ক্র্যাক প্লাটুন থেকে কিলো ফ্লাইট: স্টুডেন্ট ফর্মুলা রেসিংয়ের দুনিয়া
রেসিং ট্র্যাকের পিচঢালা পথের ওপর দিয়ে সাঁইসাঁই করে ছুটে চলেছে একের পর এক গাড়ি। হঠাৎ দেখে মনে হবে কোনো সত্যিকারের ফর্মুলা ওয়ান রেসিং প্রতিযোগিতা চলছে, লড়ছে ফেরারি-ম্যাকলারেন-হোন্ডার তৈরি ফর্মুলা রেসিং গাড়ি। তবে একটু ভালোমতো তাকালেই বোঝা যাবে গাড়িগুলোতে ভিন্নতা রয়েছে। এর কারণ গাড়িগুলো একেবারেই পেশাদারভাবে তৈরি করা গাড়ি নয়, এর সবগুলোই বানিয়েছে ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। আর এই প্রতিযোগিতার নাম ফর্মুলা স্টুডেন্ট।
শিক্ষার্থীদের ফর্মুলা গাড়ি তৈরির প্রতিযোগিতাটি ফর্মুলা স্টুডেন্ট হিসেবে পরিচিতি পেলেও মূলত যুক্তরাজ্যের সংস্করণটিকেই ডাকা হয় 'ফর্মুলা স্টুডেন্ট' নামে। ফর্মুলা ওয়ান শুরু হওয়ার পর ভাবা হতে থাকে ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষার্থীদের জন্যও এমন একটা প্রতিযোগিতা শুরু হলে কেমন হয়? এরই পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৮০ সালে সোসাইটি অফ অটোমোটিভ ইঞ্জিনিয়ার্সের (এসএই) উদ্যোগে টেক্সাসের অস্টিন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত হয় ফর্মুলা এসএই। এসএই-র আয়োজনের তালিকায় অ্যারোডিজাইন, বাজা, ক্লিন স্নোমোবাইলসহ আরও অনেক ধরনের প্রতিযোগিতা থাকলেও অন্যতম জনপ্রিয় প্রতিযোগিতা ফর্মুলা এসএই-ই। সারাবিশ্ব জুড়ে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, ইতালি, জার্মানি, যুক্তরাজ্যসহ বেশ কিছু দেশে ফর্মুলা স্টুডেন্ট প্রতিযোগিতা নিয়মিতভাবে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে।
শুরু থেকেই ফর্মুলা স্টুডেন্ট আয়োজনের উদ্দেশ্য ছিল একটিই: আর তা হলো অটোমোবাইল ইঞ্জিনিয়ারদের পাইপলাইন প্রস্তুত রাখা, প্রতিযোগিতার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের দক্ষতা বৃদ্ধি করা। আর সে কারণেই বিভিন্ন দেশের ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গড়ে উঠেছে ফর্মুলা রেসিং ক্লাব, যারা নিয়মিতভাবে বিভিন্ন দেশের ফর্মুলা স্টুডেন্ট প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে চলেছে। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। ফর্মুলা স্টুডেন্ট প্রতিযোগিতাকে কেন্দ্র করে রাজশাহী প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (রুয়েট)-এর 'টিম ক্র্যাক প্লাটুন', খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েট)-এর 'টিম কিলো ফ্লাইট', আইইউটি-এর ফর্মুলা আইইউটি, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়য় (বুয়েট)-এর 'অটোমায়েস্ত্রো', আহসানউল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের 'টিম স্বপ্নযান'সহ অন্যান্য পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও বেশ কিছু ক্লাব গড়ে উঠেছে।
ফর্মুলা স্টুডেন্ট প্রতিযোগিতা, ক্লাব কার্যক্রম, গাড়ি নির্মাণ থেকে শুরু করে ভবিষ্যত পরিকল্পনা পর্যন্ত বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা হয়েছে টিম ক্র্যাক প্লাটুনের বর্তমান টিম ক্যাপ্টেন শেখ তকী তাহমিদ এবং টিম কিলো ফ্লাইটের প্রতিষ্ঠাতা আরফান ইসলামের সাথে। জেনে নেওয়া যাক ক্লাবের ভেতরের গল্প।
ক্লাবের যাত্রাপথ
মূলত গাড়ির প্রতি ভালোবাসা আর প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ, এই দুটো জিনিস মিলিয়েই ক্লাব দুটোর যাত্রা শুরু হয়। ২০১৫ সালে রুয়েটের বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী ভারতের কোয়েমবাটোর শহরে এক অফরোড ভেহিকেল প্রতিযোগিতায় নিজেদের তৈরি কোয়াডবাইক নিয়ে অংশগ্রহণ করেন। সেখান থেকে জিতে নেন 'বেস্ট প্যাশনেট টিম'-এর অ্যাওয়ার্ড। এরপর থেকেই তারা খুঁজতে থাকেন এ ধরনের প্রতিযোগিতা আর কী কী হয়। এরপরেই তারা জানতে পারেন ফর্মুলা স্টুডেন্টের কথা, যেটিকে ধরা হয় এ ধারার সবচেয়ে জনপ্রিয় প্রতিযোগিতা হিসেবে। সেখান থেকেই দল গঠন আর 'টিম ক্র্যাক প্লাটুন'-এর যাত্রা শুরু।
২০১৮ সালে প্রতিষ্ঠিত কিলো ফ্লাইটের প্রতিষ্ঠাতা আরফান ইসলামও জানান, বিভিন্ন প্রতিযোগিতা সম্পর্কে খোঁজখবর রাখার সূত্র ধরেই তিনি ফর্মুলা স্টুডেন্ট সম্পর্কে জানতে পারেন এবং এ ধরনের একটি ক্লাব গঠন করতে উদ্যোগী হন। মূলত উদ্ভাবনী কিছু করার মন মানসিকতা থেকেই ক্লাবের কার্যক্রম শুরু হয়।
একটি ক্লাবের একেবারেই মূলে থাকে তার সদস্যরা। এদিকে ফর্মুলা স্টুডেন্ট প্রতিযোগিতার নিয়ম হলো প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে হলে তাকে অবশ্যই বর্তমান শিক্ষার্থী হতে হবে, সাবেক কেউ নন। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া নতুন ব্যাচ থেকেই আগ্রহী শিক্ষার্থীদেরকে বিভিন্ন ধাপে বাছাই করে ক্লাবের সদস্য নেওয়া হয়।
ক্র্যাক প্লাটুনের ক্ষেত্রে প্রথমেই সামাজিক মাধ্যমে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন জায়গায় বুথ বসিয়ে ক্লাব সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে সদ্য ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের কাছে ফর্মুলা স্টুডেন্ট বা এ ধরনের প্রতিযোগিতা সম্পর্কে না জানাটাই স্বাভাবিক হওয়ায় প্রথমে আগ্রহী শিক্ষার্থীদেরকে নিয়ে এক দিনব্যাপী একটি ওয়ার্কশপের আয়োজন করা হয়। ওয়ার্কশপের পর একটি লিখিত পরীক্ষা এবং মৌখিক পরীক্ষার আয়োজন করার পর সেখান থেকেই যাচাই-বাছাই করে নতুন সদস্যদেরকে নেওয়া হয়।
'নতুন সদস্যদের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তার আত্মবিশ্বাস এবং দল হিসেবে কাজ করার মানসিকতা', জানান শেখ তকী তাহমিদ। এছাড়া গাড়ি সম্পর্কে তার মৌলিক জ্ঞান আর আগ্রহের বিষয়টিও জরুরি। আরফান ইসলামও জানান, 'নতুন সদস্যদের ক্ষেত্রে আগ্রহ জিনিসটিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়াও সৃজনশীলতা, মনোবলের ওপরও প্রাধান্য দেওয়া হয়।'
ফর্মুলা স্টুডেন্ট প্রতিযোগিতা কেবল যে মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ারদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ তা নয়, বরং গাড়ির ডিজাইন, পরিকল্পনা, তৈরি থেকে শুরু করে টেস্টিং পর্যন্ত প্রতিটি ক্ষেত্রেই বিভিন্ন ক্ষেত্রের জ্ঞান ও দক্ষতার প্রয়োজন হয়। তবে সদস্য হওয়ার ক্ষেত্রে তার বিভাগ বা বিষয় কোনো বাধা হয়ে দাঁড়ায় না। এ কারণে দুইটি ক্লাবেই ইঞ্জিনিয়ারিং ক্ষেত্রের বিভিন্ন বিষয়ের শিক্ষার্থীরা যুক্ত হন, যার মধ্যে রয়েছে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, মেকাট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং, ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড প্রোডাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং, মেটারিয়াল সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং, কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, লেদার ইঞ্জিনিয়ারিংসহ নানা বিষয়ের শিক্ষার্থীরা।
রেসিং গাড়ি নির্মাণ
একটি গাড়ি নির্মাণের ক্ষেত্রে বেশ কিছু ধাপ অতিক্রম করতে হয়। আরফান ইসলামের মতে, 'প্রথমেই দরকার একটি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা। তারপর একে একে পার্টসগুলো ডিজাইন করে সবগুলোকে নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে অ্যাসেম্বল করতে হয়।'
এদিকে তকীর মতে, একটি ফর্মুলা স্টুডেন্ট গ্রেডের গাড়ি নির্মাণের জন্য দরকার আত্মবিশ্বাস এবং একটি কার্যকরী দল। তিনি জানান, দলের সদস্যদেরকে বিশ্বাস রাখতে হবে যে এ ধরনের কিছু তৈরি করা সম্ভব। তাছাড়া দল যদি ভালো হয়, তাদের মধ্যে যদি ভালো টিমওয়ার্ক থাকে, তবে ভালো ফলাফল বের করে আনা সম্ভব বলেও মনে করেন তিনি।
তবে একটি ফর্মুলা স্টুডেন্ট গ্রেডের রেসিং গাড়ি নির্মাণের পথে বাধার সংখ্যাও কম নয়। এর মধ্যে সবার প্রথমেই চলে আসে অর্থ সংক্রান্ত বিষয়। প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে সক্ষম এরকম মানের একটি গাড়ি নির্মাণের জন্য প্রয়োজন প্রচুর অর্থ। গাড়ির ধরন অনুযায়ী অর্থের পরিমাণ ওঠানামা করলেও ফর্মুলা স্টুডেন্ট প্রতিযোগিতার জন্য গাড়িগুলো নির্মাণের জন্য খরচ পড়ে গড়ে ১২ থেকে ১৮ লাখ টাকা। এই ফান্ড ম্যানেজ করাটাই অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ। তবে ক্লাবগুলো নিজেদের গাড়ি নির্মাণের জন্য স্পন্সরদের সাথে যোগাযোগ করেন, তাদের মাধ্যমেই গাড়ি নির্মাণের খরচের বেশিরভাগ অংশ উঠে আসে।
ফান্ড জোগাড়ের পর আরেকটি মূল সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় গাড়ির পার্টস জোগাড় করা। বাংলাদেশে অটোমোবাইল শিল্প তেমন শক্তিশালী না হওয়ায় গাড়ি নির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় বেশিরভাগ পার্টসই বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। তবে এক্ষেত্রে বেশ কিছু বিদেশি প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যারা ফর্মুলা স্টুডেন্ট ক্লাবগুলোকে পার্টস সরবরাহ করে সহায়তা করে। তারপরও প্রতিটি নতুন প্রজেক্টের জন্য নতুনভাবে পার্টস জোগাড় করা বেশ বড় একটা চ্যালেঞ্জই হয়ে দাঁড়ায় ক্লাবগুলোর জন্য।
এছাড়াও কারিগরি বিভিন্ন ক্ষেত্রেও বাধা রয়েছে। একটি গাড়ি ঠিকভাবে কাজ করছে কিনা তা নিয়ে প্রচুর টেস্ট করা প্রয়োজন। সে ধরনের অবকাঠামোগত সুবিধা বাংলাদেশে একেবারেই অপ্রতুল। নির্মাণের সময় বেশ কিছু গবেষণামূলক কাজও করতে হয়, বিভিন্ন রিসার্চ স্যাম্পল টেস্ট করতে হয়, যে জন্য প্রয়োজন অর্থের পাশাপাশি উন্নত কারিগরি সুবিধা। এই সীমাবদ্ধতাগুলোর জন্য মূল প্রতিযোগিতাতেও বাংলাদেশের মতো দেশগুলো খানিকটা পিছিয়ে থাকে বলে অনুমান করা যায়।
দুটো ক্লাবই গাড়ি নির্মাণের ক্ষেত্রে দেশীয় এবং পরিবেশবান্ধব মেটারিয়াল ব্যবহারের দিকে নজর দেয়। যেমন: ক্র্যাক প্লাটুন দেশীয় বেতশিল্পকে তুলে ধরার জন্য তাদের গাড়ির সিটে বেত ব্যবহার করেছে। এছাড়াও দুই ক্লাবের গাড়িতেই পাটের ফাইবার থেকে বানানো মেটারিয়াল ব্যবহার করা হয়েছে।
গাড়ির ক্ষেত্রে এনার্জি কনজাম্পশন বেশ বড় একটা ব্যাপার এবং মূল প্রতিযোগিতাতেও একে আলাদাভাবে মূল্যায়ন করা হয়। এজন্য ২০১৯ সাল থেকে পুরোপুরি ইলেকট্রিক গাড়ি নিয়ে কাজ করা ক্র্যাক প্লাটুন তাদের গাড়িতে এমন এক ধরনের ব্রেকিং সিস্টেম ব্যবহার করছে যেটি গাড়ির গতিশক্তিকে ব্যবহারযোগ্য বিদ্যুৎ শক্তিতে রূপান্তর করতে সক্ষম। টিম কিলো ফ্লাইটও পরবর্তী প্রতিযোগিতাগুলোর জন্য ইলেকট্রিক গাড়ি নির্মাণ নিয়ে কাজ শুরু করেছে। কমবাসশন ইঞ্জিন থেকে ইলেকট্রিক গাড়িতে রূপান্তর হওয়াও পরিবেশবান্ধব হওয়ার ক্ষেত্রে একটি বড় পদক্ষেপ।
অভিজ্ঞতা এবং অর্জন
ফর্মুলা স্টুডেন্ট প্রতিযোগিতার ধারণার মূলে রয়েছে একটি কাল্পনিক গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান, যারা একটি ফর্মুলা রেসিং গাড়ি নির্মাণের জন্য শিক্ষার্থীদের গাড়ি ডিজাইন দলের সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে। গাড়িটি নির্মাণের জন্য বেশ কিছু শর্ত বেঁধে দিয়েছে তারা। শিক্ষার্থী দলগুলোর কাজ হলো এই নিয়মগুলো মেনে সেই কাল্পনিক গাড়ি নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানের জন্য একটি প্রোটোটাইপ ফর্মুলা রেসিং গাড়ি তৈরি করা।
প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের জন্য প্রথমেই দলগুলোকে নিয়ে একটি বাছাই কুইজ প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। কুইজ প্রতিযোগিতার ফলাফলের ভিত্তিতে চূড়ান্ত প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের সুযোগ পায় দলগুলো।
ফর্মুলা স্টুডেন্টের ইভেন্টগুলোকে দুইটি ক্লাসে ভাগ করা হয়। কনসেপ্ট ক্লাসের দলগুলো কেবল স্ট্যাটিক ইভেন্টে অংশগ্রহণ করতে পারে। স্ট্যাটিক ইভেন্টের মধ্যে রয়েছে ডিজাইন, কস্ট অ্যান্ড ম্যানুফ্যাকচারিং এবং প্রেজেন্টেশন। এখানে মূলত গাড়িটির ডিজাইন কত ভালোভাবে করা হয়েছে, কতটা কম খরচে কতটা ভালোভাবে গাড়িটি নির্মাণ করা সম্ভব এবং দলগুলো কতটা সুন্দরভাবে তাদের গাড়িটিকে উপস্থাপন করতে পারছে তা দেখা হয়।
দ্বিতীয় ক্লাসটি হলো ফর্মুলা স্টুডেন্ট ক্লাস, যারা স্ট্যাটিক ইভেন্ট পেরিয়ে ডাইনামিক ইভেন্টে অংশগ্রহণ করার সুযোগ পায়। মূলত যেসব দলের গাড়ি নির্মাণের কাজ শেষ হয়েছে এবং সেই গাড়িটি আয়োজক দেশে পরিবহন করে নিয়ে যেতে পারে, তারাই এই ইভেন্টগুলোতে অংশগ্রহণ করতে পারে। ডাইনামিক ইভেন্টের মধ্যে রয়েছে অ্যাকসেলারেশন, স্কিডপ্যাড, অটোক্রস, ফুয়েল ইকোনমি এবং এনডিউর্যান্স। এখানে মূলত গাড়িটির পারফরম্যান্সের জায়গাগুলো মূল্যায়ন করা হয়।
সময় হিসাব করলে ক্র্যাক প্লাটুন এবং কিলো ফ্লাইট, দুইটি ক্লাবেরই বয়স খুব বেশি নয়। তবে এ সময়ের মধ্যেই আন্তর্জাতিক পর্যায়ের বেশ কিছু ইভেন্টে অংশগ্রহণ করেছে তারা।
ক্র্যাক প্লাটুনের ক্ষেত্রে ২০১৫ সালে ভারতের অফরোড ভেহিকেল প্রতিযোগিতার পর ২০১৭ সালে প্রথম ফর্মুলা এসএই জাপানে অংশগ্রহণ করে তারা। সেবার তাদের কমবাসশন ইঞ্জিনের গাড়িটি মূলত কন্সেপচুয়াল ধারণার মধ্যেই ছিল। তবে এরপর ২০১৯ সালে ফর্মুলা এসএই জাপানে ডাক পাওয়ার পর তারা তাদের নির্মাণ করা ইলেকট্রিক গাড়ি নিয়েই অন-স্পট ফর্মুলা স্টুডেন্ট ক্লাসে অংশগ্রহণ করে। সেখানে ৭টি দেশের ২৮টি দলের মধ্যে ১৬তম স্থান অর্জন করে তারা।
সর্বশেষ ২০২৩ সালের ফর্মুলা ভারতে তারা আবারো কনসেপ্ট ক্লাসে অংশগ্রহণ করে ৩৭টি দেশের মধ্যে ১৬তম হয়েছে। তবে আগামী বছরের ফর্মুলা ভারতে সরাসরি গাড়ি নিয়েই অংশগ্রহণ করবে তারা। এছাড়াও এই জুলাই মাসে ফর্মুলা স্টুডেন্ট সুইটজারল্যান্ডে ফর্মুলা স্টুডেন্ট ক্লাসে অংশগ্রহণ করার কথা থাকলেও ভিসা জটিলতার কারণে কেবল কনসেপ্ট ক্লাসেই অংশগ্রহণ করে সন্তুষ্ট থাকতে হবে ক্র্যাক প্লাটুনকে।
এদিকে কিলো ফ্লাইট এর আগে দুইবার ফর্মুলা স্টুডেন্ট ইউকেতে অংশগ্রহণ করেছে, যার দুটিই কনসেপ্ট ক্লাসে। ২০২০ ও ২০২১ সালের প্রতিযোগিতায় তাদের স্থান ছিল যথাক্রমে ৫০ এবং ৩৩তম। ২০২৩ সালের ফর্মুলা স্টুডেন্ট ইউকে, ফর্মুলা এসএই জাপান এবং রোমানিয়াতেও কন্সেপ্ট ক্লাসে অংশগ্রহণের ডাক পেয়েছে তারা।
মোট ১০০০ পয়েন্টের মধ্যে যে দল সবচেয়ে বেশি নম্বর পায়, তারাই বিজয়ী হয়। মোট ৮টি ইভেন্ট থাকায় একেক দল একেকভাবে তাদের কৌশল সাজায়, কারণ এক জায়গায় কিছুটা পিছিয়ে থাকলেও অন্য জায়গায় ভালো করে সেই ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব। এর ফলে কেবল মূল প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেও অনেককিছু জানা সম্ভব হয়।
এ প্রসঙ্গে তকী জানান, 'আন্তর্জাতিক পর্যায়ের ফর্মুলা স্টুডেন্ট প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করাটাও আমাদের অভিজ্ঞতা বাড়াতে সাহায্য করেছে। সেখানে অংশগ্রহণ করা একেকটি দল তাদের সুবিধাগুলোকে কাজে লাগিয়ে কিংবা সীমাবদ্ধতাগুলোকে অতিক্রম করার জন্য একেকভাবে তাদের কৌশল সাজায়, একেকভাবে নিজেদের প্রজেক্টকে উপস্থাপন করে। তাদের চিন্তার ধরন, কাজ করার ধরনও অনেকখানি আলাদা হয়ে থাকে। ফলে এ ধরনের প্রতিযোগিতায় সরাসরি অংশগ্রহণ করার ফলেও আমরা অনেক কিছু গভীরভাবে জানতে পারি, যেগুলো পরবর্তীতে আমরা আমাদের দলে প্রয়োগ করার চেষ্টা করি।'
আরফান ইসলামও জানান যে, আন্তর্জাতিক পর্যায়ের প্রতিযোগিতায় দলগুলো একে অপরের সাথে অভিজ্ঞতা শেয়ার করার ফলে সেখান থেকে অনেক কিছু শিখতে পেরেছে কিলো ফ্লাইট, যেগুলো কেবল দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে সম্ভব হতো না। এই জ্ঞানকে কাজে লাগিয়েই নিজেদের দক্ষতাকে আরও কয়েক ধাপ এগিয়ে নেওয়ার জন্য চেষ্টা করছেন তারা।
ফর্মুলা স্টুডেন্ট ক্লাবগুলোর মাধ্যমে যে কেবল জ্ঞান অর্জনই হয় এমন নয়, বরং দেশে ও বিদেশের নানা পর্যায়ে নেটওয়ার্কিং-এর ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে ক্লাবগুলো। আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের মাধ্যমে বিদেশি প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত হওয়ার সুযোগ থাকে ক্লাবগুলোর সামনে। যেমন: ২০২৩ সালে ক্র্যাক প্লাটুনের ইনোভেশন পার্টনার হিসেবে যুক্ত হয়েছে ইলন মাস্কের প্রতিষ্ঠান টেসলা, যারা গাড়ির ডিজাইন থেকে শুরু করে ম্যানুফ্যাকচারিং পর্যন্ত নানা ধাপে ক্র্যাক প্লাটুনের সদস্যদেরকে পরামর্শ দিয়ে থাকে। এছাড়াও বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ক্র্যাক প্লাটুন এবং কিলো ফ্লাইটের সাথে স্পন্সর হিসেবে যুক্ত হয়, যেগুলোর মধ্যে অনেকগুলোই ইঞ্জিনিয়ারিং সেক্টরের সাথে জড়িত। তাদের সাথেও যোগাযোগের ফলে ক্লাবের সদস্যদের নেটওয়ার্কিং বাড়ে এবং যোগাযোগ দক্ষতা বৃদ্ধি পায়।
ক্লাবের সাথে যুক্ত হওয়ার মাধ্যমে একজন শিক্ষার্থী নানাভাবে উপকৃত হতে পারেন। তকীর মতে, এ ধরনের ক্লাবের পুরো কার্যক্রমকে একটি প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্ট-এর সাথে তুলনা করা যায়। প্রথমত, গাড়ির ডিজাইন, সিমুলেশন, পার্টস প্রোকিউরমেন্ট কিংবা ম্যানুফ্যাকচারিং প্রক্রিয়া শেষ করার মাধ্যমে একজন শিক্ষার্থী প্রতিটি ধাপ সম্পর্কে একটি বিস্তারিত ধারণা লাভ করতে পারেন। এই প্রতিটি ধাপই কারিগরি বিষয়ের সাথে জড়িত। ফলে হাতেকলমে বিষয়গুলো শেখা হয়ে যায়। দ্বিতীয়ত, প্রতিযোগিতাগুলো আন্তর্জাতিক পর্যায়ে হওয়ায় গাড়িগুলোকে বিদেশে নিয়ে যেতে হয়। সে সময় সি ফ্রেইটিং (Sea Freighting)-এর মতো লজিস্টিকস বিষয় সম্পর্কেও শিক্ষার্থীরা সরাসরি জানতে পারেন।
এছাড়াও পুরো প্রজেক্টের খরচ বা ম্যানুফ্যাকচারিং-এর ধাপগুলো উপস্থাপন করতে হয় প্রতিযোগিতায়। ফলে সামগ্রিকভাবে একে একটা প্রজেক্ট-ই বলা যায়, যেখানে টিমওয়ার্ক থেকে শুরু করে সময় ও বাজেট ব্যবস্থাপনা বা উপস্থাপনার মতো নানা বিষয় সরাসরি জানা যায়। এই অভিজ্ঞতা পরবর্তীতে চাকরি থেকে শুরু করে স্টার্টআপ শুরু করা পর্যন্ত নানাভাবে সাহায্য করতে পারে।
কারিগরি দিক ছাড়াও তত্ত্বীয় বা অ্যাকডেমিক থেকেও ক্লাবের সদস্যরা লাভবান হন। কারণ ফর্মুলা গাড়ি নির্মাণের পুরোটাই একটি রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট। ফলে এর সাথে জড়িত সবকিছু নিয়েই গবেষণা করতে হয়, যেটি শিক্ষার্থীদের অ্যাকাডেমিক কাজে সাহায্য করে। এছাড়াও এ সময় ইঞ্জিনিয়ারিং-এর অন্যান্য বিভাগের কাজ সম্পর্কেও পরিচিত হতে পারেন শিক্ষার্থীরা, যে কারণে তাদের জ্ঞান আরও বিস্তার লাভ করে, ইঞ্জিনিনিয়ারিং-এর বিভিন্ন বিষয়কে একত্রে কাজে লাগিয়ে কীভাবে একটি সম্পূর্ণ প্রজেক্ট দাঁড় করানো যায়, তার একটি সম্পূর্ণ চিত্র তাদের মাথায় গেঁথে যায়।
ভবিষ্যত পরিকল্পনা
পরিবেশ নিয়ে সচেতনতা প্রতিনিয়ত বাড়ছে, ফলে ইলেকট্রনিক গাড়ি নিয়েও আগ্রহ বাড়ছে, যার ছাপ দেখা যাচ্ছে ফর্মুলা স্টুডেন্ট প্রতিযোগিতাতেও। প্রতি বছরই ইলেকট্রিক ভেহিকেলে প্রতিযোগীদের সংখ্যা আগের বছরের তুলনায় বাড়ছে। টেসলাসহ আরও নানা ইলেকট্রিক গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ফর্মুলা স্টুডেন্টে অংশগ্রহণকারী দলগুলোকে কারিগরি সহায়তা ও পরামর্শ দিয়ে চলেছে। ক্র্যাক প্লাটুন আর কিলো ফ্লাইটও তাই সেদিকে ধাবিত হচ্ছে।
২০১৯ সালে প্রথম ক্লাব হিসেবে সম্পূর্ণ ইলেকট্রিক ফর্মুলা গাড়ি তৈরি করে ক্র্যাক প্লাটুন। এ বছরের জুলাই মাসে দ্বিতীয় আরেকটি ইলেকট্রিক গাড়ি নিয়ে ফর্মুলা এসএই সুইটজারল্যান্ডে অংশগ্রহণ করবে তারা। কমবাসশন গাড়ি থেকে সরে গিয়ে ইলেকট্রিক গাড়ি তৈরির দিকেই আপাতত নজর তাদের। কিলো ফ্লাইটও তাদের ইলেকট্রিক গাড়ি নিয়ে কাজ করে চলেছে। তাদের পরবর্তী লক্ষ্য চালকবিহীন গাড়ি তৈরি।
দুটো ক্লাবেরই ভবিষ্যৎ লক্ষ্য একই ধরনের। তাদের ফর্মুলা রেসিং গাড়ি তৈরির অভিজ্ঞতা থেকে অটোমোবাইল ইঞ্জিনিয়ারের একটি নিয়মিত পাইপলাইন গড়ে তোলা এবং বাংলাদেশেই বাণিজ্যিকভাবে গাড়ি নির্মাণ শুরু করা, যেগুলোতে জ্বলজ্বল করবে 'মেইড ইন বাংলাদেশ'।