রোগী নিবাস: যে ‘হোটেলের’ অতিথি শহরের বাইরে থেকে আসা রোগী ও আত্মীয়স্বজন
লেবুর খোসা দিয়ে মুখ ঘষছিলেন রুম্পা। বিছানায় দুই পায়ে ব্যান্ডেজ নিয়ে তার মা শোয়া। অপরিষ্কার সবুজ রংয়ের দেওয়াল থেকে পলেস্তরা খসে বিছানায় পড়ে আছে। এ ঘরে এ বিছানাটাই একমাত্র আসবাব। খাটের নিচে কালো সিমেন্টের মেঝে আলু, রসুন আর পেঁয়াজ দিয়ে ঢাকা।
"আমরা গত ১০ দিন ধরে এই 'হোটেলে' বাস করছি। ডাক্তার বলেছেন পায়ের ঘা শুকানোর আগ পর্যন্ত আমাদের আরও ১০ দিন এখানে থাকতে হবে। আমরা রান্নাঘরে নিজেদের জন্য রান্না করি,' বলেন রুম্পার মা।
'রান্নাঘর' বলতে তিনি শাহবাগ গেস্ট হাউজ এবং রোগী নিবাসের স্যাঁতসেঁতে সবুজ দেওয়ালের একটি ছোট ঘরকে বুঝিয়েছেন। প্রতিটি ঘরের লাগোয়া একটি টয়লেটও রয়েছে। রাজধানীর শাহবাগ এলাকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালের পশ্চিম পাশে ভবনের তৃতীয় ও চতুর্থ তলায় ৩০টি কক্ষ নিয়ে তৈরি হয়েছে এই গেস্ট হাউজটি।
শাহবাগ গেস্ট হাউজ ও রোগী নিবাসের ম্যানেজার সাইফুর ইসলাম বলেন, 'আপনি ফ্রিজ ব্যবহার করতে পারবেন, খাবার রান্না করতে পারবেন; আমরা এর জন্য কোনো টাকা নেই না। তাছাড়া কাছাকাছি ভাতের হোটেল থেকেও খাবার অর্ডার করতে পারবেন।'
রুম্পা এবং তার মা ফেনী থেকে এখানে এসেছেন চিকিৎসা করাতে। মা বর্তমানে শাহবাগের বারডেম হাসপাতালে এক চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে রয়েছেন। ডাক্তার প্রতিদিন এসে তার মাকে দেখে যান। তার জন্য ডাক্তারকে দৈনিক ফি এক হাজার টাকা দিতে হয় বলে জানান রুম্পা।
রুম্পা ও তার মায়ের মতো রাজধানীর বাইরে থেকে আসা রোগী ও তাদের পরিচর্যাকারীরা ঢাকার সরকারি হাসপাতালের কাছাকাছি গেস্ট হাউজগুলোতে আশ্রয় নেন। যদিও ভালভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা হয় না, তারপরও এ গেস্ট হাউজগুলো তাদের জন্য একটি সাশ্রয়ী সমাধান।
ভাড়া ৫০০ থেকে ২,২০০ টাকা
শাহবাগ গেস্ট হাউজ ও রোগী নিবাসে একটি ডাবল বেডরুমের ভাড়া পড়ে বারোশ টাকা। আর দুটি সিঙ্গেল বেডের একটি কক্ষের ভাড়া ১,৪০০ টাকা।
'কিন্তু আপনি অনুরোধ করলে এবং অগ্রিম টাকা দিয়ে দিলে তারা আপনাকে কিছুটা ছাড় দেবে। আমরা প্রতিদিন ৫০০ টাকা ভাড়ায় ডাবল বেডরুমে উঠেছি,' রুম্পা বলেন।
শাহবাগ গেস্ট হাউজ থেকে মাত্র কয়েক মিটার দূরে স্টার গেস্ট হাউজ এবং রোগী নিবাসের একটি কক্ষে থাকেন ৩০ বছর বয়সি রূপালী।
যশোরের বাসিন্দা রূপালী হাড় ও পেশির জটিলতায় ভুগছেন। তিনি বর্তমানে বিএসএমএমইউতে একজন চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে রয়েছেন। 'ডাক্তার বলেছেন আমাকে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার দরকার নেই, তবে নিয়মিত দুই সপ্তাহ তাদের কাছে যেতে হবে। [কিন্তু] শহরে আমার কোনো আত্মীয়স্বজন নেই। এখানে থাকাটা আমার জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত বলে মনে হয়েছে,' বলেন রূপালী। নন-এসি সিঙ্গেল বেডরুমের একটি ঘরে থাকতে তার প্রতিদিন দেড় হাজার টাকা খরচ হয়।
'অন্যগুলোর চেয়ে এটার ভাড়া কিছুটা বেশি, তবে এটি তুলনামূলক পরিষ্কার। এছাড়া আমি এখানে আমার খাবার রান্না করি, তার জন্য অতিরিক্ত কোনো চার্জ দিতে হয় না। চাইলে ফ্রিজও ব্যবহার করতে পারি,' রূপালী বলেন।
এই গেস্ট হাউজটির এসি, নন-এসি, সিঙ্গেল বেড এবং ডাবল বেড বিভাগে ভবনের প্রথম থেকে তৃতীয় তলা পর্যন্ত মোট ২৯টি কক্ষ রয়েছে।
এসব কক্ষের ভাড়া দেড় হাজার টাকা থেকে ২,২০০ টাকা পড়ে বলে জানান মিজানুর রহমান নামক একজন কর্মী। তিনি আরও বলেন, 'সাধারণত রোগীরা প্রথম তলায় রুম পছন্দ করেন কারণ তারা সিঁড়ি বেয়ে উঠতে পারেন না।'
মো. জামাল ও তার বাবা কম দামে দোতলায় এমন একটি ঘর খুঁজছিলেন। 'আমার মায়ের মস্তিষ্কে আঘাত আছে; তিনি সিঁড়ি বেয়ে উঠতে পারেন না। আমরা চুয়াডাঙ্গা থেকে এসেছি। এখানে থাকার মতো কেউ নেই । এছাড়া রুমের ভাড়া [স্টার গেস্ট হাউজ ও রোগী নিবাসে] দেড় হাজার টাকার বেশি। অত টাকা দিয়ে থাকা আমাদের পক্ষে সম্ভব না,' জামাল বলেন।
রোগী নিবাসের বাইরে
জামাল আর তার বাবা-মা একটি হোস্টেল রুমে থাকবেন বলে ঠিক করেছেন। তাদের খাবার আসবে আশপাশের ছোট হোটেলগুলো থেকে। এভাবে থাকতে হবে যতক্ষণ না তার মা ভর্তি হন। এরপর নিউরোলজি ওয়ার্ডে একটি বিছানা পাবেন তারা।
উল্লেখ্য, রাজধানীতে খুব বেশি রোগী নিবাস নেই। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ঢাকায় আসা অনেক পরিবার সস্তা আবাসিক হোটেলে থাকতে বাধ্য হন। এসব হোটেল আবার হাসপাতাল থেকে কাছেও হয় না।
রাজবাড়ীর ১৯ বছর বয়সি তানভীর কিডনি রোগে আক্রান্ত। তার দুটি কিডনিই প্রতিস্থাপন করতে হবে। মা-বাবার সঙ্গে তিনি এখন বিএসএমএমইউ-তে ভর্তি রয়েছেন।
শহরের বাইরে থেকে আসা অনেক রোগীর মতো এই পরিবারটিরও রাজধানীতে কোনো আত্মীয়স্বজন নেই। তানভীর হাসপাতালের নেফ্রোলজি বিভাগে পুরুষদের ওয়ার্ডে একটি বিছানা পেয়েছেন। কিন্তু রাতে তার বাবা-মা কোথায় থাকেন?
'ওয়ার্ডে রোগীর দুটো বিছানার মাঝখানে। আমাদের একটি পাটি আছে; ওটা বিছিয়ে, জামাকাপড় দিয়ে বালিশ বানিয়ে ঘুমাই। তানভীরের বাবা মাঝেমধ্যে বারান্দায় বা বেঞ্চে ঘুমান,' বলেন তানভীরের মা ফাতেমা।
তার বাবা রফিক বলেন, 'ছেলের অস্ত্রোপচারের জন্য আমাদের সাত লাখ টাকা দরকার। থাকার জন্য প্রতিদিন এক হাজার টাকা খরচ করার কোনো উপায় নেই। এখানেই চলে যাচ্ছে।'
রোগীর দেখাশোনায় পরিবার
ডাক্তারদের দেওয়া প্রেসক্রিপশন মেনে চলতে সাহায্য করার জন্য হাসপাতালে আমাদের সেবাযত্নকারীর দরকার হয়। এই পরিস্থিতিতে হয় প্রাতিষ্ঠানিক সেবাদাতা নিয়োগ দিতে হয় বা পরিবারের সদস্যরা শুশ্রূষাকারী হিসেবে কাজ করেন।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ বলেন, 'আমাদের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থায়, বিশেষ করে সরকারি হাসপাতালগুলোতে, নার্সের সংখ্যা কম। প্রাতিষ্ঠানিক সেবাদাতা কম থাকায় অনেক লোক রোগীদের সঙ্গে হাসপাতালে থাকতে বাধ্য হন।'
দেশের স্বাস্থ্য খাত প্রয়োজনের তুলনায় ৭৬ শতাংশ কম নার্স দিয়ে চলছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুযায়ী একজন চিকিৎসকের বিপরীতে তিনজন নার্স নিয়োগ দিতে হবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ২০২১ হেলথ বুলেটিনে উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলাদেশে বিএমডিসি (বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল) থেকে নিবন্ধিত ডাক্তারের সংখ্যা এক লাখ ৩৫ হাজার ১৯৫ জন। আর প্রতি একজন ডাক্তারের বিপরীতে রোগীর সংখ্যা এক হাজার ৩৮৯ জন। অর্থাৎ দেশে চার লাখের বেশি নার্সের প্রয়োজন।
তবে, বাংলাদেশ নার্সিং অ্যান্ড মিডওয়াইফারি কাউন্সিল (বিএনএমসি) অনুসারে, ২০২৩ সালের অক্টোবর পর্যন্ত দেশে নিবন্ধিত নার্সের সংখ্যা ৯৪ হাজার ৯১৮ জন।
সরকারি হাসপাতালের নার্সরা বেশিরভাগ প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করেন এবং রোগীদের ওষুধ সরবরাহ করেন। এর বাইরে মূলত রোগীর চাপের কারণে নার্সরা আর বেশি কিছু করতেও পারেন না। রোগীদের গোসল করানো, খাওয়ানো, তাদের পোশাক পরিবর্তন করা, বাথরুমে নিয়ে যাওয়া ইত্যাদি কাজও করতে হয় তাদেরকে।
তবে তা সত্ত্বেও রোগীদের সেবাদাতাদের প্রয়োজনীয়তা কমে না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পরিবারের সদস্যরা পরিচর্যাকারীর ভূমিকা পালন করেন। তাদেরও থাকার জায়গার দরকার হয়।
এই পরিচর্যাকারীদের অনেককেই হাসপাতালে থাকতে বাধ্য হন। সেটা মেঝেতে হোক বা বারান্দায়। আর প্রায়ই জনাকীর্ণ হাসপাতালের মেঝে এবং অন্যান্য স্থানগুলোতে স্বাস্থ্যবিধি এবং পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখার অবকাশ থাকে না।
'আমাদের স্বাস্থ্য খাত এবং ব্যবস্থাপনার পরিকল্পনায় এটিকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। আমাদের এই সেবাদাতাদের স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দেওয়া দরকার, অন্যথায় পুরো পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। কখনও কখনও আপনাকে রোগীর জন্য একটি ট্রলি পেতেও ঘুষ দিতে হয়,' বলেন অধ্যাপক বে-নজির।