বানোয়াট দানব: গণমাধ্যম যেভাবে বাংলাদেশে মানুষ-বন্যপ্রাণীর মধ্যে সংঘাতে ইন্ধন জোগাচ্ছে
ফেব্রুয়ারি মাসের শুরুর দিকে সুন্দরবনের তিনটি বাঘ খবরের শিরোনাম হয়। বনবিভাগের একটি টহল ফাঁড়িতে পুকুরের চারপাশে ঘোরাফেরা করতে শুরু করে বাঘগুলো। পায়চারি, ঘুমানো, পানি পান, হুটোপুটি ইত্যাদি করে দুই ছানা ও তাদের মা বেশ কয়েক ঘণ্টা ওই ফাঁড়িতে সময় কাটায়। বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী মানুষের সংস্পর্শে সহজে আসতে চায় না, সেদিক থেকে বাঘেদের এ ছোট্ট অভিযানটি এক প্রকার সুখবরই ছিল।
কিন্তু পত্রিকার পাতা ওল্টানো, খবর দেখা, আর ফেসবুকে স্ক্রল করার পরেই এ আনন্দ উবে গেল। এসব জায়গায় ওই বাঘগুলোকে 'আতঙ্কের' তকমা দেওয়া হলো, যারা কিনা 'বন কার্যালয় দখল করে রেখেছিল (যেন ওই বাঘগুলো ভূমিদস্যু ছিল!)' এবং 'বন বিভাগের কর্মীদের অবরুদ্ধ করে' মানুষের জীবনকে 'হুমকি'র মুখে ফেলেছিল।
ওরকম হলেও আমি খুশি বই অন্য কিছু হতাম না। দুঃখজনকভাবে, ওগুলো ছিল স্রেফ তিনটে বাঘ — এমনকি আর দশটা বাঘের চেয়েও আকারে ছোট। আমরা মানুষেরা এ বাঘেদের পূর্বপুরুষদের ম্যানগ্রোভের কিনারায় ঠেলে দিয়েছি, তাদের জায়গা দখল করে নিজেদের করে নিয়েছি — যাকে আমরা বাংলাদেশ নামে ডাকি।
বাঘ বিষয়ে এ আতঙ্ক আর বক্র ধারণা এখনো কেন সর্বত্র বিরাজমান? বাঘ এখন আমাদের নিয়ন্ত্রণে বাস করে, এটি আমাদের জাতীয় পশু, এবং এর রাজকীয়ভাব সমীহের দাবি রাখে। তাই এ বাঘগুলোকে নিয়ে এত ভয় আর নাটকীয়তা কোনো কাজের মনে হয়নি। বাঘগুলো যে পরিষ্কার জায়গায় বেরিয়ে এসেছিল, তার চারপাশটা জঙ্গলে ঘেরা। এমন পরিবেশে ওই বাঘেদের কাজটা কি ভুল কিছু ছিল?
হয়তো গণমাধ্যম এ ঘটনাটি উদযাপন করতে পারত, একটু মায়াদয়া দেখাতে পারত। হয়তো বাঘগুলোকে এত কড়া ভাষায় 'হুমকি' ঘোষণা না করে গণমাধ্যম স্রেফ বলতে পারত, 'বাঘেরা এখন আমাদের সঙ্গে বাস করা শিখছে' এবং 'এটা একটা ভালো লক্ষণ।'
মানুষ ও বাঘের সহাবস্থান নিশ্চিত করতে আমরা সবাই চাই। অনেক প্রতিষ্ঠান এ লক্ষ্য অর্জনে কাজ করছেও। কিন্তু গণমাধ্যম যদি এভাবে বন্যপ্রাণীর প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি অব্যাহত রাখে, তাহলে সব প্রচেষ্টা জলে যাবে।
গণমাধ্যম মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করে। কিন্তু এটি যদি এভাবে বন্যপ্রাণী সম্পর্কে আমাদের মধ্যে নেতিবাচক ধারণা প্রবেশ করানো নিরবচ্ছিন্ন রাখে, তাহলে আমাদের আশেপাশে বনবিড়ালের বিচরণকে কি আমরা খুব সহজেই মেনে নিতে পারব? আমরা কি বাড়ির পাশে ওই বুনো প্রাণীগুলোর ছানাদের বেড়ে ওঠার সুযোগ দেব নাকি 'উদ্ধারের' লেবাসে এগুলোকে তাদের প্রাকৃতিক আবাস থেকে সরিয়ে নিয়ে আজীবনের জন্য বন্দিশালায় পাঠিয়ে দেব? দেশের জাতীয় পশু নিয়ে এটাই যদি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি হয়, তাহলে ধরুন, একটা ভল্লুক বা লেপার্ড যদি পার্বত্য চট্টগ্রামের কোনো শহরে হুট করে দেখা যায়, তখন কী হবে? ওটাকে কি সঙ্গে সঙ্গে মেরে ফেলা হবে?
বন্যপ্রাণী নিয়ে গণমাধ্যমের সঠিক উপস্থাপন নিয়ে কাজ করার অনেক সুযোগ রয়েছে। এ সমস্যায় দেশের প্রায় সব ধরনের জীববৈচিত্র্যই ভুগছে। ২০২৩ সালের জানুয়ারি মাসে দেশের একটি টেলিভিশন চ্যানেল অচিন্তনীয় একটি কাজ করে। এটি মৌমাছির মতো পৃথিবীর সবচেয়ে উপকারী পতঙ্গকে শত্রুজ্ঞান করে উপস্থাপন করেছিল! ওই মৌমাছিগুলোর দোষ কী ছিল? তারা খেতিজমির কাছাকাছি এলাকায় একটি স্কুলের পাশে মৌচাক গড়ে তুলেছিল। বাংলাদেশের মতো দেশে যেখানে কৃষিখাতে রাসায়নিক পদার্থের ব্যবহার এত প্রবল, সেখানে মৌমাছির বুনো পরিবেশে বেঁচে থাকাটাই একটি বিরল ঘটনা। ওই টিভি চ্যানেলটি কোনো সমাধানের কথা উল্লেখ না করে কেবল ওই মৌমাছিগুলোর বিরুদ্ধে গবাদিপশু হত্যা ও আহত করার অভিযোগ আনে।
বন্যপ্রাণী নিয়ে মিথ্যা সংবাদের বহুমুখী সমস্যা রয়েছে। বিকৃত সত্য এবং ক্ষেত্রবিশেষে ডাহা মিথ্যা তীব্র ভয় ও ভুল ধারণা, অযৌক্তিক অবিশ্বাস ও ঘৃণার সৃষ্টি করতে পারে। বন্যপ্রাণীর ক্ষেত্রে এ ধরনের চর্চা মানুষের মধ্যে 'দেখামাত্রই মেরে ফেলার' মতো প্রতিশোধমূলক প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিতে পারে।
আমাদের ঘরবাড়ির আশেপাশে বাস করা ছোটখাটো মাংসাশী প্রাণীগুলোকেও এসবের ধকলটা নিতে হচ্ছে। বিশেষ করে মেছোবাঘ এ কারণে প্রাণ হারাচ্ছে। প্রায় সব খবরেই ১৫ কেজির এ বিড়াল প্রজাতির প্রাণীটিকে 'মানুষখেকো', 'জীবনের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ' হিসেবে বর্ণনা করা হয়। হরহামেশাই যখন কোনো মেছোবাঘ গণপিটুনিতে মারা যায়, তখন কাগজে ছাপা হয় 'বাঘের সঙ্গে লড়ল মানুষ', মুরগির খাঁচা থেকে বাঘ ধৃত', 'শহরে ঘুরে বেড়াচ্ছে বাঘ' ইত্যাদি। এ তালিকা বলে শেষ করা যাবে। কিন্তু বাস্তবে, কোনো মেছোবাঘের কখনো একটা মানুষকে মারারও রেকর্ড নেই। একেবারে না ঘাঁটালে এ প্রাণীটি মানুষের সংস্পর্শ থেকে দূরে থাকে।
বন্যপ্রাণীর সঠিক ও সযতন গণমাধ্যম উপস্থাপনের গুরুত্ব নিছক কোনো তাত্ত্বিক কথা নয়। জেন্ডার ভূমিকা, জাতিগত সহনশীলতা ইত্যাদি বিষয়ে গণমাধ্যম যেভাবে কাজ করে, বন্যপ্রাণীর ক্ষেত্রেও গণমাধ্যমের ভূমিকাও একই।
১৯৭৫ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত স্টিভেন স্পিলবার্গের জস সিনেমাটি এর প্রকৃষ্ট একটি উদাহরণ। ওই সিনেমায় কল্পনামিশ্রিত বিষয় যুক্ত করে হাঙরকে ভীষণ ভুলভাবে তুলে ধরা হয়েছে। এর ফলে বিশ্বব্যাপী হাঙর নিয়ে তৈরি হয়েছে ভয়। হাঙরকে সবসময় রক্তপিপাসু, খুনে, সমুদ্রের দানব হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, বছরে মানুষের ওপর হাঙরের আক্রমণের সংখ্যা কেবল ১৫০। এসবের মধ্যে আবার মানুষ কর্তৃক হাঙরকে ঘাঁটিয়ে আক্রমণের মুখে পড়ার হিসাবও সংযুক্ত।
বিপরীতক্রমে, ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক-এর তথ্যমতে, প্রতি বছর মানুষের হাতে ১০ কোটি হাঙর মারা পড়ে। তথ্য-উপাত্ত আমাদেরকে বাস্তবতা বুঝতে সাহায্য করে। স্পিলবার্গ পরে প্রকাশ্যে তার সিনেমার এ ভুলের জন্য দুঃখপ্রকাশ করেন।
একই দৃশ্য দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশেও। অতিরিক্ত নাটকীয়ভাবে উপস্থাপন প্রায়ই বন্যপ্রাণীকে মৃত্যু এবং জঙ্গলকে সমস্যা হিসেবে ইঙ্গিত করে। পূর্বাচলে যে 'বাঘের' কথা খবরে এসেছিল, তা ছিল মূলত দুটি পুরুষ মেছোবাঘের আবাস নিয়ে দ্বন্দ্ব। কিছু কিছু চ্যানেলতো এটিকে 'বাঘের ছানারা' খেলছে বলেও প্রচার করেছে। এমনকি স্থানীয়দের উদ্ধৃতিতে ওসব চ্যানেল এটাও প্রচার করেছে যে পূর্বাচলের আশেপাশের জঙ্গল পরিষ্কার করে ফেলতে হবে।
বন্যপ্রাণীর দর্শন বিষয়ে গণমাধ্যমের ভুল তথ্য ছড়ানোর পেছনের কারণ অনেকগুলো নয়। চমকপ্রদ হেডলাইন বানিয়ে দর্শক টানার ইচ্ছা থেকেই প্রায় এ সমস্যার সৃষ্টি হয়। এসব খবরে বিশেষজ্ঞদের কোনো বক্তব্য থাকে না, প্রায় সময়ই কেবল স্থানীয়দের দৃষ্টিভঙ্গিই এ ধরনের সংবাদগুলোতে প্রচারিত হয়। এমনকি কোনো প্রকার পূর্ববর্তী গবেষণা, ফ্যাক্ট-চেকিং ও কোনো গঠনমূলক সমাধান উল্লেখ করা ছাড়াই এসব সংবাদ তৈরি করা হয়।
বন্যপ্রাণী সংরক্ষণকারীরা এ পরিস্থিতির বিষয়ে অবগত। কিন্তু এ ধরনের ভুল উপস্থাপনের প্রভাব ইতোমধ্যে পড়তে শুরু করেছে। মানুষজন এখন বেজি দেখলেও ভয়ার্ত ও প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে ওঠে — যেমনটা আমার সিরাজগঞ্জের ঘটনায় দেখেছি। সেখানে একটি বেজি নাকি ১২০ জনকে কামড়েছে! শেরপুর ও টাঙ্গাইলের মানুষেরা বনবিড়াল দেখে ভয় পেয়েছেন। আরও দুঃখের কথা হলো, খবরে এগুলোকে যথাক্রমে কারাক্যাল ও চিতা হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। এ দুই ধরনের প্রাণীই বাংলাদেশ থেকে অনেক দূরে বাস করে। ফ্যাক্ট-চেকের কোনো বালাই নেই।
এ অধঃপতিত পরিস্থিতি ও বন্যপ্রাণীর প্রতি অসহিষ্ণুতার মাত্রা এখনই টেনে ধরা উচিত। সাংবাদিক ও বিজ্ঞানীদের মধ্যকার ফাঁকটুকু আরও কমিয়ে আনতে হবে। বিভিন্ন সংলাপের আয়োজন করা ও কিছু মূলনীতি তৈরি করা যেতে পারে। একটি সার্বিক প্রচেষ্টার ফলে দেশে বন্যপ্রাণী নিয়ে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি আবারও ইতিবাচক করে তোলা যাবে।