বিশেষজ্ঞদের মতে সেরা 'ন্যাপ' হতে হবে: সংক্ষিপ্ত, চটজলদি আর বিছানাতে অবশ্যই নয়
"একটা সময় ছিল যখন আমরা সন্ধ্যা নামার সাথেসাথেই ঘুমিয়ে পড়তাম এবং কাকডাকা ভোরে উঠে পড়তাম। এখনও আমরা সকালে ওই একই সময়ে ঘুম থেকে উঠি, কিন্তু যখন দিন গড়িয়ে রাত নামে তখন দেখা যায় মাত্র আমরা দিনের কাজকর্ম শেষ করেছি; তাই তখন আরও কিছু সময় জেগে থাকতে হয়"- 'হোয়াই উই স্লিপ: আনলকিং দ্য পাওয়ার অব স্লিপ অ্যান্ড ড্রিমস' বইয়ে এমনটাই লিখেছেন স্নায়ুবিজ্ঞানী ম্যাথিউ ওয়াকার। এই বিজ্ঞানী ও লেখক মনে করেন, জেনেটিকভাবে ঘুমের যে প্যাটার্ন- 'বাইফেজিক স্লিপ' (রাতে দীর্ঘ সময়ের ঘুম এবং দিনেরবেলা সংক্ষিপ্ত সময়ের) মানুষের অনুসরণ করার কথা, আধুনিক সমাজে তা বাস্তবায়ন খুবই কঠিন হয়ে পড়েছে। স্প্যানিশ সংবাদমাধ্যম এল পাইস-এর 'ঘুম' বিষয়ক একটি প্রতিবেদনে বিষয়টি ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের স্লিপ অ্যান্ড নিউরোইমেজিং ল্যাব-এর পরিচালক ম্যাথিউ ওয়াকার বলেন, ভৌগলিক ও সাংস্কৃতিক ব্যবধান নির্বিশেষে সকল মানুষের মধ্যে জেনেটিকভাবেই 'ঈষৎ নিদ্রার মধ্যেই জাগ্রত অবস্থা'র মতো একটা ব্যাপার থাকে যা সাধারণত বিকেলের মাঝামাঝি সময়ে তৈরি হয়। আর এর সমাধান হচ্ছে 'ন্যাপ নেওয়া' বা সংক্ষিপ্ত ঘুম। তার ভাষ্যে, "আমাদের পূর্বপুরুষদের জেনেটিক কোডে বহুকাল আগে থেকেই বিষয়টি প্রোথিত- বাইফেজিক স্লিপ এবং স্বাস্থ্যকর ডায়েটের চর্চাই দীর্ঘায়ু লাভের মূলমন্ত্র।
ন্যাপ নেওয়া বা স্বল্প সময়ের ঘুম আমাদের স্বাস্থ্যের ওপর বড় প্রভাব ফেলে- হয় ভালো কিংবা খারাপ। যদিও বিজ্ঞানীরা এখনও পর্যন্ত ন্যাপ নেওয়ার সামগ্রিক প্রভাব সম্পর্কে পুরোপুরি স্পষ্ট ধারণা পাননি; কিন্তু বিষয়টি নিয়ে মেডিক্যাল রিসার্চে প্রধান যে দিকটি উঠে এসেছে তা হলো- 'যত কম তত ভালো'। গত মাসে 'ওবিসিটি' নামক জার্নালে প্রকাশিত একটি গবেষণায় দেখা গেছে, যারা বেশি সময় ন্যাপ নেন, তাদের অতিরিক্ত ওজন বৃদ্ধির ঝুঁকি ২৩ শতাংশ বেশি। কিন্তু যারা সংক্ষিপ্ত ন্যাপ নেন, তাদের উচ্চ রক্তচাপে ভোগার সম্ভাবনা তুলনামূলক কম।
গবেষকরা বলছেন, সংক্ষিপ্ত ঘুম (সর্বোচ্চ ৩০ মিনিট) শরীরে বল বৃদ্ধি করে এবং একইসঙ্গে সজাগ থাকতেও সাহায্য করে। তবে তারা এও বলেছেন যে, এই সংক্ষিপ্ত ঘুম কখনো বিছানায় হওয়া যাবে না এবং দুপুরের খাবারের সময় বা বিকালের শুরুর দিকে হতে হবে, এর চেয়ে বেশি দেরি করা যাবে না।
তবে ন্যাপ নেওয়ার প্রতিটি ধরনের মধ্যেই পার্থক্য আছে। বিজ্ঞানীদের মধ্যে এ বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক ও মতপার্থক্য আছে এবং প্রায়ই প্রকাশিত গবেষণাগুলো পরস্পরবিরোধী হয়ে থাকে। তবে শেষ পর্যন্ত ন্যাপ নেওয়ার সময়কাল এবং কোন জনগোষ্ঠীর ওপর তারা গবেষণা চালিয়েছেন, এই দুটোর ভিত্তিতে তারা সিদ্ধান্তে আসতে পেরেছেন। জানা যায়, সোফায় স্বল্প সময়ের ঘুম আর বিকালের শেষভাগে বিছানায় শুয়ে কয়েক ঘন্টা ঘুমের প্রভাব সমান নয়। আবার মুটিয়ে যাওয়া ব্যক্তির ন্যাপ নেওয়া এবং স্বাভাবিক স্বাস্থ্যের একজন ব্যক্তির ন্যাপ নেওয়ার মধ্যেও রয়েছে পার্থক্য; কিংবা একজন প্রাপ্তবয়স্ক তরুণের এবং বয়স্ক ব্যক্তির ন্যাপ নেওয়ার মধ্যেও পার্থক্য বিদ্যমান।
স্প্যানিশ স্লিপ সোসাইটির ইনসমনিয়া বিষয়ক টাস্ক ফোর্সের সদস্য ফ্রান্সেসকা ক্যানেলাস বলেন, "উদাহরণস্বরূপ, আমরা নার্কোলেপ্সিতে (যে অসুখে রোগী মাঝেমাঝে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে) আক্রান্তদের ক্ষেত্রে আমরা প্রতিরোধমূলক হিসেবে ১০ মিনিটের ন্যাপ নেওয়ার পরামর্শ দেই। আর যাদের স্লিপ অ্যাপনিয়া (নিদ্রাহীনতা) আছে, তাদেরও সক্রিয় থাকার প্রয়োজন আছে। ইনসমনিয়ায় ভুগছেন যারা, তাদেরও হয়তো ন্যাপ নিতে ভালো লাগবে কিন্তু তাদের পক্ষে এটা সম্ভব হয় না।"
জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে আমাদের ভিন্ন ভিন্ন ঘুমের চক্র রয়েছে। যেমন, কিশোর বয়সে অধিক সময় ঘুমের প্রয়োজন, অন্যদিকে বয়স্কদের ক্ষেত্রে রাতের ঘুমের প্যাটার্ন এমন যে বারবার ঘুম ভেঙে যায়। 'স্লিপ মেডিসিন রিভিউস' নামক জার্নালে প্রকাশিত একটি গবেষণায় দেখা গেছে, প্রাপ্তবয়স্ক তরুণরা ২০ মিনিটের মতো ঘুমালে এটি তাদেরকে ভেতর থেকে জাগ্রত রাখায় তাৎক্ষণিক ও ইতিবাচক প্রভাব ফেলে এবং রাতের ঘুমের রুটিনকে ব্যহত করে না।
অন্যদিকে, বয়স্কদের ক্ষেত্রে আধা ঘণ্টার ঘুম তাদের রাতেরবেলা ভালো ঘুমের ওপর প্রভাব ফেলে না, কিন্তু দীর্ঘ সময় ন্যাপ নিলে তা প্রভাব ফেলে। এজন্যেই বয়স্কদের বলা হয় দিনে স্বল্প সময়ের ন্যাপ নিতে এবং দিনের ২৪ ঘণ্টার ছন্দটি বজায় রাখতে, বলেন ক্যানেলাস। এর মানে হলো, আপনার 'বডি ক্লক', অর্থাৎ শরীর প্রাকৃতিকভাবে যে নিয়মে চলে তা বজায় রাখা এবং দিনের বেলা সূর্যালোকে আসা, যাতে করে আপনার শরীর বুঝতে পারে যে তাকে সক্রিয় থাকতে হবে।
'ওবিসিটি' জার্নালে প্রকাশিত গবেষণাটিতে স্পেনের ৩৩০০ মানুষ অংশগ্রহণ করেছিলেন। গবেষকরা দেখেছেন, মানুষের বিপাকীয় স্বাস্থ্যের উপর ন্যাপ নেওয়ার প্রভাব এবং এই বিশ্রামের সময়কাল ও নির্দিষ্ট বিপাকীয় সূচকগুলোর মধ্যে একটি সম্পর্ক রয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব ব্যক্তি দীর্ঘ সময় ন্যাপ নেন (৩০ মিনিটের বেশি), তাদের বডি-মাস ইনডেক্স (বিএমআই) দিনের বেলা না ঘুমানো ব্যক্তিদের চেয়ে ২ শতাংশ বেশি এবং তাদের মুটিয়ে যাওয়ার ঝুঁকি ২৩ শতাংশ বেশি।
অন্যদিকে, যারা স্বল্প সময়ের ন্যাপ নেন (৩০ মিনিটের বেশি নয়), তাদের উচ্চ সিস্টোলিক রক্তচাপে ভোগার ঝুঁকি ২১ শতাংশ কম। "শুধুমাত্র দীর্ঘ সময় ন্যাপ নেওয়ার সঙ্গেই স্থূলতার একটা সম্পর্ক রয়েছে", বলেন গবেষণাটির একজন সহ-লেখক মার্তা গারাউলেট।
বিছানায় ন্যাপ নেওয়া নিষেধ
মার্তা গারাউলেট এবং তার দল গবেষণা করে দেখেছেন, যেসব ব্যক্তি দীর্ঘ সময় ন্যাপ নিয়েছেন তারা সোফা কিংবা আর্মচেয়ারের বদলে বিছানায় ন্যাপ নিতেই পছন্দ করেন। "সোফার বদলে যদি বিছানায় শুয়ে ন্যাপ নেন, তাহলে এর সঙ্গে হাইপারটেনশনের একটা যোগসূত্র তৈরি হয়", বলেন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিজিটিং অধ্যাপক গারাউলেট।
তিনি আরও বলেন, "ন্যাপ নেওয়ার সময়কার অঙ্গভঙ্গির সাথে এর একটা সম্পর্ক আছে বলে মনে হচ্ছে, তবে আমরা পুরোপুরি নিশ্চিত নই।" গারাউলেট আরও দেখেছেন যে, ন্যাপ নেওয়ার সঙ্গে ১২৩টি জিনের সম্পর্ক রয়েছে, এখান থেকে হয়তো কারণ জানা সম্ভব যে কেন কিছু মানুষ দিনের বেলা ঘুমানো বেশি সহজ ও সুবিধাজনক মনে করে।
মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর ন্যাপ নেওয়ার প্রভাব সম্পর্কে 'ওবিসিটি' জার্নালের গবেষণাটির সপক্ষে আরও কিছু শারীরবৃত্তীয় ব্যাখ্যা দেন গারাউলেট। তিনি বলেন, "আমাদের শরীর এমনভাবে গঠিত যে রাতে ঘুম এবং দিনের বেলা সজাগ থাকাই নিয়ম। তাই আপনি যদি দিনের বেলা ঘুমান এবং গভীর ঘুমে চলে যান, তাহলে আপনি নিজের শরীরকে বিশ্বাস করাতে চাইছেন যে রাতেরবেলা ঘুমাচ্ছেন। কিন্তু যখন স্বল্প সময়ের ন্যাপের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখবেন নিজেকে, তখন শুধু ঘুমের প্রথম বা দ্বিতীয় পর্যায় পর্যন্ত যাবেন- যা আপনার শরীরকে প্রশান্তি দিবে কিন্তু গভীর ঘুমে নিয়ে যাবে না।"
"কিন্তু যদি লম্বা সময় ন্যাপ নিয়ে ফেলেন, তাহলে রাতে ঘুমাতে দেরি হবে। এর ফলে আপনার শরীর এই নিয়মে চলবে যে- আপনি রাতে দেরিতে খাবার খাবেন এবং ঘুমাতেও যাবেন দেরিতে। আর এই অভ্যাসের কারণেই মানুষ মুটিয়ে যায় এবং স্বাস্থ্য খারাপ হয়। এছাড়াও, দীর্ঘ সময় ন্যাপ নিলে কর্টিসলের (একটি স্টেরয়েড হরমোন) স্বাভাবিক ছন্দে পরিবর্তন আসে যা দুশ্চিন্তার জন্ম দেয়।"
গারাউলেটের গবেষণার মতোই আরও কিছু গবেষণাতেও ন্যাপ নেওয়ার সময়কালের উপর জোর দেওয়া হয়েছে। পোস্ট মেনোপজ পর্যায়ে থাকা নারীদের নিয়ে পরিচালিত একটি গবেষণায় দেখা গেছে, যারা ৩০ মিনিটের বেশি ন্যাপ নেন, ন্যাপ না নেওয়া নারীদের চাইতে তাদের ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা ৭৪ শতাংশ বেশি। অন্যদিকে, আমেরিকান একাডেমি অব নিউরোলজি'র একটি গবেষণায় দেখা গেছে, যারা দিনের বেলা এক ঘণ্টার বেশি ন্যাপ নেন, দিনে না ঘুমানো ব্যক্তিদের তুলনায় তাদের স্ট্রোকের ঝুঁকি ৮৮ শতাংশ বেশি।
আরও একটি বৈজ্ঞানিক গবেষণায় এ বিষয়টি নিয়ে সতর্ক করে বলা হয়েছে, দিনে দীর্ঘ সময় ন্যাপ নিলে তা 'রাতে বিছানায় শোয়ার পর ঘুম আসতে যে সময়টুকু লাগে এবং রাতের ঘুমের পরিমাণ ও গুণগত মানে পরিবর্তন আনে'। তাই গারাউলেট মনে করেন, "সংক্ষিপ্ত ন্যাপ নেওয়া অবশ্যই শরীরের জন্য ভালো, এই বিশ্রাম শরীরে বল ফিরিয়ে আনে। এটা মানুষকে ওই পর্যায়ের গভীর ঘুমে নিয়ে যায়না যা শরীরে অস্থিরতা ভাব তৈরি করে।"
শরীরের জন্য বলকারক ন্যাপ নেওয়া
"দীর্ঘ সময় ন্যাপ নিলে তা মানুষের ঘুম এবং জেগে থাকার চক্রের উপর প্রভাব ফেলে, আর সেটা খুব খারাপ অভ্যাস", বলেন ক্যানেলাস। স্পেনের বার্সেলোনার সান্ট পাউ হাসপাতালের স্লিপ ইউনিটের প্রধান, মার্সে মাজুস জানান, 'ন্যাপ নেওয়ার বিষয়ে অনেক প্রশ্নেরই এখনও উত্তর পাওয়া বাকি' এবং এ বিষয়ে অনেক পরস্পরবিরোধী তথ্যও রয়েছে।
কিন্তু তিনি মনে করেন, "ন্যাপ নেওয়ার বিষয়ে যত গবেষণা পাওয়া যায়, বেশিরভাগেই বলা হয়েছে যে সংক্ষিপ্ত ন্যাপ নেওয়ার উপকারিতা বেশি। যেমন- স্বল্প সময়ের ন্যাপে শরীরে বেশি প্রশান্তি আসেম কিন্তু একইসঙ্গে জাগ্রত থাকা যায়, মনমেজাজ ভালো থাকে ইত্যাদি। কিন্তু ঘণ্টাখানের বেশি ন্যাপ নিয়ে ফেললে স্থূলতা ও বিপাকীয় নানা সমস্যা দেখা দিতে পারে।"
তবে আমাদের স্বাস্থ্যের ওপর ন্যাপ নেওয়ার প্রভাবের বিষয়ে করা গবেষণাগুলোতে সরাসরি 'কারণ ও প্রভাব' এর বদলে দুটি বিষয়ের মধ্যে সংযোগই দেখানো হয়েছে বেশি। মাজুস মনে করেন, "সম্ভাব্য 'বিভ্রান্তিকর ফ্যাক্টরগুলোর' উপর ভিত্তি করেও এসব গবেষণা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করতে পারেন কেউ কেউ। আমাদের লাইফস্টাইল বা অন্যান্য শারীরিক সমস্যাও হয়তো এর সাথে জড়িত থাকতে পারে। যেমন, গারাউলেটের গবেষণায় ন্যাপ নেওয়া ও স্থূলতার মধ্যে একটা সম্পর্ক দেখানো হয়েছে। কিন্তু তিনি জানেন না কোনটা আগে আসছে, আর কোনটা পরে! "বেশি খাচ্ছে বলে বেশি সময় ঘুমাচ্ছে নাকি ঘুম বেশি বলে খাচ্ছে বেশি? এ ব্যাপারে আমরা নিশ্চিত নই!" এই বলে নিজের কথার ইতি টানেন গারাউলেট।