৯০ দিন পর সাগর থেকে উদ্ধার: স্যুট-টাই পরা কর্পোরেট জীবন বদলাতে চেয়েছিলেন এই অস্ট্রেলিয়ান!
টিম শ্যাডক ছিলেন স্বনামধন্য একটি প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের কর্মী; পরিপাটি স্যুট-বুট ও টাই পরা, কর্পোরেট চাকুরিজীবি। তারপর একদিন হঠাৎ উপলব্ধি করলেন, এই জীবন তিনি চাননি; তাকে জীবনে পরিবর্তন আনতে হবে। তাই একদিন নিজের কম্পিউটার সঙ্গে নিয়েই বেরিয়ে পড়লেন- গভীর বন-পাহাড়ে এবং এশিয়ার প্রত্যন্ত অঞ্চলে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন। এরপরে তিনি গেলেন সমুদ্রের কাছে- কিন্তু সেই সমুদ্রই তার জীবনের ইতি টেনে দিচ্ছিল প্রায়! ২০২০ সালে এই অস্ট্রেলিয়ান নাগরিক মেক্সিকোতে পৌঁছান এবং মেক্সিকোর লা পাজ থেকে ফ্রেঞ্চ পলিনেশিয়ায় সমুদ্রপথে ভ্রমণের সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু এই স্থলবন্দর থেকে ১২০০ মাইল দূরে, সম্পূর্ণ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় সমুদ্রে ঝড়ের কবলে পড়েন টিম শ্যাডক। ঝড়ে তার নৌকার পাল ছিঁড়ে যায়, ইঞ্জিন বিকল হয়ে যায় এবং প্রশান্ত মহাসাগরে আরও গভীর সমুদ্রের দিকে ভাসিয়ে নিয়ে যায় তাকে। গত ১২ জুলাই সমুদ্রে টুনা মাছ ধরার একটি নৌকা শ্যাডককে খুঁজে পায় এবং তাকে ও তার তার কুকুর বেলাকে উদ্ধার করে।
মেক্সিকোর কলিমায় বসে বিগত দিনগুলোর স্মৃতিচারণ করেন শ্যাডক: গত ৯০ দিন তার টিকে থাকার সংগ্রাম ছিল অনেকটা রবার্ট জেমেকিস পরিচালিত, ২০০০ সালে মুক্তি পাওয়া বিখ্যাত চলচ্চিত্র 'কাস্ট অ্যাওয়ে'র মতো; যেখানে প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন কিংবদন্তি অভিনেতা টম হ্যাংকস। ৯০ দিন খোলা আকাশের নিচে, সমুদ্রে কাঁচা মাছ খেয়ে শ্যাডকের বেঁচে থাকাকে 'অস্ট্রেলিয়ান কাস্ট অ্যাওয়ে' বলে অভিহিত করেছেন অনেকে।
প্রশান্ত মহাসাগরের ঢেউয়ের শব্দে নীরবতা ভঙ্গ হয় মেক্সিকোর মানজানিলো সমুদ্রসৈকতে। গত মঙ্গলবার থেকে এখানেই রয়েছেন টিম শ্যাডক। এখানে একটি হোটেলে রাখা হয়েছে তাকে; তার স্বাস্থ্যের উন্নতির এবং নিজ দেশে ফেরানোর জন্য চেষ্টা করা হচ্ছে। কিন্তু নিজের জীবনের সবচেয়ে রোমাঞ্চকর তিনটি মাসের কথা ভুলতে পারছেন না শ্যাডক। নীল চোখের এক নাবিক, মাথায় ক্যাপ এবং মুখভর্তি ঘন দাড়ি, সঙ্গে নিজের কুকুর বেলাকে নিয়ে ভাসছেন সমুদ্রে। ঘুম থেকে উঠে শ্যাডক বললেন, "আমি ভালো আছি। এখানে আমার দেখাশোনা করা হচ্ছে, যারা আমার জীবন বাচিয়েছে, তাদের প্রতি আমি খুবই কৃতজ্ঞ। সমুদ্রে থাকার সময়ের চেয়ে এখন আমি অনেক ভালো আছি।"
'রিমোট ওয়ার্ক' বা অফিসে না গিয়েই অন্য কোনো জায়গা থেকে কাজ করার সুবিধা থাকার কারণেই শ্যাডক অস্ট্রেলিয়া ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্র থেকে কাজ করতে চেয়েছিলেন। এরপরে বিশ্বজুড়ে কোভিড-১৯ সংকট শুরু হয় এবং অস্ট্রেলিয়া এক বছরেরও বেশি সময় তাদের সীমান্ত বন্ধ রাখে। এর ফলে বিদেশে থাকা হাজার হাজার অস্ট্রেলিয়ান নাগরিক (শ্যাডক বলেন, তিনি সেই ২০ হাজারেরই একজন) আটকা পড়ে। শ্যাডক জানান, ভিসা বিধিনিষেধের কারণে তার দেশে ফেরা নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়েছিল, তাই তিনি মেক্সিকোর কুয়েরেতারোতে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। সেখানে থেকেও তিনি কিছুদিন অফিসের কাজ করেন। প্রায় তিন বছর আগে সান মিগুয়েল দে আলেন্দের কাছে পাহাড়ে গিয়ে তিনি বেলা নামের কুকুরটিকে খুঁজে পান। "সে আমাকে সব জায়গায় অনুসরণ করেছিল। আমি ভেবেছিলাম, আমি হয়তো কুকুর পালতে পারব না। কিন্তু বেলা আমার পিছু ছাড়েনি।"
এদিকে মেক্সিকান সীমান্তে কয়েক মাস আটকে থাকার পর নিজের কৌশল পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নেন শ্যাডক। তাই তিনি বেলাকে নিয়ে মেক্সিকোর জালিস্কো রাজ্যের পুয়ের্তো ভালার্তাতে চলে যান। সেখানে তিনি 'আলোহা তোয়া' নামের ছোট নৌকাটি কেনেন এবং পরবর্তীতে এটাই হয়ে ওঠে তার ঘরবাড়ি। "নৌকায় ওঠার পর থেকে কম্পিউটারে কাজ করা খুব কঠিন হয়ে পড়েছুইল", বলেন তিনি।
শ্যাডক তার সমুদ্রে অভিযানের পরিকল্পনা করেছিলেন আরও বছর দুয়েক আগে। "যখন আমি প্রথম এই নৌকাটা কিনি তখন গ্রীষ্মকাল চলে আসছিল এবং সেটা হারিকেন সংঘটনের মৌসুম। তাই আমাকে পুয়ের্তো ভালার্তাতে অবস্থান করতে হয়েছিল এবং সী অব কর্টেজ পেরিয়ে লা পাজে যাওয়ার জন্যও অপেক্ষা করতে হয়েছিল। বছরখানের মতো শ্যাডক শুধু নৌকায় জীবনযাপনের কৌশল শেখার পেছনে ব্যয় করেছেন। "শুধুমাত্র বন্দরে প্রবেশ ও বের হওয়ার সময় জ্বালানি ব্যবহার করব, বাকি সময় নৌকা এমনি চালিয়ে যাওয়ার বিষয়টা নিশ্চিত করতে হয়েছে আমাকে", বলেন শ্যাডক।
ফোন, জিপিএস এবং এক দুঃসাহসিক অভিযান
মানজানিলো সমুদ্রসৈকতের বাতাসের মধ্যেই কেমন যেন তাজা মাছের একটা অন্যরকম গন্ধ রয়েছে। উপকূলে আসার পর প্রথম এই জায়গাটিই দেখেছিলেন এই অস্ট্রেলিয়ান। সূর্যের প্রখর রোদের আভাস মিলতে লোকজন ছায়ায় এসে বসে। ৫৩ বছর বয়সী রেনে তাপিয়া পরেছেন একটা লম্বা হাতার পোলো শার্ট এবং হ্যাট; তিনি এখানে ঝাড়ু দেওয়ার কাজ করেন। তিনিও জানান, এখানে আগত অস্ট্রেলিয়ান ব্যক্তিটির কথা তিনি শুনেছেন। "ঈশ্বরকে ধন্যবাদ যে তাকে উদ্ধার করা গেছে। কি অদ্ভুত, লোকালয়ের মধ্যে থেকেও যদি আমাদের তিন মাসের খাবার যোগাড় করতে এত কষ্ট হয়, তাহলে সেখানে কি অবস্থা ছিল ভাবুন...।"
ফিরে আসা যাক টিম শ্যাডকের অভিযানে। এবছর শ্যাডক সিদ্ধান্ত নেন কিভাবে তিনি সমুদ্রযাত্রা শুরু করবেন। তিনি নৌকা পরীক্ষা করেন এবং পরীক্ষামূলকভাবে সমুদ্রে নামেন এবং লা পাজে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। "এটাই সেই বছর, আমি ভেবেছিলাম যে আমি সী অব কর্টেজ জয় করেছি। কিন্তু প্রশান্ত মহাসাগরে কি তা সম্ভব? পরীক্ষামূলক অভিযানে তিনি বুঝতে পারেন যে, তিনি সঙ্গে করে খুব বেশি জ্বালানি বা পানি নিয়ে যেতে পারবেন না। তাই তিনি তার নৌকায় সোলার প্যানেল বসান যাতে যন্ত্রপাতি ভালোভাবে চলে এবিং পানি বিশুদ্ধকরণের জন্যও একটি ব্যবস্থা রাখেন। এছাড়াও, কিছু খাবার রিজার্ভ করে নেন এবং পাল তুলে যাতে সহজে যাওয়া যায় সেজন্য নৌকা যতটা সম্ভব হালকা রাখার চেষ্টা করেন।
শ্যাডক নিজের সঙ্গে একাধিক জিপিএস ডিভাইস, সেলফোন এবং ডাউনলোড করা ম্যাপ নিয়েছিলেন, যেগুলো কানেকশন ছাড়াই দেখা যাবে। কিন্তু এতসব ব্যবস্থা নেওয়ার পরেও একমাত্র মারিয়া ডেলিয়া নামের জাহাজই তাকে উদ্ধার করতে পেরেছিল।
শার্ক সুশি
রওনা দেওয়ার আগে কিছু খাদ্যসম্ভার তো অবশ্যই নিয়েছিলেন শ্যাডক। টুনা মাছের ক্যান, চাল এবং আরও কিছু খাবার যেগুলো ফ্রিজে রাখার দরকার পড়বে না। আর নৌকায় থাকার সময় তিনি মাছ ধরে খাওয়ার চেষ্টা করেছেন, যখন মাছ পাওয়া যায়নি তখনই শুধু ক্যানের খাবারের দিকে নজর দিয়েছেন। "আমার কুকুর এবং আমি একসাথে খেতাম, একসাথে পান করতাম। সে সবসময় আমার সাথেই খেত। আমি একটু খেয়ে তারপর ওকে দিতাম। আমি যদি মাছ পেতাম কখনো, সেটা কেটে ভাগ করে দুজনে খেতাম", বলেন শ্যাডক।
সমুদ্রে থাকার সময় শ্যাডক বিভিন্ন উপায়ে মাছ ধরেছেন। তিনি নৌকার নোঙর ফেলতেন পানিতে এবং লম্বা শ্বাস নিয়ে ঐ রশি বেয়ে পানির নিচে ডুব দিতেন একটা মাছ ধরার স্পেয়ারগান হাতে নিয়ে। যখনি মাছ পাশ দিয়ে যেত, স্পেয়ারগান চালাতেন তিনি। আবার কখনো কখনো হাস চলে আসতো নৌকায়, তখন শ্যাডক হাসটাকে ধরে জবাই করে ফেলতেন। এমনকি এর চেয়ে বড় শিকারও করেছেন তিনি। পানিতে একটা লাইন ফেলে তিনি হাঙ্গরও শিকার করেছেন। প্রাণীটিকে নৌকার কাছাকাছি এনে ছুরিকাঘাত করে তারপর খাওয়ার উপযুক্ত করে ছাড়িয়ে নিয়েছেন। তার ভাষ্যে, "তার মানে আমি হাঙ্গর সুশি খেয়েছি।"
প্রথম দিকে তিনি স্টোভে রান্না করতেন, কিন্তু কিছুদিন পরেই সেটা ভেঙ্গে যায়। নব্বইয়ের দশকে শ্যাডকের ক্যান্সার ধরা পড়ার পর থেকে তিনি 'র ভেগান ডায়েট' শুরু করেছিলেন। "কিন্তু শরীর অনেক বেশি শুকিয়ে গেলে, এখন যেমনটা আছে, তাহলে আবারও মাংস খেতে আমার কোনো আপত্তি নেই", বলেন তিনি।
কিন্তু প্রশান্ত মহাসাগরের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া একটি ঝড়ে শ্যাডকের নৌকার পাল ভেঙ্গে যায় এবং ইঞ্জিন বিকল হয়ে পড়ে। শ্যাডক পাল ঠিক করার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু মাস্তুলে উঠতে গিয়ে কয়েকবার পড়ে যাওয়ার পর তিনি ক্ষান্ত দেন। পরে তিনি এটা নামিয়ে রাখেন, যেহেতু ঠিক করার কোনো উপায় ছিল না।
৭ জুলাই মানজানিলো থেকে ২০০ মাইল দূরে হারিকেন ক্যালভিন শুরু হয় এবং প্রশান্ত মহাসাগরের দিকে ধেয়ে আসতে থাকে। ১২ জুলাই কলিমা উপকূল থেকে ১২৫ মাইল দূরে তখনো শ্যাডক সমুদ্রে হারিকেনের খুব কাছাকাছি ছিলেন। উত্তাল সমুদ্রে সেদিন হয়তো তার মৃত্যুও হতে পারতো। "খুব সংকটপূর্ণ সময় ছিল সেটা; সমুদ্রে যখন ঝড় ওঠে তখন হাতে খুব কম বিকল্প হাতে থাকে... নৌকায় থেকে তখন বেশিকিছু করার সুযোগ থাকে না", বলেন শ্যাডক।
কিন্তু এই অস্ট্রেলিয়ানের ভাগ্য ভালোই ছিল বলতে হয়। ওই এলাকা দিয়ে উড়ে যাওয়া একটি হেলিকপ্টার তখন ছোট্ট সাদা রঙের নৌকাটি দেখতে পায় এবং মারিয়া ডেলিয়া নামের জাহাজকে জানায়। এরপর ওই জাহাজ থেকে একটি ছোট নৌকা পাঠানো হয় শ্যাডকের নৌকার কাছে।
ঐ মুহূর্তের কথা মনে করে শ্যাডক বলেন, "ওই সময় চিন্তা করছিলাম- আমাকে একটা সিদ্ধান্ত নিতে হবে, আমি কি এই লোকগুলোর সাথে যাব? আর যদি না যাই, তাহলে কি এখানে আমার বেঁচে থাকা সম্ভব? আর এটা তো স্পষ্টই হয়ে গেছে যে আমি এখানে এভাবে টিকে থাকতে পারব না।" এরপর তিনি নৌকায় উঠে বসলেন এবং মারিয়া ডেলিয়াতে তাকে নিয়ে যাওয়া হলো।
শ্যাডকের কুকুর বেলা
অবাক করা ব্যাপার হলো, জাহাজের ক্রুরা দেখলেন, মনিবের চেয়ে তার কুকুর বেলার স্বাস্থ্য ভালো রয়েছে। জাহাজে উঠেই বেলা জাহাজের একজন নেভিগেটর জেনারো রোজালেসের কাছে চলে যায়। তিনিও কুকুরটিকে সাদরে গ্রহণ করেন এবং তার গায়ের একটি ক্ষত পরিচর্যা করেন। শ্যাডক জানান, রোজালেসই কুকুরটিকে পালক নিয়েছেন।
হোটেলের জানালা থেকে প্রশান্ত মহাসাগরের দিকে তাকিয়ে থাকেন শ্যাডক, দেখেন ঢেউয়ের আছড়ে পড়া। কখনো কখনো সমুদ্রে ভাসমান জাহাজগুলোর হর্ন শুনতে পান।
আবারও কি কখনো সমুদ্রে অভিযানে যাবেন তিনি? উত্তরে মজার ছলে শ্যাডক বলেন, "আমার মনে হয়, আমি যাব। কিন্তু এবার আরও বড় নৌকা নিয়ে। হয়তো ক্রুজ শিপ নিয়ে। শুধু লাউঞ্জে বসে থাকবো, খাবার খাব, আর এসি ঘরে থাকবে একটা বড় টিভি।"