর উত্তর যদি 'হ্যাঁ' হয়ে থাকে, তাহলে হয়তো আপনিও স্লিপ স্ট্রিমারদের লাইভ স্ট্রিম উপভোগ করবেন। স্প্যানিশ সংবাদমাধ্যম এল পাইস-এ প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে জানা গেল অদ্ভুত এই স্ট্রিমিংয়ের খুঁটিনাটি।
বেশি কিছু নয়। ভালোমানের ভিডিও রেকর্ড করার মতো কোনো ডিভাইস (ফোন বা ক্যামেরা) ও সেটি ধরে রাখার জন্য একটি ট্রাইপড থাকলে আপনিও বনে যেতে পারেন স্লিপ স্ট্রিমার। মূলত করোনাকালে জনপ্রিয়তা পায় ঘুমন্ত লোকেদের এই স্ট্রিমিং। যারা স্লিপ স্ট্রিমিং উপভোগ করেন, তাদের বেশিরভাগই নিজেদের চাপমুক্ত করার জন্য এ ধরনের স্ট্রিমিং দেখতেন। এছাড়া, অন্যকে ঘুমাতে দেখার দৃশ্য তাদের অনিদ্রা দূর করতেও সাহায্য করেছে বলে জানান অনেকেই।
তবে করোনার শুরুতে, অর্থাৎ ২০২০ সালে তেমন বেশি উপার্জন করতে পারতেন না স্লিপ স্ট্রিমাররা। ফলে আয়ের উৎস হিসেবে সে সময় তেমন জনপ্রিয়তা পায়নি এ মাধ্যম। তবে মাঝে মাঝে বালিশ কিংবা ম্যাট্রেসের কোম্পানি স্লিপ স্ট্রিমারদের স্পন্সর করলে তার মাধ্যমে কিছু অর্থ আয় করতেন তারা। কিন্তু ধীরে ধীরে এর জনপ্রিয়তা বাড়তে শুরু করলে পাল্টে যেতে থাকে স্ট্রিমিংয়ের ধরন।
এখন কেউ স্লিপ স্ট্রিম করতে চাইলে তাকে অবশ্যই তাদের স্ট্রিম মানিটাইজ করতে হবে। পাশাপাশি লাইভ দেখা অডিয়েন্সরা যাতে চাইলেই তাদেরকে ঘুম থেকে জাগাতে পারে, তার সুযোগ দিতে হবে স্ট্রিমারদের। মূলত বিচিত্র এই মাধ্যমেই আয় করে থাকেন তারা। যত বিরক্তিকরভাবে, যত অদ্ভুতভাবে, যত উচ্চ শব্দ ব্যবহার করে স্ট্রিমারদেরকে জাগানো হবে, তত বেশি অর্থ আয় করবেন তারা।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায় জেকি বোয়েমের কথাই। স্লিপ স্ট্রিমিং করা ২৮ বছর বয়সি অস্ট্রেলিয়ান এ টিকটকারের ফলোয়ার সংখ্যা ১ মিলিয়নেরও বেশি। ওয়্যার্ড এবং ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল-এর তথ্য অনুসারে, স্ট্রিমিংয়ের মাধ্যমে তার মাসিক আয় ৩৫ হাজার ডলার।
প্রতি রাতে নিজের ঘুম লাইভ স্ট্রিম করেন তিনি। রাত ১০টায় স্ট্রিম চালু করে ঘুমান জেকি। এরপর সারারাত ধরেই নানা ধরনের গেমের মাধ্যমে তাকে জাগানোর চেষ্টা করে ভিউয়াররা। এই গেমগুলো (স্ট্রিমিংয়ে এগুলোকে 'গিফট' হিসেবে উল্লেখ করা হয়) খেলার জন্য তাদের গুনতে হয় নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থও। একেকটি গেমের জন্য রয়েছে একেক ধরনের পেমেন্ট। রুমে উজ্জ্বল আলো জ্বালিয়ে, তীব্র কোনো শব্দ, কিংবা উচ্চস্বরে কোনো গান বাজিয়ে জেকির ঘুম ভাঙানোর চেষ্টা করতে পারেন তার ভিউয়াররা। এরমধ্যে একটি হলো 'দ্য শাইনিং'-এ জ্যাক নিকলসনের চরিত্রের বলা "হিয়ার্স জনি!" লাইনটি উচ্চস্বরে বাজানো।
জেকির ভিউয়াররা তাকে জাগাতে ১ ডলার থেকে শুরু করে ৩৮০ ডলার পর্যন্ত খরচ করতে পারেন। ১ ডলার খরচ করে একজন ভিউয়ার একটি রোবটের সাহায্যে জেকির ঘুম ভাঙাতে পারেন। এ অর্থ খরচ করে চ্যাটরুমে কেউ নিজের পছন্দসই বার্তা লিখলে, একটি বট সেই বার্তা উচ্চশব্দে বাজায়। ৯৫ ডলার খরচ করে জেকির হাতে পরা একটি ব্রেসলেটের মাধ্যমে তার দেহে ইলেকট্রিক শক দিতে পারেন ভিউয়াররা। ৩৮০ ডলার খরচ করে একজন ভিউয়ার জেকির রুমের প্রত্যেকটি ডিভাইস পাঁচ মিনিটের জন্য চালু করে রাখতে পারবেন। তাছাড়া যখনই কোনো ভিউয়ার ডলার খরচ করে তাকে জাগানোর চেষ্টা করেন, তখন বাকি ভিউয়াররাও অ্যালার্ট পান। তারাও উপভোগ করতে পারেন এই গেম। প্রতি রাতে ১০টা থেকে শুরু করে ভোর ৫টা ২০ মিনিট পর্যন্ত চলে এই লাইভ স্ট্রিম।
তবে মানুষকে ঘুমাতে দেখা নতুন কোনো বিষয় নয়। ১৯৬৪ সালে অ্যান্ডি ওয়ারহল 'স্লিপ' নামক একটি সিনেমা নির্মাণ করেন। ৫ ঘণ্টা ২০ মিনিটের এ পুরো সিনেমাজুড়ে কেবল তার প্রেমিক জন জিওর্নোকে ঘুমাতেই দেখেন দর্শকরা। এরপর ২০০৪ সালে শিল্পী স্যাম টেলর-জনসনের নির্মিত একটি ভিডিও প্রদর্শন করে লন্ডনের ন্যাশনাল পোর্ট্রেট গ্যালারি। 'ডেভিড' নামক সেই ভিডিও আর্টেও এক তরুণকে ১০৭ মিনিট ধরে ঘুমাতে দেখা যায়।
কিন্তু কেন আমরা অন্যদের ঘুমাতে দেখতে পছন্দ করি? বেশ কয়েকজন স্লিপ স্ট্রিমার জানিয়েছেন, তাদের আগে অনিদ্রার সমস্যা ছিল। অপরিচিত কাউকে ঘুমাতে দেখার পর প্রথমবারের মতো শান্তিতে ঘুমিয়েছিলেন তারা।
তবে স্লিপ স্ট্রিমাররা তাদের ভিউয়ারদের নিদ্রার ওপর কোনো ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারছেন কি না, তা যাচাইয়ের জন্য দুই বছর খুবই কম সময়। আবার ডেভিড স্পিগালের মতো কিছু নিদ্রা এবং সম্মোহন বিশেষজ্ঞ মনে করেন, মানুষ সামাজিক প্রাণী হওয়ায় তার মধ্যে অন্যের জন্য সহানুভূতি দেখানো খুবই স্বাভাবিক বিষয়। এ কারণে অন্যকে ঘুমাতে দেখলে, তা আমাদেরও মন শান্ত করতে সাহায্য করে।
ওয়্যার্ড ও ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে জেকির উপার্জনের পরিমাণ প্রকাশিত হলেও, স্লিপ স্ট্রিমারদের উপার্জন নিয়ে তেমন কিছু জানা যায় না। তবে ২৬ বছর বয়সি স্লিপ স্ট্রিমার মিকেল নিয়েলসেন জানান, মাসে কেবল দুটি লাইভ স্ট্রিম করেই একটি অ্যাপার্টমেন্টের যাবতীয় বিল ও ভাড়ার খরচ মেটানো সম্ভব।
অন্যদিকে '(নট) গেটিং পেইড টু ডু হোয়াট ইউ লাভ' বইয়ের লেখক এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম অর্থনীতির বিশেষজ্ঞ ইরিন ডাফির মতে, স্ট্রিমারদের উপার্জনের এই অঙ্কগুলো নির্দিষ্ট নয়। একজন স্লিপ স্ট্রিমার সফলভাবে উপার্জন করতে পারলেও, আরেকজনও যে একই পরিমাণে উপার্জন করতে পারবেন তা কিন্তু নয়। তাছাড়া শুরুর দিককার স্লিপ স্ট্রিমারদের সাফল্য দেখে অনেকেই এদিকে আগ্রহী হতে পারেন। কিন্তু দেখা যায়, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এতে তাদের ঘুমের সাইকেল, সর্বোপরি জীবনযাত্রার গুণগত মানই ব্যাহত হচ্ছে।