মার্কিনীরা এক সময় ভাবত কালোরা সাদাদের মতো গাইতে পারে না!
১৮৫১ সালে এলিজাবেথ টেইলর গ্রিনফিল্ড নামক একজন কনসার্ট সপরানোর একটি ন্যাশনাল ট্যুর ভেঙেচুরে দিয়েছিল আমেরিকার সঙ্গীতজগতের দৃশ্যপটকে।
যে নারী শিল্পী উচ্চগ্রামে গাইতে পারেন, তাকে সপরানো বলা হয়। গৃহযুদ্ধের আগের আমেরিকায় বিনোদনের অনুষঙ্গ হিসেবে অপেরা ও কনসার্ট সঙ্গীত তুমুল জনপ্রিয় ছিল। ইউরোপের তখনকার খ্যাতিম্যান কনসার্ট সপরানো ছিলেন জেনি লিন্ড, ক্যাথেরিন হেইস প্রমুখ।
গ্রিনফিল্ড ছিলেন এদের চেয়ে ভিন্ন। তিনি ছিলেন একজন সাবেক দাস। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গীত জগতে তখন তার গাওয়া গানগুলো কেবল শ্বেতাঙ্গদের গাইবার উপযুক্ত বলে মনে করা হতো।
জন সুলিভান ডুইটের মতো ১৯ শতকের বেশিরভাগ সঙ্গীত সমালোচক মনে করতেন, আফ্রিকান-আমেরিকান শিল্পীদের পক্ষে শ্বেতাঙ্গদের মতো করে গান গাওয়া সম্ভব নয় — তারা কেবল সাধারণ গানই তৈরি করতে পারতেন, যেগুলোর কোনো শৈল্পিক গভীরতা ছিল না।
কিন্তু গ্রিনফিল্ড দৃশ্যপটে আবির্ভূত হয়ে শিল্প ও জাতি সম্পর্কে মার্কিনীদের পূর্বনির্ধারিত ধারণাকে ভেঙে গুড়িয়ে দিলেন।
'দ্য ব্ল্যাক সোয়ান'
দাসপ্রথার সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিসিসিপিতে ১৮২০ সালের দিকে জন্মগ্রহণ করেন এলিজাবেথ টেইলর গ্রিনফিল্ড। বাল্যকালে তাকে ফিলাডেলফিয়ার একজন দাসপ্রথাবিরোধী ব্যক্তি লালন-পালন করেন।
গান গাওয়াটা মূলত নিজের চেষ্টায় শিখেছিলেন তিনি। নিউ ইয়র্কে বাফেলো মিউজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন-এর সহায়তায় কনসার্ট ক্যারিয়ার শুরু করেন তিনি। তার ডাকনাম হয়ে যায়, 'দ্য ব্ল্যাক সোয়ান'। প্রসঙ্গত, তখন জেনি লিন্ডকে ডাকা হতো 'দ্য সুইডিশ নাইটিংগেল' হিসেবে।
১৮৫১ সালে কর্নেল জোসেফ এইচ. উড গ্রিনফিল্ডের প্রমোটার নিযুক্ত হন। উড ছিলেন একজন বর্ণবাদী মানুষ, সে কথা খোলাখুলিভাবেই স্বীকার করতেন তিনি। সঙ্গীতের প্রমোটার হিসেবেও তিনি অমানবিক ছিলেন। গ্রিনফিল্ডকে দিয়ে খ্যাতি অর্জন করতে চেয়েছিলেন তিনি।
উড ১৮৫০ সালের ফিউজিটিভ স্লেভ অ্যাক্টের কড়া সমর্থক ছিলেন। গ্রিনফিল্ডের সঙ্গে উডের এ যৌথ পেশাদার সম্পর্ক গ্রিনফিল্ডের আফ্রিকান-আমেরিকান সমর্থকদের জন্য বিতর্কের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু ছিল।
বর্ণবাদে ডুবে ছিলেন সমালোচকেরা
গৃহযুদ্ধপূর্ববর্তী আমেরিকায় সঙ্গীত বিষয়ক বিনোদনের অন্যতম জনপ্রিয় ধারা ছিল মিন্সট্রেল শো। এসব শোয়ে শ্বেতাঙ্গ অভিনয়শিল্পীরা মুখে কালো রং করে আফ্রিকান-আমেরিকান মানুষদের নিয়ে বিভিন্ন স্টেরিওটাইপ ব্যাঙ্গাত্মকভাবে উপস্থাপন করতেন।
কিন্তু গ্রিনফিল্ডের নৈপুণ্যের দরুন সমালোচকেরা এসব স্টেরিওটাইপ নিয়ে নতুন করে ভাবতে বাধ্য হন। দ্য ক্লিভল্যান্ড প্লেইন ডিলার নামক একটি স্থানীয় পত্রিকার বদৌলতে জানা যায়, গ্রিনফিল্ডের সঙ্গীত শুনে উপস্থিত দর্শকেরা বিভ্রান্ত হয়ে পড়তেন। '...আমরা একজন কৃষ্ণাঙ্গ নারীকে চোখের সামনে গাইতে দেখছি, কিন্তু শুনতে পাচ্ছি একজন দেবদূতের গলা, এটার মানে কী?' এভাবেই দর্শকদের বিভ্রমকে বর্ণনা করেছে ওই পত্রিকাটি।
গ্রিনফিল্ড একজন বড় মাপের মেধাবী শিল্পী ছিলেন — এ ব্যাপারে সমালোচকেরা অবশেষে ঐকমত্যে পৌঁছান। কিন্তু তারপরও বর্ণবাদের সঙ্গে তাদের কর্ণসুধার বিবাদ মেটাতে বিস্তর বেগ পেতে হচ্ছিল। এর একটা সমাধান তারা বের করেন অবশ্য — গ্রিনফিল্ডের মেধার কথা মেনে নেন, কিন্তু তাকে অপরিশীলিত শিল্পী হিসেবে বর্ণনা করেন তারা।
যেমন, নিউ-ইয়র্ক ডেইলি ট্রিবিউন-এ লেখা হয়, 'বলা বাহুল্য, এরকম একজন শিল্পীকে খুঁজে পাওয়ার প্রত্যাশা করিনি আমরা। তার গলা খুব সুন্দর কিন্তু সেটাকে ব্যবহার করতে জানেন না তিনি।'
জন্মাল এক নক্ষত্র
১৮৫৩ সালের ৩১ মার্চ নিউ ইয়র্কে নিজের প্রথম কনসার্টটি মেট্রোপলিটন হলে পরিবেশন করেন গ্রিনফিল্ড।
এ হলটি তৈরি করা হয়েছিল জেনি লিন্ডের কথা মাথায় রেখে। বিশ্বের অন্যতম বড় পারফর্ম্যান্স হল ছিল এটি। কনসার্টের আগের দিন নিউ-ইয়র্ক ডেইলি ট্রিবিউন একটি বিজ্ঞাপন ছাপায়। সেখান লেখা হয়:
'বিশেষ বিজ্ঞপ্তি — কোনো কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তি প্রবেশ করতে পারবে না, কারণ তাদের জন্য জুতসই করে এ গৃহের কোনো অংশ তৈরি করা হয়নি।' এ নিষেধাজ্ঞার পর সারা শহরে বিক্ষোভ শুরু হয়। তার জেরে নিউ ইয়র্ক সিটির প্রথম পুলিশ কমিশনার জর্জ ডব্লিউ. ম্যাটসেল মেট্রোপলিটন হলে পুলিশের একটি বিশাল দল পাঠাতে বাধ্য হন।
মঞ্চে ওঠার পর দর্শক গ্রিনফিল্ডের উদ্দেশে হাসতে শুরু করেন। কিছু সমালোচক এ দর্শকদের অভদ্র হিসেবে আখ্যা দেন। অন্য সমালোচকেরা এটিকে হালকা বিনোদন হিসেবে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। শোয়ের শুরুর একটি বিব্রতকর মুহূর্তের বর্ণনা পাওয়া যায় একটি সংবাদ প্রতিবেদনে। সেখানে লেখা হয়, গ্রিনফিল্ডকে স্পর্শ করতে ভয় পাচ্ছিলেন একজন শ্বেতাঙ্গ। 'সোয়ান'কে যেন তার কাছে একটি দুপেয়ে জলহস্তী হিসেবে মনে হচ্ছিল — বর্ণনা করা হয় প্রতিবেদনটিতে।
শুরুটা অপয়া হলেও, কনসার্ট শুনে সমালোচেকার রায় দেন, গ্রিনফিল্ডের কণ্ঠের পাল্লা ও সক্ষমতা ছিল বিস্ময়কর। আমেরিকা ট্যুর শেষ করার পর ইউরোপে ট্যুর শুরু করেন তিনি। সে ট্যুরে তার সঙ্গী হয়েছিলেন আঙ্কল টম'স কেবিন-এর লেখক হ্যারিয়েট বিচার স্টো।
এক শিল্পীর লেগেসি
সিসিয়েরেটা জোন্স থেকে শুরু করে অড্রা ম্যাকডোনাল্ডের মতো কৃষ্ণাঙ্গ নারী কনসার্ট শিল্পীদের ক্যারিয়ারের পথ তৈরি করে দিয়েছিলেন গ্রিনফিল্ড। ১৯২১ সালে সঙ্গীতশিল্পী ও সঙ্গীত প্রকাশক হ্যারি পেস কৃষ্ণাঙ্গ মালিকানাধীন প্রথম সফল রেকর্ড কোম্পানি ব্ল্যাক সোয়ান রেকর্ডস-এর নাম তার সম্মানে রাখেন।
কিন্তু গ্রিনফিল্ডের কিংবদন্তী তার চেয়েও বড় ছিল।
নিউ ইয়র্কের কনসার্টের পর নিউ-ইয়র্ক ডেইলি ট্রিবিউন গ্রিনফিল্ডের সক্ষমতাকে সর্বান্তকরণে মেনে নিয়ে তাকে আমেরিকা ছেড়ে ইউরোপে চলে গিয়ে সেখানে বাস করার আহ্বান জানায়। এর মাধ্যমে পত্রিকাটি বোঝাতে চেয়েছিল, গ্রিনফিল্ডের মাতৃভূমি তখনো কৃষ্ণাঙ্গ শিল্পচর্চার বৈধতাকে গ্রহণ করার জন্য প্রস্তুত ছিল না।
কিন্তু গ্রিনফিল্ডের ট্যুর আফ্রিকান-আমেরিকান শিল্পীদের সক্ষমতাকে প্রমাণ করা ছাড়াও আরও অনেক বড় প্রভাব ফেলেছিল। তার ট্যুর আমেরিকার কৃষ্ণাঙ্গ শিল্পীদের স্বীকৃতি দেওয়া ও তাদেরকে সম্পূর্ণ মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার জন্য আমেরিকাকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছিল।
সূত্র: দ্য কনভার্সেশন