নায়কদের বয়স বাড়ে, নায়কেরা বুড়ো হয়!
বিশ্বের অনেক দেশেই অবসরে যাওয়ার বয়স বাড়ানো নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। তবে সিনেমার জগতে অবসরে যাওয়াটা সম্পূর্ণ নিজের ইচ্ছার ওপর, এখানে কোনো ধরাবাঁধা নিয়ম নেই যে কখন আপনি অভিনয়ে ইস্তফা দেবেন। তবে সিনেমা শিল্পে এরই মধ্যে বয়স্ক অভিনেতাদের একটা আলাদা জনপ্রিয়তা তৈরি হয়ে গিয়েছে। জেমস ডিনের মতো তারকাদের ব্র্যান্ড নিউ অবতার থেকে শুরু করে আজ সিনেমাপ্রেমীদের সামনে রয়েছেন এমন সব অভিনেতারা, যাদের চেহারা ও শরীরে পড়েছে বার্ধক্যের ছাপ।
হিরোরা এখন আর যৌবনেই বীরত্বের সঙ্গে মৃত্যুবরণ করেন না; যে বয়সে তাদের পেনশন উপভোগ করার কথা কিংবা সমুদ্রের পাড়ে আয়েশ করার কথা, সেই বয়সে তারা বিপজ্জনক ভঙ্গিতে দেয়াল বেয়ে ওঠেন, ঝুলন্ত অবস্থায় লড়াই করেন এবং শত্রুকে পরাহত করেন। আধুনিক নায়কদের অভিনয়ের মেয়াদ ফুরোয় না, তাদেরকে সরিয়ে দেওয়াও সম্ভব নয়। কিন্তু তারা যদি কখনো অবসরে না যান, তাহলে আমাদের মতো বেচারা দর্শকদের কী হবে?
আর বুড়িয়ে যাওয়া নায়কদেরও 'হিরো' হয়ে ওঠার সর্বশেশ দৃষ্টান্ত দেখা গিয়েছে 'ইন্ডিয়ানা জোনস অ্যান্ড দ্য ডায়াল অব ডেস্টিনি' ছবিতে হ্যারিসন ফোর্ডকে, যিনি আর এই সিরিজের চলচ্চিত্রে অভিনয় করবেন না বলে জানিয়ে দিয়েছেন। ৮১ বছর বয়সী এই অভিনেতা একজন প্রত্নতাত্ত্বিকের চরিত্রে অভিনয় করেছেন ইন্ডিয়ানা জোনস চলচ্চিত্রে। সিনেমার প্লটের একটি উপাদানই ছিল হ্যারিসন ফোর্ডের বয়স।
অন্যদিকে, সায়েন্স-ফিকশন ইউনিভার্সে, স্টার ট্রেক-এও সময় যেন খুবই ধীরগতিতে এগোচ্ছে। ১৯৮৭ সালে 'স্টার ট্রেক: দ্য নেক্সট জেনারেশনস' সিরিজের মধ্য দিয়ে ক্যাপ্টেন জ্য-লুক পিকার্ডের চরিত্রে অভিনয় শুরু করেন স্যার প্যাট্রিক স্টুয়ার্ট। এরপরে স্টার ট্রেকের আরও চারটি ছবিতে এবং সম্প্রতি 'স্টার ট্রেক: পিকার্ড' সিরিজেও তাকে দেখা গিয়েছে। ১৯৮৭ সালে স্টারফ্লিট ইউনিফর্ম গায়ে চাপিয়েছিলেন, আজ ৮৩ বছর বয়সেও এই ফিকশনাল চরিত্রে কাজ করে যাচ্ছেন স্টুয়ার্ট। ইতোমধ্যেই তার ঝুলিতে রয়েছে ২০০ এপিসোড এবং চারটি সিনেমা।
অন্যদিকে, 'এক্স-মেন' চলচ্চিত্র সিরিজে জেভিয়ার চরিত্রটি প্যাট্রিক স্টুয়ার্টের আরও একটি বিখ্যাত চরিত্র এবং ২০২২ সালে সর্বশেষ যখন এই চরিত্রে দেখা গেছে তাকে, তখন তার বয়স ছিল ৮১ বছর। একজন ব্রিটিশ অভিনেতা হিসেবে নিঃসন্দেহে এ এক অদ্ভুত ভাগ্য যে ক্যারিয়ারে এত দীর্ঘকাল টিকে আছেন তিনি।
তবে ট্রেকি ইউনিভার্সে শুধুমাত্র স্টুয়ার্টই অনন্য উদাহরণ নয়। তার পূর্বসূরি, ক্যাপ্টেনদের ক্যাপ্টেন জেমস টি. কার্ক (উইলিয়াম শাটনার অভিনীত) ওষুধের বাক্স এবং ব্লাড প্রেশার মনিটর সঙ্গে নিয়ে ঘুরার মতো বুড়ো হওয়ার আগপর্যন্ত তার অ্যাডভেঞ্চার অব্যহত রেখেছিলেন। উইলিয়াম শাটনারের ক্যাপ্টেন কার্ক চরিত্র এতটাই ধারাবাহিক ও অটল ছিল যে শুধু কার্ক হিসেবে থেকেই সন্তুষ্ট ছিল না। শাটনার এই চরিত্র থেকে নিজেকে সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছেন।
৭৩ বছর বয়সে তিনি 'বোস্টন লিগ্যাল'-এ, ৭৯ বছর বয়সে একটি সিটকমে গোমড়ামুখো-অশীতিপর বৃদ্ধের চরিত্রে এবং ২০২১ সালে ৯০ বছর বয়সে একটি সেলফ-প্যারোডি কমেডিতে অভিনয় করেন। শেষোক্ত ছবিতে তিনি ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত এক মহাকাশচারীর চরিত্রে, যিনি গাড়ি দুর্ঘটনার শিকার হওয়ার পর নিভৃত জীবনকে বেছে নিয়েছেন। এমনকি সপ্তাহখানেক আগেও উইলিয়াম শাটনার স্টেজ শো'র জন্য ট্যুর করে বেড়াচ্ছিলেন এবং বুকিংও চালু ছিল।
উপরোক্ত তারকাদের কথা বিবেচনা করলে ৬১ বছর বয়সী টম ক্রুজকে টিনেজারই মনে হয়! শুধুমাত্র দৈনন্দিন রুটিনের কারণেই নয়, টম ক্রুজ সত্যিই এখনো অভিনয়ের জন্য কর্মক্ষমতা ধরে রেখেছেন। হয়তো ভিন্ন এক পৃথিবীতে টম একটু শান্ত-স্থির জীবনকেই বেছে নিতেন, কিন্তু গতবছর তিনি হাজির হন আরেক ধামাকা নিয়ে! 'টপ গান: ম্যাভেরিক' দিয়ে দুর্দান্তভাবে ফিরে আসেন, সিনেমা হলে উত্তাপ সৃষ্টি করেন! অন্যদিকে, গত মাসে মুক্তি পেয়েছে 'মিশন ইম্পসিবল-ডেড রিকনিং পার্ট ওয়ান', যেখানে ইথান হান্ট চরিত্রে আবারও দেখা দিয়েছেন টম। হ্যারিসন ফোর্ড বা স্টুয়ার্টের মানদণ্ডে তাকে বিচার করলে দেখা যায়, টম ক্রুজ আরও বছর দশেক এই লম্ফঝম্প, শ্যুটিং, মেয়েদের সাথে রোমান্স করার ধারা বজায় রাখতে পারবেন। (যদিও টমের বয়স ৬১, কিন্তু পর্দায় অভিনেত্রীদের বয়স সবসময় বিশের কোঠায় বলেই মনে হয়)।
সিনেমা জগতে সক্রিয় 'সিনিয়র সিটিজেন'দের মধ্যে আরেকজনের নাম বলা যায়; তিনি আর্নল্ড শোয়ার্জনেগার। সম্প্রতি নেটফ্লিক্সের একটি ডকুসিরিজে তাকে দেখা গিয়েছে, আবার একইসঙ্গে 'ফুবার' নামক একটি টিভি সিরিজে সিআই এজেন্টের চরিত্রে অভিনয় করছেন তিনি। এই সেলফ-প্যারোডি কি সচেতনভাবে নাকি অনিচ্ছাকৃত তা বোঝা যায়নি, কিন্তু ফ্যাক্ট হচ্ছে ৭৬ বছর বয়সী টার্মিনেটর অভিনেতা এখনও এক নিমিষে ২৫ বছর বয়সী কাউকে কাবু করে ফেলতে পারবেন। এরকম রেকর্ড ভাঙার মতো আরেকটি উদাহরণ হলো, সিলভেস্টার স্ট্যালন ২০১৯ সালে যখন জন র্যা ম্বো চরিত্রে অভিনয় করেন, তার বয়স ছিল ৭৬ বছর।
অ্যাকশন হিরোদের এই দীর্ঘ মেয়াদে সিনেমার পর্দায় টিকে থাকার পেছনের কারণটা সম্পূর্ণ বাণিজ্যিক, কারণ সবাই যেসবের সুপারহিরো না অ্যাকশন চরিত্রের সঙ্গে পরিচিত সেটিকেই পুঁজি করা হয়। কিন্তু প্রতিটি সাংস্কৃতিক প্রপঞ্চ সমাজকে প্রভাবিত করে: সিনেমায় এই পরিবর্তন এমন একটা সময়ে এসেছে যখন থিংক ট্যাংক এবং সংস্কৃতি, উভয় ক্ষেত্রেই বার্ধক্যের প্রতিফলন চোখে পড়ছে। হয়তো অন্য কোনো সময়ে হলে ধূসর চুল ও কুঁচকানো চামড়ার ইন্ডিয়ানা জোনস জনপ্রিয়তা পেত না।
বর্তমানে মধ্য ও উচ্চ আয়ের দেশগুলোতে- যেখানে শিশু জন্মহার কম, এবং জনসংখ্যার পিরামিড এখন উল্টে গেছে- সেখানে 'সিলভার ইকোনমি' ধারণার উত্থান ঘটছে। পণ্য ও পরিষেবা, দুটোই বয়স্ক জনগোষ্ঠী- যাদের ক্রয়ক্ষমতা বেশি, তাদের কথা মাথায় রেখে তৈরি করা হচ্ছে। অনেক সমাজই এখন বৃদ্ধদের কেন্দ্র করে তৈরি হচ্ছে, নার্সিং হোমকে মনে করা হচ্ছে বিনিয়োগের আকর্ষণীইয় ক্ষেত্র।
উদাহরণস্বরূপ, 'দ্য কমিনস্কি মেথড' সিরিজের কথা ভাবুন। চাক লরের এই কমেডি সিরিজে দুই বৃদ্ধ বন্ধুকে দেখানো হয়; তাদের শারীরিক অসুস্থতা আছে, বিপত্নীক এবং প্রোস্টেটে সমস্যা। এই বৃদ্ধরাই সিরিজের মূল চরিত্র এবং তাদের সমস্যাগুলোই স্টোরিলাইনের বিষয়বস্তু হয়ে উঠেছে। এখানে অবশ্য পুরুষদের বৃদ্ধ হয়ে ওঠার চিত্র উঠে এসেছে, কিন্তু তার মানে এই না যে নারীদেরকে তুলে ধরা হচ্ছে না। সেটার জন্যেও সিরিজ ও গল্পের অভাব নেই।
ইন্ডিয়ানা জোনসের সমকক্ষ কোনো নারী চরিত্র নেই বটে, কিন্তু জেন ফন্ডার মতো নিয়মিত অভিনেত্রী আছেন অনেকেই। ২০২২ সালে ৮৫ বছর বয়সে জেন ফন্ডার সর্বশেষ সিনেমা মুক্তি পায়। আবার জিন স্মার্ট ৭২ বছর বয়সে 'হ্যাকস'র মতো কমেডি সিরিজে অভিনয় করেছেন। এই সিরিজটি ১৯৫০ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত 'সানসেট বুলেভার্দ' সিনেমার কথা মনে করিয়ে দেয়, যেখানে প্রাক্তন অভিনেত্রি নর্মা ডেসমন্ডের চরিত্রে অভিনয়ের সময় গ্লোরিয়া সোয়ানের বয়স ছিল ৫১ বছর। কিন্তু বর্তমান মানদণ্ডে গ্লোরিয়া হয়তো এখনও হাইস্কুল সিরিজে অভিনয় করতে পারতেন... শিক্ষক চরিত্রে নয় কিন্তু!