গুলবদন বেগম: দুঃসাহসী মোগল রাজকন্যার মহাকাব্যিক সমুদ্রযাত্রা
১৫৭৬ সালের শরতের একটি দিনে মক্কা ও মদিনার শহরগুলো ভ্রমণ তথা হজ্জের উদ্দেশে যাত্রা করেছিলেন রাজকীয় একদল নারী। আর এই দলটিকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এক মোগল রাজকন্যা। তিনি গুলবদন বেগম। মোগল সম্রাট বাবরের কন্যা। মোগল ভারতে কোনো নারীর হজ্জ বা তীর্থযাত্রায় যাওয়ার ঘটনা এটিই প্রথম।
মোগল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা ও সম্রাট বাবরের ৫৩ বছর বয়সী মেয়ে গুলবদন বেগমের এই যাত্রা শুরু হয়েছিল ভারতের আগ্রা জেলার ফতেহপুর সিক্রি থেকে। ছয় বছরের দীর্ঘ এই যাত্রায় তার সঙ্গে ছিলেন রাজপরিবারের আরও ১১ নারী।
তবে তাদের এই যাত্রার বিস্তারিত বিবরণ নথি থেকে গায়েব হয়ে গিয়েছিল। ঐতিহাসিকদের মতে, সম্ভবত নারীদের এই ভ্রমণ ও তাদের তীর্থযাত্রার 'শালীনতা ও পবিত্রতা' বজায় রাখার জন্য এ বিষয়ে বিস্তারিত বিবরণ বাদ দেওয়া হয়েছে।
মক্কার উদ্দেশে গুলবদনের এই যাত্রাকে দয়া ও সাহসী এবং একইসঙ্গে বিদ্রোহী পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হয়ে থাকে। যেমনটা ইতিহাসবিদ রুবি লাল তার ভগবদ প্রিন্সেস: দ্য গ্রেট অ্যাডভেঞ্চার অব গুলবদন বইতে লিখেছেন। বইটি এ মাসের শেষের দিকে বের হওয়ার কথা রয়েছে।
হুমায়ুননামা গ্রন্থে উল্লিখিত গুলবদনের জীবনের নানা অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে তাকে মোগল সাম্রাজ্যের প্রথম এবং একমাত্র নারী ইতিহাসবিদ হিসেবে বিবেচনা করা হলেও গ্রন্থটিতে কৌতূহলীভাবে তার এই তীর্থযাত্রা সম্পর্কে বিশদ বিবরণের উল্লেখ নেই। হুমায়ুননামা বইটির বেশ কয়েকটি পৃষ্ঠাও পাওয়া যায়নি।
রুবি লাল উল্লেখ করেন, 'গুলবদন যে সময়টিতে লিখেছিলেন, সে সময়ে কাহিনিকার বা ঘটনাপঞ্জি লিপিবদ্ধকারীদের কাছে রাজপরিবারের সদস্যদের লেখাগুলোর একাধিক কপি তৈরি করে রাখা সাধারণ একটি বিষয় ছিল। কিন্তু গুলবদনের লেখা বইটির পরিপূর্ণ একটি কপিও নেই।'
রুবি লাল মোগল রাজকন্যাদের অজানা রয়ে যাওয়া এসব ভ্রমণকাহিনি একত্রে লিপিবদ্ধ করেছেন। অটোমান ইতিহাস, ফার্সি ও মোগল পাণ্ডুলিপিসহ অন্যান্য সূত্র থেকে পাওয়া তথ্য নিয়ে গবেষণার পর এসব কাহিনি তিনি একত্র করেছেন।
তিনি বলেন, 'ক্ষমতাধর এই নারীর সমুদ্রযাত্রা ঘিরে নীরবতা অনেক কথারই জানান দিচ্ছে।'
১৫২৩ সালে আফগানিস্তানের কাবুলে সম্রাট বাবরের তৃতীয় স্ত্রী দিলদার বেগমের ঘরে জন্ম গুলবদনের। জন্মের সময় তার বাবা কাবুল থেকে বহু মাইল দূরে তার হিন্দুস্তান জয়ের পরিকল্পনায় ব্যস্ত ছিলেন, যা তৎকালীন ভারতবর্ষ হিসেবে পরিচিত ছিল।
বিভিন্ন যুদ্ধের ফাঁকে ফাঁকে সম্রাট বাবর যখন অল্প কিছুদিনের জন্য বাড়ি ফিরতেন, তখনই কেবল গুলবদন বাবার দেখা পেতেন। বাবার সংস্পর্শ থেকে এই দূরে থাকাটা গুলবদনের সৎ ভাই হুমায়ুন ও ভাতিজা আকবরসহ পরিবারের অন্য ক্ষমতাধর ব্যক্তির সঙ্গে তার সম্পর্ককে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছিল।
গুলবদনের পরিবারের পুরুষ সদস্যরা যখন বাইরে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে লিপ্ত ছিলেন, তখন গুলবদন এই যোদ্ধাদের তথা সম্রাটের মা, খালা, বোন, স্ত্রী ও অন্য মেয়েদের সঙ্গে বেড়ে উঠছিলেন। তারা রাজা ও রাজকন্যার বিশ্বস্ত পাত্র ও উপদেষ্টা হিসেবে রাজ দরবারের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতেন।
গুলবদনের শৈশব জীবনও এমন ঘটনাবহুল। তার বাবা আগ্রা দখল করে নেওয়ার পর মাত্র ছয় বছর বয়সেই গুলবদন প্রথম মোগল মেয়ে হিসেবে কাবুল থেকে আগ্রায় গিয়েছিলেন। পরে এক সময় আফগান রাজা শের শাহ সুরি মোগলদের পরাজিত করেন এবং তাদের ভারত থেকে বিতাড়িত করেন। গুলবদন তখন তার মাতৃভূমিতে ফিরে গিয়েছিলেন।
তাদের এই যাত্রায় সময় লেগেছিল কয়েক মাস। আর এই যাত্রা অতোটাও সহজ ছিল না। জনশূন্য পাহাড়ি পথের এই যাত্রায় গুলবদন ও রাজপরিবারের অন্য নারীরা নানা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছিলেন। ছিল চোর-ডাকাতের উপদ্রবও। তারা দীর্ঘ পথ ভ্রমণ করেছেন পালকিতে ও ঘোড়ায় চড়ে, অবস্থান করেছেন তাঁবুতে।
রুবি লাল বলেন, 'মোগল নারীরা ভবঘুরে জীবনযাত্রায় অভ্যস্থ ছিলেন। যুদ্ধরত পুরুষ সঙ্গীদের সঙ্গে থাকার কারণে প্রতিনিয়ত তাদের এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যেতে হতো কিংবা অস্থায়ী শিবিরে বসবাস করতে হতো।'
রুবি লাল জানান, সম্ভবত এই ভবঘুরের বিষয়টিই ভাতিজা আকবরের কাছে হজ্জে যাওয়ার অনুমতি চাইতে গুলবদনের সাহস জুগিয়েছিল।
রুবি লাল তার বইতে লিখেছেন- আকবরের সবচেয়ে বড় উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল মোগল রাজবংশের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা। এই লক্ষ্য নিয়ে হিন্দুস্তানের দিকে আগানোর সঙ্গে সঙ্গে তিনি 'নিজেকে পবিত্র ব্যক্তিত্ব, অদম্য আধ্যাত্মিক কর্তৃত্ব হিসেবে দাঁড় করাতে চেয়েছিলেন।'
তিনিই প্রথম মোগল শাসক হিসেবে মোগল নারীদের প্রাচীর ঘেরা হারেমে থাকার নির্দেশ দিয়েছিলেন।
চার দেয়ালের মধ্যে আবদ্ধ থেকে গুলবদন অস্থির হয়ে উঠেছিলেন। আর তাই ১৫৭৬ সালে তিনি ও রাজপরিবারের আরও কয়েকজন নারী মক্কার উদ্দেশে তীর্থযাত্রা করেন। তিনি আকবরকে বলেছিলেন যে তিনি হজ্জ করবেন বলে প্রতিজ্ঞা করেছেন। আকবরের তৈরি করা সালিমি ও ইলাহি নামে দুটি রাজকীয় মোগল জাহাজে করে তারা যাত্রা করেছিলেন। জাহাজ দুটিতে দান বা বিতরণ করার জন্য সোনা ও রূপার তৈরি বিপুল পরিমাণ জিনিস, হাজার হাজার রুপির সম্পদ ও ১২ হাজার 'সম্মানীয় পোশাক'ও ভর্তি করা হয়েছিল।
রুবি লিখেছেন- তাদের এই যাত্রা দেখার জন্য 'সাধারণ পুরুষ ও নারী, বৃদ্ধ, যুবক ও শিশুরা মোগল রাজধানী ফতেপুর সিক্রি'র রাস্তায় ভিড় করেছিল।
তবে তাদের এই যাত্রায় শুরু থেকেই বিপদ-আপদ লেগেই ছিল। মক্কার সমুদ্রপথটি ছিল পর্তুগিজদের নিয়ন্ত্রণে। সে সময় মুসলমানদের জাহাজে আক্রমণ ও লুটের জন্য তাদের বেশ পরিচিতি ছিল।
পারস্যের মধ্য দিয়ে চলা স্থলপথটিও একই রকম অনিরাপদ ছিল। এ পথেও সশস্ত্র হামলার ভয় করতেন ভ্রমণকারীরা।
গুলবদন এবং তার সঙ্গীরা পর্তুগিজদের কাছ থেকে নিরাপদ স্থানে পৌঁছানোর পথ পাওয়ার এক বছর আগে সুরাট বন্দরে আটকা পড়েছিলেন। তারা জেদ্দায় পৌঁছানোর জন্য আরব সাগর পেরিয়ে চার সপ্তাহ যাত্রা করেছিলেন এবং মক্কায় পৌঁছানোর জন্য উত্তপ্ত মরুভূমির বালির মধ্যে দিয়ে কয়েক দিন উটে চড়ে ভ্রমণ করেছিলেন।
মক্কা ভ্রমণের পর গুলবদন ও তার সঙ্গীরা পরবর্তী চার বছরের জন্য আরবে থেকে যেতেও মনস্থির করেছিলেন।
রবি লাল তার গ্রন্থে এ বিষয়ে বলেন, হারেম ছেড়ে বেরিয়ে আসতে সর্বসম্মত হওয়া এই নারীরা সম্ভবত এবার মরুভূমিতে যাযাবার, মুহাজির (আধ্যাত্মিক যাত্রী) হিসেবে জীবনযাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।
এই সময়ে গুলবদন ও তার সঙ্গীরা তাদের সঙ্গে থাকা সম্পদ দান করে আলোচনায় আসেন। মোগল রাজকন্যার এই দানশীলতায় ক্ষমতাসীন অটোমান সুলতান মুরাদ ক্ষুব্ধ হন। তিনি এই কাজগুলোকে আকবরের রাজনৈতিক শক্তির প্রমাণ হিসেবে দেখেছিলেন।
আর তাই সুলতান মুরাদ আরব থেকে গুলবদনদের উচ্ছেদের জন্য চারবার ফরমান জারি করেন। প্রতিবারই গুলবদন চলে যেতে অসম্মতি জানান।
রুবি লাল বইতে লেখেন, 'মোগল নারী কর্তৃক বিদ্রোহের এই ঘটনা নজিরবিহীন। এ থেকে বোঝা যায় যে গুলবদন তার স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষার প্রতি কতটা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলেন।'
অবশেষে গুলবদনের একগুঁয়েমিতে সুলতান এই নারীদের সম্পর্কে অটোমান তুর্কি ভাষায় নিন্দনীয়- না-মেশরু (একটি অনুপযোগী বা ভুল কাজ) শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন। শব্দটি এতটাই অপছন্দনীয় বা গুরুতর বলে বিবেচিত হয়েছিল যে আকবর এতে অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন।
এর পর পঞ্চমবার ডিক্রির পর ১৫৮০ সালে গুলবদন এবং তার সঙ্গীরা আরব ছেড়ে চলে যান। ১৫৮২ সালে তাদের কাফেলা ফতেহপুর সিক্রির ৬০ কিলোমিটার (৩৭ মাইল) পশ্চিমে খানওয়ায় পৌঁছে।
ফেরার পর গুলবদনকে 'নবাব' (শাসক) এর মতো করেই অভ্যর্থনা জানানো হয়। আকবরনামায় পাওয়া যায়- সে সময় রাজদরবারের কাজ পরিচালনার জন্য একমাত্র নারী হিসেবে গুলবদনকে আমন্ত্রণও জানিয়েছিলেন আকবর।
আকবরনামার পুরো একটি অংশ গুলবদনের মক্কা ভ্রমণকে উৎসর্গ করা হয়েছে। কিন্তু বইয়ের কোথাও আরবে তার কাটানো সময় ও সুলতান মুরাদের তিরস্কারের সেই কাহিনির উল্লেখ পাওয়া যায়নি।
অনুবাদ: রেদওয়ানুল হক