ইতিহাস-ছোট বন, ফলের বাহার, উটের কুঁজের মতো ছোট পাহাড়
ঢাকা শহরের ব্যস্ত জীবনে হাঁপিয়ে উঠেছেন? অফিস কিংবা ক্লাসের পরে সেই একই রাস্তা, জ্যাম, চায়ের দোকান, বন্ধুদের আড্ডাজুড়ে সেই একই টপিকের বারংবার চর্বিত চর্বন আপনাকে ক্লান্ত, আরও ক্লান্ত করে তুলছে? মন ক্ষণে ক্ষণে একটা ব্রেক চাইছে, কিন্তু অফিসের ছুটি নাই অথবা বন্ধু বান্ধবদের নানাবিধ ব্যস্ততার কারণে একসাথে বাইরে কোনো ট্যুরে যাওয়া হছেনা! বিশেষ করে যারা শিক্ষার্থী, তাদের সময় আছে, বন্ধুবান্ধব আছে কিন্তু পকেটে টাকা নাই অথবা রাতে বাইরে থাকার অনুমতি নাই! এতো নাইয়ের মাঝে আমিও বলছি "নাই; কোনো চিন্তা নাই, কোনো চিন্তা নাই, ইচ্ছা থাকলে মিলবেই মিলবে উপায়"।
ব্যাগে হাল্কা এক প্রস্থ কাপড়, একটা গামছা, পানির বোতল আর পকেটে ৫০০/১০০০ টাকা নিয়ে হাল্কা কিছু মুখে দিয়ে ভালো করে দুইগ্লাস পানি খেয়ে একদিনের জন্য বেড়িয়ে পড়ুন। সকাল সকাল সোজা কুড়িল বিশ্বরোডে এসে নরসিংদীগামী বিআরটিসির এসি বাসে উঠে পড়ুন (কুড়িল বিশ্বরোড ছাড়াও ঢাকার বিভিন্ন স্থান যেমন- গুলিস্তান থেকে নরসিংদীর বাস ছাড়ে); গন্তব্য শেখেরচর; ভাড়া জন প্রতি ১২০ টাকা।
সকাল ৭টার বাসে উঠতে পারলে মোটামুটি সাড়ে ৮টার মধ্যে পৌঁছে যাবেন প্রাচ্যের ম্যানচেস্টার খ্যাত শেখেরচর বাবুরহাটে। বৃহস্পতি-শুক্র-শনি এই তিনদিন বসে এই হাট। তিনদিনের কোনো একদিন গেলেই দেখতে পাবেন হাটের আসল রূপ। কেবল আড়মোড়া ভাঙতে থাকা হাটকে আরেকটু জমে উঠার সুযোগ দিয়ে আমরা হাটের পাশের কোনো একটা ছাপড়া হোটেলে ঢুকে নাস্তা সেরে নিই। নাস্তা করতে গেলে একটা মজার জিনিস দেখতে পাবেন। এখানে এক ধরনের রুটি বানানো হয়, যার তাওয়াগুলো চুলার উপর বসানো নয়, দাঁড়িপাল্লার মতো করে চুলার উপরে ঝুলানো। আটার রুটি বেলে সেই ঝুলানো তাওয়ায় এপাশ ওপাশ হাল্কা সেঁকে তা খুন্তিতে করে সরাসরি চুলার আগুনে ধরছে, আর সেই আগুনে রুটি গোল হয়ে ফুলে উঠতেই ধোঁয়া উঠা অবস্থায় সেসব রুটি গরম গরম পরিবেশন করা হচ্ছে। যাদের বাজেট ট্রিপ তারা রুটি সবজি আর চা সহযোগে খুব সহজেই জনপ্রতি ৩০ টাকার মধ্যে নাস্তা সেরে নিতে পারবেন।
নাস্তা খেতে খেতে গুগলে হাল্কা নজর বুলিয়ে দেখে নিতে পারেন এই হাট গড়ে উঠার চমকপ্রদ ইতিহাস। বাংলার তাঁত বস্ত্র শিল্পের অন্যতম প্রাণকেন্দ্র নরসিংদী অঞ্চলটি বহুকাল থেকেই তাঁত বস্ত্রের জন্য প্রসিদ্ধ। সেই ম্যালা দিন আগে থেকেই তাঁতিরা সারা সপ্তাহে যে কাপড় তৈরি করত, সেগুলি হাটবারে হাটে এনে পাইকারদের কাছে বিক্রয় করত। খাজনা সংক্রান্ত বিরোধের কারণে নরসিংদীর জমিদার ললিতমোহন রায় ও পরবর্তীতে মাধবদীর জমিদারদের সাথে বনিবনা না হলে তাঁতিরা শেখেরচরের তালুকদার হলধর সাহা ওরফে কালিবাবুর শরণাপন্ন হন। বিচক্ষণ কালিবাবু হাটের সুদূরপ্রসারী ব্যবসায়িক দিকটা ভালোই বুঝেছিলেন, পাশাপাশি বুঝেছিলেন হাটের প্রাণ হচ্ছে এই হাটুরেরাই; তাই শুধু হাট করলেই হবে না, একে টিকিয়ে রাখতে তাদেরকে সাথেও রাখতে হবে। ফলে বাংলা ১৩৪৩ সনের ৮ জ্যৈষ্ঠ (১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দ) এই হাট প্রতিষ্ঠা করার পাশাপাশি তাঁতি ও পাইকারদের নিরাপত্তার জন্য স্থানে স্থানে লাঠিয়াল নিয়োগ, সুপেয় পানির নলকূপ স্থাপনসহ বিভিন্ন বাণিজ্যবান্ধব পদক্ষেপের মাধ্যমে তিনি এই হাটটিকে জনপ্রিয় ও দীর্ঘস্থায়ী করে তোলেন। প্রথমদিকে, জনসাধারণের মুখে মুখে ইমামগঞ্জের হাট (প্রখ্যাত গান্ধিবাদী নেতা সুন্দর আলী গান্ধির দেওয়া নামানুসারে), পাবলিকের বাজার, নয়াবাজার ইত্যাদি নামে পরিচিত হলেও, বাবুদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত বলে পরবর্তীতে এটি বাবুরহাট নামে পরিচিতি পায়।
নাস্তা খেয়ে আমরা হাটে ছোট্ট করে একটা চক্কর দিতে পারি। এতো সকালে বিভিন্ন জায়গা থেকে কাপড় আসাটা আমরা দেখতে পাবো। শাড়ি পাঞ্জাবি, লুঙ্গি, থ্রি পিস, ইত্যাদি হরেক কাপড়ের বাহার আর পারিপার্শ্বিক ব্যস্ততা দেখতে দেখতে বিস্মৃত হলে হবে না যে আমাদের হাতে অফুরন্ত সময় নেই। তাই যা দেখার দ্রুত দেখে নিতে হবে। আমি যখন প্রথম এই হাটে যাই, একটি বিষয়ে আমি খুব হোঁচট খেয়েছিলাম; তা হলো সস্তা ও কম টেকসই কাপড়গুলো (বিশেষ করে গায়ে হলুদ বা এ ধরনের প্রোগ্রামে যেসব ওয়ান টাইম শাড়ি-পাঞ্জাবি গণহারে কেনা হয়) এখানে লোকের মুখে মুখে রোহিঙ্গা কাপড় বলে পরিচিত। এটা শোনামাত্র আমি কল্পনায় ১৯৭১ সালে ফিরে গিয়েছিলাম, আহমদ ছফার 'অলাত চক্রে' পড়েছিলাম, সে সময়ে কলকাতায় সস্তা ও কম টেকসই জামা-জুতা-ছাতা ইত্যাদি 'জয় বাংলা' জামা-জুতা-ছাতা বলে লোকের মুখে মুখে প্রচলিত ছিল। আমরা নিজেরা একসময় যেভাবে অপমানিত হয়েছি, সেই একইভাবে আমরা আবার অন্য ভিক্টিমদের উপহাস করছি!
শেখের চর থেকে বাসে বা হাইওয়ে মিনি (বাস আর লেগুনার মাঝামাঝি এক ধরনের বাহন) বলে প্রচলিত যানে করে জনপ্রতি ১০ টাকা ভাড়া দিয়ে পাঁচদোনা আসা যায়। এখানেই কোরানের প্রথম সার্থক বঙ্গানুবাদকারি ভাই গিরিশ চন্দ্র সেনের বাড়ি। ভাই গিরিশ চন্দ্র সেনের বাড়ির মিউজিউয়াম বেলা ১১টার সময় খোলে, তাই সময়টা কাজে লাগাতে আমরা পাঁচদোনা থেকে জনপ্রতি ২০ টাকা করে শেয়ারে সিএনজি নিয়ে ডাঙ্গা চলে যাবো। সেখান থেকে ২০ মিনিটের হাঁটা পথ বা অটো রিকশায় ২০ টাকার মত ভাড়া দিলে পৌঁছে যাবো লক্ষণ সাহার জমিদার বাড়ি।
জমিদার লক্ষণ সাহা এই জমিদার বংশের মূল গোড়াপত্তনকারী। তবে কবে নাগাদ এই জমিদার বংশ এবং জমিদার বাড়িটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তার সঠিক তথ্য জানতে পারিনি। এই জমিদার বংশধররা অন্য জমিদারের আওতাভুক্ত ছোট জমিদার ছিলেন। লক্ষণ সাহার জমিদার বাড়ির ছোট্ট একটি কারুকার্যখচিত দালান, কষ্টি পাথর দিয়ে ঢালাই করা ভবনের মেঝে, বাগানবাড়ি, সান বাঁধানো পুকুর ঘাট প্রায় সবগুলোই মোটামুটি বেশ ভালো অবস্থাতেই আছে। শুধু একটি বাদে পুকুরের চারপাশের মঠ বা মন্দিরগুলোর ধ্বংস হয়ে গেছে।
লক্ষণ সাহার অধস্তন তৃতীয় পুরুষ বৌদ্ধ নারায়ণ সাহা পরবর্তীতে আহম্মদ আলী উকিলের কাছে বাড়িটি বিক্রি করে দেন। তাই আহম্মদ আলী সাহেব পেশায় একজন উকিল হওয়াতে বর্তমানে অনেকে এই বাড়িটিকে উকিল বাড়ি নামেও চেনে।
ডাঙ্গা থেকে আমরা আবার পাঁচদোনা চলে আসবো, পাঁচদোনা মোড় থেকে হেঁটে শেখেরচর বরাবর কয়েক মিনিট হাঁটলেই চোখে পড়বে শতবর্ষী স্যার কৃষ্ণ গোবিন্দ গুপ্ত উচ্চ বিদ্যালয়। বাংলার প্রথম আইসিএস অফিসার নরসিংদীর কৃতি সন্তান কে জি গুপ্তের নামে নামকরণ করা স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল ১৯১৯ সালে।
বলে রাখা ভালো, যেহেতু এটি কোনো গতানুগতিক ট্যুরিস্ট স্পট নয় তাই এই ট্যুরে মনমতো এবং মানসম্মত টয়লেটের অভাব বেশ ভালোই বোধ করতে হবে। জরুরি প্রয়োজন মেটাতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ক্লিনিক, হোটেল এরকম বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সহায়তা নিয়েই চলতে হবে।
যাহোক, কে জি গুপ্ত স্কুল পেরিয়ে আরেকটু সামনে গেলেই হাতের ডানপাশের একটা গলির ভিতরে ভূমি অফিসের পাশের প্রাচীন দোতলা দালানটাই হচ্ছে ভাই গিরিশ চন্দ্র সেনের তিনপুরুষের ভিটা। যেহেতু গিরিশ চন্দ্র সেনের ঠাকুর'দার আমলে এই বাড়ি নির্মাণ করা হয়েছিল, তাই সে হিসেবে গিরিশ চন্দ্র সেন এই বাড়ির তৃতীয় পুরুষ।
প্রায় দুইশ বছরের বেশি পুরনো গিরিশ চন্দ্রের পৈত্রিক বাড়ির খানিকটা অংশ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক শাহ সুফি মুস্তাফিজুর রহমানের (যিনি উয়ারী-বটেশ্বরের উৎখনন কাজের জন্য সর্ব মহলে বিশেষভাবে পরিচিত) তত্ত্বাবধানে সংরক্ষণ করে, তা পূর্বের আদলে পুনঃনির্মাণের মাধ্যমে 'ভাই গিরিশ চন্দ্র সেন জাদুঘর' প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে । জাদুঘরে তার অনুদিত কোরান ও অন্যান্য গ্রন্থের পাশাপাশি বাস্তুভিটায় আবিষ্কৃত প্রত্নবস্তু, সমসাময়িক তৈজসপত্র, পোশাক ও আসবাব ইত্যাদি প্রদর্শিত হচ্ছে। সোম থেকে শনি সাপ্তাহে ছয় দিন বেলা ১১টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত খোলা থাকা এই জাদুঘরটিতে দর্শনার্থীদের গাইড করার জন্য সার্বক্ষণিকভাবে নিয়োজিত থাকেন মোঃ কাউসারুল হক কানন (মোবাইল নাম্বার ০১৭২৮০৭৯২১৫)।
তিনি আপনাকে অভ্যর্থনা জানিয়ে ভিতরে নিয়ে গিয়ে ভাই গিরিশ চন্দ্র সেনের সম্মানে ব্রাহ্ম সঙ্গীত চালিয়ে দিবেন, দুইশ বছরের পুরনো বাড়িতে সেই সময়ের গান শুনতে শুনতে একটা ঘোরের মতো তৈরি হয়, সে ঘোরের মধ্যে কাউসার ভাই যখন আপনাকে বিভিন্ন ঘর ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে প্রাঞ্জলভাবে সেগুলোর ইতিহাস বর্ননা করবেন, তখন কিছুক্ষণের জন্য আপনার মনে হলেও হতে পারে যে, টাইম মেশিনে করে আপনি চলে গেছেন ১৯ শতকের কোনো এক অলস দুপুরে।
এবার আবারও পাঁচদোনা মোড়ে ফিরে এসে সেখান থেকে আমরা ঘোড়াশাল বাইপাসের শেয়ারের সিএনজিতে চেপে বসবো, গন্তব্য রাবান। ঘোড়াশাল বাইপাস রোড ধরে ৬ কিমি গেলে আমরা পাবো একটা সিএনজি ফিলিং স্টেশন; নাম নাজমুল সিএনজি। শেয়ারে সিএনজির ভাড়া নেবে জনপ্রতি ২০ টাকা। নাজমুল সিএনজির উল্টোপাশের গেইটম্যানবিহীন রেল ক্রসিংটা পেরিয়ে সোজা যে রাস্তাটা গিয়েছে, সেটা দিয়ে একটু সামনে গিয়ে ডানের রাস্তাটাই রাবানে যাবার পথ।
এখান থেকে স্থানীয় মিশুকে (পেছনে দুইজন আর সামনে চালকের পাশে একজন মোট তিনজন বসা যায়, তবে সাইজে ছোট হলেও কষ্ট করে সামনে দুইজন বসা যেতে পারে) করে রাবান যেতে ৪০-৫০ টাকা ভাড়া লাগে অথবা শেয়ারের অটোতে মাথাপিছু ১০ টাকা করে দিয়েও রাবান বাজারে যাওয়া যায়। তবে আমি পরামর্শ দেবো সম্ভব হলে একটু কষ্ট করে হেঁটে যেতে। কেননা এই ১-২ কিমি রাস্তাই আসলে রাবানের প্রকৃত সৌন্দর্য। রেললাইন পেরিয়ে সামনে গিয়ে ডানের রাস্তায় ঢুকতেই মনে হবে, সেই পথ যেন পল্লীকবির ভাষায় নিমন্ত্রণ জানাচ্ছে-
"তুমি যাবে ভাই- যাবে মোর সাথে, আমাদের ছোট গাঁয়,
গাছের ছায়ায় লতায় পাতায় উদাসী বনের বায়"
ঠিক যেন পল্লী কবির বর্ণনার মতো ঘন বাঁশঝাড়, গাছের ছায়ায় ছায়ায় আর গাছে গাছে ঝুলে থাকা আম, জাম, কাঁঠাল, বাতাবি লেবু, জাম, পেয়ারা, কলা, লটকন, বেল আরও অনেক নাম না জানা ফলের লোভনীয় হাতছানির মাঝে মাঝে ভুবন রাঙ্গানিয়া মাধবীলতা, জবা, জারুল, কৃষ্ণচূড়াসহ নানাবিধ রঙিন ফুলে মোহনীয় সাজ দেখতে দেখতে আমরা পৌঁছে যাবো বাংলা ১১৩৮ সালে প্রতিষ্ঠিত তিনশো বছরের পুরনো 'রাবান শ্রী শ্রী রাধাকৃষ্ণ মন্দির' এ।
যদি কোনো বাহনে এসে থাকেন, তবে তা এখানেই ছেড়ে দিয়ে একটু হেঁটে মন্দিরের ভেতরে ঢ়ুকে পড়ুন। আশ্চর্য্য রকম স্নিগ্ধ সেই মন্দিরের কলের কোমল-শীতল পানি হাত-মুখে ছিটিয়ে নিমিষেই সারাদিনের ক্লান্তি ধুয়ে নিয়ে হাত পা ছড়িয়ে সেখানে কিছুক্ষণ জিরিয়ে নিন। এবার পায়ে পায়ে রাবান বাজারের দিকে হাঁটতে হাঁটতে উপভোগ করুন রাবানের অপার নিসর্গ ও নৈশব্দ।
গাছের পাতার ঝিরিঝিরি আর মুহুর্মুহু ডেকে ওঠা পাখির কাকলি ছাড়া অন্যকোনো শব্দই পাবেন না বলতে গেলে। দুপাশে বড় বড় গাছ, মাঝে মাঝে আনারসের ক্ষেত, নানান রঙের ফুল, আদিগন্ত জলা, মাঝে মাঝে দু-একটা বাড়ি... এইতো রাবান! সেই বাড়িগুলোর মধ্যে কিছু হালের ইট সিমেন্টের বাড়ি থাকলেও ঐতিহ্যবাহী মাটির বাড়িই বেশি আর প্রতিটা বাড়ির সামনে ছোট ছোট ফলের বাগানজুড়ে বিবিধ দেশিয় ফলের সমাহারের সাথে বোনাস হিসেবে নানা বর্ণের ফুল।
রাবানের পথে হাঁটার সময় যেসব ফলের গাছ দেখবেন সেগুলো থেকে কোনো প্রকার ফল পাড়া কড়াকড়িভাবে নিষেধ এবং এ ধরনের কাজ কেউ করলে স্থানীয়রা তা শক্ত হাতে দমন করে থাকেন; সে অভিজ্ঞতা আপনার জন্য মোটেও সুখকর হবে না। তবে আপনার চলার পথে টুপ করে গাছ থেকে কোনো আম বা অন্যকোনো ফল যদি আপনার সামনে পড়েই যায়, তবে আপনি তা নিতে পারবেন।
বাজারের ঢোকার মুখেই পাবেন বিশাল কম্পাউন্ড সম্বলিত রাবান হাইস্কুল। গত পঞ্চাশ বছরেরও বেশি কাল ধরে এই বিদ্যালয় যে অনেক রুচিশীল, সমাজ সচেতন মানুষ উপহার দিয়েছে তা বাজারের অপর পাশে নির্মিত পাঠাগারটা দেখলেই বোঝা যায়।
এবার বাজারে চলে আসুন। ছোট্ট বাজার অল্প কিছু দোকান। বাজারে পথের ধারে ধারে স্থানীয়রা ফলের টুকরি নিয়ে পসরা সাজিয়ে বসে থাকে। ফলের গ্রামে ক্ষেত থেকে সরাসির আসা এইসব ফল দিয়ে দুপুরে ফলাহার করে নিন, ভাত তো রোজই খান। আনারস প্রতিপিস ২০/২৫ টাকায় পেয়ে যাবেন, তারাই কেটে দেবে (কোন প্রকার হাতের স্পর্ষ ছাড়াই); এছাড়া কলা, আম, কাঠাল, লটকন, পেয়ারা (মৌসুম ভেদে) পাবেন। বাজারের মুদির দোকানগুলোতে চিড়ামুড়ি, গুঁড়াদুধ সবই পাওয়া যায়। মুড়ি-কাঁঠাল, আম-চিড়া, সাথে চাইলে পাউরুটি-কলা ইত্যাদি দিয়ে আয়েশ করে দুপুরের খাবারটা সাবাড় করে চা খেতে খেতে স্থানীয়দের সাথে হাল্কা গল্পগুজব করতে পারেন। গ্রামের লোকেরা খুবই আন্তরিক।
জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক বলেছিলেন নতুন কোনো জায়গায় গেলে ঐখানের বাজার আর লাইব্রেরি দেখলে সহজেই বোঝা যায় ঐ অঞ্চলের লোক কী খায়, আর কী পড়ে। বাজার তো দেখা হলো এবার চলে আসুন বাজারের অপর পাশে রাবান স্কুলের প্রাক্তনদের উদ্যোগে নির্মিত 'স্বপ্নাশ্রয়ী' পাঠাগারে। সম্মিলিত উদ্যোগে গড়ে উঠা এই পাঠাগারের তাকে তাকে সাজানো ইতিহাস, দর্শন, সাহিত্য সহ আরো নানা ধারার বই দেখে আপনি এই গ্রামের মানুষদের রুচি ও সংস্কৃতি সম্পর্কে একটা ধারণা পেতে পারেন। বুকশেলফে এখনো অনেক খালি তাক আছে; আপনি চাইলে যাওয়ার সময় আপনার পক্ষ থেকেও উপহার হিসেবে ২/১টি বই দিয়ে যেতে পারেন (এই লাইব্রেরিতে বই উপহার দেবার যথাযথ পদ্ধতি অবশ্য আমার জানা নেই, তবে সার্বজনিন লাইব্রেরিগুলোতে সাধারণত এ ধরনের অপশন থাকে)। লাইব্রেরি কর্তৃপক্ষের অনুমতি সাপেক্ষে সেখানে বই দেখতে দেখতে হাল্কা জিরিয়েও নিতে পারেন।
বেলা চার/সাড়ে চারটার মধ্যে আবার যাত্রা শুরু করতে হবে। দলে ভারি হলে পুরো অটো বা মিশুক রিজার্ভ নিয়ে রাবান থেকে অটোতে করে সরাসরি ঘোড়াশাল চলে যাওয়া যায়। বিকল্প হিসেবে রেগুলার রুটের অটোতো আছেই, আমি রাবান থেকে সরাসরি ঘোড়াশাল মনু মিয়ার বাড়ি গিয়েছি শেয়ারে ৩০টাকা ভাড়া দিয়ে। মনুমিয়ার বাড়ি আসলে পাশাপাশি থাকা তিনটি স্বতন্ত্র জমিদার বাড়ি।
মনু মিয়া (পুরো নাম আহমুদুল কবির মনু মিয়া) ১৯৪৫-৪৬ সালে ডাকসুর ভিপি ছিলেন, পরবর্তীতে সংসদ সদস্য, দীর্ঘদিন দৈনিক সংবাদের সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করা এবং সার কারখানার জন্য ঘোড়াশালকে নির্ণয় করার নেপথ্যে তার বিশেষ ভূমিকা থাকার পাশাপাশি তার অমায়িক ব্যবহার ও ব্যাপক জনসম্পৃক্ততার কারণে এখানকার মানুষদের কাছে উনি এখনো অনেক সম্মানিত ও জনপ্রিয়। তাই স্থানীয়রা পাশাপাশি তিনটি পৃথক জমিদার বাড়িকে মনু মিয়ার জমিদার বাড়ি বলেই চিনে থাকেন।
মনু মিয়ার জমিদার বাড়ি যেহেতু প্রাইভেট প্রপার্টি, তাই এর ভেতরে ঢুকতে পারা না পারা পুরোটাই মালিক পক্ষের বিবেচনার উপর নির্ভরশীল, তবে ভেতরে ঢুকতে না পারলেও খুব ভালো করে দেখা যাবে বাউন্ডারীর বাইরে অবস্থিত শাহী মসজিদটা, আর তিনটি বাড়ির মধ্যে যে বাড়িটি বাইরের দিকে রয়েছে তার বাইরের অংশও দেখতে পাবেন। অনুমতি না পাওয়া গেলে এটুকুতেই সন্তুষ্ট থাকতে হবে। আর যদি অনুমতি পাওয়া যায় তবে ভেতরে গেলেই দেখতে পাওয়া যাবে প্রায় ১০ একর জমির উপর রুচি আর প্রাচুর্য্যের মিলন মেলা।
প্রায় ১০ একর জায়গা জুড়ে অবস্থিত মনু মিয়া জমিদার বাড়ির বাইরে থেকে বোঝার কোনো উপায় নেই যে ভেতরে কি অপরূপ সৌন্দর্য অপেক্ষা করে আছে। প্রতিটি বাড়িই অসাধারণ কারুকাজ আর সাদা রঙে রাঙায়িত। সেই সাথে সবুজ ঘাস এবং গাছ পালার বিস্তৃত এক অপরূপ সৌন্দর্যে রুপ দেয়। ভেতরে রয়েছে আলিসানভাবে শান বাঁধানো দুটি পুকুর আর বহু দুর্লভ ফুলের গাছ। খোলামেলা পরিবেশ আর গাছ-গাছালিই মনু মিয়ার জমিদার বাড়ির অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
বিকাল প্রায় মরে এসেছে এমন একটা সময় আমরা পৌঁছাবো ঘোড়াশাল বাজারে। এখানে কয়েকটা হোটেলে সারাদিনই ভাতের পাশাপাশি সকাল বিকাল পরোটাও পাওয়া যায়। পকেটের স্বাস্থ্যের সাথে সমন্বয় করে ভাত বা পরোটা দিয়ে বেশ ভালো করে পেট ভরে খেয়ে নিতে হবে, কেননা ঢাকায় ফিরতে ফিরেতে রাত ১০টা বেজে যাবে। খাওয়া দাওয়ার পরে ঘোড়াশাল আর পলাশে রয়েছে তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র, সার কারখানাসহ বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠান। চাইলে চট করে একবার সেগুলোতে নজর বুলিয়ে আসা যেতে পারে অথবা সোজা চলে আসুন ঘোড়াশাল ফ্ল্যাগ রেল স্টেশনে (রেল স্টেশন কিন্তু দুইটা, ভুল করে অন্যটায় চলে গেলে পস্তাবেন, কেননা ঐটাতে ট্রেন থামে না)। ফ্ল্যাগ স্টেশনের কাছাকাছি আসতেই শাল কাধে একজন ঘোড়সোয়ারির ভাস্কর্য চোখে পড়বে।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, প্রায় সাড়ে তিনশো বছর আগে ঈশা খাঁর বংশধর জমিদার শরিফ খানের সাথে দিল্লির সম্রাটে আওরঙ্গজেবের ভুল বোঝাবুঝিজনিত দূরত্ব সৃষ্টি হলে শরিফ খান তার পক্ষ থেকে শেখ গোলাম মোহাম্মদেকে দিল্লীর দরবারে প্রেরণ করেন। এবং তার কার্যতৎপরতা ও বিচক্ষণতায় ভুল বোঝাবুঝির অবসান হলে সম্রাট আওরঙ্গজেব ও জমিদার শরিফ খান উভয়েই অত্যন্ত সন্তুষ্ট হন। তখন এ কাজের পুরস্কার হিসেবে সম্রাট আওরঙ্গজেব ঘোড়া ও মূল্যবান শাল উপহার দেন শেখ গোলাম মোহাম্মদকে। জমিদার শরিফ খানও স্বীয়পালিত কন্যা চাঁদ বিবিকে শেখ গোলাম মোহাম্মদের দ্বিতীয় পুত্র শেখ গোলাম নবীর সঙ্গে বিয়ে দেন এবং উপহারস্বরূপ চরপাড়া, টেকপাড়া, টেঙ্গরপাড়া, বিনাটি, করতেতৈল, রাজাব ও চামড়াব নামে ক্ষুদ্র পল্লীগুলোর জমিদারি প্রদান করেন। সম্রাটের দেওয়া ঘোড়া ও শাল দেখতে তখন দূরদুরান্ত থেকে লোকজন আসতে শুরু করলে সেই ঘোড়া-শাল থেকে এ অঞ্চলের নাম হয়ে যায় ঘোড়াশাল।
এই ভাস্কর্যের ঠিক অপর পাশের সিঁড়িটা দিয়ে আমরা উঠে যাবো ঘোড়াশাল ফ্ল্যাগ স্টেশনে। প্রায় একশ বছরের পুরোনো এই স্টেশন এখন অনেক জীর্ণ অবস্থায় থাকলেও যথেষ্ট দৃষ্টি নন্দন। স্টেশন, স্টেশনের পাশ দিয়ে বয়ে শীতলক্ষ্যা নদী, রেল ব্রিজ এগুলো দেখতে দেখতে বিকেলটা ভালোই কেটে যাবার কথা।
সন্ধ্যায় সেই ভাস্কর্যের পাশে দোকানগুলোতে গরুর খাঁটি দুধের চা খওয়ার ফাঁকে ফাঁকে স্থানীয় মানুষদের সাথে হাল্কা গল্পগুজব করে স্টেশনে উঠে যাওয়া ভালো। কেননা এরই মাঝে সময় হয়ে যাবে চট্টগ্রাম থেকে ছেড়ে কর্ণফুলী কমিউটার ট্রেন আসার। এই ট্রেন ৬/৬ঃ৩০ এর মধ্যে আসার কথা থাকলেও তা নিয়মিত দেরি করে। ট্রেনের অবস্থান জানতে 'TR<space>3' লিখে '16318' এই নম্বরে পাঠিয়ে দিলে ফিরতি মেসেজে ট্রেনের বর্তমান অবস্থান জানিয়ে দেয় (চার্জ ৫টাকা)। এই ট্রেন আপনাকে মোটামুটি ৯টা থেকে সাড়ে ৯টার মধ্যে এয়ারপোর্ট, তেজগাঁও হয়ে কমলাপুর পৌঁছে দেবে, ভাড়া নেবে ২০-২৫ টাকা। এছাড়াও ঘোড়াশাল থেকে মহাখালী পর্যন্ত একাধিক বাস আছে, ভাড়া ১০০ টাকার মতো নেয়।
এর মাধ্যমেই শেষ হবে আমাদের আজকের ঝটিকা সফর, তবে আজকের সফর যদি আমাদের ভালো লাগে তবে আরেকদিন আমরা নরসিংদীর আরো গভীরে যাবো, গভীরে যাবো ইতিহাসের, প্রকৃতিরও। গিয়ে দেখে আসবো উয়ারী-বটেশ্বরের প্রায় ২৫০০ বছরের প্রাচীন পরাক্রমশালী 'গঙ্গা রিডই' এর দুর্গ নগরী, শিবপুরে সোনামুখীর টেক, শহিদ আসাদের কবর ও স্মৃতি সৌধ, প্রাচীন বৌদ্ধ মন্দির, আশরাফপুরের শাহি মসজিদ, মরজাল (রায়পুরা)-এর নৈসর্গিক বুনো সৌন্দর্য আর লটকন-পেয়ারা-কলার বাগান, বীর শ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানের পৈত্রিক নিবাস ইত্যাদি ইত্যাদি।