৩৭ নম্বর র্যানকিন স্ট্রিট: ঢাকার প্রথম পরিকল্পিত শহর ওয়ারী আর এক ডা. নন্দীর বাড়ি
প্রতিদিনকার মতো সেদিনও সময়মতোই রিকশা নিয়ে সুলতান হাজির ৩৭ নম্বর র্যানকিন স্ট্রিটের বাড়ির সদর দরজায়। চুন-সুড়কির তৈরি বড় সে বাড়ি। দালানের পিছন দিকে দোতলায় ওঠার সিঁড়ি। লোহার গরাদ দেওয়া ঘরের জানালাগুলোও বিশাল। বড় রাস্তার দিকে খোলা বারান্দা। প্রবেশপথের দুইপাশে ছোট ছোট বাগান। ডান দিকে গাড়ির গ্যারেজ। পেছনে খোলা জমি, বিশাল এক আমগাছ সেখানে আর এক কদমগাছ। মূল বাড়িটার বাঁ দিকে একটি একতলা বাড়ি, যার ঘর মোটে তিনটি, তবে বড় বড়। রান্না আর খাবার ঘর হিসাবে ব্যবহৃত হয়। এক ফাঁকে সুলতান ঘণ্টা বাজিয়ে নিজের উপস্থিতি জানান দিল।
ডাক্তার সাহেব সময়নিষ্ঠ মানুষ। ঠিক সাড়ে ৭টায় বের হন। আজ যাচ্ছেন মওলা বখশ সরদারের মাকে দেখতে কাগজীটোলায়। এই তার নিত্য দিনের রুটিন। আউটকলে রোগী দেখে ফেরেন ১১টা নাগাদ। তারপর বাড়িতে ভিড় করা রোগী দেখতে লেগে যান। দুপুরে কিছু বিরতি নিয়ে আবার শুরু করেন, শেষ করতে রাত ১১টাও বেজে যায়। অন্য ডাক্তাররা তখন ২০টাকা ভিজিট নিলেও ডা. নন্দী ৫ টাকার বেশি নিতেন না। গেল শতকের পঞ্চাশ দশকের কথা।
ঢাকা শহরে অল্প মানুষই আছে, যারা ডাক্তার মন্মথনাথ নন্দীর কথা জানে না। ওয়ারীর লারমিনি স্ট্রিটের বাসিন্দা, এক সময় র্যানকিন স্টিটেও ছিলেন, সৈয়দ এহতেশাম-উল হকের বাবা মোহাম্মদ ফজলুল হক ছিলেন ভাষা সৈনিক। এহতেশাম বাবার কাছে শুনেছেন, ডাক্তার নন্দী ভালো ডাক্তার তো ছিলেনই, উপরন্তু মানবিক গুণাবলীসম্পন্ন মানুষ ছিলেন। তার পরিচিতি এতই ব্যাপক ছিল ডাক্তার নন্দীর বাড়ি যাবো বললে রিকশাওয়ালা ঠিক ঠিক পৌঁছে দিত।
মওলা বখশ সরদারের ছেলে ও ঢাকা কেন্দ্রের সভাপতি আজিম বখশ। ডা.নন্দীকে তিনি এক-দুবার দেখেছেন। শ্রীনগরে ভাগ্যকুলের জমিদারদের পৃষ্ঠপোষকতায় জনহিতকর কাজ করতেন নন্দী। চিকিৎসাবিদ্যা ছিল তার হাতিয়ার। শুরুটা সেই ঊনচল্লিশ সালে। তিনি কলকাতার কারমাইকেল মেডিকেল কলেজ থেকে চিকিৎসাবিদ্যা সম্পন্ন করে উচ্চশিক্ষার জন্য বিলেত যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তিনি ছিলেন ডাক্তার বিধান রায়ের প্রিয় ছাত্র। ভাগ্যকুলের জমিদাররা বিধান রায়ের কাছে একজন ডাক্তার চেয়ে পাঠিয়েছিলেন যার জনসেবার মন আছে। বিধান রায় নন্দীকেই বাছাই করলেন আর নন্দীও খুশি হলেন এই ভেবে যে, তার মনস্কামনা পূর্ণ হতে চলেছে। চিকিৎসাবিদ্যা তিনি আয়ত্ত্বে এনেছেন তো মানুষের সেবা করার জন্যই! এখন নিজ থেকেই সে সুযোগ এসে ধরা দিল। তিনি সবকিছু গুছিয়ে ভাগ্যকুল চলে এলেন। জমিদারদের একটা বাড়িকে হাসপাতালের মতো করে গড়ে তুললেন, সেখানে তিনি শল্যচিকিৎসাও দিতেন। তেতাল্লিশের মন্বন্তরের সময় ডা. নন্দীর খুব খাটুনি গিয়েছে। অভুক্ত মানুষগুলোর কাছে খাবার পৌঁছানো এবং খাবারের অভাবে যারা মরতে বসেছিল তাদের স্বাস্থ্য ফিরিয়ে আনার কাজে দিনরাত পরিশ্রম করেছেন।
ডা. নন্দী গয়না নৌকায় করে ভাগ্যকূল থেকে ঢাকা আসতেন। এখন সদরঘাটের যেটা ভিআইপি জেটি সেটিই ছিল গয়নাঘাট। আজিম বখশ তেমনই কোনোদিনে গয়নাঘাটে দেখেছিলেন ডা. নন্দীকে। পাতলামতো সুন্দর মাঝারি গড়নের মানুষ ছিলেন ডাক্তার সাহেব। আজিম বখশ বললেন, "একজন আদর্শ মানুষের সব গুণাবলী ছিল তার মধ্যে। কথা বলতেন, ঢাকাইয়া, মানিকগঞ্জ ও বিক্রমপুরের ভাষা মিশিয়ে। ইংরেজিও বলতেন। বস্তুত যে রোগী যেমন ভাষা বুঝতে পারে তার সঙ্গে সে ভাষাতেই কথা বলতেন।"
ডা. নন্দীর পিতার নাম মথুরনাথ নন্দী। তিনি পুলিশের চাকরি করতেন। বাড়ি মানিকগঞ্জ। তবে বদলির চাকরিসূত্রে নানান জায়গায় ঘুরে বেড়াতে হতো। ১৯১০ সালে মথুরনাথের জেষ্ঠ্য পুত্র মন্মথনাথের জন্ম হয় মানিকগঞ্জে। মন্মথনাথ ১৯৩৫ সালে ডাক্তার হয়ে ভূমিকম্পে বিধ্বস্ত বিহারে স্বেচ্ছাসেবক হিসাবে কাজ করতে চলে যান। ফিরে এসে কারমাইকেল মেডিকেল কলেজেই সার্জন হিসাবে যোগ দেন। তারপর ভাগ্যকূলে চলে এসেছিলেন স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে পাশ করা আধুনিকা স্ত্রী শান্তি নন্দী ও যমজ পুত্র-কন্যা নিয়ে।
মির্জা আ. কাদের সরদারের ভাস্তে নাট্যব্যক্তিত্ব সাঈদ আহমদ তার ঢাকা আমার ঢাকা গ্রন্থে লিখেছেন, "এরপর এলো মানচিত্র বদলের পালা। পূর্ব বাংলা পূর্ব পাকিস্তানে পরিণত হলো। অনেক হিন্দু পশ্চিমবঙ্গে পাড়ি জমালো কিন্তু ডা. নন্দী জন্মভূমির মাটি আঁকড়ে রইলেন।" দেশভাগ হয়ে যাওয়ার পর তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিযুক্তি পান। যুগীনগরের এক বাড়িতে এসে ওঠেন।
১৯৫০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে দাঙ্গা বাঁধে। ঠাটারিবাজারে লাগে আগুন যার শিখা দেখা যাচ্ছিল যুগীনগর থেকেও। প্রাণভয়ে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠির অনেকেই ডা. নন্দীর বাড়িতে এসে আশ্রয় নেন। যেহেতু তিনি জনপ্রিয় চিকিৎসক এবং সমাজে তার গ্রহণযোগ্যতাও আছে তাই বাড়িটা তাদের কাছে নিরাপদ ভাবা ছিল স্বাভাবিক। তখন সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন ডা. নন্দীর বাল্যবন্ধু ও কলকাতা মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের ক্যাপ্টেন খ্যাতনামা ব্যক্তিত্ব আব্বাস মীর্জা এবং ঢাকার পুলিশ কমিশনার জনাব ইত্তেজা।
দাঙ্গার পর পর ডা. নন্দী চলে এসেছিলেন ওয়ারীর ৩৭ নম্বর র্যানকিন স্ট্রিটে। তার জ্ঞাতিভাই রাজনীতিক ভবেশ চন্দ্র নন্দী আগে থাকতেন বাড়িটায়। ১৯৫৩ বা ৫৪ সালে বাড়িটা ডা. নন্দী কিনে নেন। যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী কবি সালেহা চৌধুরী, ডা. নন্দীর কন্যা মন্দিরা নন্দীর বন্ধু ছিলেন। তার স্মৃতিচারণা থেকে জানা যাচ্ছে, মন্দিরাদের পাশের বাড়ি ৩৮ নম্বর র্যানকিন স্ট্রিট মানে ধল্লা হাউজে থাকতেন তারা। ধল্লার জমিদারের বাড়ি ছিল সেটি। সম্প্রতি গিয়ে দেখা গেছে, ধল্লা হাউজ এখনো আদি অবস্থায় টিকে আছে। লাল ইটের তৈরি মোগল ও ব্রিটিশ নকশার মিশেলে তৈরি সে বাড়ি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলের কথা মনে করিয়ে দেয়। ষাটের দশকে পাকিস্তান সরকার এ বাড়িকে টেক্সট বুক ভবন হিসাবে ব্যবহার করতে শুরু করে। সালেহা ও মন্দিরা রিকশায় চড়ে হলিক্রস কলেজে যেতেন। ভাড়া ছিল ১ টাকা। ফিরতেন মন্দিরার বাবার গাড়িতে করে। ডা. নন্দীর একটা সেকেন্ডহ্যান্ড ফোর্ড প্রিফেক্ট ছিল, পরে নতুন একটা ফোর্ড প্রিফেক্ট কিনেছিলেন, শেষ গাড়িটা ছিল হিলম্যান।
এবার ঢাকার প্রথম পরিকল্পিত শহর ওয়ারীর ইতিহাস নিয়ে কিছু বলার সময় হলো। ব্রিটিশ সরকার ১৮৮০ সালে সরকারি কর্মকর্তাদের কথা ভেবে ৭০১ একর জায়গা অধিগ্রহণ করেন ওয়ারীতে। প্রতিটি প্লটের জন্য জমি নির্ধারিত হয় ১ বিঘা। উত্তর দক্ষিণে রাস্তা ভাগ করা হয় যেগুলো ভেদ করে পূর্ব থেকে পশ্চিমগামী রাস্তা। প্রতিটি রাস্তা ৩০ ফুট প্রশস্ত ছিল। জমি বরাদ্দ দেওয়ার সময় সরকার শর্ত দেয়, তিন বছরের মধ্যে পাকা বাড়ি তুলতে হবে। ১৮৮৪ সাল থেকে পরের পাঁচ বছরেই পরিকল্পিত এক নগরী হিসাবে গড়ে উঠেছিল ওয়ারী। ঢাকার ইংরেজ কর্মকর্তাদের নামানুসারে এর স্ট্রিটগুলোর নাম রাখা হয় যেমন র্যানকিন স্ট্রিট, লারমিনি স্ট্রিট, ওয়্যার স্ট্রিট বা হেয়ার স্ট্রিট। ইতিহাস গবেষক হাশেম সূফী বললেন, "অনেকে ধারণা করেন ঢাকার ম্যাজিস্ট্রেট ওয়্যারের নাম থেকে ওয়ারী নাম হয়েছে, আসলে কিন্তু তা নয়। ওয়ারী একটি ফার্সি শব্দ যার অর্থ বড় তাঁবু। মোগল আমলে এখানে সেনানিবাস ছিল। বড় বড় তাঁবুতেই মোগল সেনারা বসবাস করত। নামটি সেখান থেকেই এসেছে।"
বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে এটি অভিজাত এলাকা হয়ে ওঠে। আজিম বখশ একটি খাবারের প্রসঙ্গ টেনে আভিজাত্যের ব্যাপারটি আরও পরিস্কার করেন, "ওয়ারীর মতো পরিচ্ছন্ন, ঝকঝকে এলাকা ঢাকায় আর দ্বিতীয়টি ছিল না। বাড়িগুলো ছিল দোতলা, একতলা। প্রায় সব বাড়ি বড় জায়গা জুড়ে ছিল। রুচিশীল, শিক্ষিত লোকেরা বাস করত ওয়ারীতে। তাদের কেউ অধ্যাপক, কেউবা বিচারপতি অথবা সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। পাউরুটি দিয়ে নাস্তা করতেন তারা।"
"ঢাকার প্রথম বেকারি ছিল আবেদ অ্যান্ড কোম্পানি। ঢাকার প্রথম ডেকরেটরও তারা। বেকারির প্রধান কারিগর ছিলেন পিঞ্চু মিস্ত্রী। টুকরিতে পাউরুটি সাজিয়ে ভালো করে ঢেকে নিয়ে আবেদ কোম্পানির ডেলিভারিম্যানরা যেতেন ওয়ারীতে। বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দিতেন সাত সকালেই। তেমন একজন ডেলিভারিম্যানকে আমি চিনতাম, সূত্রাপুরে থাকতেন তিনি, নাম ছিল নওয়াব মিয়া। বছর কয় আগে তিনি মারা গেছেন," জানালেন তিনি।
সম্পাদক-সাংবাদিক আবুল হাসনাত স্মৃতিচারণায় লিখেছেন , 'কত খ্যাতিমান ও সমাজে প্রতিষ্ঠিত মানুষ জীবন অতিবাহিত করেছেন এ-এলাকায়। সরকারি আমলা, প্রতিষ্ঠিত ব্যবসাজীবী, চিকিৎসক, অধ্যাপক আর অনেক সাংবাদিকের বাসস্থান ছিল সেখানে। প্রতিটি গৃহে বৃক্ষ ও বাগানের পরিচর্যা ছিল। শহরের গণ্যমান্য ব্যক্তিরা সন্ধ্যায় মিলিত হতেন এখানে। সন্ধ্যা থেকে রাত অব্দি রবীন্দ্রনাথের গান শোনা যেত অনেক বাড়ির অন্দরমহল থেকে।'
আবুল হাসনাতের স্মৃতিচারণা থেকে আরো জানা যাচ্ছে, হেয়ার স্ট্রিটের ২ নম্বর বাড়িটায় শিল্পী কামরুল হাসান, শিল্পী সফিউদ্দিন আহমেদ ও সাংবাদিক জহুর হোসেন চৌধুরী থাকতেন। র্যানকিন স্ট্রিটে থাকতেন অ্যাডভোকেট সবিতা রঞ্জন পাল, রাজনীতিবিদ শুধাংশু শেখর হালদার, বিচারপতি দেবেশ ভট্টাচার্য প্রমুখ। লারমিনি স্ট্রিটে চল্লিশের দশকে ছিলেন অমর্ত্য সেনরা।
পঞ্চাশের দশকে ডা. নন্দীর বাড়িটি সংস্কৃতি চর্চার কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল। নাচ, গান, নাটকের মহড়া চলত। তার মেয়ে মন্দিরা বুলবুল ললিতকলা একাডেমিতে নাচ শিখতো। রবীন্দ্রনাথের শ্যামা নাটকের নাম ভূমিকায় অভিনয় করেছিল। সাংবাদিক ফয়েজ আহমদ ছিলেন পরিবারের একজন সদস্যের মতো। অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, অজিত কুমার গুহের যাতায়াত ছিল ৩৭ নম্বর র্যানকিন স্ট্রিটে। খোকা রায়, নেপাল নাগ, মোহাম্মদ তোহার মতো নিষিদ্ধ কমিউনিস্ট পার্টির নেতারাও পরামর্শ বা আশ্রয়ের জন্য আসতেন সে বাড়িতে। মওলানা ভাসানীর কাগমারি সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন ডা. নন্দী। তিনি ছিলেন শের-ই-বাংলা ফজলুল হকের ব্যক্তিগত চিকিৎসক। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গেও তার ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়েছিল।
হেয়ার রোডের বর্তমান বাসিন্দা মীর মাহবুবুর রহমানের দেখা পেয়েছিলাম ৩৭ নম্বর বাড়িটার শেষ মাথায়। তিনি বললেন, "যখন ডা. নন্দী দেশত্যাগ করেন, আমার বয়স তখন পাঁচ কি ছয়। আমার তেমন কোনো স্মৃতি নেই তাকে নিয়ে। তবে শুনেছি তিনি আমার বাবার যক্ষ্মা সারিয়েছিলেন। সেসময় যক্ষ্মা হলে আর রক্ষা ছিল না।"
তিনি বলেন, "ডা. নন্দী বাবাকে একটা ঘরে দেড় বছর আলাদা করে রেখে চিকিৎসা চালিয়ে গিয়েছিলেন, বাবা এক সময় সুস্থও হয়ে উঠেছিলেন। মানবদরদী, সমাজসেবক হিসেবেই তিনি বেশি পরিচিতি পেয়েছিলেন। লোকমুখে শুনেছি, একবার তার বাড়ির কাছে কেউ একজন কাশছিল, তিনি তৎক্ষণাৎ কাজের লোক পাঠিয়ে লোকটিকে চেম্বারে নিয়ে এসেছিলেন; বলেছিলেন, তোমার তো অসুখ আছে, চিকিৎসা লাগবে। এমনি সব জনশ্রুতি আছে তাকে নিয়ে।"
"বাড়িটা এখন দুই মালিকানায়। তবে দুই বাড়ির মাঝখানে মূল বাড়ির কিছু অংশ টিকে আছে," যোগ করেন তিনি।
ডা. নন্দী দেশত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন ১৯৬৫ সালে। ১৯৬৪ সালে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মোনায়েম খান আদমজী জুট মিলের অবাঙালি শ্রমিকদের দিয়ে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে দাঙ্গা বাঁধিয়েছিলেন। ডা. নন্দীর বাড়িও আক্রান্ত হয়েছিল। ফয়েজ আহমদ নিজে গিয়ে তাকে নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে যান। ডা. নন্দী তখন দুঃখ পেয়ে বলেছিলেন, "আমি তো হিন্দু মুসলমান চিনি না, আমার কাছে সকলেই মানুষ।"
পরে তিনি পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়িতে চলে যান। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে বঙ্গবন্ধু তাদেরকে ৩৭ নম্বর র্যানকিন স্ট্রিটের বাড়িতে ফিরিয়ে আনার জন্য উদ্যোগী হয়েছিলেন। বার্তা পাঠিয়েছিলেন এই বলে যে, দাদা-বউদি যেন ঢাকায় ফিরে নিজেদের বাড়িতে ওঠেন এবং প্র্যাকটিস শুরু করেন। কিন্তু ডা. নন্দীর তখন ষাট পেরিয়েছে। নতুন করে শুরু করার মন তার ছিল না। তার চার ছেলে মেয়ের সকলেই প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন। সাঈদ আহমদ লিখেছেন, 'আমরা বন্ধুরা দল বেঁধে মাঝে মধ্যে ওয়ারী যেতাম। তার (ডা. নন্দীর) দুই ছেলে, দুই মেয়ে। ভাস্কর, শেখর, ইন্দিরা ও মন্দিরা। তখন তারা কেউ কলেজে আবার কেউবা স্কুলের ওপরের শ্রেণিতে পড়ত। তাদের সঙ্গে খেলা করেছি। চারজনই আজ প্রতিষ্ঠিত। বড় ছেলে ভাস্কর নন্দী পশ্চিমবঙ্গের সিপিএমের (এমএল) একজন প্রভাবশালী নেতা, আর শেখর নন্দী ব্রিটিশ ইউনিভার্সিটি গ্র্যান্টস কমিশনের ইনচার্জ। মেয়েদের দুজন ইন্দিরা ও মন্দিরা মায়ের মতো শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত আছেন।'
মন্দিরা নন্দী (ভট্টাচার্য)মাঝেমধ্যে ঢাকায় এসেছেন। ২০১৭ সালে যখন এসেছিলেন তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে 'পঞ্চাশের দশকে ঢাকার সাংস্কৃতিক জীবন' নিয়ে একটি বক্তৃতাও দিয়েছিলেন। প্রথমা প্রকাশন থেকে তার লেখা 'ঢাকার স্মৃতি ও ডাক্তার নন্দী' নামে বই প্রকাশিত হয়েছে।
ইতিহাস গবেষক হাশেম সূফী বলেছিলেন, '৩৭ নম্বর র্যানকিন স্ট্রিটের বাড়িটা একটি ঐতিহাসিক বাড়ি। এটি প্রথমে ছিল ত্রিপুরা রাজার রেস্ট হাউজ। তারপর জনৈক দাশগুপ্তা (সম্ভবত ঢাকার তৎকালিন চিফ জাস্টিস কমলনাথ দাশগুপ্তা) ছিলেন বাড়িটায়। এই বাড়িকে সংগীতশিল্পী শচীন দেববর্মণের শ্বশুরবাড়িও বলা হয়েছে। তার স্ত্রী গীতিকার মীরা দেববর্মণের টাইটেল ছিল দাশগুপ্তা, আর তিনি নিজে ছিলেন ত্রিপুরা রাজপরিবারের সদস্য। তারপর থেকেছেন ডা. নন্দীর জ্ঞাতিভাই ভবেশ চন্দ্র নন্দী। তবে ডা. মন্মথনাথ নন্দীকেই বলা যায় বাড়িটার প্রধান চরিত্র, যিনি ঢাকায় ছিলেন সর্বজন নন্দিত।'