বাঁশের তৈরি মাদুর, বরফ, সালাদ… যেভাবে গরম মোকাবিলা করছেন বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ!
গ্রিস এবং সুইজারল্যান্ডে ফায়ারফাইটিং বিমান এবং সেগুলো পরিচালনাকারীরা অতিরিক্ত সময় কাজ করছে; অন্যদিকে, তিউনিশিয়ানরা তাদের পরিবারের সদস্যদের দেশের সবচেয়ে উত্তরাঞ্চলের সমুদ্রসৈকতের কাছাকাছি জায়গায় পাঠিয়ে দিচ্ছে। চীনে এসির ব্যাপক চাহিদা বৃদ্ধির মধ্যেই কর্মকর্তারা পাওয়ার ব্ল্যাকআউট নিয়ে সতর্ক করেছেন এবং কেউ কেউ দেশের সাধারণ মানুষকে বাঁশের তৈরি মাদুরে ঘুমাতে এবং পানিতে ভিজিয়ে রাখা ঠাণ্ডা তরমুজ খেতে বলেছেন।
উপরের সবগুলো কাজের পেছনে কারণ একটাই- প্রচণ্ড গরম মোকাবিলা।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বৈষ্ণিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি এবং এবছরই বিশ্বের ইতিহাসে সবচেয়ে উষ্ণতম দিনের রেকর্ড হয়েছে। ক্যালিফোর্নিয়ার ডেথ ভ্যালি থেকে শুরু করে চীনের জিনজিয়াং, ফিনিক্স থেকে শুরু করে রোম- বিশ্বের সব অঞ্চলই তীব্র তাপপ্রবাহের মুখোমুখি হচ্ছে।
প্রচণ্ড গরমের কারণে ইউরোপের প্রধান প্রধান পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে ভ্রমণ করা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। রোমান কলোসিয়াম বা অ্যাক্রোপলিসে যাবেন? সেটা নাহয় দিনের যে সময়টা একটু ঠান্ডা, তখনকার জন্য পরিকল্পনা করে রাখুন; অন্তত স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা এমনটাই পরামর্শ দিয়েছেন। তাছাড়া, প্রচুর পানি পান করা, সানস্ক্রিন বা সানব্লক এবং হ্যাট ব্যবহারের পরামর্শ তো রয়েছেই। ইতালির আবহাওয়া দপ্তর তাদের দেশের সর্বশেষ তাপপ্রবাহের নাম দিয়েছে গ্রিক মিথোলজির একটি চরিত্র 'শ্যারন' এর নামানুসারে।
জলবায়ু পরিবর্তন এবং মানুষের কার্যকলাপের ফলে তাপপ্রবাহ আরও ঘন ঘন দেখা যেতে পারে বলে ইতোমধ্যেই সতর্ক করেছে। তাই বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের অধিবাসীরা গরম মোকাবিলা করতে নিজেদের মতো নানা পদক্ষেপ নিয়েছেন। (তাদের বক্তব্য ঈষৎ সম্পাদনা করা হয়েছে এই নিবন্ধে)
রোম
জুলাই মাসে রোমে সর্বোচ্চ গড় তাপমাত্রা ছিল ৩১ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
"আমি ফ্লোরিডা থেকে এসেছি, কিন্তু আমার মনে হচ্ছে সহ্যের শেষ সীমায় পৌঁছে গেছি। আমার লিভিংরুমে এসি ইউনিট আছে কিন্তু সেটা দিয়ে আমার পুরো ঘর ঠান্ডা হয় না। আমি রাতেরবেলা ওই এসির কাছে একটা কাউচে শোয়ার চেষ্টা করি। কিন্তু বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় মাথা খারাপ করার মতো বিদ্যুৎ বিল আসে! তাই আমি সারাক্ষণ এসি চালিয়েও রাখতে পারি না। তাই একটু পর পর এসি বন্ধ করে রাখি এবং ঘণ্টা দুয়েক পর দেখা যায়, সারা শরীর ঘেমে গিয়েছে।
ফ্লোরিডায় বেড়ে ওঠায় গ্রীষ্মকালে বাইরে পা রাখলেই যেন রোদের একটা ধাক্কা লাগতো! কিন্তু ইউরোপে এসে আগে কখনো এখনকার মতো গরম অনুভূত হয়নি। উপকূল থেকে রোম মাত্র ২০ মাইল দূরে। সাধারণত গ্রীষ্মাকালে এখানে হালকা হাওয়া বইতে থাকে এবং কয়েকদিন পরপরই বৃষ্টি হয়, ফলে গরম ততটা লাগে না। কিন্তু এবার তা হচ্ছে না। গরমের জন্য আমি ঠিকমতো খাবারও খেতে পারছি না, খাওয়ার রুচিই থাকছে না আমার। এমনকি আমার কুকুরটাও গরমে কাহিল, সেও হাঁটাচলায় আগের মতো দুরন্ত নেই", বললেন ২০ বছর ধরে রোমের বাসিন্দা এরিক জে. লাইমান।
মাদ্রিদ
মাদ্রিদে জুলাই মাসে সর্বোচ্চ গড় তাপমাত্রা ছিল ৩২ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং এ মাসে এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৩৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস। মাদ্রিদের বাসিন্দা, কাস্টমার কোয়ালিটি ম্যানেজার লরা মোরেনো বলেন, "মাদ্রিদের অনেক মানুষেরই পার্বত্য অঞ্চলে দ্বিতীয় আরেকটি বাড়ি আছে, যেখানে তাপমাত্রা অনেক কম থাকে। কিন্তু শহরের মধ্যে গরমটা অনেক বেশি। ট্রাফিক, গাড়ি, ভবন এবং এসি… সবকিছু থেকেই শহরে বাড়তি তাপমাত্রা সৃষ্টি হয়।
এই গরমে নিজেকে ঠান্ডা রাখতে আমি সালাদ খাই। আমি সৌভাগ্যবান যে আমার বাড়িতে একটা সুইমিং পুল আছে, তাই কাজ শেষেই সোজা সুইমিং পুলে নেমে দুই ঘণ্টা গোসল করি।"
তিউনিস, তিউনিশিয়া
জুলাই মাসে তিউনিসে সর্বোচ্চ গড় তাপমাত্রা ছিল ৩২ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৪৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
"তিউনিশিয়ায় এর আগে কখনো এমন ঘটনা ঘটেনি। কর্তৃপক্ষ আমাদের বলেছে সতর্ক থাকতে, যতটা সময় সম্ভব ঘরেই থাকতে এবং বাড়ির বৃদ্ধ ও অসুস্থদের প্রতি খেয়াল রাখতে। সেইসঙ্গে বিদ্যুৎ সরবরাহের কথা মাথায় রেখে প্রয়োজন বুঝে এসি ব্যবহার করতে। আমাদের দেশে এখন দাবানল দেখা গেছে।
এ মাসের কিছুদিন ধরেই স্বাভাবিক গড় তাপমাত্রার চেয়ে আরও ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে গিয়েছে। দক্ষিণের কিছু কিছু অঞ্চল, যেমন- জারবাতে স্থানীয়রা সূর্যের আলো থেকে নিজেদের সুরক্ষার জন্য প্রথাগত উপায় প্রয়োগ করছে। উদাহরণস্বরূপ, তারা ঐতিহ্যবাহী হ্যাট পরছে, যেটা খড় ও অন্যান্য প্রাকৃতিক উপাদানে তৈরি। আমি নিজে একজন সাংবাদিক এবং রোদ-ঝড়-বৃষ্টি সবকিছু মাথায় নিয়েই কাজ করতে হয় আমাকে। আমার পরিবার উপকূলীয় অঞ্চল বিজার্তেতে আমার জন্য অপেক্ষা করছে", বলেন নাইমা আবদাল্লাহ জুইনি।
শান্তো, দক্ষিণপূর্ব চীন
এ অঞ্চলে জুলাইয়ের সর্বোচ্চ গড় তাপমাত্রা ছিল ৩১ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
টেকনোলজি কোম্পানির কর্মী ঝেং জেরং বলেন, "বাঁশের তৈরি ম্যাট গরমের জন্য ভালো। আমরা বিছানায় বা সোফায় এগুলো বিছিয়ে থাকি। কেউ কেউ তাদের গাড়ির সিটের ওপরেও রাখে এই ম্যাট। গ্রামের দিকে দেখা যায়, লোকজন তাদের বিছানা বাইরে এনে রেখে, তার উপর বাঁশের ম্যাট বিছিয়ে ঘুমাচ্ছে। রাতেরবেলা এভাবে ঘুমাতে খুবই আরাম।"
আমাদের প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের মেঝেতে ঘুমানোর অভিজ্ঞতা আছে; তা সেই মেঝে ইটের হোক বা সিরামিক টাইলসের হোক। কেউ কেউ মেঝেতে পানি দিয়ে রাখে আরও ঠান্ডা হওয়ার জন্য। তার উপর একটা পাতলা ম্যাট বিছায়, তাতে আরও আরাম লাগে। গ্রামের লোকেরা কুয়ার পানিতে তরমুজ ফেলে রাখে এবং কয়েক ঘন্টা পর উঠিয়ে খায়, এতে তরমুজ অনেক ঠান্ডা হয়। কিন্তু আজকাল এরকম দৃশ্য দেখাই যায় না। প্রায় সবাই বাড়িতেই এসি থাকে। এটাই কি গরম মোকাবিলার জন্য সেরা উপায়? কখনো কখনো এখানে টাইফুন হয়, ভারী বৃষ্টির পর গরমটা সাথেসাথে কমে যায়।"
ফিনিক্স
অ্যারিজোনার ফিনিক্স শহরে জুলাই মাসে সর্বোচ্চ গড় তাপমাত্রা ছিল ৩৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং এ মাসে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৪৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
ফিনিক্সের বাসিন্দা শেরিল মেনজার বলেন, "প্রায়ই আমি ঠান্ডা পানি নিয়ে মাথায় ঢালি গরম কমাতে। আমি প্রচুর পানি পান করি। ইলেক্ট্রোলাইটের চাহিদা পূরণ করতে আমাকে প্যাকেট দেওয়া হয়। আর গরম সহ্য করতে না পারলে আমি আবার সেন্ট্রাল অ্যারিজোনা শেল্টার সার্ভিস-এ ফিরে যাই। অনেক মানুষকে দেখেছি গরমের তীব্রতায় জগ দিয়ে গায়ে পানি ঢালছে, সুইমিং পুলে বাচ্চাদের নামিয়ে দিয়েছে গোসল করতে। আমি ভেজা তোয়ালে ঘাড়ে পেঁচিয়ে রাখি।"
দাইর আল-বালাহ, গাজা উপত্যকা
জুলাইয়ে এখানে সর্বোচ্চ গড় তাপমাত্রা ছিল ৩২ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
দাইর আল-বালাহ'র বাসিন্দা, লেখক ও সম্পাদক আকরাম এলোহ বলেন, "তাপপ্রবাহ এবং এখানে প্রায়ই বিদ্যুৎ না থাকায় আমার মতো অনেক পরিবারের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। আমি আমার স্ত্রী দুটি ছোট ছোট সন্তান নিয়ে থাকি। গরমের সময় বিদ্যুৎ না থাকলে আমার বাচ্চাদের কষ্ট হয়। আমার তিন বছরের ছেলের সম্প্রতি হিটস্ট্রোকও হয়েছে। আর রাতে বাচ্চারা মাঝেমধ্যে ঘুমাতে চায় না। তারা মেঝেতে শুয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করে। আমরা এমনিতে বাতাস করে তাদেরকে শীতল রাখার চেষ্টা করি। আবার গরমের কারণে মেজাজ তিক্ত হয়ে থাকা, রাগান্বিত হওয়ার মতো মনস্তাত্ত্বিক সমস্যাগুলো তো আছেই।"
বাসেল, সুইজারল্যান্ড
জুলাই মাসে বাসেলে সর্বোচ্চ গড় তাপমাত্রা ছিল ২৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
ফাইন্যান্সিয়াল কন্ট্রোলার হিসেবে কর্মরত পেট্রা নাইজেল বলেন, "রাইন নদীতে নৌকার তলা আর নদীগর্ভের মাঝে খুব বেশি ফারাক নেই। তাই আমাদের এখানে ২৭-২৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা মানেই অনেক গরম এবং এমন একটা তাপমাত্রা যার সঙ্গে আমরা পরিচিত নই। আমাদের বাড়িতে এসি নেই। তাই একমাত্র উপায় হচ্ছে পর্দা নামিয়ে ঘর অন্ধকার করে দেওয়া। আর সকালে বা রাতে সব দরজা-জানালা খুলে দিতে হবে। আমি যেখানে কাজ করি, সেটা হচ্ছে ১৯০০ সালের দিকের একটা ভিলা; এমনকি আমাদের এ অঞ্চলের আধুনিক অনেক ভবনেও এসি নেই, কারণ সবাই শক্তি সঞ্চয়ের চেষ্টা করছে।"
মারাকেশ, মরক্কো
মারাকেশে জুলাই মাসে সর্বোচ্চ গড় তাপমাত্রা ছিল ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৪৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
রাবাতের একজন শিক্ষার্থী সামিয়া জুবাইর বলেন, "কোনো কোনো দিন এমন গরম পড়ে যে আপনি বাইরেও বের হতে পারবেন না না। রাবাতে মারাকেশের চেয়ে কিছুটা ঠান্ডা আছে। আমি গত সপ্তাহে মারাকেশ গিয়েছিলাম এবং সেখানে এত গরম ছিল যে রাত না হওয়া পর্যন্ত আমরা ঘরেই ছিলাম। আমরা প্রচুর পানি পান করে, ঢিলেঢাকা কাপড় পরে এবং ছায়ায় থাকার মাধ্যমে গরম মোকাবিলার চেষ্টা করছি।"
এথেন্স, গ্রিস
এথেন্সে জুলাই মাসে সর্বোচ্চ গড় তাপমাত্রা ছিল ৩২ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
"আমরা বাইরে বের হওয়া কমিয়ে দিয়েছি এবং সত্যি বলতে কিছুটা লকডাউনের মতো পরিস্থিতি মনে হচ্ছে। আমার তিন সন্তান রয়েছে, গরমের কারণে তারা বাইরে যেতে পারে না, শুধু এসি আছে যে জায়গায় সেখানে থাকে। এজন্য তারা খুব বিরক্ত হয়ে গেছে। আমিও বাচ্চা নিয়ে ঘুরাফেরা কমিয়ে দিয়েছি। কারণ আমি চাই না তারা অসুস্থ হয়ে যাক। তবে সৌভাগ্যবশত, গ্রিসে ভবনগুলো এমনভাবে নির্মিত যেন গরম কম লাগে। আমাদের সিলিংগুলো উঁচু এবং মেঝে মার্বেল পাথরের। গ্রিসে মার্বেল পাথরের দাম কম এবং এটা ঘর ঠান্ডা রাখে।
আমি যেখানে থাকি, এখান থেকে ৪০ মিনিট দূরেই বড় দাবানল হচ্ছে। বাড়ির উপর দিয়ে উড়ে যাওয়া প্লেনের শব্দ পাই সারাদিন। গ্রিসের আবহাওয়া বদলে যাচ্ছে। বসন্ত এবং শরৎকাল এখন আর নেই বললেই চলে। এখন আর আলাদা চারটি ঋতু নেই। এখন আছে শুধু দীর্ঘ গ্রীষ্ম আর শীত। হয় গরম নাহয় ঠান্ডা। আমরা প্রায়ই ঘরে আলোচনা করি যে, এথেন্স যদি আর বাসযোগ্য শহর না থাকে, তখন আমরা কি করবো?" বলেন ৪১ বছর বয়সী ফ্রিল্যান্স মার্কেটিং প্রফেশনাল ওমায়রা গিল।
( এ নিবন্ধের জন্য তাপমাত্রার তথ্যগুলো ব্রিটেনের আবহাওয়া থেকে নেওয়া হয়েছে)