নতুন চাকরি নেওয়ার ক্ষেত্রে দরকষাকষির ১৩ কৌশল
ধরুন, একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরির সাক্ষাৎকার দিচ্ছেন। একে একে প্রথম দুই ধাপ পেরিয়ে তৃতীয় ধাপের সাক্ষাৎকারে বসে আছেন এখন। এই প্রতিষ্ঠানে চাকরি করা আপনার বহুদিনের স্বপ্ন।
হঠাৎ নিয়োগদাতাদের একজন প্রশ্ন করে বসলেন, 'আপনি তো জানেনই, আমরা অনেক চাকরিপ্রার্থীর পরীক্ষা নিচ্ছি। আপনাকে আমাদের পছন্দ হয়েছে। আশা করি আপনারও আমাদেরকে পছন্দ হয়েছে। আমরা যদি আপনাকে "কম্পিটিটিভ অফার" দিই, আপনি কি তা গ্রহণ করবেন?'
নিজের পছন্দের একটি চাকরির প্রস্তাব পেয়েছেন, কিন্তু বেতন আপনার প্রত্যাশার চেয়ে কম। নিয়োগদাতাকে জিজ্ঞেস করলেন, বেতন বাড়ানোর সম্ভাবনা আছে কি না। নিয়োগদাতা বললেন, 'আমরা সাধারণত আপনার ব্যাকগ্রাউন্ডের কাউকে নিয়োগ দিই না, আর আমাদের এখানকার সংস্কৃতিও আলাদা। এই চাকরি শুধু টাকার জন্য ন। আপনি তাহলে বেতন না বাড়ালে কাজ করবেন না?'
তিন বছর হয়ে গেছে আপনার চাকরির বয়স। অন্য প্রতিষ্ঠান থেকে ক্রমাগত বেশি বেতনের চাকরির প্রস্তাব পাচ্ছেন। কিন্তু আপনি যে চাকরি করছেন সেটি ছাড়তে চান না—বরং চান অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের প্রস্তাব ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য পুষিয়ে নেওয়ার মতো একটা প্রস্তাব। কাজেই আপনি বেতন বাড়ানোর প্রস্তাব দিতে ইচ্ছুক। দুর্ভাগ্যবশত, আপনার বর্তমান প্রতিষ্ঠানের বাজেট খুব কম। আর অন্য প্রতিষ্ঠানে চলে যেতে চাইলেও আপনার বস ব্যাপারটিকে ভালোভাবে নেন না। এখন কী করবেন?
তিনটি পরিস্থিতিই কঠিন। এই তিনটি পরিস্থিতিই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, চাকরির প্রস্তাব নিয়ে দরকষাকষি করা কতটা কঠিন।
অনেক কোম্পানিতেই কম বেতন পুষিয়ে দেয়া হয় বিভিন্ন রকমের বোনাস দিয়ে। আবার এখন বিভিন্ন বিষয়ে দক্ষ কর্মীর সংখ্যা এত বেশি যে মানসম্মত বেতন বা বোনাস প্যাকেজ ঠিক করা প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষের জন্য কঠিন হয়ে পড়ছে।
কিছু কিছু শিল্পে শ্রম বাজার ভীষণ দুর্বল। এ কারণে চাকরিপ্রার্থীদের বেতন নিয়ে দরকষাকষি করার সুযোগ খুব একটা থাকে না। এছাড়া যারা বেকার বা যাদের চাকরি ঝুঁকির মুখে আছে, তাদের এই দরকষাকষির ক্ষমতা আরও কমে গেছে।
তা সত্ত্বেও একটু কৌশল অবলম্বন করলেই চাকরিদাতাদের সঙ্গে দরকষাকষি করা সম্ভব। চাকরি নিয়ে দরকষাকষির প্রতিটি পরিস্থিতিই আলাদা, কিন্তু কিছু কৌশল ও নিয়মনীতি প্রয়োগ করলে অনেকক্ষেত্রেই সাফল্য পাওয়া সম্ভব। চলুন জেনে নেওয়া যাক হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউ অনুসারে চাকরির আলোচনায় সাহায্য করার মতো ১৩টি নিয়ম।
মনে রাখবেন, আপনাকে পছন্দ করে বলেই চাকরি দিয়েছে
কথাটা বহু পুরনো—কিন্তু আজও কার্যকর—কেউ যদি আপনাকে পছন্দ না করে, তাহলে সে আপনার পক্ষে সাফাই গাইবে না। দরকষাকষির সময় যদি নিয়োগদাতার মনে আপনার ব্যাপারে বিরূপ ধারণা সৃষ্টি হয়, তবে ভালো প্রস্তাব দেওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়।
ব্যাপারটা শুধু ভদ্রতা রক্ষার নয়; আলোচনার সময় চাপা উত্তেজনা সামাল দেয়ারও বটে। যেমন, কোনো সুবিধা চাইতে হলে এমনভাবে চাইবেন, যেন আপনাকে লোভী মনে না হয়। আপনার কথার ধরনের ওপর ভিত্তি করে নিয়োগদাতারা আপনাকে মূল্যায়ন করতে পারে। কাজেই তাদের মন জয় করতে চেষ্টা করুন।
আপনি যা চাইছেন, তা কেন আপনার প্রাপ্য বোঝান
নিয়োগদাতারা আপনাকে পছন্দ করলেই যথেষ্ট না। যা চাইছেন, আপনি তার যোগ্য—নিয়োগদাতাদের মনে এই বিশ্বাস সৃষ্টি করাটাও অত্যন্ত জরুরি।
শুধু আপনার চাহিদা জানিয়েই খালাস হয়ে যাবেন না। বরঞ্চ আপনি কেন এই চাহিদার যোগ্য দাবিদার, তা বুঝিয়ে বলুন। যেমন, নিয়োগদাতাদের বুঝিয়ে বলুন কেন আপনি বেশি বেতন প্রাপ্য।
বিশ্বাসযোগ্য ব্যাখ্যা দিতে না পারলে আপনার দাবি বোকা বোকা শোনাতে পারে। এতে নিয়োগদাতাদের মনে উল্টো আপনার ব্যাপারে বিরূপ ধারণা জন্মাতে পারে।
স্পষ্ট করুন আপনি দীর্ঘদিন কাজ করবেন
নিয়োগদাতার যদি সন্দেহ হয় আপনি তাদের প্রতিষ্ঠানে বেশিদিন কাজ করবেন না, তারা আপনাকে ভালো প্রস্তাব দেবে না। কে-ই বা চাইবে এমন মানুষের ওপর বিনিয়োগ করতে, যে কিছুদিন পরই অন্য কোথাও চলে যাবে?
কাজেই ভালো প্রস্তাব পেতে চাইলে নিয়োগদাতাদের স্পষ্ট বুঝিয়ে দিন যে আপনি তাদের প্রতিষ্ঠানে দীর্ঘমেয়াদে কাজ করতে আগ্রহী। তবে সেইসঙ্গে খুব মার্জিতভাবে, সুকৌশলে জানিয়ে দিন যে আপনার হাতে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের প্রস্তাবও রয়েছে (যদি থাকে আরকি)।
নিয়োগদাতাদের মন বুঝুন
প্রতিষ্ঠান দরকষাকষি করে না, মানুষ করে। তাই আপনার মুখোমুখি বসে থাকা মানুষটাকে প্রভাবিত করতে চাইল আগে তাকে বুঝতে হবে।
বুঝতে হবে টেবিলের ওপাশে বসা মানুষটির পছন্দ-অপছন্দ। তার মন জয় করতে পারলে যা আশা করছেন, তার চেয়ে বেশি কিছুও পেয়ে যেতে পারেন।
নিয়োগদাতাদের সীমাবদ্ধতা বুঝুন
নিয়োগদাতারা আপনাকে পছন্দ করতে পারে। মনে করতে পারে, আপনি যা যা চান, তার সবই আপনার প্রাপ্য।
কিন্তু তারপরও আপনার দাবি তারা মেনে না-ও নিতে পারে। কেন? কারণ তাদের কিছু সীমাবদ্ধতা থাকতে পারে। যেমন, একটা নির্দিষ্ট অঙ্কের বেশি বেতন না দেওয়া।
আপনার কাজ হচ্ছে, কোন কোন দাবি নিয়োগদাতারা মেনে নিতে পারবে আর কোনগুলো মানতে পারবে না, তা চিহ্নিত করা। যেমন, বড় একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আলোচনা করছেন আপনি। তারা একইসঙ্গে একই পদের জন্য আপনার সঙ্গে আরও ২০ জনকে নিয়োগ দেবে। সেজন্য প্রতিষ্ঠানটি আপনাকে অন্যদের চেয়ে বেশি বেতন দিতে পারবে না। তবে ছুটিছাটা ও বোনাসের ক্ষেত্রে বাড়তি কিছু সুবিধা তারা আপনাকে দিতে পারবে।
অন্যদিকে ধরুন, আপনি অপেক্ষাকৃত ছোট একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে দরকষাকষি করছেন। প্রতিষ্ঠানটি আগে কখনও আপনার পদে কাউকে নিয়োগ দেয়নি। তারা হয়তো আপনাকে বেতন কিছুটা বাড়িয়ে দিতে পারবে, কিন্তু অন্যান্য সুবিধা তেমন দিতে পারবে না। এরকম সীমাবদ্ধতা যত বেশি বুঝতে পারবেন, তত ভালো প্রস্তাব দিতে পারবেন, যার ফলে দুপক্ষই লাভবান হবেন।
কঠিন প্রশ্নের জন্য প্রস্তুত থাকুন
অনেক চাকরিপ্রার্থীই ভীষণ কঠিন সব প্রশ্নের সামনে পড়ে যান। যেমন: আপনি আমাদের কোম্পানিকে কী দিতে পারবেন? আমরা যদি আগামীকাল একটা প্রস্তাব দিই, আপনি কি হ্যাঁ বলবেন? আমাদের প্রতিষ্ঠানই কি আপনার পছন্দের শীর্ষে?
এমন প্রশ্ন অনেকের কাছেই অপ্রত্যাশিত। অপ্রস্তুত থাকলে আপনি হয়তো উত্তর দিতে গিয়ে তালগোল পাকিয়ে ফেলতে পারেন। ফলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।
এমন পরস্থিতিতে সবচেয়ে ভালো পন্থা হলো মিথ্যা না বলা। মিথ্যে বললে হিতে বিপরীত হতে পারে। তা না হলেও মিথ্যে বলাটা অনৈতিক।
আরেকটা ঝুঁকি হচ্ছে, কঠিন প্রশ্নের মুখোমুখি হলে নিয়োগদাতাদের খুশি করার জন্য বেশি চেষ্টা করতে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।
কাজেই যেসব প্রশ্ন আপনাকে অস্বস্তিতে ফেলে দেবে কিংবা আপনার দুর্বলতা বের করে আনবে—এমন প্রশ্নের জন্য সবসময় প্রস্তুত থাকাটাই সবচেয়ে ভালো পদ্ধতি। আপনার উদ্দেশ্য হলো সততার সঙ্গে আকর্ষণীয়ভাবে এসব প্রশ্নের উত্তর দেয়া।
প্রশ্ন নয়, প্রশ্নকর্তার উদ্দেশ্যের ওপর গুরুত্ব দিন
সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া থাকা সত্ত্বেও যদি নিয়োগদাতা অপ্রত্যাশিত কোনো প্রশ্ন করে ফেলে, তাহলে সহজ-সরল একটা নিয়ম মনে রাখবেন—প্রশ্নটি গুরুত্বপূর্ণ নয়, গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে প্রশ্নকর্তার উদ্দেশ্য।
বেশিরভাগ সময়ই প্রশ্ন কঠিন হলেও প্রশ্নকর্তার উদ্দেশ্য ভালো হয়। আপনি কালই যোগ দিতে প্রস্তুত কি না—এমন প্রশ্ন করা হয় আপনি সত্যিই চাকরিটার ব্যাপারে আন্তরিক কি না তা জানার জন্য। আপনাকে কোণঠাসা করার জন্য নয়।
আবার অন্য কী কী চাকরির প্রস্তাব আপনার হাতে আছে, তা জানতে চাওয়া হয় আপনার দুর্বলতা বের করার জন্য নয়—বরং আপনি ঠিক কোন ধরনের চাকরি খুঁজছেন, সে সম্পর্কে ধারণা পাওয়ার জন্য।
কাজেই এরকম প্রশ্নের পেছনে প্রশ্নকর্তার উদ্দেশ্য কী, তা চিহ্নিত করুন।
সামগ্রিক চুক্তি নিয়ে ভাবুন
অনেকেই মনে করেন, 'চাকরির প্রস্তাব' এবং 'বেতন' নিয়ে দরকষাকষি একই ব্যাপার। কিন্তু চাকরির ব্যাপারে সন্তুষ্টি অন্যান্য সুবিধা থেকেও আসতে পারে।
শুধু বেতনের ওপরই নজর দেবেন না। চাকরির সব দায়িত্ব ও সুযোগ-সুবিধার ওপর নজর দিন। যেমন, আপনার কার্যপরিধি, চাকরির স্থান, যাতায়াত, কর্মঘণ্টার সুবিধা, প্রমোশন সুবিধা প্রভৃতি।
একটার পর একটা নয়, একবারে সব আলোচনা সারুন
একবারে সবগুলো দাবি তুলে ধরুন, একটা একটা করে তুলবেন না। যেমন, প্রথমে বেতন নিয়ে দরকষাকষি করলেন। তারপর খানিক বাদে অন্য আরেকটি দাবি তুললেন—এরকম করবেন না।
প্রথমে যদি শুধু একটি দাবি তোলেন, তাহলে নিয়োগকর্তা ভাবতে পারেন এই দাবি মেনে নিলেই আপনি চাকরির প্রস্তাব গ্রহণ করতে প্রস্তুত। তাছাড়া একটার পর একটা দাবি তুললে নিয়োগকর্তা আপনার ওপর নাখোশও হয়ে উঠতে পারেন।
কাজেই দরকষাকষির সময় একাধিক দাবি থাকলে সবগুলো নিয়ে একবারে আলোচনা সেরে ফেলুন। এবং প্রত্যেকটা দাবিই যে আপনার কাছে গুরুত্বপূর্ণ, তা স্পষ্ট করে তুলে ধরুন। নইলে যে দাবি সবচেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ, নিয়োগকর্তা সেগুলো মেনে নিতে পারে—কেননা ওসব দাবি পূরণ করা সবচেয়ে সহজ। এবং মনে করতে পারে, তারা তো আপনার অর্ধেক দাবি মেনেই নিয়েছে। সেক্ষেত্রে আপনি আর দরকষাকষি করে সুবিধা করতে পারবেন না।
স্রেফ করতে হয় বলেই দরকষাকষি করবেন না
আপনি দরকষাকষিতে ভালো—এমনটা প্রমাণ করার জন্য দরকষাকষি করবেন না। কেবল গুরুত্বপূর্ণ মনে হলেই কোনো দাবি নিয়ে আলোচনা করুন। স্রেফ দরকষাকষির জন্য আলোচনা চালিয়ে যাবেন না। ছোটখাটো সব ব্যাপার নিয়েও দরকষাকষি করবেন না। এতে পরবর্তীতে প্রতিষ্ঠানে দরকষাকষির সুযোগ কমে আসতে পারে।
যেকোনো ধরনের আল্টিমেটাম দেওয়া থেকে বিরত থাকুন
'হয় এটা করো, নয়তো ওটা'—এ ধরনের কথা শুনতে কেউই পছন্দ করে না। অতএব, কখনোই আল্টিমেটাম দেবেন না।
কখনও কখনও আমরা অনিচ্ছাসত্ত্বেও আল্টিমেটাম দিয়ে ফেলি। হয়তো নিজের শক্তি দেখাতে গিয়ে, কিংবা হতাশ হয়ে এ কাজ করে ফেলি। এতে নিয়োগদাতাও একই প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারে।
মনে রাখবেন, নিয়োগদাতা শুধু আপনাকে নিয়েই ভাবছে না
দরকষাকষি কঠিন হয়ে পড়লে কিংবা চাকরির আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব পেতে দেরি হলে মনে হতেই পারে নিয়োগদাতারা আপনার ব্যাপারে তেমন আগ্রহী না। কিংবা কোনো ইস্যু নিয়ে দরকষাকষিতে সময়ক্ষেপণ করলে আপনি নাখোশ হয়ে উঠতে পারেন।
চাকরির অফার লেটার দিতে দেরি হওয়ার মানে হতে পারে, নিয়োগদাতারা সম্ভবত শুধু আপনাকে নিয়েই ভাবছে না। নিয়োগদাতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখুন, কিন্তু ধৈর্য ধরুন।
ধৈর্য ধরতে না পারলে হতাশা বা ক্ষোভ প্রকাশ করে ফেলবেন না। বরং নিয়োগদাতার কাছে জানতে চান অচলাবস্থা কাটানোর জন্য আপনার পক্ষ থেকে কিছু করণীয় আছে কি না।
ধৈর্য ধরে সুযোগের অপেক্ষায় থাকুন
একটা কথা সবসময় মনে রাখবেন—আজ যা নিয়ে দরকষাকষি করতে পারছেন না, তা নিয়ে আগামীকালই হয়তো দরকষাকষির সুযোগ খুলে যাবে আপনার সামনে।
বস আজ যে দাবি এক কথায় নাকচ করে দিল, ছয় মাস পরই হয়তো তার মন বদলাবে। পরিস্থিতি বদল বা আপনি তার আস্থা অর্জনের কারণেই হয়তো তার এই মনবদল।
কাজেই ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করুন। আলোচনা চালিয়ে যাবার মানসিকতা বজায় রাখুন। অমীমাংসিত ইস্যু নিয়ে কথা বলতে অপরপক্ষকে উৎসাহিত করুন।