বাংলাদেশি এক সমুদ্রবিজ্ঞানীর চোখে ‘শুভ্র বরফের’ অ্যান্টার্কটিকা
২০ ডিসেম্বর, ২০২৩। ঠিক যেমনটা আবহাওয়ার পূর্বাভাস দিয়েছিল, স্ফটিক নীল আকাশ আর উজ্জ্বল সূর্যালোকের নিচে এমভি ভ্যাসিলি গোলভনিন জাহাজ দিনের শেষ যাত্রীদের জন্য অপেক্ষা করছিল দক্ষিণ আফ্রিকার কেপটাউন বন্দরে ৷
ভ্লাদিভোস্টকে রাশিয়ান কার্গো যাত্রার তত্ত্বাবধান করছিল এম/এস ফেস্কোর প্রায় ৪২ জন সদস্যের একটি দল। বিমান সহায়তার জন্য ছিল – অ্যারোস্প্যাটিয়েল ৩৫০ বি৩ এবং কামোভ ৩২—এই দুটি হেলিকপ্টার।
১৯৮০-র দশক থেকে জাহাজ ভ্যাসিলি এই একই রুটে একাধিকবার যাতায়াত করেছে। অ্যান্টার্কটিকা বা দক্ষিণ মেরুর দুটি ভারতীয় স্টেশন এবং বেলজিয়ামের প্রিন্সেস এলিজাবেথ আইল্যান্ডের জন্য ১৫৬ মিটার উচ্চতার সাততলা এই কার্গোশিপ জ্বালানি, খাদ্য এবং অন্যান্য জিনিস বহন করার জন্য নির্ধারিত ছিল।
তবে আরও গুরুত্বপূর্ণ হলো, জাহাজটি ২৪ জন মানুষকে বিশ্বের "সাদা মহাদেশে" নিয়ে যাওয়ার জন্যও নির্ধারিত ছিল। তাদের মধ্যে ১৩ জন বিজ্ঞানী, একজন ডাক্তার, দুইজন শেফ বা পাচক, দুইজন ভারতীয় নৌবাহিনীর কর্মকর্তা এবং ছয়জন লজিস্টিক পেশাদার– যারা যাচ্ছেন বিজ্ঞানীদের সহায়তা দিতে।
ভারতের ন্যাশনাল সেন্টার ফর পোলার অ্যান্ড ওশান রিসার্চ (এনসিপিওআর) এর একজন বিজ্ঞানী, ৪৫ বছর বয়সী ভূতাত্ত্বিক ডঃ যোগেশ রায় ছিলেন অভিযানের নেতৃত্বে।
কলম্বো সিকিউরিটি কনক্লেভ-ভুক্ত দেশ ভারত, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ এবং মরিশাস এবং পর্যবেক্ষক দেশ বাংলাদেশ ও সিশেলসের বিজ্ঞানীদের শত শত আবেদন ও প্রস্তাবগুলোর মধ্যে সংস্থাটি ১৩টি প্রস্তাব চূড়ান্ত করে।
যোগেশ দলকে নির্দেশ দিয়ে আসছিলেন আগস্ট মাস থেকেই। প্রায় পাঁচ মাস পর, তিনি এবং তার দল অবশেষে পা রাখলেন জাহাজে।
তারা দক্ষিণ মেরুতে ভারতের ৪৩তম অভিযানের পথে রওনা হন। "জলবায়ু পরিবর্তন এবং অ্যান্টার্কটিকায় এর প্রভাবের" ওপর গুরুত্ব দিয়ে বৈজ্ঞানিক গবেষণা করতেই এই যাত্রা।
একমাত্র বাংলাদেশি হিসেবে বিজ্ঞানীদের এই দলে সুযোগ পেয়ে অভিভূত সৌমিত্র চৌধুরী। এই অভিযানের উদ্দেশ্যে তিনি বাংলাদেশ ছাড়ার পর তখন ১০ দিন কেটেছে। ঢাকা থেকে দিল্লি, তারপর গোয়া, এরপর মুম্বাই এবং সবশেষে কেপটাউন – চোখের পলকে যেন কেটে গেল এই যাত্রাপথ।
কিন্তু কেপটাউনে জাহাজে চড়ার সময়ে তাঁর মনে পড়ে মায়ের চিন্তাক্লিষ্ট মুখখানি, তিনি চাননি সৌমিত্র এই জাহাজে চড়ে এই পাড়ি জমাক সুদূর অ্যান্টার্কটিকায়। স্ত্রী, ছোট্ট কন্যা সন্তান এবং অন্য প্রিয়জনদের কথাও মনে পড়ে সৌমিত্রর।
অথচ অভিযানে থাকা অবস্থায় পরের দুই মাস পরিবার ও প্রিয়জনদের সাথে যোগাযোগের জন্য ছয় মিনিট করে রেশন করা ইন্টারনেট পরিষেবা ব্যবহার করতে হয়েছে সৌমিত্রকে। তবু সারা বিশ্বের বিজ্ঞানীদের সাথে কাজ করা, গবেষণা এবং 'সাদা মহাদেশে' থাকার অকল্পনীয় সুযোগ এই তরুণ সমুদ্রবিজ্ঞানীর জন্য স্বপ্নের মতোই ছিল।
"এটা সত্যিই তেমন কোনো ব্যাপার ছিল না। সেখানে পৌঁছানোর পর, আমি আমার ফোনের কথা বেমালুম ভুলে গিয়েছিলাম। অ্যান্টার্কটিকায় যাওয়ার আগে, দিনে আমার প্রায় পাঁচ থেকে ছয় ঘণ্টা স্ক্রিন টাইম ছিল। কিন্তু, এখন আমার মনে হয় আমার এর কোন প্রয়োজনই নেই"- বলছিলেন সৌমিত্র।
তার লক্ষ্য ছিল অ্যান্টার্কটিকার জৈবিক এবং পরিবেশগত স্থায়িত্ব বা টেকসইতা নিয়ে অধ্যয়নের জন্য নমুনা সংগ্রহ করা।
এই বছরের ১০ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ফিরে আসেন সৌমিত্র। গবেষণার জন্য সাথে নিয়ে আসেন শিলা, পানি, সিল, পেঙ্গুইন ও পাখির মল-মূত্রের ৩০টিরও বেশি নমুনা।
কলকাতার একজন বাঙালি, যোগেশ এই তরুণ বিজ্ঞানীকে বেশ পছন্দ করেছিলেন। দক্ষিণ সাগরে যাওয়ার পথে, এই দুজনকে দেখা যেত জাহাজের ব্রিজে দাঁড়িয়ে অ্যান্টার্কটিকার পাখিদের দেখতে, আর তাদের ছবি তুলতে।
যোগেশের পূর্বপুরুষরা সিলেটের। তার বাবা এখনও সিলেটি ভাষায় কথা বলেন। সাইক্লোনের কবলে পড়ে বরফের সাগরে আটকে থাকা জাহাজে সৌমিত্রের সাথে সিলেটি ভাষা অনুশীলন করতেন যোগেশ।
কিন্তু সে কথা আরো পরে নাহয় বিস্তারিত বলা যাবে, আগে দেখা যাক সৌমিত্র ও যোগেশ ছাড়া আর কে কে ছিলেন অ্যান্টার্কটিকা অভিযানের বিজ্ঞানীদের এই দলে।
এদের একজন হলেন সুমিত কুমার। ভারতের তরুণ এই ভূতাত্ত্বিক পিএইচডি করছেন যোগেশের তত্ত্বাবধানে। সুমিত অ্যান্টার্কটিকার ভূতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যগুলো অধ্যয়ন করেন। এজন্য মহাদেশটিতে ঘুরে বেড়ান তিনি। এর পাশাপাশি অধ্যয়ন করে আমেরি আইস শেল্ফ নিয়ে।
এই শেলফটি একসময় ভারতীয় প্লেটের অংশ থাকলেও পরে আলাদা হয়ে অ্যান্টার্কটিক প্লেটের সাথে একীভূত হয়ে যায়। সৌমিত্র পরে সুমিতের সাথে জুটিবদ্ধ হযন। এই দুই 'বন্ধু' মিলে চালান নানান গবেষণা। অ্যান্টার্কটিকার তুষারে লাফালাফি করে এবং কাজ শেষে হেলিকপ্টারের জন্য একসাথে অপেক্ষা করে দারুণ সময় কাটান দুজনে।
মরিশাস ওশানোগ্রাফি ইনস্টিটিউটের কেমিক্যাল ওশেনোগ্রাফি ইউনিটের রাসায়নিক সমুদ্রবিদ্যা ইউনিটের সহযোগী গবেষণা বিজ্ঞানী– প্রেরণা রায় এবং অনিষ্ট অদিত-মান্না ছিলেন এই জাহাজে একমাত্র নারী বিজ্ঞানী। মরিশাস এবং অ্যান্টার্কটিকার মধ্যে সমুদ্র অম্লকরণের (ওশেন অ্যাসিডিফিকেশন) তুলনা করার কথা ছিল এই দুই জনের।
"প্রেরণা রায় একজন অসাধারণ লেখিকা। আমাদের অ্যান্টার্কটিকার দিনগুলোতে, তিনি তাঁর ডায়েরিতে অনেক সুন্দর সুন্দর পঙক্তি লিখতেন," বলছিলেন সৌমিত্র।
তবে কাহিনির কেন্দ্রে আবার সৌমিত্রকেই আনা যাক। হওয়া যাক জাহাজে তাঁর যাত্রাসঙ্গী।
পরের দিন, ২১ ডিসেম্বর, দক্ষিণ আফ্রিকার ভারতীয় কনস্যুলেট জেনারেল শ্রী মহেশ কুমার জাহাজের অভিযাত্রী দলটির সাথে দেখা করতে আসেন। তিনি গবেষণা প্রকল্প সম্পর্কে তাদের সাথে কথা বলেন এবং গবেষণার জন্য সাফল্য কামনা করেন।
দিনটা সামান্য মেঘলা থাকবে, ২৩ ডিসেম্বরে এমনটাই ছিল আবহাওয়ার পূর্বাভাসে। এদিন সকালের শুরুতেই, সমস্ত পণ্যসামগ্রী, রসদ ও যাত্রীদের নিয়ে চার মাসের জন্য অ্যান্টার্কটিকায় দুঃসাহসিক অভিযানের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে ভ্যাসিলি গোলভনিন।
তবে ভিসার মেয়াদ সীমিত হওয়ায় ফেব্রুয়ারির প্রথম দিকেই ফিরতে হয় সৌমিত্রকে । যদিও ফিরে আসার পরে, তিনি মোটেও বিচলিত হননি এনিয়ে। গলায় ঝোলানো ক্যানন সিক্স-ডি মার্ক থ্রি নিয়ে, সৌমিত্র বরং ভাবছিলেন তার অ্যান্টার্কটিকায় কাটানো সময়ের কথা। আসলেই তিনি অ্যান্টার্কটিকায় ছিলেন কি? নাকি সবই স্বপ্ন!
শুরু: ২০২২ ওশেনোগ্রাফারস এন্ড হাইড্রোগ্রাফারস সম্মেলন
কলম্বো সিকিউরিটি কনক্লেভের (সিএসসি) বহুপাক্ষিক ফোরামের অধীনে, "আমাদের মহাসাগরের সাথেই আমাদের ভবিষ্যৎ"কে মূল প্রতিপাদ্য রেখে ২০২২ সালের ১৫-১৮ নভেম্বরে অনুষ্ঠিত হয় প্রথম ওশেনোগ্রাফারস অ্যান্ড হাইড্রোগ্রাফারস কনফারেন্স।
বাংলাদেশ ওশানোগ্রাফিক রিসার্চ ইনস্টিটিউটের তৎকালীন মহাপরিচালক হিসেবে সাঈদ মাহমুদ বেলাল হায়দারকে এই সম্মেলনে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন করপোরেশনের চেয়ারম্যান।
২০২৩ সালের এপ্রিলে, ভারতের আর্থ সায়েন্স মন্ত্রণালয় থেকে তাকে চিঠি পাঠানো হয়। তাতে দুজন বাংলাদেশি সমুদ্রবিজ্ঞানীকে গবেষণার কাজে অ্যান্টার্কটিকায় যাওয়ার সুযোগ দেয়া হবে বলে জানানো হয়। তবে সেজন্য বিজ্ঞানীদের অবশ্যই গবেষণা প্রস্তাব জমা দিতে হবে।
"আমি এবং আমার সহকর্মী মো. মোজাম্মেল হোসেনের সাথে কথা বলার পরে, বেলাল স্যার আমাদের গবেষণা প্রস্তাব ও শারীরিক সক্ষমতা পরীক্ষা করেন। এরপর তিনি প্রাথমিকভাবে আমাদের নির্বাচন করেন এবং আমাদের নাম পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেন,"—সৌমিত্র বলেন।
পরে সংস্থাটি বাংলাদেশ থেকে শুধু মাত্র একজন বিজ্ঞানী নিতে পারবে জানালে দুঃখজনকভাবে মোজাম্মেল এই অসাধারণ অভিযানে অংশ নিতে পারেনি।
যার ভিত্তিতে অ্যান্টার্কটিকায় গবেষণা চালানো হবে, পরবর্তীতে সেসব প্রস্তাব জমা দেওয়ার সময় এলে এনসিপিওআর বিভিন্ন বিভাগে প্রস্তাব চায়। জৈবিক সমুদ্রবিদ্যা, পরিবেশগত, ভূতাত্ত্বিক এবং আরও অনেক বিভাগে চাওয়া হয় গবেষণা বিষয়ক প্রস্তাব। এসব ক্ষেত্রগুলোতে কাজ করেন এমন যে কোন বিজ্ঞানীর এই গবেষণা কাজে আবেদন করার এবং প্রস্তাব পাঠানোর যোগ্যতা ছিল।
"প্রাথমিকভাবে, আমি ফোরামিনিফেরা এবং অ্যান্টার্কটিক ক্রিল মাছের উপর একটি গবেষণা প্রস্তাব তৈরি করেছিলাম। কিন্তু আমাদের প্রকল্পের প্রধান ডক্টর যোগেশ বলেছেন যে এগুলো নিয়ে আগেও কাজ করা হয়েছে। তাই আমি আরও কিছু জিনিস নিয়ে গবেষণা করেছি যা নিয়ে খুব বেশি কাজ হয়নি। এই কথা মাথায় রেখেই আমি অ্যান্টার্কটিকার বিভিন্ন অঞ্চলে মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি সম্পর্কে একটি গবেষণা প্রস্তাব তৈরি করেছিলাম," তিনি যোগ করেন।
প্রস্তাবনাগুলো প্রাথমিক নির্বাচনের পর দ্বিতীয় ধাপে আবেদনকারীকে নিজ গবেষণার বিষয়ের উপর সায়েন্টিফিক প্রেজেন্টেশন দিতে হয়। এরপর ভারতের ভূবিজ্ঞান মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের মাধ্যমে অভিযানের জন্য বিজ্ঞানীদের চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত করা হয়।
জুলাইয়ের শেষ নাগাদ চূড়ান্তভাবে মনোনীত হওয়ার বিষয়টি জানতে পারেন সৌমিত্র। আগস্ট নাগাদ সারা বিশ্বের প্রায় ৬০ জনেরও বেশি বিজ্ঞানীদের নিয়ে একটি দল গঠন করা হয়। আলাদাভাবে অ্যান্টার্কটিকায় ভারতীয় একটি অভিযান পরিচালনা করা হয় গত অক্টোবর থেকে নভেম্বর মাসে। সেই অভিযানের জন্য ভারতি ঘাঁটি থেকে ৪৭ জন কর্মীকে বিমানে করে পাঠানো হয় সেখানে।
অন্যদিকে সমুদ্রপথে অভিযানের জন্য ভারত, বাংলাদেশ ও মরিশাস থেকে প্রায় ১৪ জন বিজ্ঞানীকে বেছে নেওয়া হয়।
৪৭ জন বিজ্ঞানী এবং কর্মী আকাশপথে যাওয়ার কারণ তারা অ্যান্টার্কটিকায় আরও সুদূরপ্রসারী এবং সময়-সংবেদনশীল একটি গবেষণা চালাচ্ছিল। সেই সময়ে অ্যান্টার্কটিকায় গ্রীষ্মকাল ছিল এবং বরফ খুব শীঘ্রই গলতে শুরু করেছিল। এই ক্ষেত্রে পরিবেশগত অবস্থা বিবেচনায় রেখে আগেভাগে যাওয়া সত্যিই তাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
অন্যদিকে, যোগেশ রায় যে দলটির নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তাতে সেই বিজ্ঞানীরা ছিলেন, যাদের মহাদেশে যাওয়ার পথে নমুনা সংগ্রহের প্রয়োজন ছিল।
যেমন, একজন ভারতীয় বিজ্ঞানী ভারত এবং অ্যান্টার্কটিকার বাতাসে কার্বন ডাই-অক্সাইডের উপস্থিতির তুলনা করছিলেন। তাই, একটি নির্দিষ্ট দূরত্বে থাকা বিস্তৃত অঞ্চলের কার্বন ডাই-অক্সাইড স্তর পরিমাপ করতে হতো তাঁকে।
অন্যদিকে, দক্ষিণ সাগরের তাপমাত্রা, লবণাক্ততা এবং জলের পরিবাহিতা নিয়ে কাজ করছিল আরেকজন বিজ্ঞানী। এ কারণে, তাঁকে অ্যান্টার্কটিকা ভ্রমণের সময় দিনে প্রায় তিন থেকে চার বার নমুনা সংগ্রহ করতে হয়েছিল," সৌমিত্র বর্ণনা করেছিলেন।
""আমি পরবর্তী অভিযাত্রী দলের অংশ ছিলাম" যুক্ত করেন সৌমিত্র। এই দলের অংশ হতে পেরে তাঁকে খুশি বলেই মনে হচ্ছিল। সৌমিত্র ২১ ডিসেম্বর থেকে শুরু করে দক্ষিণ সাগরে এবং পরে অ্যান্টার্কটিকায় ছিলেন প্রায় দুই মাস।
ঢাকা থেকে কেপটাউন
১০ ডিসেম্বর ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে দিল্লির উদ্দেশ্যে রওনা হন সৌমিত্র। এরপর সেখান থেকেই দক্ষিণ আফ্রিকার ভিসা নেন তিনি।
"আপনি বাংলাদেশ থেকে দক্ষিণ আফ্রিকার ভিসা পাবেন, কিন্তু এর জন্য প্রায় এক মাস অপেক্ষা করতে হবে। তাই, আমাকে ভারত থেকে ভিসা নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়," জানান সৌমিত্র। তবে সমস্যা হলো, ভারতে দক্ষিণ আফ্রিকা কর্তৃপক্ষ তাকে চার মাসের জন্য ভিসা দিতে রাজি হলেন না।
"আমি তাদের বোঝাতে থাকলাম যে আমার মাত্র ছয় দিনের জন্য কেপটাউনে থাকতে হবে। আমি অ্যান্টার্কটিকায় যাচ্ছি এবং আমার দক্ষিণ আফ্রিকার ভিসা দরকার কারণ আমরা কেপটাউন বন্দর থেকে জাহাজে উঠব। কিন্তু তারা তাদের সিদ্ধান্তে অনড় ছিল," সৌমিত্র বললেন।
যা-ই হোক, তিনি যেভাবেই হোক যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন এবং তার দলনেতাকেও বিষয়টি জানিয়ে দেন। "আমি আট মাস ধরে প্রস্তুতি নিয়েছি। ১০ কেজি ওজন কমিয়েছি, ট্রেকিং এবং হাইকিং প্রশিক্ষণ নিয়েছি। ফিট থাকার জন্য প্রতিদিন জিমে যেতাম এবং টেবিল টেনিস খেলতাম। যাই হোক না কেন– আমি এই সুযোগটি কোনোভাবেই হাতছাড়া করতে চাইনি।"
অবশেষে, সৌমিত্র তিন মাসের জন্য ভিসা পান। সেই অনুযায়ী সিদ্ধান্ত হয় যে, সৌমিত্র তাঁর কাজ এবং নমুনা সংগ্রহ অন্যদের আগে শেষ করবেন, এবং ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই ফেব্রুয়ারিতে ফিরে আসবেন।
১৩ ডিসেম্বর, আমাদের এই তরুণ বিজ্ঞানী যান ভারতের গোয়াতে। সেখানেই অ্যান্টার্কটিকায় অগ্নিনির্বাপণ, করণীয় এবং নিষেধ, উপস্থাপনা, এবং মেরু অভিযানের আগে যাওয়াদের স্বাস্থ্য বিষয়ক অভিজ্ঞতা শোনা এবং স্বাস্থ্য নির্দেশনাসহ বেশ কয়েকটি প্রশিক্ষণে অংশ নেন তিনি।
"১৬ ডিসেম্বর আমরা গোয়া থেকে মুম্বাই যাই। পরদিন ভোর ৪টায়, সেখান থেকে কেপটাউনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করি আমরা।"
দলটি কেপটাউনে তিন দিন অবস্থান করে। তারা শহরটি ঘুরে ফিরে দেখে এবং একই সাথে শেষ মুহূর্তের কিছু কেনাকাটাও সেরে নেয়। "শক্তিশালী হাইকিং দড়ি, নমুনা সংগ্রহের পাত্র, বাক্স এবং ক্যান দরকার ছিল আমাদের। কেউ কেউ জাহাজে এবং হিমায়িত সেই মহাদেশে খাওয়ার জন্য বিস্কুট এবং চকোলেটের মতো কিছু খাদ্যসামগ্রীও কিনে নেয়।"
অবশ্য আমরা তখনও জানতাম না, এই সমুদ্রযাত্রায় এবং অ্যান্টার্কটিকায় অফুরন্ত খাবার, চিপস এবং চকলেটের ব্যবস্থা করা হয়েছে আমাদের জন্য। তবে শেষমেষ আমরা খুব বেশি খাওয়া এড়িয়ে চলতে হয়েছে, যাতে আমাদের ওজন না বেড়ে যায়" সৌমিত্র হাসতে হাসতে বলল।
তারা কেপটাউন থেকে চারজন দক্ষিণ আফ্রিকান হেলিকপ্টার পাইলটকে নিয়োগ করেন, যারা আগামী কয়েক মাসের জন্য বিজ্ঞানীদের অ্যান্টার্কটিকার বেশকিছু জায়গায় নিয়ে যাবে।
ভ্যাসিলি গোলভনিনের যাত্রা
ভ্যাসিলি গোলভনিন আগেও এই রুটে চলাচল করেছে। কেপটাউন বন্দর থেকে অ্যান্টার্কটিকায় পৌঁছাতে সাধারণত ১০-১২ দিন সময় নেয়। কিন্তু এবার পৌঁছতে সময় লেগেছে প্রায় ২৫ দিন।
"আমরা ২৩ ডিসেম্বর ২০২৩ এ যাত্রা শুরু করে ১৬ জানুয়ারি ২০২৪-এ লারসেম্যান পাহাড়ে পৌঁছাই। আমাদের প্রায় দ্বিগুণেরও বেশি সময় লেগেছিল এখানে পৌঁছাতে। এর একটি কারণ হলো, প্রিন্সেস এলিজাবেথ দ্বীপে আমাদের কিছু জিনিস পৌঁছে দিতে হয়। আবার এদিকে যাত্রাপথে ৫টি সাইক্লোন পাড়ি দিতে হয় আমাদের" জানান সৌমিত্র।
এই সমুদ্রযাত্রা শুরুর আগে, যোগেশ রায়, একবারে পাকা দলনেতার মতো, তার দলের সাথে বসেন। জাহাজে আগামী কয়েকদিন কেমন হবে তা বোঝাতেই এই আয়োজন। থাকার ব্যবস্থা,স্বাস্থ্যবিধি থেকে শুরু করে বিনোদন ইত্যাদি বিভিন্ন কমিটি তৈরি করে দেন যোগেশ। সকাল ৬টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত প্রত্যেকেরই নির্দিষ্ট কোন না কোন দ্বায়িত্ব ছিল। নির্দিষ্ট একটি রুটিনও মেনে চলতে হয় তাদের।
"আমাদের রুটিন শুরু হয় সকাল ৭টা থেকে। সকাল সাড়ে ৭টা থেকে সাড়ে ৮টা পর্যন্ত ছিল আমাদের সকালের নাস্তা; দুপুর ২টার মধ্যে সারতে হতো দুপুরের খাবার এবং রাত সাড়ে আটটার মধ্যে রাতের খাবার শেষ করতে হতো," সৌমিত্র বর্ণনা করেছেন।
প্রতিদিন দুটো মিটিংয়ের আয়োজন করা হতো। একটি সকালের নাস্তার পর ৮টা ৩০ মিনিটে এবং অন্যটি রাতের খাবারের পরে সন্ধ্যা সাড়ে আটটায়। মিটিংগুলোতে দলের সদস্যরা তাদের দিনের পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করতো। তাদের গবেষণা কার্যক্রম কীভাবে চলছে, আপডেট সরবরাহ করা এবং তার উপর উপস্থাপনা প্রদান করা এসবই ছিল মূল আলোচ্য বিষয় এই মিটিংয়ের।
"দুইজন শেফ ছাড়াও, আমাদের ২২ জনের প্রত্যেককে, সে দলনেতা, বিজ্ঞানী বা লজিস্টিকসের ব্যক্তি যেই হোক না কেন– সপ্তাহে অন্তত একবার গ্যালি ডিউটি বা রান্নাঘরের দায়িত্ব পালন করতে হতো," বলছিলেন সৌমিত্র।
জাহাজে প্রায় সব রকমের খাবার পাওয়া যেত। গ্যালি ডে তে প্রত্যেকে তাদের পছন্দের খাবার তৈরি করতে পারতো। এই দিনগুলোতে তরুণ বিজ্ঞানীরা সকাল ৬টায় রান্নাঘরে চলে যেতেন এবং সাড়ে সাতটার আগে নাস্তা তৈরি করতে হতো তাদেরকে। শেফরা তাদের নির্দেশনা দিতেন রান্নার বিষয়ে।
সকালের খাবারের জন্য ছিল রুটি, জ্যাম, জেলি, শাকসবজি ইত্যাদি। "তবে ৪০ ডিগ্রী অক্ষাংশ অতিক্রম করার পর, আমাদের পাতলা খিচুড়ি তৈরি করতে হয়েছিল। কারণ আমাদের বেশিরভাগই সমুদ্রের উচ্চ জোয়ার এবং জাহাজের ঘূর্ণায়মান এবং পিচিংয়ের কারণে ভুগছিল 'সি সিকনেসে', বলছিলেন সৌমিত্র।
"আশ্চর্যের বিষয় আমি খুব বেশি অসুস্থ হইনি। এর কারণ বোধহয় ছিল বঙ্গোপসাগরে নৌকায় আমার কাজ করার অভিজ্ঞতা। অসম্ভব রকমের ঢেউ উপেক্ষা করে কাজ করতে হতো সেখানে। সে কারণেই আমি বেশ অভ্যস্ত ছিলাম এই ধরনের অবস্থার সাথে,"—মৃদু হেসে বলছিলেন সৌমিত্র।
অন্যান্য দিনগুলোতে, বই পড়া বা খাবারের পাত্রগুলো সরিয়ে রাখা ছিল তাদের কাজ। "শাকসবজি সংরক্ষণ করা হতো মাইনাস ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। সেগুলো বের করে রান্নাঘরে নিয়ে যাওয়ার জন্য, আমরা একটি দীর্ঘ মানবশৃঙ্খল তৈরি করতাম, এরপর হাতে হাতে দিয়ে দেয়া হতো।
অ্যান্টার্কটিকায় পরার জন্য একটি বিশেষ ধরণের স্যুট দেওয়া হয়েছিল আমাদের। আমরা সেই বিশেষ পোশাক পরে জাহাজে হাঁটা এবং দৌড়ানো অনুশীলন করতাম। আমরা সেখানে সহকর্মীদের জন্মদিন উদ্যাপন করেছি। সাধারণত সেদিন শেফ কেকসহ আরো নানান পদের ভাল ভাল খাবার তৈরি করতেন।"
"বেশিরভাগ সময় আমরা ব্রিজে [জাহাজের উপরের তলায়] কাটিয়েছি। ৩০ ডিগ্রী অক্ষাংশ অতিক্রম করার সাথে সাথে আমরা অ্যান্টার্কটিকের পাখি দেখতে শুরু করতাম। অ্যালবাট্রস, স্নো পেট্রেল, এসব পাখি আপনি অন্য কোথাও দেখতে পাবেন না সমুদ্রের এমন পরিবেশ ছাড়া। যোগেশ স্যার এবং আমি দুজনেই ছবি তুলতে পছন্দ করতাম। আমার মনে আছে সেইসব দিনগুলোতে আমরা জাহাজের ডেকে পাখি দেখে এবং ছবি তুলে সময় কাটিয়েছি," সৌমিত্র তার স্মৃতি আওড়ে বললেন এসব দিনের কথা।
তবে দক্ষিণ সাগরে ৩০ ডিগ্রী অক্ষাংশ অতিক্রম করার পর, রাশিয়ান ক্যাপ্টেন তাদের জানান যে দুটি ঘূর্ণিঝড় ধেয়ে আসছে জাহাজের দিকে। ক্যাপ্টেন ঘূর্ণিঝড়টি অতিক্রম করার চেষ্টা করলেও বুঝতে পারেন যে তা সম্ভব নয়।
অবশেষে, জাহাজটি গতিপথ থেকে পিছনে সরে আসে এবং ঘূর্ণিঝড়টি চলে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করে। ভাসিলি সমুদ্রে শুধু ভাসছিল কোন প্রকার নড়াচড়া ছাড়াই। ঘূর্ণিঝড় কেটে যাওয়ার সাথে সাথে আবার যাত্রা শুরু হয় তাদের।
তাছাড়া সমুদ্রের বরফের অবস্থা গুরুত্বপূর্ণ। গ্রীষ্মে, ১.৫ মিটার থেকে ৩ মিটারের প্যাক বরফ গলতে শুরু করে। যদি বরফ না গলে তবে আপনাকে অপেক্ষা করতে হবে। ভ্যাসিলি বরফ-ভাঙা জাহাজ ছিল না। এটি সর্বোচ্চ এক মিটার পর্যন্ত বরফ ভাঙতে সক্ষম। এই সমস্ত কারণে তারাও কিছুটা ধীর গতিতেই আগাতে থাকে।
ভ্যাসিলি ৫০ ডিগ্রী অক্ষাংশ অতিক্রম করার একদিন পরে, যোগেশ ব্রিজ থেকে নিচে নেমে এসে সৌমিত্রকে জানালেন যে তিনি গ্রোয়ার বরফ (বরফের টুকরো) দেখেছেন।
সৌমিত্র ছুটে জাহাজের উপরের তলায় গিয়ে খুঁজতে লাগল সেই গ্রোয়ার বরফ। তবে দেখতে পেলেন না কিছুই। তাদের এই সমুদ্র যাত্রায় প্রথম বরফ দেখতে পাননি বলে বেশ কষ্ট পান সৌমিত্র । সেদিনের পর থেকে ৬০ ডিগ্রী অক্ষাংশ অতিক্রম না করা পর্যন্ত বরফ খুঁজতে জাহাজের ব্রিজে পুরো দিন কাটাতেন তিনি।
"সেখানে থাকাকালীন নিয়মিত আমার ডিজিটাল প্যাডে [নোটবুক] টুকে রাখতাম সব অভিজ্ঞতা,"—বলছিলেন সৌমিত্র।
এই সমুদ্রযাত্রার শেষ দিনগুলোতে, যোগেশ তাদের উপস্থাপনার বিষয়গুলো পরীক্ষা করে দেখেন এবং দুজন করে দলে ভাগ করে দেন আমাদের। কাউকেই একা যেতে দেওয়া হয়নি ফিল্ড ভিজিটের জন্য। "আমিই ছিলাম একমাত্র বাংলাদেশি, তাই আমাকে দেয়া হয় ভারতীয় বিজ্ঞানীদের সাথে।"
ভূতত্ত্ববিদ এবং যোগেশের অধীনে থাকা পিএইচডি ছাত্র সুমিত কুমার ছিল ফিল্ড ভিজিটে সৌমিত্রের জুটি। "সুমিত ছিল আমার সবচেয়ে ভালো বন্ধু। সে আক্ষরিক অর্থেই আমাকে ভূতত্ত্ব শেখায়, যা পরে আমার ফিল্ডওয়ার্কেও সাহায্য করে," বলছিলেন সৌমিত্র।
৬০ ডিগ্রী অক্ষাংশের পর, অ্যান্টার্কটিকা অঞ্চলের উত্তাল সমুদ্রপথ কুখ্যাত "ড্রেক প্যাসেজ"। "আমরা সেই সময়টায় ফটোগ্রাফি এবং জাহাজের নিয়মিত দায়িত্ব নিয়ে কাটিয়ে দিয়েছি। ঘূর্ণিঝড়ের দিনে, অভিযানকারী দল অনুশীলন করেছে এবং ঝড় কেটে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করেছে।"
"যাইহোক, আমরা ৬০ ডিগ্রী অক্ষাংশ অতিক্রম করার পরে, বরফের চাঁই এবং তারপর হিমশৈল দেখতে শুরু করি, আমরা প্রায় (প্রিন্সেস এলিজাবেথ দ্বীপ) এর দিকে এগিয়ে গেলাম এবং তারপরেই পৌঁছে গেলাম আমাদের স্টেশনে। চারিদিকে শুধু বরফ! আমি কল্পনাও করিনি যে এমন একটি মায়াময় জায়গা পৃথিবীতে থাকতে পারে।"
অবশেষে ১৬ জানুয়ারি অ্যান্টার্কটিকায় পৌঁছাল ভ্যাসিলি।
ভারতের 'ভারতি' স্টেশনটি লারসেম্যান পাহাড়ের প্রিডজ বে দ্বীপে। স্টেশনে প্রায় ৪৭ জনের উপরে কর্মী থাকলেও, যোগেশের দল জাহাজে থাকার সিদ্ধান্ত নেয়।
অবশেষে 'শুভ্র মহাদেশে' অবতরণ!
সৌমিত্রের হাতে পর্যাপ্ত সময় ছিল না কারণ তার ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই তাকে ফিরে যেতে হয়েছিল কেপটাউনে। তাই যোগেশ তাকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নমুনা সংগ্রহ করতে বলেন।
"অ্যান্টার্কটিকার আবহাওয়া খুবই পরিবর্তনশীল। আপনি কোন ভাবেই আগে থেকে বলতে পারবেন না যে পরের দিনের আবহাওয়া কেমন হবে। কিছু দিন ছিল যখন পর্যাপ্ত সূর্যালোক এবং নীল আকাশ দেখা যাচ্ছিল। অথচ পরদিন, তুষার ঝড় আর প্রচণ্ড তুষারপাতের কারণে আমরা বের হতে পারিনি"- সৌমিত্র বলছিলেন।
সৌমিত্র সেখানে ছিলেন ২৫ দিন, এবং এরমধ্যে গবেষণার কাজে মাত্র ১১ দিন ফিল্ড ভিজিটে যাওয়ার পান। তবে এটাও ছিল আবহাওয়ার উদারতা।
এজন্য যোগেশকে, সৌমিত্রের ফিল্ড ওয়ার্কের সময় বাড়াতে হয়েছিল। "মাঠে দিনে কেউ তিন চার ঘণ্টার বেশি কাজ করে না। এক ঘণ্টা পরে পোশাকের ভেতরের উভয় স্তর ভিজে যায়। এরও কিছুক্ষণ পরে, আপনি ঠান্ডায় কাঁপতে শুরু করবেন। এবং দুর্ভাগ্যবশত, যদি আপনার গ্লাভস ভিজে যায় তাহলে আপনাকে সাথে সাথেই তা পরিবর্তন করতে হবে।"
"বরফের মাঠে পা রাখার আগে আমরা চার স্তরের কাপড় পরতাম—তিনটি ভিতরের স্তর, এবং শেষ কভারঅল ডাংরি [ডুঙ্গারি]। আমাদের কমলা ডাংরি দেওয়া হয়েছিল। আমি রংটি নিয়ে মোটেও খুশি ছিলাম না।"
যদি তারা কোন ভাবে আটকে পড়েন বা হারিয়ে যান সেজন্য বাইরে বেরোনোর আগে, বিজ্ঞানীদের অন্তত চার জোড়া শুকনো গ্লাভস, দুই সেট জামাকাপড় এবং অন্তত দুই দিনের খাবার সাথে নিতে হতো।
প্রতিদিন সকাল নয়টায়, হেলিকপ্টার বিজ্ঞানীদের নিয়ে যেতো তাদের গন্তব্যে। "আমি সবসময় একেবারে চূড়ায় নামতাম কারণ সেখান থেকে সবকিছু দেখা যায়। এরপরে আমি নিচে নেমে যেতাম।"
"দিনের সবচেয়ে খারাপ অংশ ছিল যখন মাঠের কাজ শেষ হওয়ার পর আমাদের অপেক্ষা করতে হতো হেলিকপ্টারের জন্য। এমনও হয়েছে যে প্রায় পাঁচ ঘণ্টা হয়ে গিয়েছে এদিকে কোনও হেলিকপ্টার আসেনি। আমরা ঠান্ডায় কাঁপতে শুরু করি।
আমাদের দলের একজন সদস্যের প্রচণ্ড ঠান্ডা লাগতে শুরু করলে– তাঁকে প্রবল ঠান্ডা বাতাস থেকে রক্ষার জন্য তাঁকে একটি বড় পাথরের আড়ালে নিয়ে যেতে হয়েছিল আমাকে। তাঁর মনে হচ্ছিল– সেদিন সে মারা যাবে। তবে অবশেষে, হেলিকপ্টার এসে আমাদের জাহাজে নিয়ে গেল।"
এমন আরেকটি ঘটনা হলো, সৌমিত্র দ্বীপের তুষার টুকরোর উপর থেকে সামুদ্রিক পানির নমুনা সংগ্রহ করছিলেন। তিনি বরফের উপর শুয়ে সংগ্রহের বালতি ফেলে দেন পানিতে। এসময় একজন সিনিয়র বিজ্ঞানী একটি পাহাড়ের চূড়া থেকে তাঁকে দেখতে পান।
"আমাদের ওয়াকি-টকি সাথে রাখতে হতো; আমরা সেগুলোর নাম দিয়েছিলাম 'মটোরোলা'। তিনি আমাকে ওয়াকি-টকির মাধ্যমে সতর্ক করলেন, 'তুমি কি করছ? এটা খুবই বিপজ্জনক। সিলগুলো এতই শক্তিশালী যে তাদের মধ্যে কেউ তোমাকে পানিতে টেনে নিয়ে গেলে তুমি মারা যাবে।" এটি আমার জন্য একটি বিশাল শিক্ষণীয় অভিজ্ঞতা ছিল," সৌমিত্র বলছিলেন।
তিনি বরফের কম্পার্টমেন্ট থেকে তুষারের নমুনা সংগ্রহ করেন। তুষার পাহাড়ের সর্বোচ্চ শিখর এবং দ্বীপের সর্বনিম্ন বিন্দু থেকে নমুনা সংগ্রহ করেন। এছাড়াও, দ্বীপে কিছু মিঠা পানির হ্রদ বা ক্যাচমেন্ট এলাকা আছে।
গ্রীষ্মকালে বরফ গলে গেলে এই হ্রদে মিঠা পানি জমা হয়। সৌমিত্র হ্রদ থেকে পানি এবং পলি সংগ্রহ করেন। তিনি সামুদ্রিক পানি ও সামুদ্রিক মাটি থেকেও নমুনা সংগ্রহ করেন।
"দ্বীপে, আমরা পেঙ্গুইন, সিল আর অ্যান্টার্কটিক পাখির মতো প্রাণী খুঁজে পেয়েছি। আমি তাদের মলের নমুনাও সংগ্রহ করেছি," জানালেন তিনি।
তা ছাড়া, সৌমিত্র সেখানে যত ধরনের শিলা, শ্যাওলার নমুনা এবং লাইকেন খুঁজে পেতেন তার সব কিছুরই নমুনা সংগ্রহ করেছেন। "আমি সেখান থেকে ৩০টিরও বেশি নমুনা সংগ্রহ করেছি। আমার মাঠ পরিদর্শনের দিন শেষে, আমার নমুনার বালতির ওজন ছিল প্রায় ২৫ থেকে ৩০ কেজি," জানান সৌমিত্র।
বাংলাদেশে এসব নমুনা নিয়ে এসেছেন সৌমিত্র। আগামী কয়েক মাসের মধ্যে সেগুলোর পরীক্ষা শেষে তার গবেষণাপত্র লিখবেন সৌমিত্র।
২৫ দিন পর, তার ফিরে আসার সময় হয়। ৪ ফেব্রুয়ারি, একটি কার্গো বিমান সৌমিত্র এবং আরও কয়েকজন বিজ্ঞানীকে ভারতি স্টেশন থেকে ২,৫০০ কিলোমিটার দূরে মৈত্রী স্টেশনে নিয়ে যায়। সেখান থেকে তারা সরাসরি কেপটাউনের উদ্দেশ্যে রওনা হন।
১৫ ফেব্রুয়ারি অবশেষে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছান সৌমিত্র।
"এটি আমার জন্য এক অভূতপূর্ব অভিজ্ঞত। বাংলাদেশে যারা সমুদ্র নিয়ে গবেষণা করতে চান তাদের সবাইকে বলবো এমন অনেক অভিযানে যাওয়ার সুযোগ আছে। আপনি যদি সত্যিই চান তবেই তা সম্ভব। আপনাকে শুধু নিজেকে প্রস্তুত করতে হবে।"
"আমি আমার ডিজি, অধ্যাপক ড: তৌহিদা রশিদ, মন্ত্রী স্থপতি ইয়াফেস ওসমান এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সচিব মোঃ আলী হোসেনকেও ধন্যবাদ জানাতে চাই, আমাকে এমন একটি সুযোগ করে দেয়ার জন্য" এভাবেই কৃতজ্ঞতা প্রকাশের মধ্য দিয়ে সৌমিত্র শেষ করেন তার রোমাঞ্চকর অভিযানের গল্প।