ধুয়ে দেই: বিশ্ববিদ্যালয়ে লন্ড্রিসেবা চালু করে যেভাবে উদ্যোক্তা ৪ শিক্ষার্থী
অ্যাকাডেমিক প্রেজেন্টেশনের তারিখ হুট করে ঠিক হয়ে যাওয়ায় বেশ বিপাকে পড়ে যান বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আদনান। কারণ তার একমাত্র ফর্মাল সাদা শার্টটি শেষবার পরার পর আর ধোয়া হয়নি। অবশ্য এ কাজে তিনি বরাবরই অলস প্রকৃতির। কিন্তু প্রয়োজনের সময় এখন উপায় কি হবে!
ব্যাচেলর জীবনযাপনের কঠিন বিষয়গুলোর মধ্যে রান্না ও কাপড় ধোয়ার মতো কাজ চাইলেও এড়ানো যায় না। বাইরে খেটে আসার পর ঘরে এসে আবার এ কাজগুলো করতে হয়। অনেক চাকুরিজীবী অর্থের বিনিময়ে লোক দিয়ে এগুলো করিয়ে নেন, কিন্তু ব্যাচেলর শিক্ষার্থীদের পক্ষে তো তা আর সম্ভব হয় না। পকেট খরচা যা পাওয়া হয়, তা দিয়ে ব্যক্তিগত প্রয়োজন মেটানোর পর আলাদা করে কাজের লোক রাখার বিলাসিতা এই বয়সে খাটে না। তাই অল্প খরচে লন্ড্রিসেবা পাওয়া গেলে অনেক হ্যাপা থেকে বেঁচে যাওয়া সম্ভব। কারণ সারাদিনের ক্লাস, পরীক্ষা, ল্যাব শেষ করে দু'বেলা পেটপুজোর জন্য ক্যান্টিনের খাবার খেয়ে কোনোরকম দিন গুজরান করা গেলেও কাপড় কাচার জন্য শরীর আর সায় দেয় না।
আদনান ফোন করার কিছুক্ষণের মধ্যে দোরগোড়ায় এসে একজন হাঁক দিয়ে জানান দিলেন — 'ধুয়ে দেই' সার্ভিস হাজির। কাপড় ধুয়ে ইস্ত্রি করে পুনরায় তা ঠিকানায় পৌঁছে দিয়ে যায় এ সার্ভিসটি। দুবছর ধরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদেরকে এবং শহরজুড়ে লন্ড্রিসেবা দিচ্ছে ধুয়ে দেই সার্ভিস। চার বন্ধুর এ উদ্যোগ বর্তমানে বড় আকারের ব্যবসায় রূপ নিয়েছে। গ্রাহকের ঠিকানা থেকে আধোয়া কাপড় সংগ্রহ করে নিয়ে এসে সেগুলো ধুয়ে ভাঁজ করে পুনরায় ঠিকানায় পৌঁছে দেয় ধুয়ে দেই।
সমস্যার সমাধানে উদ্যোক্তা হয়ে ওঠা
কোনো এক সময় আদনানের মতো একই সমস্যার ভুক্তভোগী ছিলেন উদ্যোক্তা সালমান ফারসী। কাপড় ধোয়ার বিষয়টি তার মতো ব্যাচেলরের জন্য ছিল অত্যন্ত বিরক্তিকর এক কাজ। ক্যাম্পাসে একদিন বন্ধুদের আড্ডায় এ নিয়েই কথা উঠল। কথায় কথায় সবাই মিলে চিন্তা করলেন, নিজেরাই লন্ড্রিসেবা শুরু করলে কেমন হয়! এতে নিজেদের সমস্যার সমাধান হবে, আবার ছাত্রাবস্থায় অর্থ আয়ের একটা উপায়ও তৈরি হবে।
২০১৯ সালের সেই পরিকল্পনা ২০২০ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি উদ্যোগে রূপ নেয়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী সালমান খান ফারসি, হামিম শেঠ, পলাশ বিন ফারুক ও অভিষেক চৌধুরী বিশাল — চার বন্ধু মিলে লন্ড্রিসেবা চালু করেন। কিন্তু তাদের এই উদ্যোগ প্রথমদিকে লোকসানের মুখে পড়েছিল।
সালমান ফারসী বলেন, 'কাপড় ধোয়ার জন্য ওয়াশিং মেশিন কিনতে আমরা সবাই মিলে কিছু নগদ টাকা দিই। টাকার স্বল্পতা থাকায় মাসিক কিস্তি চুক্তিতে ওয়াশিং মেশিনটি কেনা হয়। কিন্তু তার কিছুদিনের মধ্যেই করোনাভাইরাসের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে যায়। পরিবার থেকে টাকা চেয়ে নিয়ে আমাদের সেই কিস্তি পরিশোধ করতে হয়েছিল। বলতে গেলে উদ্যোক্তা হওয়ার প্রথমদিকেই আমাদের ধাক্কাটা খেতে হয়েছিল। করোনার পর অর্ডার আসতে শুরু করলে ধীরে ধীরে আমরা গুছিয়ে নিতে শুরু করি।'
'ধুয়ে দেই' — এমন অদ্ভুত নামের পেছনে কারণ কী জিজ্ঞেস করতেই প্রতিষ্ঠাতা সালমান হেসে উঠলেন। তারপর বললেন, "আমাদের এ উদ্যোগটা বন্ধুরা মিলে মজা করতে করতে গল্পের ছলে শুরু হয়েছিল। কী নাম দেওয়া যায় তা নিয়ে আমরা ভাবতে থাকি। তখন ফেসবুকে একজন বক্তার একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছিল। যেখানে তিনি চা হাতে নিয়ে বলেছিলেন, 'খাবেন? ঢেলে দিই?' সেখান থেকেই আমাদের কাপড় ধোয়ার এই উদ্যোগের নাম রাখি 'ধুয়ে দেই'। আমরা চেয়েছিলাম নামটা একটু ভিন্নধর্মী হোক, যাতে মানুষ মনে রাখতে পারে।"
'ধোপাগিরি করি বলে কটাক্ষের শিকার হতে হয়েছিল'
একসময় বাকল্যান্ড সেতুতে বুড়িগঙ্গার ধারে সারিবদ্ধভাবে ধোপাদের কাপড় ধোয়ার দৃশ্য চোখে পড়ত। কাপড় ধোয়ার পর তা ইস্ত্রি করার প্রচলন প্রথম ঢাকায় শুরু করেছিল পর্তুগিজরা। দেশভাগের আগে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন ধোপা পেশার সাথে জড়িত ছিলেন। এই পেশা তখন নিম্নবর্গীয় মানুষের কাজ বলে ঠাহর করা হতো। দেশভাগের পর মুসলিম সম্প্রদায়ের লোকেরা এই কাজ করতে শুরু করলেও, এটিকে সম্মানজনক চোখে কখনোই দেখা হয়নি।
একসময়ে ধোপারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে কাপড় সংগ্রহ করে, সেগুলো ধুয়ে আবার পৌঁছে দিতেন। এই নিয়মের পরিবর্তন ঘটে পাড়া-মহল্লায় লন্ড্রির দোকান গড়ে উঠলে। দোকানগুলোতে লোকেরা এসে কাপড় দিয়ে যায় এবং নির্দিষ্ট সময় শেষে তা আবার নিজেরাই নিয়ে যায়। লন্ড্রিসেবার এ কাজকে আরও সহজ করতে 'ধুয়ে দেই' অনলাইনে চালু করেন এই শিক্ষার্থীরা। শিক্ষিত হয়ে ধোপার কাজ করছেন — এটা মেনে নিতে পারেননি তাদের আশেপাশের লোকজন। সহপাঠী, শিক্ষক, পরিবার ও পরিচিত অনেকেই তাদের কটাক্ষ ও ঠাট্টার ছলে নানা কথা শুনিয়ে দিতেন। কিন্তু কোনো কাজই ছোট নয় ধারণায় বিশ্বাসী চার বন্ধু ছোট কিছু থেকেই বড় উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে পিছপা হননি। সে অদম্য ইচ্ছাশক্তির জেদ তাদেরকে সফলতার পাশাপাশি বিভাগের শিক্ষকদের থেকেও উৎসাহ এনে দিয়েছে।
সালমান বলেন, 'একসময় যারা আমাদেরে উপহাস করতেন, তারা এখন এই কাজের জন্য সাধুবাদ জানিয়ে প্রশংসা করেন। আমাদের সার্ভিস নিয়ে উপকৃত হওয়ার পর মানুষের মধ্যে চিন্তার পরিবর্তন আসতে শুরু করে। তারা নিয়মিত আমাদের থেকে সেবা নিতে শুরু করেন। বিভাগের শিক্ষকেরা স্রোতের বিপরীতে গিয়ে আমাদের এমন ভিন্নধর্মী উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন। প্রথমদিকে এই কাজের কথা আমরা পরিবারের কাউকে বলিনি। শুরুতে সাপোর্ট না পেলেও ধীরে ধীরে পরিবার থেকে আমাদের এই কাজকে সমর্থন করা হয়।'
সারাদিন ক্লাসের পর রাতভর চলে লন্ড্রির কাজ
সারাদিন ক্লাসের ব্যস্ততা শেষ করার পর সন্ধ্যা ৭টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত গ্রাহকের ঠিকানায় গিয়ে কাপড় সংগ্রহ করে আনা হয়। 'ধুয়ে দেই' ফেসবুক পেজ ও 'ধুয়ে দেই ডটকম' নামক ওয়েবসাইটের মাধ্যমে হলের নাম, কক্ষ নাম্বার ও মোবাইল নাম্বার দিয়ে গ্রাহক তার অর্ডার নিশ্চিত করার পর ধুয়ে দেই-এর পক্ষ থেকে নির্দিষ্ট ঠিকানায় গিয়ে কাপড় নিয়ে আসা হয়। পেজ ও ওয়েবসাইটে দেওয়া নাম্বারে কল করেও অনেকে অর্ডার দিয়ে থাকেন।
যারা হলের বাইরে থাকেন তারাও একইভাবে ঠিকানা দিয়ে অর্ডার নিশ্চিত করার পর সন্ধ্যার পর তাদের দোরগোড়ায় গিয়ে কাপড় সংগ্রহ করে আনে 'ধুয়ে দেই' সার্ভিস। ডেলিভারি সার্ভিস চালু করার পর এই কাজের জন্য তারা একটি কাভার্ড ভ্যান কিনে নিয়েছেন কাজের সুবিধার্থে। স্থানের দূরত্ব ও কাপড়ের সংখ্যার ওপর ডেলিভারি চার্জ নির্ধারণ করা হয়। কাপড় ধোয়ার চার্জ ১০০ টাকার ওপর হলে ফ্রি ডেলিভারি দেওয়া হয় ধুয়ে দেই-এর পক্ষ থেকে।
কাপড় সংগ্রহ শেষ হলে রাতভর চলে ধোয়া ও ইস্ত্রি করার কাজ। পরদিন সন্ধ্যা ও ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ধুয়ে রাখা কাপড় পুনরায় গ্রাহকদের ঠিকানায় পৌঁছে দেওয়া হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছাকাছি একটি ভাড়া ফ্ল্যাটে ধুয়ে দেই-এর যাবতীয় কাজ চলে। অর্ডারের পরিমাণ বেশি আসতে শুরু করলে দুইজন কর্মচারী রাখা হয়। মাসিক ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা আয় হয়, যা দিয়ে কর্মচারীদের বেতন ও ফ্ল্যাট ভাড়া পরিশোধ করার পর বাকিটা চার বন্ধু মিলে ভাগ করে নেন। কাজের দায়িত্বও তারা নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নিয়েছেন। কেউ অনলাইনের দিকটা সামলান, কেউ আর্থিক হিসাবনিকাশ, কেউ যাবতীয় অন্যান্য দায়িত্ব দেখাশোনা করেন।
কাপড় ধোয়ার খরচ কত?
কাপড় ধোয়ার জন্য কত টাকা দিতে হবে? কোন কাপড়ের জন্য কেমন টাকা লাগবে? — এমন সব প্রশ্নের উত্তর বারবার দিতে হবে বলে নির্দিষ্ট একটি মূল্য তালিকা তৈরি করেছে ধুয়ে দেই। ফেসবুক পেজে তাদের যাবতীয় কাজ ও কাপড় অনুযায়ী কোনটার দর কত পড়বে তার তালিকা করে ছবি দিয়ে দেওয়া হয়েছে। প্রতিটি পায়জামা, সাদা গেঞ্জি, ফুল হাতা গেঞ্জি, সাদা শার্ট, পাঞ্জাবি, গামছা এবং লুঙ্গি পরিষ্কার করতে নেওয়া হয় ১০ টাকা। এছাড়া বালিশের কভার পাঁচ টাকা; শার্ট আট টাকা; গেঞ্জি, স্যান্ডো গেঞ্জি সাত টাকা; সোয়েটার ২০ টাকা; হুডি, জিন্সের জ্যাকেট, বিছানার চাদর ২৫ টাকা, পাতলা কাঁথা ৫০ টাকা, মোটা কাথা ৮০ টাকা, মোটা কম্বল ১২০ টাকা এবং পাতলা কম্বল ৮০ টাকা খরচ করে ধুইয়ে নিতে পারেন গ্রাহক।
আর প্রতিটি কাপড় ইস্ত্রি করতে নেওয়া হয় পাঁচ টাকা করে। ড্রাই ওয়াশ করার ব্যবস্থাও রয়েছে। গ্রাহকদের চাহিদামতো তারা ব্লেজার ও ফুল স্যুট ওয়াশ করে নিতে পারেন। ভারী ও বড় কাপড়ের বেলায় সময়টা ২৪ ঘণ্টার বেশি লাগলে তা আগে থেকেই গ্রাহকদের সাথে কথা বলে জানিয়ে দেওয়া হয়। নিখুঁতভাবে সব সম্পাদন করা হয় বলেই অল্পদিনে ধুয়ে দেই সার্ভিস সবার আস্থা জুগিয়ে নিয়েছে।
সালমান ফারসী জানান, 'কাপড় ধোয়ার ব্যাপারে আমরা সতর্কতার সাথে কাজটি করে থাকি। কাপড়ে কোনো সমস্যা হলে তার ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়। যদিও এখন পর্যন্ত খুব একটা সমস্যায় পড়তে হয়নি। শুরুর দিকে একবার আমাদের পরিচিত এক বন্ধুর কাপড় ইস্ত্রি করতে গিয়ে খানিকটা পুড়ে যায়। তাকে আমরা ক্ষতিপূরণ দিয়েছিলাম। এখন কাজে অভিজ্ঞ হয়ে যাওয়ায় এসব সমস্যা হয় না। এলাকার অন্যান্য লন্ড্রি থেকে আমরা কম খরচ নেই বলে, ছাত্র ও স্থানীয় লোকজন থেকে ভালো সাড়া মিলেছে। তাছাড়া তাদের কষ্ট করে কাপড় দিয়ে ও নিয়ে যেতে হয়না। এইসব সুবিধার জন্য বর্তমানে আমাদের সেবা মানুষ গ্রহণ করছেন।'
'আমাদের চারজনের লক্ষ্য এক বলেই আমরা এমন উদ্যোগ নিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছি। বর্তমানে আমাদের সাথে আরেকজন নতুন সদস্য যুক্ত হয়েছেন। ভবিষ্যতে আমাদের এই কার্যক্রম সারাদেশে ছড়িয়ে দিতে চাই। আমাদের প্রথম লক্ষ্য হলো ছাত্রদের সুবিধার জন্যে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে এই সেবা পৌঁছে দেওয়া। সেখান থেকে ধীরে ধীরে শহরকেন্দ্রিক জায়গাগুলোতে সার্ভিস চালু করা। বর্তমানে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, রুয়েট এবং এর আশেপাশের এলাকায় 'ধুয়ে দেই' সার্ভিস চালু রয়েছে। এই বছরে আমরা পুরো শহরে সার্ভিস দেওয়া শুরু করব।'