এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলার: বিমানজট ছাড়ান তারা
১৮ জানুয়ারি, ২০২৪। চট্টগ্রাম বিমানবন্দর। সকাল সাড়ে ৯টার কিছু আগে। ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের একটি বোয়িং ৭৩৭ টেক অফের অনুমতি চাইল। কন্ট্রোল টাওয়ার থেকে কিছুক্ষণ হোল্ডিং পজিশনে বিমানটিকে হোল্ড করতে বলা হলো। কিন্তু অজ্ঞাতকারণে পাইলট হোল্ডিং পজিশন অতিক্রম করে ফেলেন। এতে আতঙ্কিত হয়ে পড়েন এটিসি, বারবার বলতে থাকেন: 'হোল্ড পজিশন, বাংলা স্টার [বিমানটির কল সাইন]।'
কারণ আরিরাংয়ের একটি চার্টার্ড বিমান ততক্ষণে মাথার ওপরে চলে এসেছে, কিছুক্ষণের মধ্যেই ল্যান্ড করবে। যদি তা হয়, তবে দুটি বিমানই দুর্ঘটনায় পড়বে। তা-তে প্রাণ যেতে পারে অনেকের। সময় খুবই কম, এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলার [এটিসি] মাথা ঠান্ডা রাখলেন। ভেবে দেখলেন, আরিরাংয়ের বিমানটি হালকা, পরিস্থিতি সামাল দিতে হলে এটিকেই কাজে লাগাতে হবে। তিনি পাইলটকে আকাশে আরেকটি চক্কর দিতে অনুরোধ জানালেন। সে যাত্রায় দুর্ঘটনা থেকে রেহাই পেল বিমান দুটি।
এমন পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছিল গেল জুলাই মাসে ঢাকা বিমানবন্দরেও। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের একটি বিমান উঠে পড়েছিল রানওয়েতে; তখন আরেকটি বিমানের ল্যান্ডিং টাইম সন্নিকটে। এটিসির নির্দেশনা ছাড়া বিমানের অবতরণ ও উড্ডয়ন মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ। যখন বিমান উড়তে থাকে তখনো এটিসি পাইলটকে সাহায্য করতে থাকেন। এটিসির প্রধান কাজ সংঘর্ষ এড়ানো ও শৃঙ্খলা রক্ষা করা। সঙ্গে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিয়ে সময় বাঁচানো।
ভূমি থেকে উঁচুতে কাচঘেরা গোলাকার একটি ঘরে অফিস করেন তারা। এটিকে বলা হয় টাওয়ার। দিল্লী বিমানবন্দরের টাওয়ার ১০৩ মিটার উঁচু, টোকিও বিমানবন্দরে ১১৫ মিটার, ব্যাংককে ১৩২ মিটার। ঢাকা বিমানবন্দরের নতুন টাওয়ার তৈরি হচ্ছে। পুরোনো যেটি বর্তমানে সক্রিয়, সেটির উচ্চতা ৭৫ ফুট।
লন্ডনের ক্রয়ডন প্রথম
পৃথিবীর প্রথম এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল টাওয়ার প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯২০ সালে লন্ডনের ক্রয়ডন বিমানবন্দরে। চারটি জানালার কাঠের তৈরি ঘরটি ছিল মাত্র ১৫ ফুট উঁচু। টাওয়ার কর্মীদের দায়িত্ব ছিল বিমান ওঠানামার টাইমটেবিল ঠিক রাখা এবং পাইলটকে আবহাওয়া বিষয়ক তথ্য দেওয়া। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপের শহরগুলোর মধ্যে যাতায়াত বৃদ্ধি পায়। ক্রয়ডনে দুই ডজন বিমান ওঠানামা করত তখন। সময়ের হিসেবে সংখ্যাটি নেহায়েত কম নয়, সে সময়কার পৃথিবীর সবচেয়ে ব্যস্ত বিমানবন্দর সেটি। তাই ইংল্যান্ডের বিমান মন্ত্রণালয় আকাশযানের শৃঙ্খলা আনতে চাইল। আর তাতে জন্ম হলো এটিসি'র।
ক্রয়ডনের জায়গা এখন দখল করেছে হিথ্রো। বিমানবন্দরটির ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে একদিনে হিথ্রোতে ওঠানামা করে এক হাজার ৩০০ ফ্লাইট। সেকালে প্রযুক্তি ছিল সীমিত, পতাকা নাড়িয়ে সংকেত জানানো হতো পাইলটকে। তারপর দিনে দিনে প্রযুক্তি উন্নত হয়েছে — রেডিও, রাডার, কম্পিউটার নিয়ে কাজ করছেন আজকের এটিসি। সাধারণত চারপাশের ২৫ মাইল ও চার হাজার ফুট উচ্চতার বিমানগুলো নির্দিষ্ট টাওয়ারের আওতায় থাকে, তারপর এরিয়া কন্ট্রোল সেন্টারের নিকট স্থানান্তর হয়, সবশেষে যায় নিকটবর্তী এটিসি ইউনিটের কাছে।
ওহিদুর রহমান আবেদন করলেন
১৯৮৬ সালে পদার্থবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর হলেন এসএম ওহিদুর রহমান। পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেখে যোগ্যতার সঙ্গে মিলে এমন সব পদেই আবেদন করতে থাকেন। সাধারণ মধ্যবিত্তের পরিবার, বাছ-বিচারের সুযোগ বেশি ছিল না। একদিন ইত্তেফাকে দেখলেন বাংলাদেশ সিভিল এভিয়েশন অথরিটি সহকারী অ্যারোড্রোম অফিসার পদে লোক নেবে। তখনো জানেন না এ পদে নিয়োগপ্রাপ্ত লোকের কাজ কী এবং এজন্য কী জানা প্রয়োজন।
দিনকয় পরে তিনি চাকরির পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার আমন্ত্রণ পেলেন। পরীক্ষা খারাপ হয়নি, নিয়োগও পেয়ে গেলেন। তারপর ছয়মাসের একটি ট্রেনিংয়ের মধ্য দিয়ে গেলেন। তাদের শেখানো হলো এয়ার ট্রাফিক কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়, এটিসির কাজ কী, ফ্লাইট কীভাবে ওঠানামা করে, পাইলট কী ভূমিকা পালন করেন এবং যোগাযোগ পদ্ধতি। আরও জানলেন প্লেন বিধ্বস্ত হলে, ছিনতাই হলে করণীয় ইত্যাদি।
সড়ক বা নৌপথের তুলনায় আকাশপথ সাদামাটা, কারণ এখানে কোনো সীমানাপ্রাচীর নেই। কোথাও উঁচুনিচু নয়, কোথাও সরু বা প্রশস্তও নয়। তবু কেন সংঘর্ষ বেধে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে? কারণ আকাশেও বিভিন্ন রুট থাকে। যেমন ১৮ হাজার ফুট উচ্চতায় একটি রুট, আবার ১৬ হাজার ফুটে আরেকটি। দুদিক থেকে একই রুটে দুটি বিমান এলে সংঘর্ষ হতেই পারে।
এছাড়া অনেক সময় পাইলট ১৬ হাজার ফুট থেকে ১৪ হাজারে নামতে চান। তখনো এটিসির সহযোগিতা দরকার হয়। কারণ তার কাছে হিসেব থাকে ১৪ হাজার ফুট উচ্চতায় কতগুলো বিমান কোন কোন দিকে চলাচল করছে। অনেক সময় পাইলট যখন দিক হারিয়ে ফেলেন, তখনো এটিসি রাডারের সহায়তায় পাইলটকে বিমানবন্দরের পথ দেখান।
এটিসি বেশি সেবা প্রদান করে থাকেন নিয়ন্ত্রিত আকাশসীমায়। এটি হলো নির্দিষ্ট উচ্চতায় বিমানবন্দরের আশপাশের এলাকা যেখানে এটিসি বিমানকে সরাসরি গাইড করে থাকেন। অন্যদিকে অনিয়ন্ত্রিত আকাশসীমায়ও এটিসি বিমানকে গাইড করতে পারেন, তবে সেটা স্বল্প পরিসরে।
সবার আকাশ সবাই মিলে
আকাশপথের ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম একটি আন্তর্জাতিক সেবা। বিশ্বের প্রায় সবদেশ এতে অবদান রাখে। এ উদ্যোগ সফল করতে বিমান পরিচালনাকারী সংস্থাকেও বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। এজন্য সিভিল এভিয়েশন থেকে অনুমতি নিতে হয়, এয়ার সার্ভিস সমঝোতাও করতে হয়। তারপর শিডিউল্ড প্যাসেঞ্জার ফ্লাইটের ক্ষেত্রে ফ্লাইট টাইপ, ফ্লাইট লেভেল, স্পিড, কোন কোন দেশ হয়ে চলবে ইত্যাদি সবকিছু জানাতে হয় এএফটিএন [অ্যারোনটিক্যাল ফিক্সড টেলিকমিউনিকেশন নেটওয়ার্ক] চ্যানেলে।
ওহিদুর জানান, বিমানের শিডিউল বছরে দুবার নির্ধারিত হয়। এগুলো হলো সামার শিডিউল এবং উইন্টারর শিডিউল। বিমান পরিচালনাকারী সংস্থাগুলো তাদের এক মৌসুমের সব রুটের সকল সময়ের শিডিউল ইন্টারন্যাশনাল এয়ার ট্রান্সপোর্ট অ্যাসোসিয়েশনের (আইএটিএ) নিকট জমা দেয়। সব সংস্থার সব শিডিউল মিলিয়ে আইএটিএ প্রয়োজনীয় সংযোজন-বিয়োজন ঘটায় এবং সবার সম্মতিতে একটি সমন্বিত শিডিউল প্রণয়ন করে সংশ্লিষ্ট সকলকে প্রেরণ করে।
নির্দিষ্ট দিনে টেলেক্স মারফত ফ্লাইট শুরু হওয়ার দুই ঘণ্টা আগেই অন-রুট দেশগুলো রিমাইন্ডার শিডিউল পেয়ে যায়। বিমানে বেতার যোগাযোগ চালু হয় ১৯৩০ সালে। তখন থেকে রেডিও মারফত এটিসিরা পাইলটের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করার সুযোগ পান। এছাড়া ফ্লাইটের সংখ্যা বেড়ে গেলে তারা রাডারের সাহায্য নেন।
রাডারের প্রাইমারি ও সেকেন্ডারি ইউনিটের সহায়তা নেন এটিসি। ১৯৫০ সালের আগে পর্যন্ত কেবল প্রাইমারি রাডারের ব্যবহার ছিল। এ থেকে পাঠানো সিগন্যাল প্লেনের গায়ে বাধা পেয়ে ফিরে আসে যা রাডারের অ্যান্টেনা গ্রহণ করে। এর মাধ্যমে প্লেনের অবস্থান চিহ্নিত করা যায়, কিন্তু কত উচ্চতায় অবস্থান করছে বা গতিবেগ কত তা জানা যায় না। সেকেন্ডারি রাডার কাজ করে বিমানে থাকা ট্রান্সপন্ডারের সঙ্গে সংযুক্ত থেকে। এটি এমন বেতার যোগাযোগব্যবস্থা যা আগত কোনো সংকেতকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে গ্রহণ করে এবং সাড়া দেয়। এর মাধ্যমে কত উচ্চতায় ও দূরত্বে প্লেনটির অবস্থান তা বিশদ ধরা পড়ে।
ওহিদুর বলেন, 'এখন প্রযুক্তি এত বেশি উন্নত হয়েছে যে, কোনো বিমানেরই নজরদারির বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই। বিমানের পাইলটকে তার পরিচালন রুটের প্রহিবিটেড এয়ারস্পেস, ডেঞ্জারজোন বা রেস্ট্রিকটেড জোন সম্পর্কে অবহিত থাকতে হয়।'
ঢাকা বিমানবন্দরে প্রতিদিন গড়ে ২০০টি বিমান ওঠানামা করে। এর মধ্যে বাংলাদেশের আকাশসীমা ব্যবহার করে (ওভারফ্লাই) ৩৫০ থেকে ৪০০টি বিমান। ওহিদুর জানান, প্রতিটি বিমানকেই এজন্য নির্দিষ্ট অংকের টাকা দিতে হয় বাংলাদেশের সিভিল অ্যাভিয়েশন অথরিটিকে।
নিয়ম-কানুন বিমানের জীয়নকাঠি, না মানলে রক্ষা পাওয়ার সুযোগ থাকে না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে গড়ে ওঠা ইন্টারন্যাশনাল সিভিল এভিয়েশন অর্গানাইজেশনের (আইকাও) শিকাগো কনভেনশনে বিমানবন্দর, বিমান সংস্থা ও বিমান চলাচলের যাবতীয় নিয়মকানুন নির্ধারণ করা হয়।
চট্টগ্রামে পোস্টিং
বেসিক ট্রেনিং শেষ হলে ওহিদুর রহমানকে পাঠানো হয়েছিল ঢাকা টাওয়ারে। পরে অন দ্য জব ট্রেনিংয়ের জন্য চট্টগ্রামে পোস্টিং দেওয়া হয়। পাঁচ–ছয় মাস পর সলো কন্ট্রোলার হিসাবে চট্টগ্রাম টাওয়ারে কর্মজীবন শুরু করেন তিনি।
চট্টগ্রাম এয়ারপোর্ট তখন খুবই ছোট। নিয়মিত ফ্লাইট পরিচালনা করে কেবল বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স। এয়ার ইন্ডিয়া ফ্লাইট অপারেট করত সপ্তাহে ২–৩টা। রানওয়ে ছিল ছোট। এফ ২৭, এফ ২৮, বড়জোড় ডিসি ১০ নামতে পারত তখন। ওহিদুর রহমান চুরানব্বই পর্যন্ত ছিলেন চট্টগ্রামে। তবে মাঝে মধ্যে এক বা দুই মাসের জন্য সৈয়দপুর বা রাজশাহীতে গিয়ে উিউটি করে এসেছেন।
৭৫০০ মানে হাইজ্যাক
এটিসি সকাল সাড়ে ৭টা থেকে দুপুর ২টা, দুপুর ২টা থেকে রাত ৮টা এবং সপ্তাহের তৃতীয় দিনে টানা সাড়ে ১১ ঘণ্টাও দায়িত্ব পালন করেন। এটিসি পাইলটের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষার্থে কিছু সংক্ষিপ্ত পরিভাষা ব্যবহার করেন। পাইলট প্রেরিত বার্তা বা ট্রান্সপন্ডার কোডও বুঝতে হয় এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলারকে। এরকম একটি কোড হলো মে ডে (৭৭০০)। আবার পাইলট ৭৫০০ বলার মানে হলো প্লেন ছিনতাইয়ের শিকার। ৭৬০০ অর্থ রেডিও যোগাযোগ সম্ভব হচ্ছে না।
এটিসি এবং পাইলটকে বেশি লড়তে হয় আবহাওয়ার সঙ্গে। কুয়াশা ও ঝড়-বৃষ্টিতে যখন দেখার সক্ষমতা শূন্যে নেমে আসে, তখন পাইলটকে বলতে গেলে নিজের চোখ ও মগজ ধার দেন এটিসি। এটিসির সহায়তা নিয়ে পাইলট বিমান অবতরণ করান।
অবসর নেওয়ার পর
দুই বছর হতে চলল ওহিদুর রহমান অবসরে গেছেন। প্রশিক্ষণ নিতে তিনি সিঙ্গাপুর, চীন, কোরিয়া, জাপান, ফিনল্যান্ড, আমেরিকা, ইন্দোনেশিয়া,ভারত ও কানাডায় গেছেন। এটিসি হিসেবে তিনি আনন্দের সঙ্গেই কাজ চালিয়ে গেছেন। এখানে কাজ গতানুগতিক নয়, প্রায়শ নতুন সব চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়। ডিউটি শুরুর পর এটিসির কথা বলার সুযোগ থাকে না, ঈদের দিনও তাদের কাছে অন্য সব দিনের মতোই একটি দিন মাত্র।
এসব সত্ত্বেও আমাদের দেশে এটিসির বেতন কম, আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে অনেক বেশি কম বলে জানান ওহিদুর। 'এটিসিকে হতে হয় মাল্টিটাস্কার, হতে হয় ধৈর্যশীল। অংকে দক্ষতা এটিসিকে এগিয়ে রাখে। বিমানবন্দরের কোথায় হ্যাঙ্গার, ট্যাক্সিওয়ের দৈর্ঘ্য কত, রানওয়েবাতির সংখ্যা এটিসির মুখস্থ থাকা দরকার। একজন সজাগ এটিসি মানে শতপ্রাণ ঝুঁকিমুক্ত।'
অবসর নেওয়ার পর ওহিদুর মাঝে মধ্যে নতুন যোগদানকারীদের ক্লাস নেওয়ার ডাক পান। বাসার কাজে স্ত্রীকে সাহায্য করেন; তা মাছ কোটা থেকে শুরু করে রুটি সেঁকে দেওয়া পর্যন্ত। তার দুই মেয়ে উত্তরায় নিজেদের ফ্ল্যাটে থাকেন। ওহিদুরের একটা বড় দুঃখ: বাবা-মা কেউই তার সমৃদ্ধি দেখে যেতে পারেননি।