‘বিনামূল্যের’ ইন্টারনেট যুগের সমাপ্তি দেখতে যাচ্ছি আমরা?
ইন্টারনেটের ব্যবহার ছড়িয়ে পড়ার পর বিনামূল্যে ডাউনলোড করতে পারাকে ব্যবহারকারীরা ইন্টারনেটের বড় একটি সুবিধা হিসেবে বিবেচনা করতেন। নেপস্টার ও টরেন্ট জনপ্রিয় হওয়ার কারণে রেকর্ড কোম্পানি ও সিনেমাশিল্প একসময়ে এগুলোকে ভয় পেতেও শুরু করেছিল। ইন্টারনেট আরও বেশি মানুষের কাছে পৌঁছে যাওয়ার পর কোম্পানিগুলো বিনামূল্যের সেবার পরিমাণও বাড়িয়ে দিয়েছিল।
যেমন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম অ্যাপ ও সার্চ ইঞ্জিনগুলো মানুষ বিনামূল্যেই ব্যবহারের সুযোগ পেতেন (এখনো পাচ্ছেন)। এসব কোম্পানির পক্ষে গ্রাহকের কাছ থেকে কোনো অর্থ নেওয়ার অবকাশ ছিল না, কারণ লাখ লাখ গ্রাহকের ডেটা তারা ব্যবহার করেছিল তথাকথিত সুনির্দিষ্ট বিজ্ঞাপনের জন্য। এসব কোম্পানিতে বিনিয়োগ করার লোকেরও অভাব ছিল না।
কিন্তু হালে মনে হচ্ছে ইন্টারনেটের এ মডেলের দিন বুঝি ফুরিয়ে এল। সবার আগে এ নিয়মকে চ্যালেঞ্জ করেছে টুইটার। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমটির নতুন মালিক ইলন মাস্ক মনে করেন, টুইটার থেকে অর্থ আয় করার সময় এখন। টু্ইটার ব্লু নামক নতুন এ পেইড সেবাটির শুরুটা একটু হোঁচট খেলেও এখন এটি তাল ফিরে পেয়েছে।
এদিকে মেটা'র প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মার্ক জুকারবার্গও তার বড় দুই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম — ফেইসবুক ও ইনস্টাগ্রাম — নিয়েও একই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। মেটা ভেরিফাইড নামক নতুন এ সাবস্ক্রিপশন পরিকল্পনায় ব্যবহারকারীরা নিজেদের অ্যাকাউন্ট কোনো অফিসিয়াল আইডি দিয়ে ভেরিফাই করে নিতে পারবেন এবং একটি নীল ব্যাজ পাবেন। নিজের কর্পোরেট ব্লগে জুকারবার্গ এর খরচও জানিয়ে দিয়েছেন: মাসে ১১.৯৯ ডলার। প্রসঙ্গত, টুইটারে ভেরিফিকেশনের খরচ আট ডলার।
এটাই কি তবে ইন্টারনেটে বিনামূল্যের সেবার শেষের শুরু? ব্যাপারটা হয়তো একেবারেই তা নয়, তবে এ ধরনের নতুন সিদ্ধান্ত এটাই ইঙ্গিত করে যে, সামনের দিনে ইন্টারনেটে বিনামূল্যের সেবার পরিমাণ কমে যাবে এবং যেগুলো থাকবে সেগুলোর মানও খুব একটা ভালো হবে না। বিজনেস অ্যান্ড স্কুল ফর দ্য ডিজিটাল ইরা'র মহাপরিচালক রদ্রিগো মিরান্ডা বলেন, 'এখন যা যা ঘটছে তা স্বাভাবিক, আজ হোক বা কাল – এটা একদিন না একদিন হতোই।'
মিরান্ডা ব্যাখ্যা করেন, 'একক ব্যবহারকারী প্রতি খুবই কম প্রান্তিকের বড় প্রযুক্তির ব্যবসায়িক মডেলগুলো আয়তন ও নগদীকরণের ওপর নির্ভরশীল।' ফ্রিমিয়াম মডেলের মূলভিত্তিই এটি। ফ্রি ও প্রিমিয়ামের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা এ মডেলে ৯৫ শতাংশ ব্যবহারকারী বিনামূল্যে সেবা গ্রহণ করেন, এবং পাঁচ শতাংশ ব্যবহারকারীদের লক্ষ্য করে কোম্পানিগুলো নিজেদের আয় বৃদ্ধি করতে চায়।
এর আগে এসব কোম্পানিগুলোর এ ধরনের মূল্য আরোপের সিদ্ধান্ত না নেওয়ার কারণ হলো, তখন তাদের পুঁজিপ্রবাহ ভালো ছিল। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ডিজিটাল ব্যবসার বাজারে অর্থের প্রবাহ অনেক বেশি ছিল। এ ব্যবসায়র এত দ্রুত প্রবৃদ্ধি ঘটছিল যে, পরিচালকদের তখন অন্য কোনো ব্যবসায়িক ফর্মুলার কথা চিন্তা করতে হয়নি।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোর পেইড সেবা আনার আরেকটি কারণ হলো মানুষ এখন অর্থ খরচ করতে ইচ্ছুক। মিরান্ডার মতে, এসব মাধ্যম ব্যবহার করে দৈনন্দিন বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন ব্যবহারকারীরা, ফলে এগুলোর জন্য অর্থব্যয় করার সিদ্ধান্ত নিতে তাদের বিশেষ বেগ পেতে হচ্ছে না।
পেইড সেবার এ প্রবণতা এখন কেবল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে সীমাবদ্ধ নেই। ওপেনএআই'র কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন কথোপকথনের টুল চ্যাটজিপিটিও ব্যবহারকারীদেরকে আরও ভালো সেবা দিতে সাবস্ক্রিপশন ব্যবস্থার কথা ঘোষণা দিয়েছে। তাহলে কি শেষ পর্যন্ত সার্চ ইঞ্জিনগুলো ব্যবহারের জন্যও আমাদেরকে অর্থ ব্যয় করতে হবে? এ সম্ভাবনাও এখন উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না — বিশেষত সার্চ ইঞ্জিনে এআই চ্যাটবট যুক্ত করার গুগল ও মাইক্রোসফটের মধ্যকার দ্বন্দ্ব যতদিন চলমান আছে।
প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোতে সমন্বয়
২০২২ সালের শেষের মতো ২০২৩ সালও বড় প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো কর্মী ছাঁটাইয়ের মাধ্যমে শুরু করেছে। আলফাবেট, অ্যামাজন, অ্যাপল, মেটা, ও মাইক্রোসফটের মতো শীর্ষ প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো বিগত তিন বছরে তাদের কর্মীসংখ্যা দ্বিগুণ করেছিল। এখন এ প্রতিষ্ঠানগুলো হাজারো কর্মীকে ছাঁটাই করেছে।
ডিজিটাল পণ্যভোগের পরিমাণ বাড়তে শুরু করলে — বিশেষত করোনাভাইরাস মহামারির সময় এ প্রবণতা আরও বৃদ্ধি পেলে — সিলিকন ভ্যালির কর্তারা উৎসাহিত হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ভাগ্য তাদের সুপ্রসন্ন হয়নি, লাভের অংক পড়তির দিকে যেতে শুরু করে। এর প্রতিক্রিয়া হিসেবে এসব প্রতিষ্ঠান তাদের কর্মী ছাঁটাই শুরু করে।
ছাঁটাইয়ের এ প্রবণতা শুরু করেছিলেন ইলন মাস্ক। একইসঙ্গে তিনি টুইটারের মতো লাভহীন প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানে সাবস্ক্রিপশন মডেলও চালু করেন। আপাতত মেটা এ পথ অনুসরণ করেছে। মেটার এ সিদ্ধান্তের কারণ খুব সম্ভবত মেটাভার্সে ব্যর্থ বিনিয়োগ ও বিজ্ঞাপন কমে যাওয়া।
তবে অর্থব্যয় করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করা নতুন কিছু নয়। অনেক আগে থেকেই এ পদ্ধতি চালু করেছে লিংকডইন। প্রতিষ্ঠানটি এক্ষেত্রে সফলও। 'অনলিফ্যানসও। আপনি যদি মানসম্মত কনটেন্ট চান, এবং ট্রল ও অপছন্দের মানুষদের এড়াতে ইচ্ছৃক হন, সেক্ষেত্রে সাবস্ক্রিপশন মডেলই আপনার জন্য উপযুক্ত,' মিরান্ডা বলেন।
তবে দীর্ঘদিন ধরে কোনো সেবা বিনামূল্যে দেওয়ার পর এখন এর জন্য অর্থ চাওয়াটা একটি সাহসী পদক্ষেপ। একই কথা সত্য, যারা অর্থব্যয় করছেন না, তাদেরকে ইন্টারনেটে কম নিরাপত্তা সরবরাহ করা। যেমনটা এখন ঘটছে টুইটারের ক্ষেত্রে। মিরান্ডার ভাষ্যে, 'আপনার কোনো নিম্নমানের বিদ্যমান সেবাকে উন্নত করার মাধ্যমে নয়, বরং নতুন সেরা কিছু দেওয়ার মাধ্যমে মানুষকে সাবস্ক্রিপশন নেওয়ার জন্য উৎসাহ দিতে হবে।'
যদি অন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোও ব্যবহারকারীদের কাছ থেকে অর্থ নিতে সিদ্ধান্ত নেয়, এবং এখনকার বিনামূল্যের সেবাগুলো বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে আমরা নজিরবিহীন একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা দেখতে পাব। ব্যবহারকারীরা ইতোমধ্যে সংবাদপত্র পড়তে, গান শুনতে, টেলিভিশন সিরিজ দেখতে অর্থ ব্যয় করছেন। তাদের মাসিক এ ধরনের খরচের অংশ হতে পুরো ইন্টারনেট লভ্যাংশের জন্য প্রতিযোগিতায় নামবে। ব্যবহারকারীদেরকে ছুটির দিনের ছবি দেখানোর জন্য তাহলে কি সামনে থেকে টু-পাইস খরচ করতে হবে?
সূত্র: এল পাইস