আশা: ‘বডি পজিটিভিটি’ ও আত্মবিশ্বাসের এক নতুন অধ্যায়
ইংল্যান্ডের কভেন্ট্রি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি নেওয়া বাংলাদেশের মেয়ে এলমা সিদ্দিকা তার জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে গিয়ে বড় ধরনের শারীরিক পরিবর্তনের মুখোমুখি হন। ফলে তার বিভিন্ন মাপের অন্তর্বাস প্রয়োজন হয়। কিন্তু প্রয়োজনের সময় এলমা অবাক হয়ে দেখেন, বাংলাদেশের কোনো ব্র্যান্ডই গতানুগতিক শারীরিক আকারের বাইরে গিয়ে ভিন্ন ভিন্ন আকৃতির দেহের জন্য অন্তর্বাস তৈরির বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে না। এমনকি অন্তর্বাস নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠিত ব্র্যান্ডের সংখ্যাও দেশে খুবই কম।
"বেশিরভাগ ব্র্যান্ডই দেখা যায় এস, এম ও এল সাইজ নিয়ে কাজ করে। কিন্তু ডাবল এক্সএস এবং ডাবল এক্সএল এর মতো সাইজগুলো এতটাই অপ্রতুল যে আমাকে বিদেশি ব্র্যান্ডের অন্তর্বাস খুঁজতে হয়েছিল। আমি এমন একটি ব্র্যান্ড প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলাম যেখানে সব ধরনের শারীরিক আকার ও গড়নের মানুষদের জন্য অন্তর্বাস থাকবে।"
আর এই ধারণা থেকেই শুরু এলমার লঞ্জারি (অন্তর্বাস) ব্র্যান্ড 'আশা'র যাত্রা। ২০২২ সালের এপ্রিলে এই ব্র্যান্ডটি প্রতিষ্ঠা করেন এলমা। যেসব নারী এখনও নিজেদের শারীরিক গড়নকে স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারছেন না বা দ্বিধাবোধ করেন, তাদের জন্য আশার আলো বয়ে আনতে চায় 'আশা'।
এমনকি ব্র্যান্ডের লোগোটিও তৈরি হয়েছে- বাজারে নারীদের অন্তর্বাসের ক্ষেত্রে যে বৈষম্য রাখা হয়েছে এবং যার ফলে বহু নারী নিজেদের চাহিদামাফিক পণ্য কিনতে পারছেন না- এই ধারণাকে কেন্দ্র করে।
এলমার ভাষ্যে, "বডি পজিটিভিটি বা নিজের শরীর সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা রাখা আমাদের সুস্থতার একটা বড় অঙ্গ। আমরা যে যেমনই আছি, সেভাবেই নিজেকে গ্রহণ করা উচিত। 'আশা' এই ধারণাকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে এবং সেই বার্তাই প্রচার করে যাচ্ছে।"
আর সে কারণেই নিজের পণ্যের প্রচারণার জন্য ফটোশ্যুটেও এলমা সাধারণ নারীদেরই বেছে নেন। তারা মোটা হোক বা চিকন, শরীরে স্ট্রেচ মার্ক এবং অন্যান্য 'ত্রুটি' থাকলেও তা ফটোশ্যুটের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায় না।
সমাজে ট্যাবু হিসেবে বিবেচিত বিষয়, যেমন- ঋতুস্রাব, নারীদের মানসিক স্বাস্থ্য; এগুলো নিয়ে কথা বলতে নারীদের উৎসাহিত করে 'আশা'। এলমার কাছে 'আশা' একটি ব্র্যান্ডের চাইতেও বেশি কিছু। তিনি এই প্ল্যাটফর্মটিকে খুবই সন্তোষজনক এবং মানুষের সাথে যুক্ত হওয়ার একটি বড় মাধ্যম বলে মনে করেন।
"আমরা প্রায়ই অচেনা নারীদের কাছ থেকে ম্যাসেজ পাই, আমাদের ব্র্যান্ড এবং আমাদের কাজ নিয়ে প্রশংসা করেন তারা। কেউ কেউ এও বলেছেন যে আশা তাদের আত্মবিশ্বাস বাড়িয়েছে এবং নিজের মধ্যে সুন্দর অনুভূতি নিয়ে আসতে সাহায্য করেছে। এ ধরনের বার্তা আমাদের অনুপ্রেরণা জোগায় এবং সামনে এগিয়ে যেতে ও ভালো কাজ করতে সাহায্য করে", বলেন এলমা।
বর্তমানে 'আশা' ২০ সদস্যের একটি দল। ব্র্যান্ডটির উৎপাদন ইউনিট ঢাকার বাইরে অবস্থিত।
যেহেতু অন্তর্বাস ব্যবহার সরাসরি মানুষের স্বাস্থ্যের সঙ্গে জড়িত, তাই এ সম্পর্কিত সঠিক জ্ঞান থাকাটা জরুরি। অবাক করা বিষয় হলো, প্রতি পাঁচজন নারীর মধ্যে চারজন নারীই সারাজীবন ভুল বক্ষবন্ধনী (ব্রা) পরে থাকেন এবং তারা বুঝতেও পারেন না এটি তাদের স্বাস্থ্যের ওপর কী বিরূপ প্রভাব ফেলে।
"অন্তর্বাসের ক্ষেত্রে সঠিক সাইজ এবং কাপড় বেছে নেওয়া খুবই জরুরি। আমাদের অবশ্যই এ বিষয়ে পরামর্শ দেওয়া উচিত", বলেন এলমা।
অন্তর্বাসের ফ্যাব্রিক বা কাপড়ের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করে 'আশা'। এলমা নিজে পলিয়েস্টার-ভিত্তিক মিশ্রণের ফ্যাব্রিক পছন্দ করেন; যদিও কিছু মানুষের পলিয়েস্টার কাপড় নিয়ে কুসংস্কার আছে যে এটি আরামদায়ক নয় এবং স্বাস্থ্যের জন্য খারাপ।
কিন্তু এলমা মনে করেন, "পলিয়েস্টার মেশানো কাপড় আমাদের ত্বকের জন্য খুবই ভালো এবং আরামদায়ক। আমরা মনে করি, অন্তর্বাসের ক্ষেত্রে সুতি কাপড়ই সবচেয়ে ভালো অপশন; কিন্তু সব ক্ষেত্রে তা সত্য নয়। বারবার ধোওয়ার সাথে সাথে সুতি কাপড় খুবই অনমনীয় এবং অস্বস্তিকর হয়ে ওঠে।"
এছাড়াও, বড় পরিসরে পণ্য উৎপাদনের পর বেঁচে যাওয়া ফ্যাব্রিকগুলো দিয়েও অন্তর্বাস বানায় ব্র্যান্ডটি। সর্বোচ্চ গুণমান ও নান্দনিকতা বজায় রাখার জন্য আনুষঙ্গিক জিনিসগুলো আমদানিও করে থাকে তারা।
এখন পর্যন্ত 'আশা' শুধুমাত্র নিম্নাঙ্গের অন্তর্বাস (প্যান্টি) নিয়ে কাজ করছে। বেসিক ও লেস- এই দুই ধরনের প্যান্টি বাজারে এনেছে তারা। বেসিক প্যান্টিগুলো দৈনন্দিন ব্যবহারের উপযোগী। ৩টি ধাঁচে এগুলো নিয়ে এসেছে ব্র্যান্ডটি- হিপস্টার, বিকিনি ও থং। এগুলোর দাম ২৩৫ টাকা থেকে শুরু করে ২৪৫ টাকা পর্যন্ত। আর লেসের অন্তর্বাসগুলো (প্যান্টি) পাওয়া যাবে ১৮০ টাকা থেকে শুরু করে ২৫৫ টাকার মধ্যে।
আশা যেহেতু স্বতন্ত্র উপকরণ নিয়ে কাজ করে, তাই তারা খুবই সীমিত পরিমাণে পণ্য বাজারে আনে এবং সেগুলো একবার বিক্রি হয়ে গেলে পুনরায় স্টকে আনা হয় না।
এছাড়াও, 'আশা' অন্তর্বাস তৈরির ক্ষেত্রে সিমলেস বন্ডিং প্রযুক্তি নিয়ে এসেছে, যা আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডগুলোর পণ্যের ক্ষেত্রে দেখা যায়। এ প্রযুক্তিতে সাধারণ সেলাইয়ের বদলে বন্ডিং ব্যবহার হওয়ায় অন্তর্বাস পরিধানের পর খুবই মোলায়েম অনুভূতি হয়। এ প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে প্যান্টি-লাইনও দৃশ্যমান হয় না।
তবে আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় নারী হয়ে একটি অন্তর্বাসের ব্র্যান্ডের কাজ চালিয়ে নেওয়া এবং এর প্রচারণা করা সহজ ছিল না এলমার জন্য। সোশ্যাল মিডিয়ায় 'আশা' ব্র্যান্ডের পোস্ট করা ছবিগুলোতে প্রায়ই সমালোচনামূলক বা নেতিবাচক মন্তব্য আসে; এমনকি 'নগ্নতা'র অভিযোগে কিছু কিছু পোস্ট সরিয়েও নিয়েছে ফেসবুক কর্তৃপক্ষ।