মহাসমুদ্রের বুকে মোট কতগুলো জাহাজের ধ্বংসাবশেষ রয়েছে?
১৯০০ সালের বসন্তকাল। আর সব দিনের মতো সেদিনও এলিয়াস স্টাডিয়াটিস সমুদ্রে ডুব দিয়েছিলেন স্পঞ্জ সংগ্রহ করতে। তামার তৈরি ডাইভিং স্যুট পরে সমুদ্রের বুকে পা রাখার পর এক ভয়ংকর দৃশ্যের মুখোমুখি হতে হলো তাকে। তার চারপাশে মানুষের অসংখ্য দেহাবশেষ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আছে। ভয় পেয়ে সাথে সাথে ভেসে উঠে নিজের জাহাজের ক্যাপ্টেনকে বিস্তারিত জানালেন তিনি।
সেদিন হুট করেই সমুদ্রতলে অ্যান্টিকিথেরা জাহাজের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কার করেছিলেন এলিয়াস। প্রায় দুই হাজার বছরের বেশি আগে রোমানদের এ জাহাজটি সমুদ্রে ডুবে গিয়েছিল। শতবছর আগে এজিয়ান সাগরের একটি দ্বীপের উপকূলে খুঁজে পাওয়া এ ধ্বংসাবশেষ দেখতে আজও আগ্রহী মানুষ ভিড় করেন।
সম্প্রতি ভূমধ্যসাগরের স্কেরকি ব্যাংকে অভিযান চালিয়েছে ইউনেস্কো। প্রবালপ্রাচীরে ভর্তি অগভীর এ জলপথ পূর্ব ও পশ্চিম ভূমধ্যসাগরকে যুক্ত করেছে। কয়েক হাজার বছর ধরে এটি ব্যবহার করেছেন নাবিকেরা, আরে এখানে ডুবে গেছে প্রচুর জাহাজও।
মাল্টিবিম সোনার ও জলরোবট ব্যবহার করে সম্প্রতি বিশ্বের আটটি দেশের বিজ্ঞানীরা এ জলপথের সমুদ্রতলের ম্যাপ তৈরি করেছেন। এ সপ্তাহে তারা নতুন তিনটি জাহাজের ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পাওয়ার কথা জানিয়েছেন। এ জাহাজগুলো খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতাব্দী, দ্বিতীয় শতক, এবং ১৯ বা ২০ শতকে ডুবেছিল।
ইউনেস্কোর হিসাব অনুযায়ী, সমুদ্রতলে এখনো অসংখ্য জাহাজ বা নৌযানের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কারের অপেক্ষায় রয়েছে।
যে হিসাব অজানা
এখন পর্যন্ত সবচেয়ে পুরোনো নৌকাটির ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গিয়েছে নেদারল্যান্ডে। কাঠের তৈরি ছোট্ট ওই নৌকাটি তৈরি করা হয়েছিল প্রায় ১০ হাজার বছর আগে।
পৃথিবীর যেখানেই সমুদ্রপথ রয়েছে, সেখানেই জলযানের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া যাবে। আজকের মহাসমুদ্রগুলোর বক্ষে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আশ্রয় নিয়েছে বাণিজ্যপোত, যুদ্ধ ও অভিযানের জাহাজ।
আছে জলদস্যুদের জাহাজ, যেগুলোর বুকে জ্বলজ্বল করছে সোনাদানা। কত রাজা, সম্রাটকে নিয়ে সমুদ্রের বুকে ডুবে গেছে রাজকীয় বহর, তারও ইয়ত্তা নেই।
এসব সমুদ্রে যেমন পাওয়া যাবে সুপ্রাচীন মাছধরার নৌকা, তেমনি মিলবে আধুনিকযুগের ডেস্ট্রয়ার বা সাবমেরিনও। আরও আছে ১৯ শতকের তিমি শিকারের জাহাজ, অথবা টাইটানিকের মতো বড় যাত্রীবাহী জাহাজ।
কিন্তু সব মিলিয়ে কতগুলো জাহাজ সমুদ্রের গভীরে আশ্রয় নিয়েছে? মোট কত জাহাজের ধ্বংসাবশেষ এখনো মানুষের অগোচরে রয়ে গেছে?
ধ্বংসপ্রাপ্ত জাহাজের সংখ্যা নিয়ে একাধিক তথ্যভান্ডার রয়েছে, তবে এগুলোর সবগুলোতেই খুঁজে পাওয়া ধ্বংসাবশেষের সংখ্যায় কিছুটা ভিন্নতা রয়েছে।
অনলাইন সার্ভিস রেক সাইটের তথ্য অনুযায়ী মোট দুই লাখ নয় হাজার নৌযান এখন পর্যন্ত সমুদ্রে ডুবে গিয়েছে। এর মধ্যে এক লাখ ৭৯ হাজার ১১০টির ডুবে যাওয়ার অবস্থানের কথা জানা গেছে। গ্লোবাল মেরিটাইম রেকস ডেটাবেজ জানাচ্ছে, প্রায় দুই লাখ ৫০ হাজারের বেশি জাহাজ এখন পর্যন্ত মহাসমুদ্রগুলোতে ডুবে গেছে।
আরেকটি হিসাব অনুযায়ী, কেবল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ই প্রায় ১৫ হাজার জাহাজ ডুবে গিয়েছিল। প্রশান্ত মহাসাগর থেকে আটলান্টিক মহাসাগর পর্যন্ত এসব জাহাজ এখন সমুদ্রের বুকে ক্রমশ ক্ষয় হচ্ছে — সেই সঙ্গে চারপাশের পনিতে ছড়াচ্ছে তেল, রাসায়নিক পদার্থ ও ভারি ধাতু।
তবে মনে করা হয়, এখন পর্যন্ত হদিস জানা জাহাজডুবির সংখ্যা প্রকৃত জাহাজডুবির চেয়ে অনেক কম। ইউনেস্কোর একটি হিসাব অনুযায়ী, বিশ্বের সমুদ্রগুলোতে এখনো প্রায় ৩০ লাখের বেশি অনাবিষ্কৃত ধ্বংসাবশেষ রয়েছে।
লুপ্ত গুপ্তধন
হারানো এ জাহাজগুলো যেমন অতীতকালের মানুষের জীবনযাত্রার বিষয়ে আশ্চর্য সব তথ্যের ভান্ডার, তেমনিভাবে এগুলোর অনেকগুলোতেই রয়েছে প্রচুর ধনসম্পদ।
১৭০৮ সারের ৮ জুন কলম্বিয়ার উপকূলে ক্যারিবিয়ান সাগরে সান হোসে ডুবে যায়। তার দুই বছর আগে স্পেন থেকে ছেড়ে আসা এ জাহাজটি যেমন চিনি, মশলা, বিভিন্ন দামি ধাতু ও অন্যান্য পণ্য বহন করছিল ছিল, তেমনি এর মধ্যে ছিল অসংখ্য ধনরত্ন।
সান হোসে রুপা, পান্না, ও সোনার মোহরে ভর্তি ছিল। ব্রিটিশ একটি জাহাজের মুখোমুখি পড়ে সমুদ্রে ডুবে যায় এটি। কয়েক ঘণ্টার যুদ্ধের পর জাহাজটি গোলাবারুদের ঘরে আগুন ধরে গিয়েছিল। প্রায় ৬০০ ক্রু ও অসংখ্য মণিমুক্তা নিয়ে সমুদ্রের বুকে চিরতরে আশ্রয় নেয় এটি।
প্রায় ৩০০ বছর পর ২০১৫ সালে কলম্বিয়ান নৌবাহিনী অবশেষে জাহাজটির ধ্বংসাবশেষ সমুদ্রে খুঁজে পায়। সঙ্গে মেলে এর কামান, সিরামিক ও সোনার মোহরগুলোও — সবমিলিয়ে যার মূল্য দাঁড়ায় ১৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে। কিন্তু এরপর শুরু হয় এর প্রকৃত মালিকানা নিয়ে দ্বন্দ্ব।
সোনালী যুগ
জাহাজের ধ্বংসাবশেষ থেকে পাওয়া মালামাল নিয়ে এ ধরনের দ্বন্দ্ব শীঘ্রই আরও বেশি পরিমাণে বাড়তে পারে। কারণ, ক্রমেই জাহাজের ধ্বংসাবশেষ উদ্ধারের হার বাড়ছে।
অতীতে অনেকগুলো জাহাজ পাওয়া গিয়েছিল মোটামুটি অগভীর জলে। জেলেরা অনেক ধ্বংসাবশেষ হঠাৎ করে খুঁজে পেয়েছিলেন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের উপকূলীয় সমুদ্র এলাকায় বিজ্ঞানী ও গুপ্তধন শিকারিরা অনুসন্ধান চালিয়েছিলেন।
কিন্তু অত্যাধুনিক যন্ত্রের সৌজন্যে বর্তমান সময়ে গভীর সমুদ্রে ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পাওয়া কাজটাও সহজ হয়ে গিয়েছে। ফলে গভীর সমুদ্রের তলদেশের গোপন রহস্যসমূহ মানুষ এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি দ্রুতগতিতে জানতে পারছে।
তবে এখনো সমুদ্রের বুকে অনেক নৌযানের ধ্বংসাবশেষ অনাবিষ্কৃত অবস্থায় রয়েছে। কে জানে কোন দিন টাইটানিকের চেয়েও বড় কোনো জাহাজের ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পাওয়া যায়!