পাবনার এক উপজেলার অদ্ভুত সব খেলায় মাত ইউটিউব-ফেসবুক — গ্রামবাসীরাই খেলেন, পুরস্কার জেতেন
ক্লাস নাইনে পড়ুয়া মিম বেশ চাপ অনুভব করছে। তার চোখমুখ বিচলিত, অথচ একইসঙ্গে সেখানেও উত্তেজনাও ফুটে উঠেছে।
মঞ্চ প্রস্তুত। চরপাশে দর্শকেরাও উত্তুঙ্গ আগ্রহে অপেক্ষারত।
পাবনার ফরিদপুর উপজেলার আরকান্দি গ্রাম। খেলাটি হচ্ছে এখানে। একদল নারী এ খেলায় অংশ নিতে তৈরি হয়ে আছেন। মিমও তাদের একজন।
খেলাটির লক্ষ্য হলো একটা কাঠের পাটাতনের ওপর দিয়ে একটা বলকে গড়িয়ে নিয়ে পাটাতনের অপর অংশে গোলাকার কাঠের গর্তে রাখা পানির গ্লাসের মধ্যে ফেলা।
গ্লাসের মধ্যে বলটি ফেলতে পারলেই পুরস্কার হিসেবে রয়েছে এক লিটার সয়াবিন তেল। এ বাজারে তেলের দাম বিবেচনায় দারুণ লোভনীয় পুরস্কার এটি।
পুরো খেলার ভিডিও করার দায়িত্বে রয়েছেন একজন ক্যামেরাম্যান।
প্রথম অংশগ্রহণকারী কোনোমতে একটি বল গ্লাসের মধ্যে ফেলতে পারলেন।
এরপর মিমের পালা এলো। একবুক দম নিয়ে সে প্রস্তুত।
১২ বারের চেষ্টায় চার-চারটা বল গ্লাসে ফেলতে পারল সে। পুরস্কার হিসেবে পেল চার লিটার সয়াবিন তেল।
'এক পয়সাও খরচা না করে চার লিটার সয়াবিন তেল পাওয়া মানে বুঝতে পারছেন তো,' খুশিতে গদগদ মিমের উচ্ছ্বাস।
ইউটিউব আর ফেসবুকে এসএস ফুড চ্যালেঞ্জ নামক একটি চ্যানেল পাবনার ফরিদপুর উপজেলায় নিয়মিত এ ধরনের খেলার আয়োজন করে। এসব খেলায় অংশ নেন এ উপজেলার অনেক নারী ও পুরুষ।
ফরিদপুরের ২০ থেকে ২৫টি গ্রামে 'ফুড চ্যালেঞ্জের' আয়োজন করে আসছে দলটি।
খেলার আইডিয়াটা বেশ সাধারণ। গ্রামবাসীরা খেলায় অংশ নেন — আর জনতার আগ্রহ ধরে রাখতে এসব খেলার নতুন নতুন পদ্ধতি ও নিয়ম তৈরি করে আয়োজক দলটি।
খেলাগুলোর ভিডিও তৈরি করে ইউটিউব ও ফেসবুকে আপলোড করে এসএস ফুড চ্যালেঞ্জ। প্রতিযোগীরা সাধারণত সয়াবিন তেল, চাল, গম, বিস্কিট ইত্যাদি পুরস্কার হিসেবে জেতেন।
ফেসবুক ও ইউটিউবে তাদের এসব খেলার ভিডিও বেশ জনপ্রিয় হয়েছে।
এসব ভিডিও এখন পর্যন্ত ফেসবুকে একশ কোটিবার এবং ইউটিউবে ৫০ কোটিবার দেখেছেন মানুষ। কেবল বাংলাদেশি নয়, বিশ্বের অন্যান্য দেশের দর্শকও এ খেলাগুলো দেখেন।
অদ্ভুত সব খেলার মধ্যে রয়েছে ঢালু পাটাতন বেয়ে নামার সময় ফুটবল ছুড়ে হাঁড়ি ভাঙা, পুল শট, দৌড়, লাফানো, পাত্রের গায়ে ফুটবল নিক্ষেপ, পানির ওপর ঘূর্ণন, শাড়ি বা থ্রিপিসের জন্য ঝুড়িতে ফুটবল ছোড়া, ট্রিক শট, টায়ার দিয়ে পানির বোতলের টাওয়ার ভাঙা, অদ্ভুতদর্শন গাড়ি চালানোসহ আরও অনেক কিছু।
খেলাগুলোকে বিভিন্নভাবে পরিবর্তন করা হলেও এগুলোর নিয়মকানুন সহজ রাখা হয় যাতে মানুষের বুঝতে অসুবিধা না হয়।
এসএস ফুড চ্যালেঞ্জ-এর প্রতিষ্ঠাতা ও দলনেতা ওমর সানি সম্রাট জানান, গেমের ডিজাইন ও পরিকল্পনা করার জন্য তাদের একটি নিবেদিত দল রয়েছে। ওমরের তত্ত্বাবধানে প্রায় ২০ জন এ চ্যানেলের জন্য কাজ করেন।
কোভিডের দিনগুলোতে শুরু
ওমর কিছুদিন ধরে কনটেন্ট তৈরির দিকে ঝুঁকেছিলেন। স্নাতক পড়ার সময় তিনি মজার সব কনটেন্ট তৈরি করতেন।
২০২১ সাল নাগাদ যখন কোভিড-১৯ ছড়িয়ে পড়ে, ওমরের ততদিনে একটি পূর্ণকালীন চাকরি হয়েছে। একই সময়ে তিনি বেশকিছু ইউটিউব চ্যানেলও পরিচালনা করতেন।
এসএস ফুড চ্যালেঞ্জ চ্যানেলটিও তখন ছিল। কিন্তু সে সময় এটি স্রেফ খাওয়ার প্রতিযোগিতার জন্য ব্যবহার করা হতো।
তবে এভাবে দ্রুত খাওয়ার ঝুঁকিগুলোও বুঝতেন ওমর।
'কেউ যদি আমাদের খাবার খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ে তাহলে কী হবে? তাই এর পরিবর্তে আমরা খেলাধুলার আয়োজন শুরু করে মানুষের মধ্যে খাবার সামগ্রী বিতরণ করি।
'দ্বিতীয় লকডাউনের সময় আমরা দেখেছি, বাচ্চারা মোবাইল গেমস নিয়ে মজে গিয়েছিল। আমরা তাদের বলেছিলাম, তারা যদি আমাদের সঙ্গে বাইরে খেলায় অংশ নিতে আসে, তাহলে আমরা তাদেরকে খাবার দেব। এভাবেই আমাদের কার্যক্রম শুরু হয়। এ ধাঁচে আমাদের প্রথম ভিডিও মুক্তি পেয়েছিল ২০২১ সালের ১৯ জুলাই।'
তার ছোটভাই সাগর তখন খেলাগুলোর আয়োজন করতেন। সাগর এখন ক্যামেরার কাজ এবং সম্পাদনা দুটোই সামলান।
ইউটিউব এবং ফেসবুকে ইতিবাচক সাড়া পাওয়ার পর দলটি বাচ্চাদের সঙ্গে খেলাগুলো চালিয়ে যায়। এক পর্যায়ে বয়স্করাও এসে এসব খেলায় অংশ নেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন।
'বড়দের সঙ্গে বিষয়গুলো আরও জমে উঠল। মানুষজন লাইনে দাঁড়িয়ে আনন্দের সঙ্গে এসব খেলায় অংশ নিতে লাগলেন। প্রায় ৩০ থেকে ৪০ জন খেলায় অংশ নেন, কিন্তু তাদের খেলা দেখতে জড়ো হন প্রায় ২০০–৩০০ মানুষ।'
আগে পুরস্কার হিসেবে বিস্কুট দেওয়া হতো। কিন্তু পুরস্কারের চেয়ে মানুষের বরং আগ্রহ বেশি এসব সামাজিক কর্মকাণ্ডে অংশ নেওয়ার।
২০২২ সালে অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের পাশাপাশি সয়াবিন তেলের দাম আকাশচুম্বী হলে সেগুলোকে পুরস্কার হিসাবে রাখতে শুরু করে দলটি। ফলে প্রতিযোগিতা নিয়ে আরও বেশি আগ্রহ তৈরি হয়েছিল মানুষের মধ্যে।
ওমর বলেন, 'পুরস্কারের পরিবর্তন আমাদের চ্যানেলের বৈপ্লবিক বৃদ্ধি ঘটিয়েছে। দর্শকসংখ্যা এবং গ্রামের মানুষের উৎসাহ দুটোরই বড়সড় অগ্রগতি হয়েছে।'
ওমরও জনপ্রিয় উপস্থাপক রাসেলকেও তার খেলায় নিয়ে গিয়েছিলেন।
উদ্ভাবন মূল চাবিকাঠি
ওমর বলেন, তার গেম ডিজাইন ও প্ল্যানিং টিমের নেতৃত্বে আছেন মুনির।
'আমরা বিষয়টি আকর্ষণীয় রাখতে খেলাগুলোতে নতুনত্বের ওপর অত্যন্ত জোর দিই।'
মানুষ যাতে বিরক্ত না হয় তা নিশ্চিত করতে এবং দর্শকদের জন্য বিষয়বস্তুকে সতেজ রাখতে প্রতিদিন প্রায় ডজনখানেক খেলার কথা ভাবা হয়।
'খেলাগুলোর সঙ্গে অনেক ঝুঁকির কারণ রয়েছে। মানুষজন আঘাত পেতে পারে। তাই আমাদের অংশগ্রহণকারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আমরা নিজেরাই খেলাগুলো পরীক্ষা করি।
'এমনিতে দেখতে বসলে খেলাগুলোকে আপনার কাছে খুব সহজ মনে হতে পারে, কিন্তু এগুলোকে এমন রূপ দেওয়ার পর্দার পেছনের কাজটি বেশ জটিল।'
ওমর বলেন, তারা ইতোমধ্যে ৪০০ থেকে ৫০০টি খেলায় পরিবর্তনের মাধ্যমে নতুনত্ব এনেছেন।
নারীদের জন্য আয়োজন করা খেলাগুলো তাদের দৈনন্দিন জীবনের একঘেয়েমি কাটানোর দারুণ একটি সুযোগে পরিণত হয়েছে।
যেমন আরকান্দিতে চার লিটার সয়াবিন তেল জেতার পর মিম জানায়, নারীরা দারুণ মজা করেছেন।
মিম বলে, 'সবাই খুব খুশি ছিল। আমরা এটাকে এতটাই উপভোগ করেছি যে সবাইমিলে তাদেরকে আমাদের সঙ্গে আরও খেলা আয়োজনের অনুরোধ করেছি।'
ওমর অবশ্য বুঝতে পারেন তার এ কাজের মূল্য কতটা।
'প্রতি মাসে আমরা পুরস্কারের পেছনে প্রায় পাঁচলাখ টাকা খরচ করি। আশা করি এ ধরনের উদ্যোগ দেশের প্রতিটি গ্রামে গ্রামে গড়ে উঠবে। তবে এর জন্য আবেগ থাকতে হবে। কেবল টাকা আয়ের কথা চিন্তা করে করলে এটি সফল হবে না,' তিনি বলেন।