বিআরটিসির বাস: কোটি টাকায় শুরু লাখ টাকায় শেষ
পূর্ববঙ্গে জলপথেই ছিল চলাচল। সড়কপথের অস্তিত্ব ছিল নগণ্য। মাত্র ৬০০ কিলোমিটার পাকা রাস্তা ছিল ১৯৪৭ সালে; সেগুলোপ ছিল সরু। ব্রিটিশ ভারতীয় রেলব্যবস্থার অধীন রেলপথ ছিল ২৮০০ কিলোমিটার, যমুনা নদীর এপারে আর ওপারে। ১৯৬০ সালে ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ের নাম রাখা হয় পাকিস্তান ইস্টার্ন রেলওয়ে। সড়কে পরিবহন ব্যবস্থার অংশ হিসেবে ১৯৬১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ইস্ট পাকিস্তান রোড ট্রান্সপোর্ট কর্পোরেশন (ইপিআরটিসি)। এর পরের বছর প্রতিষ্ঠা লাভ করে সড়ক ও মহাসড়ক দপ্তর।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকালে এ দেশের পরিবহন অবকাঠামো প্রায় পুরোটাই বিপর্যস্ত হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর পর সড়কপথে পরিবহন ব্যবস্থা সচল করার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভারত থেকে ২০টি ট্রাক ও ২০টি বাস আনার নির্দেশ দেন। এই সময়ই ইপিআরটিসির নাম বদলে রাখা হয় বিআরটিসি (বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট কর্পোরেশন)। তবে বিআরটিএ (বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি) কার্যক্রম শুরু করে আরো পরে; ১৯৮৮ সালে।
১৯৯১ সালে সড়ক নেটওয়ার্ক দাঁড়ায় ২ লক্ষ ৭১ হাজার কিলোমিটারে। ১৯৯৮ সালে যমুনা নদীর ওপর বঙ্গবন্ধু সেতু তৈরি হলে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থায় নতুন এক দিগন্ত উন্মোচিত হয়। বিআরটিসি শীর্ষক রোকন উদ্দিন আহমেদের গবেষণাপত্র থেকে জানা গেছে, ১৯৭৫ সালে যেখানে মোট যাত্রী পরিবহনের ৫৪ শতাংশ হতো, সড়ক পথে ১৯৯৭ সালে সেটি ৭২ শতাংশে এসে দাঁড়ায়। ২০১৪ সালে দাঁড়ায় ৯৫ শতাংশে।
বিআরটিএ থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে ১৯৯০-৯১ সালে বাংলাদেশে নিবন্ধিত যানবাহন ছিল ২০ লক্ষ ২২ হাজার। ২০ বছর পর ২০০৯-২০১০ সালে সংখ্যাটি দাঁড়ায় ৭০ লক্ষ ১০ হাজারে। ওই সময়কালে পরিবহন খাতে কর্মীর সংখ্যা ২০ লাখ থেকে বেড়ে হয় ৮০ লক্ষ।
আড়াই আনা ছিল ভাড়া
সড়ক পরিবহন খাতে বিআরটিসির ভূমিকা অগ্রগণ্য। এটি বাংলাদেশ সরকারের একটি করপোরেট প্রতিষ্ঠান। এর পূর্বসুরীর (ইপিআরটিসি) প্রতিষ্ঠা ১০ বছর আগে হলেও কার্যক্রম বেশি বিস্তৃত ছিল না। মগবাজার থেকে সদরঘাট পর্যন্ত ভাড়া ছিল আড়াই আনা। এর মধ্যে গুলিস্তান পর্যন্ত ১ আনা আর পরের পথটুকুর ভাড়া ছিল দেড় আনা।
বাসগুলোর সময় ঠিক থাকত না। মাঝেমধ্যেই খুব ভিড় হতো। এক থেকে দেড় ঘণ্টা সময় লাগত এটুকু পথেই। অবশ্য বাসগুলোর যাত্রাপথ সোজা ছিল না। মগবাজার চৌরাস্তা ধরে আউটার সার্কুলার রোড ঘুরে মালিবাগ ছুঁয়ে দক্ষিণে শান্তিনগর যেত, তারপর কাকরাইল হয়ে রমনা পার্ক। সরকারি বাস হওয়াতে ভাড়া ছিল কম। আবার মালিকানাধীন বাসগুলোর রুট ছিল সংক্ষিপ্ত তবে ভাড়া গুনতে হতো বেশি।
ঢাকা কেন্দ্রের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আজিম বখশ জানান, "আমার যতদূর মনে পড়ে বাসগুলোর রং ছিল লাল, বেডফোর্ড কোম্পানির বাস ছিল সেগুলো। তখন 'পূর্ব পাকিস্তান সপ্তাহ' আয়োজিত হতো। এ উপলক্ষে গুলিস্তান স্টেডিয়ামে হতো বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠান। আমরা যারা স্কাউটিং করতাম তারা ভলান্টিয়ার হিসেবে ভিআইপি গ্যালারিতে ডিউটি দিতাম। রাত দশটায় অনুষ্ঠান শেষে ইপিআরটিসির বাসে চড়েই বাহাদুর শাহ পার্কে এসে নামতাম। বাহাদুর শাহ পার্ক ছিল বাসগুলোর শেষ গন্তব্য। তখন কিন্তু সোজা পথ ছিল না, ধরা যাক তেজগাঁও যাচ্ছি, ভিক্টোরিয়া পার্ক থেকে নওয়াবপুর রোড হয়ে গুলিস্তান, তারপর কাকরাইল, মগবাজার ও কারওয়ান বাজার হয়ে হলিক্রস কলেজের সামনে দিয়ে তেজগাঁও যেতে হতো। তবে চকবাজার, ইসলামপুর রোডে ইপিআরটিসির গাড়ি চলত না, এ রুটে চলত ব্যক্তিমালিকানাধীন গাড়ি।"
ইপিআরটিসি মিরপুর ডিপোতে প্রথম দোতলা সার্ভিসের উদ্বোধন হয় ১৯৬৮ সালে। বাসগুলো আনা হয়েছিল ইতালি থেকে। মিনিবাস আকারের বাস দিয়ে কোচ সার্ভিসও ছিল ইপিআরটিসির। সেগুলো দেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও চলেছে। ১৯৭৫ থেকে ২০০৫ সাল অবধি বিআরটিসির যাত্রী পরিবহন সক্ষমতা বৃদ্ধি পায় ধারাবাহিকভাবে। তারপর রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং সরকারের উদাসীনতার কারণে বিআরটিসির গতি নিম্নমুখী হয়। ২০১৫ সাল থেকে প্রতিষ্ঠানটি ঘুরে দাঁড়ানোর প্রয়াস পায়। এখন যেমন বিআরটিসির ডিজিটাল বাসও আছে, যেগুলোতে বিনা পয়সায় ওয়াইফাই ব্যবহারের সুযোগ আছে।
বিআরটিসিতে ৩৮ বছর
তেজগাঁও ট্রাক ডিপোতে তার কর্মজীবন শুরু, আশির দশকের ঠিক মধ্যভাগে। বি গ্রেডের মেকানিক ছিলেন কাজী বকুল হোসেন। তিনি বলছিলেন, "১৯৮৬ সালে বিআরটিসির বাস সংখ্যা ছিল ১০০০; যার মধ্যে দ্বিতল ছিল ২০টি। বিআরটিসি ছিল তখন গণমানুষের ভরসার নাম। প্রাইভেট বাস কোম্পানি ছিল হাতে গোনা যাদের সেবার মান তখনো উন্নত বলা যাবে না। দূর যাত্রায়ও আগে বিআরটিসির নাম মনে পড়ত যাত্রীদের।"
"মতিঝিল থেকে বাস যেত চট্টগ্রাম। সামরিক বাহিনীর সদস্যরা বাড়ি যাবার টিএডিএ বা ভ্রমণভাতা পেত কেবল বিআরটিসিতে ভ্রমণ করলেই। ছাত্র, প্রতিবন্ধি বা মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য টিকিট হাফ ছিল, কোনো কোনো ক্ষেত্রে মাফও ছিল। কন্ডাক্টরদের কাঁধে ঝুলত চামড়ার ব্যাগ, তারা সকালে ডিপোতে এসে টিকিট নিয়ে যেত। সন্ধ্যায় যতগুলো টিকিট বিক্রি হয়েছে সে অনুযায়ী টাকা বুঝিয়ে দিত। সেকালে ভাড়া ছিল চার আনা বা আট আনা। কন্ডাক্টরের ব্যাগ রেজগিতে (খুচরো পয়সা) ঝনঝন করত। তখন কন্ট্রাক্ট (চুক্তিভিত্তিতে গাড়ি লিজ দেওয়া) সিস্টেম ছিল না। সব গাড়িই বিআরটিসি নিজে পরিচালনা করত।"
বিআরটিসির ডাবল ডেকারগুলোর মধ্যে সুনাম অর্জন করেছিল সুইডিশ ভলভো বাসগুলো। ১৯৯৯ সালে এগুলো আনার প্রক্রিয়া শুরু হয়; তবে বাসগুলো রাস্তায় চলতে শুরু করে ২০০২ সালে। ৬০ কোটি টাকায় ৫০টি বাস আনা হয়েছিল সুইডেন থেকে। বকুল হোসেন জানান, "সেগুলো উদ্বোধন করেছিলেন তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা। মিরপুর থেকে মতিঝিল আর মতিঝিল থেকে আব্দুল্লাপুর রুটে চলতো এসব বাস। বাসগুলোর জন্য নির্ধারিত ডিপো ছিল মিরপুর। তখন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারাও এ গাড়িতে চড়ে অফিস যাওয়া-আসা করতেন। বাস কাউন্টারগুলো ছিল সুন্দর ও ছিমছাম। গাজীপুরে বিআরটিসির ওয়ার্কশপে ভলভো বাসগুলোর বডি সংযোজন করা হয়েছিল।"
বিলাসবহুল বাসগুলো অবশ্য ৮ বছরের বেশি চলেনি। প্রধান কারণ স্পেয়ার পার্টসের দুষ্প্রাপ্যতা। পার্টসের দামও ছিল বেশি। ১৬ চাকার প্রতিটি টিউবের দাম পড়ত ৩০ হাজার টাকা। শুধু গিয়ার বক্সের দামই ছিল ১২ লক্ষ টাকা।
তবে বকুল হোসেন সন্তোষ প্রকাশ করলেন এই বলে যে, "গাড়িগুলো থেকে প্রতিদিন ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা আয় করা গেছে। ১২০ সিটের ছিল গাড়িগুলো, পিক আওয়ারে আরো ৫০ জন দাঁড়িয়ে যেত। ৮ বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা আয় কম কথা নয়। সুইডেন থেকে প্রশিক্ষক এসে আমাদের বলেছিলেন, এটা এমন গাড়ি যে পাখা লাগিয়ে দিলে আকাশেও উড়তে পারবে। প্রশিক্ষক খুশি হয়ে আরো বলেছিলেন, বাংলাদেশ এ গাড়ি থেকে ভালো উপকৃত হয়েছে। এমনও দেশ আছে যারা গাড়িগুলো আমদানির পর পরই বসিয়ে রেখেছে।"
তবে গাড়িগুলোর আয়ুস্কাল নিদেনপক্ষে ১৫ বছর হওয়ার কথা। ঠিকঠাক রক্ষণাবেক্ষণ করা গেলে গাড়িগুলো থেকে আরো অধিক সেবা নেওয়া যেত। তার প্রমাণ একটি ভলভো গাড়ি। এখনো সচল আছে গাড়িটি, স্টাফ সার্ভিস দেয়।
ভলভোর চেয়ে বেশি দাম দিয়ে বিআরটিসি ৫০টি জোড়া বাস (আর্টিকুলেটেড) কিনেছিল; যেগুলো দৈর্ঘ্যে ৫৪ ফুট। প্রতিটির দাম পড়েছিল ১ কোটি ১১ লাখ টাকা। দুঃখের বিষয়, জোড়া পুনঃসংযোজনের জন্য প্রয়োজনীয় খুচরা যন্ত্রপাতির অভাবে ২০টি বাস অল্প সময়ের মধ্যে অচল হয়ে যায়। এখন যেগুলো কুড়িল-গাউছিয়া রোডে চলছে সেগুলো যাত্রীদের ভালো সেবা দিচ্ছে বলে জানালেন বকুল হোসেন।
বাস লাভার বিডি অ্যাডমিন ফজলে রাব্বিও বলেছেন, "আমাদের মতো জনাকীর্ণ দেশে এসব বাস কার্যকরী বলেই মনে হয়। তবে যদি মেইনটেনেন্স না করা যায় তবে কোনো বাসই বেশিদিন টেকানো সম্ভব নয়, তা যত উন্নত দেশের হোক আর যত দাম দিয়েই কেনা হোক।" রাব্বি উদাহরণ দিলেন, "২০০৩ সালে কেনা গ্রিনলাইনের বাস এখনও সড়কে চলছে, প্রধান কারণ এগুলোর মেনটেনেন্স প্রপারলি করা হয়।"
বকুল হোসেন জানালেন, বাস আমদানির পর বিআরটিএতে পাঠানো হয় নিবন্ধন নেওয়া ও ফিটনেস পরীক্ষার জন্য। তারপর চাহিদা অনুযায়ী ডিপোগুলোতে বরাদ্দ দেওয়া হয়। আর বাস পুরনো হয়ে গেলে সারাই কাজ চালানোর পরও যদি সাফল্য লাভের সম্ভাবনা না দেখা যায় তখন নির্ধারিত কমিটি এগুলো বিকল ঘোষণা করে এবং বিক্রির জন্য দরপত্র আহ্বান করে। ভলভো বাসগুলো শেষাবধি ৭-৮ লাখ টাকায় বিক্রি হয়েছিল। ভাঙ্গারিই বাসগুলোর শেষ পরিণতি।
আটত্রিশ বছর পর চাকরি জীবনের শেষে এসে বকুল হোসেন এখন বিআরটিসির কল্যাণপুর ডিপোর প্রধান কারিগরি কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি কর্পোরেশনের বর্তমান চেয়ারম্যান তাজুল হোসেনকে কৃতিত্ব দিতে চান বেশ কিছু কারণে, তার মধ্যে একটি হলো এখন বিইআর বা বসে থাকা গাড়ির সংখ্যা বেশি নয়। কর্মীদের বকেয়া থাকা বেতনের অনেকটাই পরিশোধ করা হয়েছে। মাসের ১ তারিখে এখন একযোগে বেতন হয় সবার। বিআরটিসির প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটে অনেক দুঃস্থ ও বেকার লোক প্রশিক্ষণ নিতে পারছে বিনামূল্যে। তিনি জানালেন, এখন এই কল্যাণপুর ডিপোতে একটিও বসে থাকা গাড়ি নেই। বিআরটিসি নিজের আয়ে চলে।
তার কাছে জানতে চেয়েছিলাম, বাসগুলো রিসাইক্লিংয়ের চেষ্টা করা হয়ে থাকে? জানালেন, "এটা হামেশাই হয়। এ গাড়ির পার্টস নিয়ে ওই গাড়ি চালানো হয়, ওই গাড়ির এটা এনে সেই গাড়িতে চালানো হয়। গাড়ির বডি তৈরির জন্য আমাদের দক্ষ কর্মী আছে। কেন্দ্রীয় মেরামত কারখানা ছাড়াও আমাদের ডিপোগুলোকেও কারখানা বলা যায়। এগুলোতেও প্রশিক্ষিত মেকানিক আছেন।"
এক নজরে বিআরটিসি
বিআরটিসির ওয়েবসাইট থেকে জানা যাচ্ছে, মোট বাস ডিপো ২১টি। ট্রাক ডিপো ২টি। মোট বাস সংখ্যা ১৮৩০টি। এরমধ্যে নতুন বাস ৬০০টি এবং পুরাতন ১২৩০টি। চলমান আছে ১১৮২টি। নিবন্ধনের অপেক্ষায় নতুন বাস ৩২৫টি। বিইআর বা বিয়ন্ড ইকনমিক্যাল রিপেয়ার ২৪৮টি। হালকা ও ভারী মেরামতের অপেক্ষায় আছে ৭৫টি বাস।
ঢাকা মহানগরীতে চলমান বাসের সংখ্যা ৭২৩টি; যার মধ্যে গণপরিবহন ৪৬৩টি, স্টাফ বাস ২৩৫টি, স্কুল বাস ৮টি এবং মহিলা বাস ১৭টি। ঢাকার বাইরে চলে ৩৬৩টি বাস, এগুলোর মধ্যে গণপরিবহন ৩০২টি, স্টাফ বাস ৫৮টি এবং মহিলা বাস ৩টি, লীজে পরিচালিত হয় ৯৬টি।
ঢাকা মহানগরীতে চলমান রুট ২৮ এবং ঢাকার বাইরে চলমান রুট ১৩৪।
দুপুরবেলার অপেক্ষা
সাধারণত মিরপুর ডিপোর প্রতিটি ডাবল ডেকার দিনে ২টি (আপ-ডাউন ১টি ধরা হয়) ট্রিপ দেয়। মিরপুর থেকে গুলিস্তান হয়ে কদমতলী যেতে ৩ ঘণ্টাও লাগে। কদমতলীতে গিয়ে সিরিয়াল নিতে আধা ঘণ্টা থেকে ১ ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়, আবার মিরপুর ১০ নম্বরে এসেও সিরিয়াল ধরতে হয়। ড্রাইভার ও কন্ডাক্টররা কখনো কদমতলীতে খেয়ে নেন, কখনো মিরপুরে এসে দুপুরের খাবার খান।
সিরিয়াল ধরার এই ফাঁকা সময়ে কয়েকজন কন্ডাক্টরের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পেয়ে গেলাম। সবুজ, বয়স ২৪। তাদের লিজের গাড়ি, কন্ট্রাক্টে চলে। পুরানো গাড়ি (১১ সিরিজের) হওয়ায় লিজহোল্ডারকে দিতে হয় ৪৪০০ টাকা, তেল নিতে হয় ৪৫০০ টাকার আর রোড খরচ আছে ১০০০ টাকা। সবমিলিয়ে ১০ হাজার টাকা খরচ আছে প্রতিদিন। ওই ১০ হাজার টাকা ওঠানোর পর কমপক্ষে ২০০০ টাকা ভাড়া তোলার টার্গেট রাখেন। এই ২০০০ এর মধ্যে কন্ডাক্টর আর হেলপার নেন ৬০০ টাকা করে এবং ড্রাইভার ৮০০ টাকা। সবুজ মিয়া বিআরটিসির স্টাফ নন, তবে একটি আইডেন্টিটি কার্ড আছে। গাড়ির আয় থেকেই তার ইনকাম। দুই দিন পর পর একদিন রেস্ট পান।
তার কাছে জানতে চেয়েছিলাম, কেন গাড়িগুলো আয়ুস্কাল পার হতে পারে না? সবুজ বললেন, "গাড়ি এক হাতে চললে ভালো থাকে। লিজের গাড়ি নানান হাতে চলে, সব ড্রাইভার সমানভাবে গাড়ি চালায় না আর এজন্যই গাড়ির কন্ডিশন খারাপ হয়।" অনেকক্ষেত্রেই ব্যাটারি ডাউন হয়ে যায়। তিনি দোতলায় ওঠার সিঁড়ি দেখালেন যার নিচের অংশটা ক্ষয়ে গেছে। বললেন, "তিনবার জানাইছি অফিসে, গুরুত্ব দেয় না। আসলে মায়া নাই কারুর।"
সবুজের পরে পেলাম মহিউদ্দিনকে। মহিউদ্দিনের গাড়িটি তুলনামূলক নতুন (১৫ সিরিজের) যদিও দেখতে পুরনোর মতোই লাগে। মহিউদ্দিন বলল, "কোনো কোনো ডিপোতে পর্যাপ্ত শেড নাই। রোদে পুড়ে গাড়ির রং উঠে যায়। নতুন গাড়ির লিজ হোল্ডারকে দিতে হয় ৫৪০০ টাকা। গাড়ির কাঁচ ভাঙলে আমাদের ইনকাম থেকে সারাতে হয়। আরো টুকটাক সারাইয়ের কাজও আমাদেরই করতে হয়। অচল গাড়ির শেষ দশা কী হয় তা আমি বলতে পারি না। তবে বিআরটিসির অবস্থা আগের চেয়ে এখন ভালো, অবস্থা দেখে মনে হয়।"
বিআরটিসি ক্রান্তিকাল পার করেছে করোনার সময় এবং লাগাতার হরতালের সময়। কিছু গাড়ি তখন পুড়িয়েও দেওয়া হয়েছিল। করোনাকালে গাড়ি চলেনি বলে ইনকামও ছিল না। এতে কর্মীদের বেতন বকেয়া পড়ে যায়।
আসছে ইলেকট্রিক বাস
শীঘ্রই নতুন আরো ১০০টি ডাবল ডেকার আনতে যাচ্ছে বিআরটিসি। ৩৮৩ কোটি টাকা ব্যয় হবে এজন্য। এগুলো ইলেকট্রিক বাস এবং এতে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ সুবিধা থাকবে।
সাতটি বৈদ্যুতিক চার্জিং স্টেশন স্থাপন করা হবে বাসগুলোর জন্য। এ দিয়ে কার্বণ নিঃসরণ কমানোর নতুন যুগে প্রবেশ করবে বিআরটিসি।
আয়ুস্কাল ফুরানোর আগেই গাড়িগুলো যাতে মরণদশায় পতিত না হয়- তা ই এখন একমাত্র আশা।