লাল গ্রহের লক্ষ্যে: বাংলাদেশের মার্স রোভার দলের জগতে
লালচে মাটির উঁচু-নিচু পথ। তার ওপর দিয়েই চাকা ঘুরিয়ে চরে বেড়াচ্ছে যান্ত্রিক সব রোভার। হঠাৎ দেখায় মঙ্গলের কোনো দৃশ্য মনে হতে পারে। তবে বাস্তবে এটি যুক্তরাষ্ট্রের ইউটা স্টেটের মার্স ডেজার্ট রিসার্চ স্টেশন। মঙ্গলের পরিবেশের সাথে মিল থাকায় এখানেই গবেষণাগার তৈরি করেছে গবেষণা প্রতিষ্ঠান মার্স সোসাইটি। আর এখানেই তাদের তত্ত্বাবধানে অনুষ্ঠিত হয় ইউনিভার্সিটি রোভার চ্যালেঞ্জ (ইউআরসি)। প্রতি বছর সারা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এখানে ছুটে আসে, একে অপরের সাথে নামে সেরা রোভার তৈরির প্রতিযোগিতায়।
মঙ্গলের পরিবেশে চলার উপযোগী করে তোলার জন্য রোবট ডিজাইন ও তৈরির এই প্রতিযোগিতাগুলোতে নিয়মিতভাবেই অংশগ্রহণ করে থাকেন বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। বেশ কিছু পর্যায়ে এনেছেন সাফল্যও। প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ থেকে শুরু করে ক্লাবের কার্যক্রম পর্যন্ত সবকিছু নিয়ে কথা বলেছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) টিম ইন্টারপ্লানেটারের মেকানিকাল ডিজাইন অ্যান্ড ম্যানুফ্যাকচারিং অংশের প্রজেক্ট লিডার নাফিজ ইমতিয়াজ, ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি মার্স রোভার টিম লিডার আবিদ হোসেন এবং ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অফ টেকনোলজির (আইইউটি) প্রজেক্ট আলতাইরের ম্যানেজিং ডিরেক্টর জুবায়ের মাহমুদ আপন।
প্রতিযোগিতার অন্দরে
প্রতিযোগিতার শুরুটা হয়েছিল শিক্ষার্থীদেরকে রোবটিক্সে আগ্রহী করে তোলার উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে। মহাকাশ আর মঙ্গল নিয়ে গবেষণায় নতুন প্রজন্মের গবেষক-প্রকৌশলীদের পাইপলাইন প্রস্তুত রাখার জন্য নন-প্রফিট প্রতিষ্ঠান মার্স সোসাইটির উদ্যোগে ২০০৭ সালে শুরু হয় ইউনিভার্সিটি রোভার চ্যালেঞ্জ।
রোভার তৈরির সময় বেশ কিছু সীমারেখা মেনে চলতে হয়। প্রতিযোগিতার নিয়ম অনুযায়ী রোভারটি কোনোভাবেই ১.২ মিটার ✕ ১.২ মিটার ✕ ১.২ মিটারের চেয়ে বড় হতে পারবে না। একইসাথে রোভারটির অতিরিক্ত যন্ত্রাংশ ছাড়া এর সর্বোচ্চ ওজন হতে পারবে ৫০ কেজি।
প্রতিযোগিতায় ধরে নেওয়া হয় রোভারটি মঙ্গলেই বিচরণ করছে। এ কারণে সেটিকে ওয়্যারলেস উপায়ে নিয়ন্ত্রণের জন্য ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ থাকে না। রোভারের সেন্সর থেকে পাওয়া ডেটা আর ভিডিওকে সরাসরি ইলেকট্রনিক সিগন্যালের মাধ্যমে গ্রহণ করে কমান্ড সেন্টারে থাকা রোভার অপারেটররা। রোভারকে সরাসরি দেখার সুযোগও থাকে না তাদের সামনে।
প্রতিযোগিতার মূল অংশ বিভক্ত চারটি সেগমেন্টে। প্রথম সেগমেন্ট সায়েন্স মিশনের উদ্দেশ্য রোভারের মাধ্যমে প্রতিযোগিতার স্থানে জীবনের অস্তিত্ব আছে কিনা তা পরীক্ষা করে দেখা। ক্যামেরার মাধ্যমে ভিডিও দেখে অথবা মাটি বা তরল পরীক্ষা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া এই সেগমেন্টের লক্ষ্য। তবে এর পুরোটাই করতে হবে রোভারে থাকা যন্ত্রাংশের মাধ্যমে। কোন যন্ত্র ব্যবহার করে দলগুলো মাটি বা তরল পরীক্ষা করবে, সেটি সমাধানের দায়িত্ব তাদেরই। এছাড়াও বিচারকদের সামনে উপস্থাপনের জন্য মাটি বা তরল কন্টেইনারে সংগ্রহের কাজটিও করতে হয় রোভারের মাধ্যমে।
দ্বিতীয় সেগমেন্ট এক্সট্রিম রিট্রিভাল অ্যান্ড ডেলিভারি মিশনের উদ্দেশ্য হলো, রোভারের মাধ্যমে নভোচারীদের কাছে বিভিন্ন যন্ত্র পৌঁছিয়ে দেওয়া। এজন্য মাটিতে পড়ে থাকা হাতুড়ি, স্ক্রু ড্রাইভার কিংবা টুলবক্সের মতো জিনিস উঁচু-নিচু পথের ওপর দিয়ে গিয়ে পৌঁছিয়ে দিতে হয়।
তৃতীয় অংশ ইকুইপমেন্ট সার্ভিসিং মিশনে রোভারের মাধ্যমে বেশ কিছু যন্ত্র নিয়ন্ত্রণের কাজ করানো হয়। এর মধ্যে রয়েছে জয়স্টিক নিয়ন্ত্রণ, সুইচ অন-অফ করা, নব ঘোরানো, স্ক্রু টাইট করার মতো বিষয়। অন্যদিকে, শেষ সেগমেন্ট অটোনোমাস নেভিগেশন মিশনে কোনো ধরনের ইলেকট্রনিক সিগন্যাল ছাড়াই রোভারগুলোকে নির্দিষ্ট কিছু মার্ক করা জায়গায় যেতে হবে। এই ভাগে রোভারের পরিবর্তে ড্রোনও ব্যবহার করতে পারে দলগুলো।
যুক্তরাষ্ট্রে ইউনিভার্সিটি রোভার চ্যালেঞ্জের সফলতার পর মার্স সোসাইটি ইউরোপ এবং এশিয়াতেও রোভার চ্যালেঞ্জ প্রতিযোগিতা শুরু করতে উদ্যোগী হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৪ সাল থেকে পোল্যান্ডে ইউরোপিয়ান রোভার চ্যালেঞ্জ (ইআরসি) নামে এবং ২০২০ সাল থেকে ভারতে ইন্টারন্যাশনাল রোভার চ্যালেঞ্জ (আইআরসি) নামে প্রতিযোগিতা শুরু হয়। আর এই তিন প্রতিযোগিতাকে একত্রে ডাকা হয় 'রোভার চ্যালেঞ্জ সিরিজ' নামে।
এগুলো ছাড়াও তুরস্কের ইস্তাম্বুল টেকনিকাল বিশ্ববিদ্যালয়ে স্পেস এক্সপ্লোরেশন সোসাইটির উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হয় আনাতোলিয়ান রোভার চ্যালেঞ্জ। প্রতিযোগিতাভেদে নিয়মেও কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। তবে সবগুলোর মূল বিষয় একই: সবচেয়ে কার্যকরী রোভার তৈরি করা।
অন-সাইট ছাড়াও রিমোট প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয় এই প্রতিযোগিতাগুলোতে। অর্থাৎ স্বাগতিক দেশে সরাসরি উপস্থিত না থেকেও অনলাইনে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করা যায়। তবে এক্ষেত্রে বাস্তবে রোভার তৈরি করতে হয় না, বরং একটি পূর্ণাঙ্গ রোভারের মডেল তৈরি করে সেটিকে ভিডিও সিমুলেশন করে দেখাতে হয়।
দলীয় অর্জন
তিনটি দলেরই শুরু হয়েছিল রোভার প্রতিযোগিতাগুলোকে কেন্দ্র করে। লক্ষ্য ছিল- শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক প্রযুক্তি প্রতিযোগিতাগুলোতে বাংলাদেশকে এগিয়ে নেওয়া। আর সেদিক থেকে সফলও তারা, যে কারণে রোভার প্রতিযোগিতাগুলোতে এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের নাম থাকে সেরা দুইয়ের মধ্যেই।
এদের মধ্যে সবচেয়ে পুরনো বুয়েটের 'টিম ইন্টারপ্লানেটার'। ২০১৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়া দলটি প্রথম দিকে নাসার হিউম্যান এক্সপ্লোরেশন চ্যালেঞ্জ, লুনাবটিক্স প্রতিযোগিতা এবং স্পেস অ্যাপ চ্যালেঞ্জের দিকে আগ্রহী হলেও পরবর্তীতে দলটির মনোযোগ ঘুরে যায় রোভার চ্যালেঞ্জগুলোর দিকে। ২০১৫ সাল থেকেই নিয়মিতভাবে রোভার প্রতিযোগিতাগুলোতে অংশগ্রহণ করে আসছে তারা। তবে তাদের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অর্জন ২০২১ সালের ইন্টারন্যাশনাল প্ল্যানেটারি এরিয়াল সিস্টেমস চ্যালেঞ্জে, যেখানে তারা তাদের ড্রোন নির্ভীকের ডিজাইনের জন্য জিতে নেয় ইনোভেশন অ্যাওয়ার্ড।
এদিকে আইইউটিতে মার্স রোভার দলগুলোর কার্যক্রম শুরু হয়েছিল ২০১৫ সালে, অনির্বাণের হাত ধরে। এর এক বছর পরেই একই ক্যাম্পাসে টিম অভিযাত্রিক নামে আরেকটি দল কার্যক্রম শুরু করে। ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে দুটো দল একত্রিত হয়ে 'প্রজেক্ট আলতাইর' নামে কার্যক্রম শুরু করে। ইতোমধ্যেই তারা এ বছর ইন্টারন্যাশনাল রোভার ডিজাইন চ্যালেঞ্জে সারাবিশ্বে দশম হয়েছে, ইউরোপিয়ান রোভার চ্যালেঞ্জের প্রাথমিক বাছাইপর্বে পরেছে এশিয়ার দ্বিতীয় সেরার মুকুট।
তিনটি দলের মধ্যে সবচেয়ে নতুন ইউআইইউ-এর মার্স রোভার টিম (ইউএমআরটি)। ২০২১ সালে কোভিড-১৯ মহামারীর সময় প্রতিষ্ঠিত হওয়া এই দলটি ইউআরসিতে টানা দুইবার হয়েছে এশিয়ার সেরা। ২০২৩ সালের আনাতোলিয়ান রোভার চ্যালেঞ্জেও তারা সারাবিশ্বে অর্জন করেছে তৃতীয় স্থান।
প্রস্তুতি
অংশগ্রহণের প্রস্তুতি হিসেবে প্রায় এক বছর সময় নিয়ে কাজ করতে হয় প্রতিটি দলকে। প্রথমেই শুরু হয় দল গঠনের পালা। রোভার প্রতিযোগিতায় অভিজ্ঞদেরকে নেতৃত্বে রেখে বিভিন্ন উপ-দলে পুরো দলকে ভাগ করা হয়। দলগুলো নিজেদের সুবিধা অনুযায়ী একেকভাবে নিজেদেরকে ভাগ করে ফেলে। যেমন: বুয়েটের টিম ইন্টারপ্লানেটার ইলেকট্রিকাল, মেকানিকাল, সফটওয়্যার, সায়েন্স এবং নন-টেকনিকালসহ মোট পাঁচ উপ-দলে বিভক্ত; আবার প্রজেক্ট আলতাইরের টেকনিকাল আর নন-টেকনিকাল অংশে ৪টি করে মোট ৮টি উপ-দল রয়েছে।
কাজ শুরুর আগে প্রতিযোগিতার গাইডলাইন দেখে নেওয়া হয়। কোন কোন টাস্ক সম্পন্ন করতে হবে সে অনুযায়ী রোভারের ডিজাইনে কী কী অন্তর্ভুক্ত থাকবে তার একটি প্রাথমিক খসড়া করা হয়। একইসাথে চলে গবেষণার কাজও। পূর্ববর্তী প্রতিযোগিতার অন্য দলগুলো কী কী প্রযুক্তি ব্যবহার করেছে, কী কী আইডিয়ার প্রয়োগ ঘটিয়েছে তা বের করা হয়। একইসাথে নাসা বা ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সির মতো বাস্তব মহাকাশ যান প্রস্তুতকারীরা কীভাবে রোভার নিয়ে গবেষণা করছেন, সেগুলো নিয়েও আপডেটেড থাকেন সদস্যরা।
আইডিয়া ব্রেইনস্টর্মিংয়ের পর শুরু হয় কীভাবে টাস্কগুলো সমাধান করা হবে তা নিয়ে পরিকল্পনা। সব উপ-দলের অংশগ্রহণ ও সবার মতামতের ওপর ভিত্তি করে শুরু হয় ডিজাইনের কাজ। রোভারের টেকনিকাল ডিজাইনের পর একে সফটওয়্যারের মাধ্যমে সিমুলেশন করে দেখা হয় এটি পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করছে কিনা। পুরো প্রক্রিয়াতেই ANSYS, GAZEBO, OpenMap, SOLIDWORKS-এর মতো বিভিন্ন সফটওয়্যার ব্যবহার করা হয়।
সিমুলেশনে আশানুযায়ী ফলাফলের দেখা পেলে রোভার তৈরি বা ম্যানুফ্যাকচারিংয়ের কাজ শুরু হয়। ইউনিভার্সিটি রোভার চ্যালেঞ্জের নিয়মানুযায়ী কোন দলই তাদের মূল রোভার এবং এর আনুষঙ্গিক যন্ত্রাংশ (যেমন: রোভার মডিউল, অ্যান্টেনা, ব্যাটারি, ট্রান্সিভার) তৈরির জন্য ২২ হাজার ডলারের বেশি খরচ করতে পারবে না। ফলে কোথায় কীভাবে খরচ করা হবে, তার একটি পরিকল্পনা আগে থেকেই তৈরি করে রাখতে হয়।
একটি রোভার তৈরির ক্ষেত্রে এর অর্থায়ন সবসময়েই একটি চ্যালেঞ্জ থাকে। তবে সৌভাগ্যক্রমে তিনটি দলের পাশেই তাদের বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এবং অন্যান্য স্পন্সররা পাশে দাঁড়িয়েছে। তবে অর্থের পাশাপাশি আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ হলো সময়। বাংলাদেশে রোভার তৈরির সব ইকুইপমেন্টের সরবরাহ না থাকায় এর অনেকগুলোকেই বাইরে থেকে নিয়ে আসতে হয়, যেগুলো হাতে পৌঁছাতে সময় লেগে যায় বহুদিন। ফলে সময় আর অর্থের সাথে পাল্লা দিয়ে কাজ করা বেশ বড় একটা চ্যালেঞ্জ।
ম্যানুফ্যাকচারিং পর্যায়ে প্রতিটি অংশকে আলাদা-আলাদাভাবে তৈরি করে পরে একসাথে জোড়া দেওয়া হয়। দলের সদস্যরা নিজেরা গবেষণা করে বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগারেই অনেক কিছু উদ্ভাবন করেন। ইউআইইউ মার্স রোভার দলের আবিদ জানান, তারা তাদের রোভারে যে অটোনমাস সিস্টেমটি ব্যবহার করেন, তার সম্পূর্ণটিই তাদের তৈরি। ইমেজ প্রসেসিং, ডিপ ম্যাপিং, ডিপ লার্নিং এবং জিপিএস নেভিগেশনের সমন্বয়ে তৈরি এই অটোনোমাস সিস্টেমের মাধ্যমে রোভারটি কোনো কন্ট্রোলার ছাড়াই নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারে এবং ছবি শণাক্ত করতে পারে।
সমস্ত পার্টস তৈরি এবং সেগুলোকে অ্যাসেম্বল করার পর শুরু হয় টেস্টিং। যেহেতু মূল প্রতিযোগিতা অনেকটা মঙ্গলের পরিবেশের আদলে হয় এবং বাংলাদেশে সে ধরনের পরিবেশ নেই, তাই এখানে যে ধরনের সুযোগ-সুবিধা রয়েছে, তার ওপর ভিত্তি করেই টেস্টিং এর কাজ শুরু হয়।
আবিদ জানান, রোভারের আর্মের মাধ্যমে যে কাজগুলো করতে হয়, তা টেস্ট করার জন্য ইউআইইউ মার্স রোভার দল নিজেরাই একটি রেপ্লিকা মক ল্যান্ডার তৈরি করে নিয়েছে। অটোনমাস নেভিগেশন ধাপের জন্য ক্যাম্পাসের মাঠে রোভারকে জিপিএস লোকেশন দিয়ে পরীক্ষা করা হয়। অন্যদিকে, বুয়েটের ইমতিয়াজ জানান, তারা কনস্ট্রাকশন সাইট বা যেখানে উঁচু-নিচু রাস্তা বা খাদ আছে, সেখানে গিয়ে রোভারকে পরীক্ষা করে দেখেন।
রোভারের যন্ত্রাংশ
রোভারের পার্টসগুলোকে মোটাদাগে পাঁচভাগে ভাগ করা যায়। এগুলো হলো: মুভিং পার্টস, পাওয়ার সাপ্লাই, সেন্সর, অপারেশনাল সিস্টেম বা সফটওয়্যার এবং কমিউনিকেশন সিস্টেম। এর অনেকগুলো অংশেই দলগুলো নিজেদের উদ্ভাবিত পার্টস ব্যবহার করে থাকে।
মুভিং পার্টসের মধ্যে রয়েছে রোভারের চাকা, ক্যামেরা, ইলেকট্রিক প্যানেল এবং আর্ম। বুয়েটের টিম ইন্টারপ্লানেটারের রোভারের চাকা বেশ আলাদা, যেগুলো তারা নিজেরাই নিজেদের ল্যাবে তৈরি করেছে। ইউআইইউয়ের রোভার দলও নিজেদের চাকা থ্রিডি প্রিন্টারের মাধ্যমে তৈরি করে নিয়েছে। এছাড়াও সায়েন্স মিশনের জন্য রয়েছে রামান স্পেক্ট্রোফটোমিটার। এর মাধ্যমে পাথর শণাক্ত করে সে অঞ্চলে জীবনের অস্তিত্ব আছে কিনা তা বলে দেওয়া যায়।
অন্যদিকে, প্রজেক্ট আলতাইরের রোভারে রয়েছে ডিপ স্যাম্পলিং মডিউল, যার মাধ্যমে ২০০ মিলিমিটার গভীরতা পর্যন্ত মাটি উত্তোলন করে একে সংরক্ষণ করতে পারে।
রোভারগুলোকে চালানোর জন্য পাওয়ার সাপ্লাই হিসেবে ব্যবহৃত হয় লিথিয়াম-পলিমার (লিপো) অথবা লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারি। অন্যদিকে যোগাযোগের জন্য রকেট অ্যান্টেনা, রেডিও কমিউনিকেশন মডিউলের মতো যন্ত্র ব্যবহার করা হয়। আবিদ জানান, তাদের রোভারের কমিউনিকেশন মডিউলের মাধ্যমে কন্ট্রোলার থেকে ২০ কিলোমিটার দূর পর্যন্ত রোভারটিকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
মঙ্গলের পরিবেশের তাপমাত্রা থেকে শুরু করে অবস্থান বোঝার জন্য বিভিন্ন সেন্সর ব্যবহার করা হয়। প্রতিযোগিতার মিশনগুলো সম্পন্ন করার জন্য প্রয়োজনীয় সেন্সরগুলোও রোভারে বসানো হয়। আর এর সবকিছু নিয়ন্ত্রণের জন্য অপারেশনাল সিস্টেম বা সফটওয়্যারও অনেকক্ষেত্রে নিজেরা তৈরি করে নেয় দলগুলো।
প্রতিযোগিতার কার্যক্রম
রোভার তৈরি চলাকালীনই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের কার্যক্রম শুরু হয়ে যায়। মূল প্রতিযোগিতার প্রায় আট মাস আগে দলগুলোকে রেজিস্ট্রেশন করতে হয়। রেজিস্ট্রেশনের পর এক থেকে দেড় মাস সময় পাওয়া যায় প্রাথমিক ডিজাইন রিপোর্ট জমা দেওয়ার জন্য। এখানে দলের সদস্য সংখ্যা, দলের গঠন, প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্ট পরিকল্পনা, প্রাথমিক বাজেট, বাজেটের অর্থায়নের পরিকল্পনা উল্লেখ করতে হয়। অন্যদিকে টেকনিকাল বিষয়ের মধ্যে রোভারের ডিজাইন, ডেভেলপমেন্ট এবং প্রোটোটাইপিংয়ের অবস্থা জানাতে হয়।
প্রতিযোগিতার তিন মাস আগে সিস্টেম অ্যাকসেপ্টেন্স রিভিউ জমা দিতে হয়। এর মধ্যেই রোভারের আনুষঙ্গিক কাজ শেষ করে ফেলা জরুরি। কারণ এর ওপরেই নির্ভর করছে অন-সাইট প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের সুযোগ।
রোভারটি নির্ধারিত মিশন টাস্ক অনুযায়ী কাজ করতে পারছে কিনা সেটিই সিস্টেম অ্যাকসেপ্টেন্স রিভিউয়ে লিখিতভাবে এবং ভিডিও আকারে জমা দেওয়া হয়। একইসাথে পুরো সিস্টেমের ডিজাইন এবং শেষ মুহূর্তে আরও কী কী পরিবর্তন আনা হতে পারে তা-ও উল্লেখ করতে হয়। ভিডিও এবং লিখিত রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে সবচেয়ে বেশি পয়েন্ট পাওয়া নির্দিষ্ট দলগুলোকে ডাকা হয় প্রতিযোগিতার মঞ্চে। ২০২৩ সালের জুন মাসে হয়ে যাওয়া ইউনিভার্সিটি রোভার চ্যালেঞ্জে প্রথম ৩৬টি দল অংশগ্রহণের সুযোগ পেয়েছিল।
অন-সাইট অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে লজিস্টিকস এবং যাতায়াত বেশ বড় একটি বিষয়। যাতায়াত এবং আবাসনের জন্য দলগুলোর অর্থের প্রয়োজন হয়ে পড়ে। এজন্য তাদেরকে স্পন্সরদের সাথে যোগাযোগ করা থেকে শুরু করে ভিসা অ্যারেঞ্জমেন্ট পর্যন্ত নানা কাজ করতে হয়।
প্রতিযোগিতায় যাওয়ার আগে আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ হলো রোভার পরিবহন। রোভার পরিবহনের জন্য একে বিভিন্ন অংশে ভাগ করে দলের সদস্যদের লাগেজে দিয়ে দেওয়া হয়। টিম ইন্টারপ্লানেটারের ইমতিয়াজ জানান, "বিমানবন্দরে কাস্টমসে এ যন্ত্রাংশগুলো পরিবহনের সময় বেশ ঝামেলা পোহাতে হয়। যেহেতু রোভারের যন্ত্রাংশগুলো ইলেক্ট্রিকাল, তাই এগুলো নিয়ে প্রশ্ন করা হয়। একবার পোল্যান্ডে ইউরোপিয়ান রোভার চ্যালেঞ্জে অংশগ্রহণের সময় একটি যন্ত্রাংশকে অস্ত্র ভেবে সেটিকে আটকিয়ে রাখা হয়েছিল।"
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
পরবর্তী প্রজন্মকে রোবটিক্স, মহাকাশবিজ্ঞানে আগ্রহী করার জন্য স্কুল-কলেজে প্রতি বছরেই ওয়ার্কশপ-সেমিনারের আয়োজন করে দলগুলো, ল্যাবে আমন্ত্রণ জানায় স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদেরকে। বিভিন্ন বাণিজ্যিক এক্সপোতেও নিজেদের রোভারগুলোর প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করে তারা। নিজেদের সাফল্য ছড়িয়ে দেওয়ার পাশাপাশি উদ্দেশ্য থাকে অন্যদেরকেও এসব কাজে সহযোগিতার জন্য উদ্বুদ্ধ করা।
এদিকে দলগুলোর অ্যালামনাইরাও পেশাদার পর্যায় থেকে শুরু করে গবেষণা পর্যন্ত তাদের এই অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন। টিম ইন্টারপ্লানেটারের একজন সাবেক সদস্য নাসাতেই কাজ করছেন ইন্টার্ন হিসেবে, জড়িত আছেন একেবারে বাস্তব মার্স রোভার তৈরির সাথে।
তিনটি মার্স রোভার দলেরই উদ্দেশ্য তাদের ক্লাবগুলোর মাধ্যমে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের নামকে সবার সামনে নিয়ে যাওয়া। এশিয়ার দল হিসেবে ভালো ফলাফল করলেও ইউরোপ বা উত্তর আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সাথে প্রতিযোগিতায় টক্কর দেওয়া বেশ কঠিন। তবে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা আর ক্রমাগত প্রচেষ্টার মাধ্যমে সেটিও অর্জন করা সম্ভব বলে মনে করেন মুখপাত্ররা।
রোভার প্রতিযোগিতার পাশাপাশি এরিয়াল সিস্টেম বা ড্রোন তৈরির দিকেও মনোযোগী হচ্ছে ক্লাবগুলো। এদিকে টিম ইন্টারপ্লানেটারের তালিকায় হিউম্যানয়েড রোবট তৈরির পরিকল্পনাও রয়েছে বলে জানান ইমতিয়াজ।
বিশ্ববিদ্যালয়ের রোবটিক্স ক্লাবগুলোর হাত ধরেই বাংলাদেশের রোবটিক্স খাত আরও এগিয়ে যাবে, দেশের মাটিতেই শুরু হবে রোবট বিপ্লব; এই আশা আর স্বপ্ন নিয়েই এগিয়ে যাচ্ছে রোভার ক্লাবগুলো। কয়েক দশক পর মঙ্গলের লাল মাটিতে উড়বে বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকা, এই স্বপ্ন দেখতেও বাধা কোথায়?