পিংক মুন বা গোলাপি চাঁদ কী? যেভাবে দেখা গেল দেশের আকাশে
হঠাৎ জানা গেল, চাঁদের রং বদলাবে। দিন তিনেকের জন্য চিরচেনা রুপালি বেশ ছেড়ে হবে গোলাপি! আমাদের একমাত্র উপগ্রহ চাঁদ, একটু আদরের তো বটেই। তাই চাঁদের এই ভোলবদল কে না দেখতে চাইবে? গত ২৪ এপ্রিল জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জাদুঘরের 'গোলাপি চাঁদ পর্যবেক্ষণ ক্যাম্পে' সেজন্য দেখা গেল উপচে পড়া ভিড়!
বুধবার সন্ধ্যার এই বিশেষ আয়োজনে বিভিন্ন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী ছাড়াও সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ ছিল চোখে পড়ার মতো। বিজ্ঞান বিষয়ক প্রশ্ন-উত্তর পর্ব, কুইজ প্রতিযোগিতা থেকে শুরু করে শক্তিশালী টেলিস্কোপে চাঁদ দেখা, সবকিছুই ছিল আয়োজনে।
'গোলাপি চাঁদ' রহস্য
এপ্রিলের শেষদিকে উত্তর আমেরিকায় ফোটে ফ্লোক্স নামের একটি বন্যফুল। ফুলটির রং গাঢ় গোলাপি। এই বন্যফুলের সঙ্গে তুলনা করেই উত্তর আমেরিকার স্থানীয় বাসিন্দারা এপ্রিল মাসের পূর্ণচাঁদকে নাম দিয়েছিল 'পিংক মুন' বা গোলাপি চাঁদ। দ্য মেইন ফার্মার্স এলম্যানাক ম্যাগাজিন ১৯৩০-এর দশকে প্রতিটি মাসের চাঁদের স্থানীয় নামগুলো প্রকাশ করতে থাকে। এপ্রিলের চাঁদ তখনই পিংক মুন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত পায়।
চাঁদ যখন পৃথিবী আর সূর্যের ঠিক মাঝামাঝি অবস্থান করে, তখনই আমরা তাকে পূর্ণচাঁদ হিসেবে দেখি। এপ্রিল মাসের এই পূর্ণচাঁদই গোলাপি চাঁদ নামে খ্যাত।
এই চাঁদ যুগে যুগে বিভিন্ন দেশ ও জাতির কাছে আলাদা গুরুত্ব পেয়ে এসেছে। তাই 'পিংক মুন' ছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন সংস্কৃতিতে এই চাঁদকে আরও একাধিক নামে ডাকা হয়। আইরিশ কেল্টরা একে ডাকত 'বাড়ন্ত চাঁদ', ইউরোপীয় পৌত্তলিকেরা ডাকতো 'জাগ্রত চাঁদ' নামে। অ্যাংলো-স্যাক্সনদের কাছে এই চাঁদের নাম ছিল 'ডিম চাঁদ'। 'গ্রাস মুন', 'ফিস মুন' কিংবা 'ব্রেকিং আইস মুন' নামেও ডাকত কোনো কোনো জাতিগোষ্ঠী। আমেরিকার প্রাচীন জনশ্রুতি মতে, এই পূর্ণচাঁদের সময়টা-ই আগাছা কাটা, ছাঁটাই কিংবা মাটির নিচের ফসল রোপণের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত সময়।
হিন্দুধর্মে পূর্ণচাঁদের সময় হনুমান জয়ন্তী পালন করা হয়। যা মূলত রামায়ণের অন্যতম নায়ক মহাবীর হনুমানের জন্মদিবস। অন্যদিকে শ্রীলঙ্কার বৌদ্ধরা এ পূর্ণিমায় 'বাক পয়া' উৎসব পালন করেন। বুদ্ধত্বপ্রাপ্তির পঞ্চম বছরে ভগবান বুদ্ধ শ্রীলঙ্কায় এসেছিলেন নাগা সম্প্রদায়ের দুটি অংশের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে। সেই ভ্রমণকে স্মরণ করেই আয়োজিত হয় এ উৎসব। সর্বোপরি, এপ্রিলের এই পূর্ণচাঁদ বিভিন্ন সংস্কৃতিতে সৌন্দর্য আর সম্প্রতির স্মারক হিসেবে কাজ করে।
'পিংক মুন' আসলে গোলাপি নয়
'আজকে আমাদের এই গোলাপি চাঁদ দর্শন ক্যাম্প বিজ্ঞানের দিক থেকে যত না গুরুত্বপূর্ণ, তার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক ভাবে। গোলাপি চাঁদের কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই, চাঁদ আসলে গোলাপি হয় না!' অনুষ্ঠানের শুরুতেই কথাগুলো বললেন জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জাদুঘরের সিনিয়র কিউরেটর সুকল্যাণ বাছাড়। তাতে কি আগ্রহে ভাটা পড়ল দর্শনার্থীদের? একদমই না। আরও বেশি উৎসাহী হয়ে তার কথা শুনতে লাগলেন সবাই। আয়োজনের শুরুতেই ছিল সুকল্যাণ বাছারের বিজ্ঞান বিষয়ক বক্তৃতা।
আমাদের চিরচেনা রুপালি চাঁদকে আমরা কেন অন্য রংয়ে দেখি? উত্তর পাওয়া গেল সুকল্যাণ বাছাড়ের কাছে। বললেন, পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে থাকা অত্যন্ত সূক্ষ্ম ধূলিকণা এবং বিভিন্ন ধরনের গ্যাসের কারণে অনেক সময় চাঁদের রংয়ের দৃশ্যমান পরিবর্তন দেখা যায়। এ ছাড়া অন্যান্য ধোঁয়া দূষণও পৃথিবীতে আলো পৌঁছাতে বাধা সৃষ্টি করে। পৃথিবীতে আসা আলো তাদের নিজ নিজ তরঙ্গদৈর্ঘ্য অনুযায়ী অনেক প্রকারে বিক্ষিপ্ত হয়ে যায়, যার মধ্যে নীল রঙকে সবচেয়ে দ্রুত বিক্ষিপ্ত হতে দেখা যায়। তখন আমরা বেশি তরঙ্গ দৈর্ঘ আছে এমন রংগুলোকেই দেখি।
এ কারণে যখন চাঁদকে পৃথিবী থেকে দেখা হয় তখন বাদামী, নীল, হালকা নীল, রুপালি, সোনালি, হালকা হলুদ রংয়ের দেখায়। আর বিভ্রমের কারণে একে স্বাভাবিকের চেয়ে কিছুটা বড়ও দেখায়। জ্যোতির্বিদ্যার ভাষায় একে রিলে স্ক্যাটারিং বা আলোর বিচ্ছুরণও বলা হয়।
নিজের বক্তৃতায় 'গোলাপি চাঁদ' নামকরণের সাংস্কৃতিক দিকটি তুলে ধরেন জাদুঘরের এই সিনিয়র কিউরেটর। 'এটা মূলত উত্তর আমেরিকার সংস্কৃতি। এ সময় ওই অঞ্চলে গোলাপি রঙের ফুল ফোটে। সেই ফুলের সাথে মিল রেখে চাঁদের নাম দেয়া হয়েছিল গোলাপি চাঁদ।'
ছিল বিজ্ঞান জিজ্ঞাসা
সন্ধ্যা নামতেই জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জাদুঘরের প্রশাসনিক ভবনের ছাদ কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায়। সকলের চোখে মুখে দারুণ উৎসাহ, গোলাপি চাঁদ দেখতে হবে। আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিলো আশপাশের বেশ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে। ব্যক্তি উদ্যোগে এসেছিলেন অসংখ্য মানুষ। এদিকে ধূলায় ধূসর ঢাকার আকাশে চাঁদ খুঁজে পাওয়া তো এত সহজ না! ফলে এক পাশে টেলিস্কোপ অপারেটরেরা খুঁজতে থাকলেন মহার্ঘ্য চাঁদকে।
বিজ্ঞান বক্তৃতা শেষে শুরু হলো উন্মুক্ত প্রশ্নোত্তর পর্ব। স্কুলের কচিকাঁচারা নিজের মনে জমে ঢাকা বিজ্ঞানের রহস্যময় প্রশ্নগুলো একে একে বের করতে লাগল। অন্যপাশে দাঁড়িয়ে সেসবেরই উত্তর করতে লাগলেন সুকল্যাণ বাছাড়।
দারুণ সব মজার মজার প্রশ্ন করতে লাগলেন দর্শনার্থীরা। একজন জিজ্ঞেস করলেন, অন্য কোন ইউনিভার্সে আমাদের মতোই আরেকজন কেউ রয়েছে কি না? আরেকজনের প্রশ্ন, সূর্য যখন মরে যাবে, তখন পৃথিবীর প্রাণবৈচিত্রের কী হবে? অন্য একজন কৌতুহল চেপে রাখতে না পেরে জিজ্ঞেস করলেন, চাঁদে যারা জমি কেনে, এটা কারা বিক্রি করে, কীভাবেই বা কেনা যায়? বাংলাদেশ কখনো চাঁদে মিশন পাঠাবে কি না, একজন শিক্ষার্থীর জানতে চেয়েছিল তাও।
গণভবন সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক সঞ্চিতা দাস শিক্ষার্থীদের নিয়ে অংশগ্রহণ করেছেন ক্যাম্পে। বললেন, "পিংক মুন শব্দটাই তো শিক্ষার্থীদের কাছে নতুন। ওরা আমাকে প্রশ্ন করেছিল, 'ম্যাডাম, চাঁদ কি কখনো পিংক হয়?' আমি ওদের বললাম, 'চলো, গিয়ে নিজেরাই দেখো।'"
এবার চাঁদ দেখার পালা
মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা জানিয়েছিল, ইউরোপ, আফ্রিকা, এশিয়া ও অস্ট্রেলিয়ায় এই গোলাপি চাঁদ পূর্ণরূপে দেখার সুযোগ পাওয়া যাবে বুধবার।
বাংলাদেশের আকাশে এই চাঁদ সবচেয়ে উজ্জ্বল হবে বুধবার। সেই হিসেবেই চাঁদ দেখা ক্যাম্পের আয়োজন করা হয়। চাঁদ পর্যবেক্ষণে মোট চারটি টেলিস্কোপ ব্যবহৃত হয়। জাদুঘরের টেলিস্কোপ অপারেটর আবু সাঈদ সরকার জানালেন, এই চারটি টেলিস্কোপ আবার দুই ধরনের। 'আমাদের এখানে সব ধরনের টেলিস্কোপ আছে। আজকে ৮ ইঞ্চির দুইটা, ১২ ইঞ্চির দুইটা ব্যবহার করব আমরা। এমনিতে চাঁদ দেখার জন্য সবচেয়ে সেরা হলো ৮ ইঞ্চি টেলিস্কোপ। বড় টেলিস্কোপে পূর্ণচাঁদ দেখা যাবে না।'
আকাশে চাঁদের সন্ধান পাওয়ার পর কয়েকটি সারিতে ভাগ হয়ে চন্দ্রদর্শন শুরু হয়। প্রতিটি টেলিস্কোপে ছিলেন আলাদা অপারেটর। একবার দেখা শেষ হয়ে আরেকবার লাইনে দাঁড়ানোর ঘটনাও লক্ষ্য করা যায়। সকলেই বেশ উচ্ছ্বসিত। অনেকে অবশ্য বলে বসলেন, খালি চোখেই না-কি চাঁদ বেশি সুন্দর! দর্শনার্থী জাহিদ ইকবাল জানালেন, টেলিস্কোপে জুম করলে চাঁদকে আহামরি কিছু লাগে না।
গোলাপি চাঁদ দেখতে না পেরে অনেকেই ক্ষাণিকটা হতাশও হয়েছে। এই যেমন নাবিল সাফায়েত! বললেন, 'ভেবেছিলাম টেলিস্কোপ দিয়ে পিংক মুন দেখবো, অনেক মজা হবে। কিন্তু যখন ছাদে এসে শুনলাম যে পিংক মুনের রহস্য অন্যরকম, তখন আমি যেন সেই চাঁদ থেকেই পৃথিবীতে এসে পড়লাম! তারপরেও বলবো, সবমিলিয়ে আজকের অনুষ্ঠান খুবই উপভোগ্য ও শিক্ষণীয় ছিল।'
শের-ই বাংলা নগর সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী নাইফা জামান বলেন, 'পিংক মুনের ইতিহাস জানতে পারলাম। আমার অনুভূতি খুব ভালো!' চাঁদ যে আসলে গোলাপি হয় না, এটা জেনে অবশ্য খারাপ লাগছে না তার। বললেন, 'পিংক না হওয়ার কারণও তো জানতে পারলাম। এজন্য আর খারাপ লাগছে না!'
মজার মজায় বিজ্ঞানচর্চাই উদ্দেশ্য
জনসাধারণ, বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে বিজ্ঞানচর্চা ও বিজ্ঞান চিন্তার প্রসার ঘটাতে নিয়মিত কাজ করে আসছে জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জাদুঘর। সিনিয়র কিউরেটর সুকল্যাণ বাছাড় জানালেন, মজার ছলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিজ্ঞানের চিন্তা পৌঁছে দিতে এমন সব আয়োজন নিয়মিত করে থাকে এই জাদুঘর।
বললেন, 'আমাদের বিজ্ঞান জাদুঘরের কাজই হচ্ছে বিনোদনের মাধ্যমে বিজ্ঞান শিক্ষা মানুষের মধ্যে পৌঁছে দেওয়া। আজকে এই পিংক মুনের ঘটনাকে সুযোগ হিসেবে নিয়ে আমরা তা কাজে লাগালাম। কিছু আলোচনা করলাম, তাদের মনে জমে থাকা কিছু প্রশ্নের উত্তর দিলাম। যার মাধ্যকে তারা মহাকাশ সম্পর্কে জানতে পারল।'
তার কথার একমত হলেন শিক্ষার্থীরা। নাবিল সাফায়েত বলেন, এমন অনুষ্ঠান তাকে বিজ্ঞান জাদুঘর ঘুরে দেখার সুযোগ দিয়েছে। 'সত্যি কথা বলতে কি আমি আগে কখনো বিজ্ঞান জাদুঘর দেখিনি। আজকের এই অনুষ্ঠানের সুযোগে আমি সেটা দেখলাম এবং ভালো লাগলো নিচের যে সংগ্রহশালাটি আছে। মিউজিয়াম, বিভিন্ন ল্যাবের অংশগুলো ঘুরলাম। দারুন অভিজ্ঞতা। আমার উত্তেজনা বেড়ে গেছে!'
অনুষ্ঠানকে সফল বলে সুকল্যাণ বাছাড় জানালেন, ভবিষ্যতে এমন অনুষ্ঠান চলতেই থাকবে।