অনেকের শৈশব, তারুণ্য জড়ানো সালাম স্ট্যাম্প সেন্টার: ৬০ বছর পেরিয়ে...
সাতানব্বই সালের এক দুপুরবেলা। ছোটমোটো এক জাপানী ভদ্রলোক এলেন সালাম স্ট্যাম্প সেন্টারে। ভদ্রলোকের কাঁধের ব্যাগটিও প্রায় তার সমান। দোকান ঘুরে নিজের মতো করে দেখছিলেন। তবে ওষুধের দোকানে যেমন বিক্রেতার সহযোগিতা ছাড়া ক্রেতা যুৎ করতে পারে না স্ট্যাম্পের দোকান তার চেয়েও কঠিন। এখানে স্ট্যাম্পগুলো থাকে ফাইলবন্দি। ফাইলের গায়ে লেখা থাকে- ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য, বার্ডস, ১৯৬০, ব্রিটিশ আমল, ফার্স্ট ডে কভার ইত্যাদি। ক্রেতা তার চাহিদার কথা বললে দোকানি ফাইল বের করে নির্দিষ্ট স্ট্যাম্পটি খুঁজে দেন। শেষে জাপানিও দোকানির শরণাপন্ন হলেন। বললেন, স্ট্যাম্প লাগবে, এশিয়ান গেমস উপলক্ষে প্রকাশিত হাডুডু খেলার। দোকানি তুহিন বিন সালাম বললেন, চারটির সেট আছে, ভেঙে নেওয়া যাবে না। মানুষটি এবার নিজের পরিচয় দিলেন, আমি ইয়াতাকা সুকাওয়া, ১৯৮৬ সালে তোমাদের হাডুডু দলের কোচ ছিলাম, ১০০টি স্ট্যাম্প নিব।
পরিচয় পেয়ে তুহিন আপ্লুত হলেন। সাদরে বসার জায়গা করে দিলেন। কিছু ভাজাপোড়া খাবার আনিয়ে নিলেন, সুকাওয়া সেগুলো আগ্রহ করেই খেলেন। শেষে তুহিন তাকে বললেন, তুমি কি আমাকে তোমার দেশের কিছু টেলিফোন কার্ড পাঠাতে পারো?
সে আমলে টেলিফোন কার্ডের প্রচলন ছিল যেগুলোকে কলিং কার্ডও বলা হতো। ফোন বুথে কার্ডটি প্রবেশ করিয়ে দেশে-বিদেশে কথা বলা যেত। জাপান ছিল এ ব্যাপারে বেশ অগ্রসর। প্রতি সপ্তাহেই তারা নতুন নতুন আকর্ষনীয় ফোন কার্ড বাজারে আনত। তুহিনের প্রশ্ন শুনে সুকাওয়া আলগোছে জবাব দিলেন, আচ্ছা আমি চেষ্টা করব।
সুকাওয়ার বাক্স
দিন পনের পর তুহিন জিপিও থেকে ফোন পেলেন, জাপান থেকে আপনার জন্য একটি বাক্স এসেছে। তুহিন গিয়ে দেখলেন ৭-৮ কেজি হবে বাক্সের ওজন। ছাড়াতে ৭০০ টাকা মাশুল লেগেছিল। বাসায় এনে তুহিন গুনে দেখেছেন সাড়ে চার হাজার কার্ড পাঠিয়েছেন সুকাওয়া। তার পনের দিন পর আরেক চমক, আবার জিপিও থেকে ফোন, আরেকটি পার্সেল এসেছে। তুহিন গিয়ে দেখেন স্ট্যাম্প পাঠিয়েছেন জাপানি বন্ধুটি, কমপক্ষে ১০-১২ হাজার টাকা মূল্যমানের।
তেমন একটা বেশ সুখকর ঘটনা ঘটেছিল তার বাবা এমএ সালামের সঙ্গেও। ১৯৬৪-৬৫ সালের কথা। পুরানো ঢাকার এক জমিদারের নাতি খবর দিলেন, কাঠের সিন্দুক ভর্তি স্ট্যাম্প আছে তাদের বাড়িতে। সালাম এসে দেখে যেতে পারেন। সালাম গেলেন দেখতে, বিস্মিত হলেন পরিমাণ ও মান দেখে। কোম্পানি আমলের (১৭৫৭ থেকে ১৮৫৭ পর্যন্ত ভারতবর্ষ ছিল ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধীনে, ব্রিটেনে প্রথম ডাকটিকিটের প্রচলন ঘটে ১৮৪০ সালে এবং ভারত উপমহাদেশে ১৮৫৪ সালে) স্ট্যাম্প, স্টেশনারি, সাতচল্লিশ সালের ফার্স্ট ডে কভার আর খামও ছিল সিন্দুকের ভিতর। সালাম সাহেব বিনীতভাবে বললেন, আমার নিজের এগুলো কেনার সামর্থ্য নেই তবে বিক্রি করে দেবার ব্যবস্থা করতে পারব।
জমিদারের গুপ্তধন
দোকানে ফিরে জার্মান বন্ধু উইলিয়াম ড্রেককে খবর পাঠালেন তিনি। ড্রেক সঙ্গে নিয়ে এলেন আরো দুজনকে, তাদের একজন দেশভাগের সময়কার প্রভিশনাল ইস্যু সংগ্রহ করতেন। সালাম তাদেরকে জমিদারের সিন্দুকের কথা খুলে বললেন, তারপর সবাই মিলে একদিন দেখতে যাওয়ার তারিখ ঠিক করলেন। যেতে যেতে ড্রেক বললেন, সালাম তোমার কত কমিশন চাই? সালাম বললেন, তোমরা বন্ধু মানুষ, আমি কোনো কমিশন নিব না।
ড্রেকরা সেদিন ১৫০০০ টাকার স্ট্যাম্প, খাম কিনেছিলেন আর জমিদারের নাতিকে অনুরোধ জানিয়েছিলেন বাকী যা পড়ে থাকল সেগুলো সালামকে উপহার দিতে। অনুরোধ মেনে বেশ পরিমাণে স্ট্যাম্প-খাম উপহার দিলেন সালামকে। সেগুলোর মধ্যে কিছু ছিল মহামূল্যবান। সালাম প্রায় ২০ হাজার টাকা উপার্জন করেছিলেন জমিদারের ওই গুপ্তধন থেকে।
সঙ্গে আরো কিছু টাকা যোগ করে পরে মধ্য বাড্ডায় দুই বিঘা জমি কিনেছিলেন সালাম সাহেব যার দেড় বিঘাজুড়ে ছিল পুকুর। বাড়ি ভর্তি গাছ-পালাও ছিল অনেক। তুহিনের ছোটবেলা কেটেছে ওই বাড়ির প্রজাপতি আর পাখির পিছনে ছুটে ছুটে। বাহাত্তর সালে তুহিনের বয়স মোটে এক, তারা নারিন্দার দাদাবাড়ি থেকে চলে আসে বাড্ডায়। এমএ সালাম ছিলেন ভ্রমণপ্রিয়, মানবদরদীও বটে। তিনি রেড ক্রসসহ আরো কয়েকটি বিদেশী এনজিওতে স্বেচ্ছাসেবী ছিলেন। পড়তেন সদরঘাটের কাছে জুবিলী স্কুলে। এমএ সালাম হুট করেই বিয়ে করে ফেলেন ১৯৬১ সালে। তখন তার বয়স বিশের কিছু বেশি হবে। তুহিনের দাদা বললেন, বিয়ে তো করলে, সংসার চালাবে কিভাবে?
১৯৬২ সালে শুরু
এমএ সালাম (পরে যিনি হাজী সালাম নামে খ্যাতি লাভ করবেন) তখন ফার্মগেটে বিমান অফিসের কাছে ছোট্ট একটি বইয়ের দোকান দিলেন, নাম রাখলেন বুকস অ্যান্ড বুকস। সেখানে বইয়ের সঙ্গে ভিউকার্ড, ডাকটিকিট, খাম ইত্যাদিও রাখলেন। স্বেচ্ছাসেবী হওয়ার সুবাদেই ড্রেকের সঙ্গে তার পরিচয়। ড্রেকের মাধ্যমে বিদেশী বন্ধু পেয়েছিলেন আরো কিছু। তারা পরামর্শ দিলেন, শুধু ডাকটিকিটের দোকান করো। তাদের কথা মেনে ১৯৬২ সালে শুরু করেন সালাম স্ট্যাম্প সেন্টার। পূর্ব পাকিস্তানে তখন এমন দোকান আর একটিও ছিল না।
স্কুল-কলেজের ছেলেমেয়েদের অনেকেরই তখন ডাকটিকিট সংগ্রহের শখ ছিল। বিদেশী যারা থাকতেন তারাও সংগ্রহ করতেন, বনেদী পরিবারের সদস্যরাও সংগ্রহ করত। পাক আমলে তিন মাস আগেই ঘোষণা করা হতো কবে কোন ডাকটিকিট কবে প্রকাশ করা হবে। এমএ সালাম জিপিওতে গিয়ে প্রথম প্রকাশের দিনই সেগুলো সংগ্রহ করে আনতেন। বিদেশী বন্ধুরা বিদেশের ডাকটিকিট আনিয়ে দিত। এভাবে যা আয় হচ্ছিল তা দিয়ে ভালোই চলে যাচ্ছিল ।
দেশ স্বাধীন হলে হাজী সালাম বাড্ডায় নিজের বাড়ি করলেন। তখন গোটা বাড্ডায় হয়তো সবমিলিয়ে ২৫-৩০টি বাড়ি ছিল। গুলশান যেতে হতো গুদারা পার হয়ে। বাড়ির ছাদে উঠলে রামপুরার টিভি ভবনের পেছন দিকের জলাশয়ও নজরে আসত। বাড়িতে তখন কারেন্ট ছিল না। বিদ্যুৎ বোর্ডের পরিচিত একজনকে বলে বাড়িতে বিদ্যুৎ সংযোগ দিলেন হাজী সালাম। তারপর উঠল পোস্ট অফিসের কথা। কাছে পিঠে পোস্ট অফিস বলতে ওই গুলশানে। সেখানে যাওয়া-আসা সহজ ছিল না, বর্ষায় চিঠি-পত্র ভিজেও যেত। ডাক বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে সালাম সাহবের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল, তিনি তাদের বলে একটি পোস্ট অফিস বসালেন নিজের বাড়িতে যেটি এখনো তুহিনের ফ্ল্যাটবাড়ির নীচতলায় বর্তমান।
এক্সপার্ট কমিটি
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর পরই ডাকটিকিটের সংকট দেখা দিল যেটা দেশভাগের সময়ও ঘটেছিল অথচ চিঠি লেনদেন তো বন্ধ থাকতে পারে না। স্বাধীন বাংলাদেশের সরকার সিদ্ধান্ত নিল পাকিস্তান আমলের ডাকটিকিট দিয়েই চিঠিপত্র আদানপ্রদান করা যাবে তবে ডাকঘরগুলো রাবার স্ট্যাম্প বানিয়ে নিয়ে তাতে বাংলাদেশ নাম লেখা সিল দিয়ে দেবে (প্রভিশনাল ইস্যু)। বাংলাদেশ নিজের ডাকটিকিট যতদিন না বানিয়ে নেবে ততদিন বহাল থাকবে এই পদ্ধতি (স্বাধীন বাংলাদেশ ৩০ এপ্রিল ১৯৭৩ প্রথম ডাকটিকিট প্রকাশ করে)। কয়েক বছর পরে প্রভিশনাল ইস্যু সংগ্রহে রাখার জন্য সংগ্রাহকরা বলতে গেলে ঝাপিয়ে পড়ল। সুযোগটা নিল দুষ্টচক্র। সুকুমার মণ্ডল বলে একজনের নাম করলেন তুহিন যিনি নিজের মতো করে রাবার স্ট্যাম্প বানিয়ে নিয়েছিলেন। বিভিন্ন পোস্ট অফিসে গিয়ে নিজের ঠিকানায় অনেক চিঠি, পোস্টকার্ড পাঠাতে থাকেন আর সেগুলো চড়া মূল্যে সংগ্রাহকদের কাছে বিক্রি করতে থাকেন।
তখন বাংলাদেশ ফিলাটেলিক সোসাইটির তরফে একটি এক্সপার্ট কমিটি গঠন করা হয়েছিল। সালাম সাহেব যিনি ততদিনে হাজী সালাম নামে পরিচিত হয়ে উঠেছেন এবং তার মিতা আব্দুস সালাম ওরফে বিকম সালাম ছিলেন ওই কমিটিতে। হাজী সালামের একটি মোটর সাইকেল ছিল, তাতে করে দুজনে মিলে সারা দেশের প্রায় ১০০টি পোস্ট অফিসে গিয়ে রাবার স্ট্যাম্পের ছাপ সংগ্রহ করে আনেন। সেগুলোর সঙ্গে যেসব ছাপ মিলত সেগুলোয় সাক্ষর দিয়ে যথার্থতা সনদ দিতেন তারা, ফলে নকলগুলো চিহ্নিত করা সহজ হলো এবং সংগ্রাহকরা সেগুলো থেকে মুখ ফিরিয়ে নিল।
বয়স যখন সাত তখন থেকেই সালাম একজন সংগ্রাহক। দিন গেছে আর সংগ্রহ তার বেড়েছে। ১৮৪০ সালে প্রকাশিত ব্ল্যাক পেনি ও পেনি ব্লু তার সংগ্রহকে সমৃদ্ধ করেছিল। ভারতবর্ষে প্রকাশিত প্রথম ডাকটিকিটও ছিল তার সংগ্রহে। বাড্ডার বাড়িতে তিনি একটি মিনি মিউজিয়াম গড়ে তুলেছিলেন। ১৯৮২ ও ২০০৫ সালে তাঁর সংগ্রহ থেকেই দেশের প্রথম ও দ্বিতীয় একক ডাকটিকিট প্রদর্শনী আয়োজিত হয়েছিল। প্রথমটিতে সহযোগিতা দিয়েছিল বিএনপিএ এবং দ্বিতীয়টিতে পিএবি। ১৯৯১ সালে জাতিসংঘ ডাক সংস্থার ৪০তম বার্ষিকীতে পেনসিলভেনিয়ায় তিনি আমন্ত্রিত অতিথি ছিলেন ।
লার্জ সিলভার অ্যাওয়ার্ড
বাংলাদেশে সংগ্রাহকদের প্রথম সংগঠন বাংলাদেশ ন্যাশনাল ফিলাটেলিক অ্যাসোসিয়েশন বা বিএনপিএ'র প্রতিষ্ঠা ১৯৭৮ সালে। হাজী সালাম ছিলেন তার প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। তুহিন বলছিলেন, 'সেসময় সংগঠনের সদস্যসংখ্যা ৫০-৬০ জনের মতো ছিল। তারা একত্রিত হতেন জিপিও বা কোনো সংগ্রাহকের বাসায়। দ্বিতীয় যে সংগঠনটি গঠিত হয় তার নাম ফিলাটেলিস্টস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ বা পিএবি। তারও সভাপতি ছিলেন হাজী সালাম। দেশে এখন সব মিলিয়ে ৮-৯টি সংগঠন আছে। সবকয়টি মিলিয়ে গঠিত হয়েছে বাংলাদেশ ফিলাটেলিক ফেডারেশন (বিপিএফ)। ফেডারেশন ইন্টারন্যাশনালে ডি ফিলাটেলি বা এফআইপির সঙ্গে যৌথভাবে বিপিএফ দেশে প্রথমবারের মতো আয়োজন করেছে আন্তর্জাতিক ডাকটিকিট প্রদর্শনী যার শিরোনাম ছিল বাংলাদেশ ২০২৩। ঢাকার শিল্পকলা একাডেমিতে চার দিনব্যাপী এ প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয় ২৯ সেপ্টেম্বর থেকে ২ অক্টোবর ।' তুহিন এতে অ্যারোগ্রাম প্রদর্শন করেছেন, তার প্রদর্শনীর শিরোনাম ছিল, অ্যারোগ্রামস অব বাংলাদেশ। লার্জ সিলভার অ্যাওয়ার্ড জিতেছে তুহিনের অ্যারোগ্রাম।
তুহিনরা ৪ ভাই-বোন। সংগ্রহের শখ ছিল সবারই। তুহিন ছোটবেলায় সংগ্রহ করতেন ভিউ কার্ড ও বিয়ের দাওয়াত কার্ড। '৮৭-'৯০ সালে বাবাকে দোকানে সাহায্য করতেন বড় ভাই শামীম বিন সালাম। তিনি আমেরিকা চলে যাওয়ার পর মেঝ ভাই শাহীন বিন সালাম ছিলেন '৯৩ সাল পর্যন্ত। বড় ভাইয়ের বিয়ে হয় টেলিফোনে। চুরানব্বই সালে ভাইয়ের স্ত্রীকে পৌছে দিতে বাবা ও মা আমেরিকায় যান। তুহিন তখন সবে গ্রাজুয়েশন শেষ করেছেন। একদিন বাবা আমেরিকা থেকে ফোন করে বললেন, মাঝে মধ্যে দোকানে যেও। একটা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দীর্ঘদিন বন্ধ রাখা ভালো দেখায় না।
ভয় নাই, নো ভয়
তুহিন তারপর থেকে দুই-চার ঘণ্টার জন্য দোকান খুলতে শুরু করেন। একদিন এলেন বিআইডব্লিউটএর চিফ ইঞ্জিনিয়ার জনাব পারভেজ আলী আনোয়ার খান। তিনি তুহিনকে ভাই বলে সম্বোধন করলেন। অতো উঁচু পদের একজন মানুষের কাছ থেকে সম্মান পেয়ে তুহিনের ভালো লাগল। আরেকদিন এক বিদেশী ভদ্রলোক এসে প্রথমেই বললেন, 'আই অ্যাম ফ্রম কেজিবি।' তুহিন চমকে গেলেন, একটু ভয়ও পেলেন। লোকটি পরে বাংলায় বললেন, ভয় নাই, নো ভয়। আলাপ পরিচয় দীর্ঘ হলে তুহিন জানতে পারলেন, বাংলাদেশে রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত তিনি। তার সঙ্গে সম্পর্ক দিনে দিনে এতদূর গড়িয়ে ছিল যে ঢাকায় কোনো চাইনিজ রেস্টুরেন্ট খুললে তুহিনকে সেখানে খেতে নিয়ে যেতেন। তিনি সোভিয়েত আমলের বেশ কিছু কয়েন শুভেচ্ছাস্বরুপ উপহার দিয়েছিলেন তুহিনকে। দিনে দিনে সেগুলো জনপ্রিয় হয় এবং মুদ্রা সংগ্রাহকরা হাজার টাকা দিয়ে সংগ্রহ করতেও দ্বিধা করত না।
নব্বই দশকের শুরু থেকে ২০১০ পর্যন্ত সময়কালকে তুহিন ডাকটিকিট সংগ্রাহকদের স্বর্ণসময় বিবেচনা করেন। উননব্বই সালে দেশে সিকিউরিটি প্রিন্টিং প্রেস প্রতিষ্ঠিত হয়। নব্বইয়ের আগে পর্যন্ত তাই বাংলাদেশ ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড বা ভারত থেকে ডাকটিকিট ছাপিয়ে আনত। সেগুলোর নকশা যেমন ভালো ছিল ছাপার মানও ছিল উৎকৃষ্ট। হলরুমের মতো বড় পরিসর ছিল ফিলাটেলিক ব্যুরোর। নতুন ডাকটিকিট ইস্যু করার দিন সংগ্রাহক ও ডিলারদের আমন্ত্রণ জানানো হতো ব্যুরোতে। আপ্যায়নের ব্যবস্থা থাকত, কিছু পরিমাণে ডাকটিকিট ও খাম নামী সংগ্রাহক এবং ডিলারদের উপহার হিসাবেও দেয়া হতো। প্রতি বছর গড়ে ১৮-২০টি নতুন ডাকটিকিট ইস্যু করা হতো। তখন প্রমিনেন্ট ডিলার যারা যেমন সালাম স্ট্যাম্প সেন্টার, সুপ্রিম স্ট্যাম্প, প্যাসিফিক ও ঢাকা স্ট্যাম্প ক্লাব আগে থেকেই প্রয়োজনীয় পরিমাণে টিকিট, ফার্স্ট ডে কভার বুকিং দিয়ে রাখত এবং পেতে অসুবিধাও হতো না।
বাংলাদেশ পিছিয়ে পড়ল
২০১০ সালের পর থেকে পরিস্থিতি বদলাতে থাকে। চিঠি মারফত খবরাখবর আদান প্রদানের চল কমে যায়, কিন্তু সংগ্রাহকদের উৎসাহ বাড়তে থাকে। তাই পৃথিবীর অন্য দেশগুলো যেমন অস্ট্রিয়া, ফ্রান্স, ফিনল্যান্ড, জার্মানি সংগ্রাহকদের কথা ভেবেই নতুন নতুন চিত্তাকর্ষক ডাকটিকিট প্রকাশ করতে থাকে। স্টিলের, মখমলের, লেদারের ডাকটিকিটও প্রকাশ হলো। সংগ্রাহকরা সেগুলোর জন্য সহস্র টাকা ব্যয় করতেও পিছপা হলো না। গড়নেও নানান পরিবর্তন দেখা গেল যেমন বৃত্তাকার, ত্রিকোনাকার বা ষড়ভুজ আকৃতির। ফলে সংগ্রাহকদের কাছ থেকেই উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থ আয় করতে থাকল ডয়শে পোস্ট, স্পেন পোস্ট বা অস্ট্রিয়া পোস্ট। সময়ের চাহিদার প্রতি খেয়াল রেখে বিষয়বস্তুতেও তারা পরিবর্তন আনল। পরিবেশ সংরক্ষণ নিয়ে মানুষের আগ্রহ বাড়লে তারা বিলুপ্ত প্রায় পাখি বা পশুকে বিষয় করল, পোশাক-আশাকে আগ্রহ বাড়ায় ফ্যাশনকে করল বিষয় । খাবারও যে ভালো বিষয় হতে পারে তাও দেখা গেছে সাম্প্রতিককালে। এছাড়া ইতিহাস, ঐতিহ্য তো আগে থেকেই বিষয় ছিল, এখন সেগুলোর উপস্থাপনায় বৈচিত্র্য আনা হলো। বিশ্বের প্রায় সকল ডাকবিভাগ ডাকটিকিট প্রকাশকে বাণিজ্যিকভাবেই দেখে হাল আমলে। অথচ সত্তর- আশি দশকে এরকম মনোবৃত্তির জন্য ইউনিভার্সাল পোস্টাল ইউনিয়ন ভুটান, হাঙ্গেরি আর সিয়েরালিওনকে একরকম ব্ল্যাকলিস্টেড করেছিল। আজ কিন্তু সবাই সে পথ ধরেছে কেবল বাংলাদেশ ছাড়া।
বিশ্বজুড়ে ডাকবিভাগের আরেকটি জনপ্রিয় কার্যক্রম হলো পারসোনাল ডাকটিকিটি। 'আমি নিজে নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সদর দপ্তরের নিচে যে পোস্ট অফিস আছে সেখান থেকে পার্সোনাল টিকিট করিয়ে এনেছি। মালয়েশিয়ায় ডাক দপ্তরে যখন গিয়ে বললাম পার্সোনাল ডাকটিকিট করাতে চাই তারা আন্তরিকভাবে সকল সহযোগিতা করল। ফিনল্যান্ডের একটি ছোট্ট ডাকঘরে গিয়েছিলাম দুই-আড়াইশ ইউরোর টিকিট কেনার জন্য। কিন্তু তাদের আতিথেয়তা ও আন্তরিকতায় এতোটাই মুগ্ধ হলাম যে প্রায় আড়াই হাজার ইউরোর টিকিট কিনে বাড়ি ফিরেছি। তারা আমার বাচ্চাদের কথা মনে করিয়ে কিছু চকলেট সঙ্গে দিয়েও দিয়েছে। কিন্তু আমাদের জিপিওতে গেলে এখন এতিম, অসহায় বোধ করি। কর্মকর্তারা আমাদের উটকো ঝামেলা মনে করে। অথচ বেশিদিন আগের কথা নয়, নিয়মিত সংগ্রাহক ও ডিলারদের সঙ্গে কর্মকর্তাদের হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক ছিল।' বলছিলেন তুহিন।
সংগ্রাহক সংখ্যা পনেরশ'র বেশি
করোনার পর দেশে রিসেলারের সংখ্যা বেড়েছে অনেক। করোনাকালে যারা কাজ হারিয়েছে আর সঞ্চয় খুইয়েছে, তারাই এখন রিসেলার। পুরোনো সংগ্রাহক বা জিপিও অথবা ডিলারদের কাছ থেকে স্ট্যাম্প কিনে তারা পরে সংগ্রাহকদের কাছে দুই বা তিনগুণ দামে বিক্রি করে। সারাদেশে এখন সংগ্রাহক সংখ্যা পনের শতের বেশি হবে এবং রিসেলারের সংখ্যা হবে দুই থেকে আড়াইশ।'
সংগ্রাহক কয়েক রকমের হন। কিছু আছেন যারা নির্দিষ্ট বিষয়ের (থিমেটিক) ওপর সংগ্রহ বৃদ্ধি করে চলেন। সংগ্রহের ধারাবাহিকতা রক্ষা ও পরিমাণ বৃদ্ধির জন্য তারা সর্বস্ব ত্যাগ করতেও রাজি থাকেন। কিছু সংগ্রাহক আছেন যারা সব রকম ডাকটিকিট সংগ্রহ করেন। তাদের কাছে কোনো কিছুই ফেলনা নয়। কিছু সংগ্রাহকের আবার লক্ষ্য থাকে শুধু প্রদর্শনীতে অংশ নেওয়া। প্রদর্শনীর উপযোগী আকর্ষনীয় ডাকটিকিট তারা সংগ্রহ করে চলেন। বিশ্বের অনেক দেশই ডাকটিকিট প্রদর্শনীর আয়োজন করে যার অনেকগুলো আন্তর্জাতিক। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, ইসরায়েল, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, ম্যাকাও, ভারত, তাইওয়ান, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ফ্রান্স, বেলজিয়াম, জার্মানি, ইংল্যান্ড, আর যুক্তরাষ্ট্র ।
২০০৮—০৯ সালেও ইংল্যান্ড, আমেরিকা ও ভারতের ডিলারদের কাছে নিয়মিত ডাকটিকিট সরবরাহ করত সালাম স্ট্যাম্প সেন্টার। ওইসব ডিলাররা সেগুলো ছড়িয়ে দিত বিশ্বময়। কিন্তু নতুন ইস্যু হওয়া ডাকটিকিট সময়মতো ও পর্যাপ্ত পরিমাণে না পাওয়ার কারণে ২০১১ সাল থেকে সেটি বন্ধ হয়ে গেছে। নতুন স্ট্যাম্প মানে হলো কোনো দেশের নতুন ভাবমূর্তি। বিদেশের অনেক মানুষ বাংলাদেশকে চেনে শুধু স্ট্যাম্প দিয়েই। তাই স্ট্যাম্প যত সুন্দর হয় দেশের ভাবমূর্তি তত উজ্জ্বল হয়।
সংগ্রাহক সংখ্যা বৃদ্ধির পরও ডাক বিভাগ কেন পিছিয়ে? জানতে চাইলে তুহিন বললেন, 'কর্মকর্তারা কোনো আগ্রহ বোধ করেন না। তাদের উদাসীনতা আমাদের কষ্টের কারণ। পারসোনাল ডাকটিকিট তৈরির একটি মেশিন প্রায় ১০ বছর আগে আনা হয়েছিল, তৎকালীন মন্ত্রী মহোদয়কে দিয়ে উদ্বোধনও করানো হয়েছিল অথচ সংগ্রাহক বা ডিলাররা সেটা জানতেই পারেনি। এখন পড়ে থেকে নষ্ট হওয়ার উপক্রম। তারপর অড শেপের ডাকটিকিট তৈরির ডাইস আনা হয়েছিল যা দিয়ে কমপক্ষে ৬-৮টি আকৃতির ডাকটিকিট তৈরি করা যায়। কিন্তু বারকয় ব্যবহারের পর তা আর কাজে লাগানো হয়নি। বর্তমানে ফিলাটেলিক ব্যুরোর স্থান স্বল্পতাহেতু উদ্বোধনী খাম মেঝেতে স্তুপ করে রাখা ছাড়া উপায় নেই অথচ সংগ্রাহকদের কাছে এমন একটি খাম মানে একটি অমূল্য রতন।'
তুহিন তবু খুশি
তুহিন আরো যোগ করলেন, 'আমাদের একজন সংগ্রাহক আছেন তপন কুমার দাশ, অকৃতদার, হোমিও ডাক্তার, চুয়াডাঙা থাকেন, ৫১ বছর ধরে টিকিট সংগ্রহ করছেন এবং অড টিকিট সংগ্রহেই তার আগ্রহ বেশি, প্রায়ই বিদেশ থেকে তার জন্য টিকিট আনিয়ে দিই, দাম যেমনই হোক তিনি পিছপা হন না। শখের জন্য খরচ করতে কেউ পিছিয়ে থাকেন না কিন্তু শখের জিনিষটা মানসম্পন্ন না হলে মানুষ আগ্রহী হবে কেন? ২০১৮ সালের পর থেকে ডাকবিভাগ যত নতুন টিকিট ইস্যু করেছে তার অনেকগুলোই মানসম্পন্ন নয়। ফলে বিদেশীরা দুরস্থান দেশি সংগ্রাহকরাও নিতে আগ্রহ করেন না। আমাদের এখানে সম্প্রতি যে আন্তর্জাতিক ডাকটিকিট প্রদর্শনী হয়ে গেল তাতে বাংলাদেশ ডাকবিভাগেরও একটি স্টল ছিল কিন্তু প্রথম দুদিন সেখানে কাউকেই দেখা যায়নি। অথচ ভারত ও ফিজি পোস্ট এ উপলক্ষে স্যুভেনির শিট, খাম ও সিলমোহর প্রকাশ করেছে এবং ৫০০ টাকা করে বিক্রি করেছে। আমাদের ডাকবিভাগ একটি বিশেষ খাম এবং চারদিনে চারটি সিল প্রকাশ করেই দায় সেরেছে। এ থেকেই বোঝা যায় আমাদের ডাকবিভাগ ফিলাটেলিতে কতটা উদাসীন।
তুহিনের বাবা এম এ সালাম ওরফে হাজী সালাম স্ট্যাম্প বিজনেস করে সংসার চালিয়েছেন, বাড়ি বানিয়েছেন, সন্তানদের শিক্ষিত করেছেন এবং প্রতিষ্ঠিত করেছেন। হাজী সালাম মারা গেছেন ২০১৭ সালে। তুহিন বাবাকে সাহায্য করে আসছিলেন চুরানব্বই সাল থেকে। বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে পুরোটা তিনিই সামলাচ্ছেন। বদলে যাওয়া সময়ে কেমন চলছে সালাম স্ট্যাম্প সেন্টার?
তুহিন বললেন, ' সংগ্রাহক সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় ব্যবসারও কলেবর বৃদ্ধি হওয়ার কথা ছিল কিন্তু সামগ্রিক পরিস্থিতি দোকানকেন্দ্রিক ডিলারদের বিপক্ষে। নতুন সংগ্রাহক বেড়েছে সত্যি কিন্তু আন্তরিক ও মনোযোগী সংগ্রাহক সে হারে বাড়েনি। পুরোনো অনেক সংগ্রাহকই সংগ্রহ বিক্রি করে দিচ্ছেন। রিসেলাররা সেগুলো ঠিকা দরে বা ভেঙে ভেঙে বিক্রি করছেন। ফেসবুকে বিক্রেতাদের পেইজ এবং গ্রুপ আছে অনেক ফলে ব্যবসাটি এখন বিক্ষিপ্ত। আমরা এখন বড়জোড় দোকান ভাড়া ও কর্মচারীর বেতন ওঠাতে পারি, কোনো কোনো মাসে হয়তো যাওয়া-আসার খরচ ওঠে।'
তুহিন তবু খুশি কারণ পারিবারিক ঐতিহ্য ধরে রাখতে পারছেন। তার ওপর স্ট্যাম্প ব্যবসার সুবাদে মাদ্রাসা শিক্ষক থেকে আইনজীবী, সামরিক বাহিনীর সদস্য, চিকিৎসক, প্রকৌশলী প্রভৃতি বিভিন্ন পেশার মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। প্রয়াত শিল্পী মুর্তজা বশীরের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়েছিল। শিল্পীর অটোগ্রাফ তুহিন আগলে রেখেছেন পরম মমতায়। এছাড়া আরো উল্লেখ করা যায় হাবিবুল আলম বীরপ্রতিক, আহসানউল্লাহ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. কাজী শরীফুল আলম, কর্নেল (অব.) লুৎফুল হক, ডা. শাফি মজুমদার. ডা. শামস মনোয়ার প্রমুখের কথা। এমন আরো অনেক মানুষ মিলে গড়ে ওঠা এক বৃহৎ পরিবারের নামই সালাম স্ট্যাম্প সেন্টার।