ইমতিয়াজের ‘স্টোরিহেড’: গল্পের ছলে জটিল বিজ্ঞানের সমাধান করেন যিনি!
বিজ্ঞান মানেই 'কঠিন' বা 'জটিল'…এমন ধারণা অনেকের মনেই রয়েছে। অনেকে আবার মনে করেন, বিজ্ঞানকে সহজভাবে শেখার জন্য যদি আলাদীনের চেরাগ পাওয়া যেত, তাহলে হয়তো অনেক সমস্যা চুকেবুকে যেতো। একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে চেরাগ ঘষে দৈত্য হয়তো পাওয়া যাবে না- কিন্তু বিজ্ঞানের জটিল সব সমস্যাকে এক চুটকিতে সমাধান করার মতো মানুষ অবশ্যই পাওয়া যাবে। আর সহজভাবে বিজ্ঞানের গল্প বলার কাজটি করে 'স্টোরিহেড'।
স্টোরিহেডের নেপথ্যের নায়ক ইমতিয়াজুল হক অর্নব ওরফে ইমতিয়াজ অর্নব। বিজ্ঞানের দাঁতভাঙ্গা সব বিষয়কে গল্পের ছলে উপস্থাপন করাই তার কাজ। আইনস্টাইনের 'থিওরি অভ রিলেটিভিটি' কিংবা নিউটনের 'সূত্র'; আবার ব্ল্যাকহোল কিংবা ভূমিকম্প- এ ধরনের কঠিন বিষয়গুলোর বিজ্ঞানসম্মত সহজ ব্যাখ্যা নিয়ে কাজ করেন ইমতিয়াজ অর্নব। শুধু কী বিজ্ঞানীদের সূত্র! মেসির পায়ে কী জাদু আছে- তার বিজ্ঞানসম্মত প্রমাণ নিয়েও ভিডিও আছে ইমতিয়াজের ঝুলিতে।
তথ্যবহুল উপস্থাপনের কারণে স্টোরিহেডের মাধ্যমে ফেসবুক ও ইউটিউবে জনপ্রিয় ইমতিয়াজ অর্নব। নেই কোনো আতিশয্য কিংবা চাকচিক্য, বরং কথার জাদু ও অ্যানিমেশনের ঝলকে সকলকে মুগ্ধ করে রাখেন ইমতিয়াজ। ছোট ছোট বিষয় নিয়ে তার দারুণ ব্যাখ্যা যে কাউকে বিজ্ঞানের প্রতি আকৃষ্ট করতে সক্ষম।
২০২১ সাল থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু হয় স্টোরিহেডের। তবে তার প্রস্তুতি শুরু হয়েছিলো ২০১৭ সাল থেকে। সেসসময় নিজের ফোন দিয়েই ইমতিয়াজ ভিডিও তৈরি করতেন এবং এডিট করে ফেসবুক প্রোফাইলে দিতেন। এক পর্যায়ে সিদ্ধান্ত নিলেন ইউটিউব চ্যানেল খুলবেন। যেমন কথা তেমন কাজ। ভিডিও তৈরির প্রতি যে বিপুল আগ্রহ আছে তা সে যাত্রাতেই প্রথম বুঝতে পেরেছিলেন ইমতিয়াজ।
সে সময়টাতে ইউটিউবের দুনিয়ায় নেহাত শিশু ছিলেন ইমতিয়াজ। ভিডিও তৈরির প্রতি আকর্ষণ থাকলেও তার খুঁটিনাটি সম্পর্কে জানাশোনা ছিলো একেবারেই কম। ২০২১ সালে যখন পেশাগতভাবে যাত্রা শুরু করলেন, তখন বুঝতে পারলেন ইউটিউবের দুনিয়ায় অবগাহনের জন্য প্রয়োজন অনেক পড়াশোনা। ফলে নেন সাময়িক বিরতি। ইউটিউব সম্পর্কে সাত-আট মাস পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে অধ্যয়নের পর স্টোরিহেডকে নিয়ে শুরু করেন নতুনভাবে পথচলা। এরপর আর থেমে যাননি। বরং আনন্দের সাথেই সবার মাঝে ছড়িয়ে দিচ্ছেন বিজ্ঞানের আলো।
বিজ্ঞানের গল্প বলাই মূল আকর্ষণ
'বিজ্ঞানের গল্প বলি'- এটিকে প্রতিপাদ্য করেই ইমতিয়াজ এগিয়ে চলছেন স্টোরিহেড নিয়ে। 'স্টোরিহেড' নামের মাহাত্ম্য জানতে চাইলে ইমতিয়াজ বলেন, 'আমি আসলে গল্প তৈরিকে ভিত্তি হিসেবে ধরে কন্টেন্ট তৈরি করি। অনেকে আমাকে বলেন, আমি নাকি অনেক তথ্যবহুল ভিডিও বানাই, সেটি অবশ্য ঠিক। কিন্তু আমার ভিডিওর মূল হচ্ছে গল্প; গল্প বলার মতো করেই একজন মানুষ কথা বলবে। এজন্যই নাম স্টোরিহেড। আমি গল্প বলতে ভালোবাসি ও পছন্দ করি।'
ছোটবেলা থেকে বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহ থাকায় বিজ্ঞানভিত্তিক ভিডিও বানাতে ভালোবাসেন ইমতিয়াজ। বিজ্ঞানের আনন্দকে উপভোগ করেন বলে এটি নিয়েই থাকেন তিনি। কথার জাদুতে সবাইকে মুগ্ধ করে রাখার গুণ এক্ষেত্রে তাকে এগিয়ে রেখেছে। এ সম্পর্কে কথা বলতে গিয়ে হেসে বলেন, 'ছোটবেলা থেকেই আমি ভালো ছাত্র ছিলাম না। কিন্তু একজন ব্যাখ্যাকারী হিসেবে যতটুকু আমি বুঝি, তা অন্যকে বোঝাতে পারি।'
কন্টেন্ট যাতে সব বয়সের মানুষই উপভোগ করতে পারে সেভাবেই বিষয় নির্বাচন করেন ইমতিয়াজ। তাই বিষয় নির্বাচনের জন্য তাকে চালাতে হয় বিস্তর গবেষণা। ভিডিওর জন্য নির্ধারিত বিষয়ের উপর প্রশ্ন ধরে উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেন তিনি। এভাবেই নিত্যনতুন ভিডিও নিয়ে আইডিয়া পান। তাছাড়া কিছু বিষয় পূর্বেই নির্ধারণ করে রেখেছেন তিনি। সেগুলো নিয়েই কাজ করে যাচ্ছেন ধীরে ধীরে।
স্টোরিহেডের জন্য একেকটি ভিডিওর কাজ করতে এক-দেড় মাস সময় লেগে যায় ইমতিয়াজের। একা হাতেই সারতে হয় ভিডিও তৈরি থেকে শুরু করে এডিটিং এর কর্মযজ্ঞ।
সব বয়সীদের জন্যই তার এসব ভিডিও। ইমতিয়াজ বলেন, '১৪-১৫ বছরের উপরে যারা আছে তারা স্টোরিহেডের কন্টেন্ট দেখে বুঝতে পারবে। যারা বিজ্ঞান সম্পর্কে জানে বা কিছু কম জানে তারাও দেখতে পারবে। যেহেতু স্টোরিহেডে শিক্ষামূলক কন্টেন্ট বেশি থাকে, তাই শিক্ষার্থীরাই দেখার জন্য বেশি আগ্রহ অনুভব করে। আমি যখন কোনো মাসের ডাটা বা এনালিটিক্স চেক করি, তখন দেখতে পাই ১৮ থেকে ২৪ বছর বয়সীরা ভিডিও বেশি দেখে। তারা মূলত কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী।'
ফেসবুকের তুলনায় ইউটিউবে বেশি পাওয়া যায় গঠনমূলক মন্তব্য
দর্শক প্রতিক্রিয়া ইমতিয়াজ তার ভাবনার চেয়েও বেশি পাচ্ছেন। এর পেছনে অবশ্য কাজ করেছে ফেসবুক অ্যালগরিদম সম্পর্কে তার সুক্ষ্ম জ্ঞান। প্রায় সবসময়ই প্রতিটি ভিডিওর কমেন্ট পড়ে ও কমেন্টের উত্তর দিয়ে দর্শকের কাছাকাছি থাকার চেষ্টা করেন তিনি। ইমতিয়াজের মতে, এখান থেকে তিনি নিয়মিত শিখছেন এবং নতুন উদ্যোমে কাজ করার অনুপ্রেরণা পাচ্ছেন। তবে নেতিবাচক মন্তব্য যে একেবারেই আসে না, তা নয়। নেতিবাচকতাকেও সাদরে গ্রহণ করেন তিনি।
ফেসবুক ও ইউটিউব উভয় জায়গা থেকেই সমানভাবে সাড়া পাচ্ছেন ইমতিয়াজ। তিনি বলেন, 'লাইক-কমেন্টের সংখ্যার দিক থেকে ফেসবুক এগিয়ে আছে সবসময়। কারণ ফেসবুকে ইউটিউবের তুলনায় মানুষ সময় বেশি কাটায়। তবে দর্শক প্রতিক্রিয়ার মানের দিক থেকে ইউটিউব এগিয়ে আছে। এটা অবশ্য অ্যালগরিদমের জন্যই হচ্ছে। ইউটিউব অ্যালগরিদম দর্শকের পছন্দের সাথে মানানসই ভিডিও সামনে এনে দেয়, যা ফেসবুক করে না। তাই ইউটিউবে গঠনমূলক মন্তব্য বেশি আসে এবং ফেসবুকে অপ্রাসঙ্গিক মন্তব্য বেশি আসে।'
শুরু থেকেই পরিবারের সমর্থন পাচ্ছেন ইমতিয়াজ। পেশাগতভাবে যখন শুরু করেন, তখনই পরিবারকে সবকিছু অবহিত করেন তিনি। তাই সেখান থেকেও কোনোরূপ বাধা পাননি।
বাদ দেন না কোনো ক্যান্ডিড মোমেন্ট
মাইকেল স্টিভেন্স ও কেসি নাইস্ট্যাটকে দেখে কাজ করার অনুপ্রেরণা পান ইমতিয়াজ অর্নব। মাইকেল স্টিভেন্স যিনি ভি-সস চ্যানেলের জন্য বিখ্যাত, বিজ্ঞানভিত্তিক ভিডিও বানানোর জন্য তাকে অনুসরণ করেন ইমতিয়াজ। অপরদিকে লাইফস্টাইল ভ্লগার হিসেবে কেসি নাইস্ট্যাটও ইমতিয়াজের পছন্দের তালিকায় রয়েছে।
ইমতিয়াজ জানান, 'ভিডিও তৈরির সময় পারফেকশন আনার জন্য অনেকসময় একেকটি শট ১০ বারও নিতে হয়। পরে যখন এডিট করতে বসি, তখন দেখি- প্রথমবার যেটি ত্রুটিপূর্ণ মনে হয়েছিলো, সেটিই সবচেয়ে ভালো হয়েছে। অথচ পারফেকশনিস্ট হওয়ার উদ্দেশে যে শটগুলো নিয়েছিলাম, সেগুলোতে দেখা যায় ত্রুটি রয়েছে। এটি খুবই মজা লাগে, যেটি আমি এডিট করার সময় খেয়াল করি।'
ভিডিও তৈরি করতে গিয়ে কাজের মধ্যে সরলতা ও স্বকীয়তা বজায় রাখার চেষ্টা করেন ইমতিয়াজ। তাই অনেকসময় ভিডিও তৈরির সময় যদি কথা বলতে গিয়ে কোনো সমস্যা হয় বা ভুল হয় তা বাদ দেন না। বরং ভুলকে সঠিক করে কন্টেন্টের মধ্যে কীভাবে আনা যায়, তার দিকে নজর দেন তিনি।
ইমতিয়াজ বলেন, 'এনায়েত চৌধুরী ভাই বা রাফসান দ্য ছোটভাই-কে দেখি, শ্যুটের মধ্যে কোনো ভুল যদি হয়েও যায় তাহলে সেগুলোকে এডিটিংয়ে বাদ দেন না, রেখে দেন। মজার কিছু ক্যান্ডিড মোমেন্ট আছে, যেগুলো খুব বেশি অর্থ বহন না করলেও দর্শককে আরো কাছে নিয়ে আসে। দর্শক অনুভব করে যে, একটা মানুষ তার ভুলকে লুকাতে চাচ্ছে না।'
বিজ্ঞানে আগ্রহী করতে প্রয়োজন উৎসাহ
শিশুদের বিকশিত হওয়ার সুযোগ দেওয়া উচিত বলে মনে করেন ইমতিয়াজ। শিশুটি যা করতে আগ্রহী, তাকে সেটাই করতে দেয়া উচিত। ইমতিয়াজের মতে, প্রত্যেক শিশুরই চাঁদ-সূর্য কী তা জানার আগ্রহ থাকে। তাই তারা ক্রমাগত প্রশ্ন করতেই থাকে। এক্ষেত্রে অভিভাবকদের উৎসাহ দিতে হবে। একটি প্রশ্ন করলে বরং আরো প্রশ্ন করার জন্য আগ্রহী করতে হবে। এমনকি উত্তর খোঁজার জন্যও তাদের অনুপ্রাণিত করতে হবে।
বিজ্ঞান বিষয়ে নতুন প্রজন্মকে আগ্রহী করতে কোনো বার্তা আছে কি-না জানতে চাইলে ইমতিয়াজ বলেন, 'বিজ্ঞান বিষয়ে মানুষ জন্মগতভাবেই আগ্রহী। ফুয়েল মানুষের ভেতরে আছে, শুধু স্পার্ক করে দিলেই দাউ দাউ করে জ্বলবে। নতুন কিছু অন্বেষণ করতে চাওয়ার প্রবণতা আমাদের এখানে ছোটবেলাতেই দমন করে দেওয়া হয়। সেটা অনেকসময় বাবা-মায়েরা না বুঝে করেন বা শিক্ষকেরা অনেকসময় না বুঝে করেন। শিক্ষকেরা বুঝলেও তাদের কিছু করার থাকে না। পরীক্ষার আগে সিলেবাস শেষ করা, অধ্যায় শেষ করা শিক্ষকের মূল দায়িত্ব থাকে। তাই তিনি চাইলেও অনেকসময় এক্সপ্লোর করতে পারেন না।'
২০২১ সালে ময়মনসিংহ পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থেকে ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ডিপ্লোমা করেছেন তিনি। এরপর ইচ্ছা স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেওয়া। বর্তমানে নেত্রকোনাতে নিজ বাড়িতেই ভিডিও তৈরির কাজ করেন ইমতিয়াজ।
বিজ্ঞানের প্রতি ভালোবাসা থাকায় ইমতিয়াজের অবসরও কাটে বিজ্ঞান বিষয়ক বই পড়ে ও বিজ্ঞান নিয়ে ভিডিও দেখে। বিজ্ঞান নিয়ে কাজ করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করায় এটি নিয়েই এগিয়ে যেতে চান তিনি। তবে ভবিষ্যতে বিজ্ঞান ছাড়াও খেলাধুলা, ইতিহাস, রাজনীতি বা সাম্প্রতিক বিষয় নিয়েও কাজ করার ইচ্ছা তার রয়েছে। তবে সেসব বিষয়ের জন্য নতুন চ্যানেল খুলে নতুন আঙ্গিকে আসতে চান ইমতিয়াজ।
বর্তমানে ফেসবুকে ২ লক্ষ ১৫ হাজার ফলোয়ার রয়েছে স্টোরিহেডের। একইভাবে ইউটিউবে ৭৮,৩০০ মানুষ অনুসরণ করে স্টোরিহেড চ্যানেলকে।
স্টোরিহেডকে বাংলাদেশের সবচেয়ে ভালো বিজ্ঞান বিষয়ক চ্যানেল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করাই হলো ইমতিয়াজের লক্ষ্য। যত সময়ই লাগুক না কেন, লক্ষ্যে অবিচল থেকে তা পূরণ করতে চান ইমতিয়াজ অর্নব।